সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস-দ্বিতীয় পর্ব

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস-দ্বিতীয় পর্ব

ঠাকুরবাড়ির `নন্দনকাননে` সন্ধ্যাবেলা বসতো গান ও সাহিত্য পাঠের আসর। এই আসরে বাড়ির লোকজনের পাশপাশি বাইরে থেকেও অনেকে যোগ দিতেন, অক্ষয় চৌধুরী ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী `লাহোরিনী`, জানকীনাথও থাকতেন সেখানে। মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। এই সভায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী ছিলেন স্থায়ী সভ্য। তাদের সামনে কাদম্বরীকে নানা ধরণের নাস্তা পরিবেশন করতে হতো। প্রথম দেখাতেই বিহারীলালের ভালো লেগে যায় এই শান্তশিষ্ট গৃহবধূটিকে। বিহারীলাল উপলব্ধি করেছিলেন তার মাঝে ছাইচাপা আগুন আছে।


বিহারীলালের স্নেহ এবং সান্নিধ্য কাদম্বরীকে আকর্ষণ করেছিল। তিনি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন, তাকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। একদিন দুপুরে বিহারীলাল এসে প্রবেশ করেছেন কাদম্বরী দেবীর ঘরে, কাদম্বরী তখন আপনমনে একটা আসন বুনছিলেন। সূচীকর্মে দারুণ নিপুণা ছিলেন তিনি। মনের ভাবনার প্রকাশ ঘটাতেন এসব হাতের কাজের মধ্য দিয়ে। এই অসমাপ্ত আসনখানি দেখে বিহারীলাল প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তারই ফলশ্রুতিতে দুদিন পরে আসনটি শেষ করে তার কোণে বিহারীলালের নাম লিখে সেটি ওই কবিকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন। আসনের ওপরে, প্রশ্নচ্ছলে লেখা ছিল `সারদামঙ্গল` কাব্যের সেই বিখ্যাত কয়েকটা লাইন,


হে যোগেন্দ্ৰ যোগাসনে

ঢুলু ঢুলু দুনয়নে

বিভোর বিহ্বল মনে

কাঁহারে ধেয়াও?   

 

আর এই লাইনগুলোকে কেন্দ্র করেই বিহারীলাল লিখলেন তার অসামান্য কবিতা সংকলন `সাধের আসন`। এই কবিতা সংকলনের প্রতিটা কবিতা যেন কাদম্বরীকে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা হয়েছে। বিহারীলাল অসম্পুর্ন সংকলন থেকে যখন কবিতা পাঠ করতেন, তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর কাদম্বরী দেবীকে শিহরিত করতো। তিনি এজন্য লজ্জায় মুখ পর্যন্ত তুলতে পারতেন না। কবি এই কাব্য সংকলন যখন শেষ করলেন, ততদিনে কাদম্বরী ইহলোকে নেই। বিহারীলাল তার উপহারকে স্মরণ করে কাব্যের নাম দিয়েছিলেন `সাধের আসন`,  

তোমার সে আসনখানি  

আদরে আদরে আনি

রেখেছি যতন করে চিরদিন রাখিবও

এ জীবনে আমি আর

তোমার সে সদাচার

সেই স্নেহমাখা মুখ পাশরিতে নারিব।    


বিহারীলাল চক্রবর্তীর এই যে অনুরাগ এটা কাদম্বরী দেবী যে বুঝতেন না তা নয়। কাদম্বরী দেবীর ভাষায়, `ঠাকুরপো, তোমাকে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তোমার আগে আমার প্রেমে পড়েছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। নতুন দাদার বন্ধু। আমি কতদিন তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছি। তবে সে প্রেমের মধ্যে একটা ভীরু সারল্য ছিল। আর তোমার ভালোবাসা? আগুনের মতো ভয়ঙ্কর, আকাশের মতো নির্ভার, মৈনাকের মতো মৌন, এই ভয়ঙ্কর বন্য ভালোবাসার স্রোত আমাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে বলো তো? বিহারীলাল বলতেন, আমার মধ্যে তিনটি স্রোত আছে- মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ আর সরস্বতী বিরহ। সে কথার অর্থ আমি বুঝতে পারতাম না। তবে বুঝতে পারতাম তার এই কথাগুলি শুনলে আমার বুকের গভীরে কোথায় যেন একটু স্পন্দন অনুভূত হয়। তখনও পর্যন্ত তোমার সাথে আমার সেভাবে সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। যখন হল তখন বুঝতে পারলাম, কেন প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে অন্যের প্রতি অঙ্গ? তোমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপকে আমি ভালোবেসেছিলাম, ঠাকুরপো আজ একথা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আমার।`     

 

অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাঝে বউদির চোখে নিজেকে যতই দামি করে তোলার চেষ্টা চলছিল, কাদম্বরী দেবী মুখ টিপে ততই অগ্রাহ্য করে গেছেন এই দেবরটিকে, `রবি সবচেয়ে কালো, দেখতে একেবারেই ভালো নয়, গলা যেন কীরকম। ও কোনদিন গাইতে পারবে না, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়।` কাদম্বরী দেবী এও বলেছেন, `তুমি যে বিহারীলাল নও, তোমার প্রেমে যে খোঁচা আছে, তির্যক আঘাত হানতে পারো তুমি।`    

 

কাদম্বরী দেবী হয়তো বিহারীলাল এর প্রেমে পড়েছিলেন, তার ভাষায়, `ঠাকুরপো, তুমি আমাকে এত ভালোবাসলে। ভালোবাসলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। আমার প্রতি বিহারীলালের ভক্তি, অনুরাগ-সত্যিই আমাকে লজ্জা দিত। তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যেও লিখতে। বিহারীলাল কখনও আমাকে এইভাবে কষ্ট দিতে পারতেন না। তিনি আমাকে ছাড়া আর কোনও নারীর কথা ভেবেছেন বলেই তো মনে হয় না আমার। প্রেমের ব্যাপারে তিনি নিতান্ত সেকেলে।` তবে কাদম্বরী দেবী এবং বিহারীলাল চক্রবর্তীর মাঝে এই যে হৃদয়ের দোলাচল, এই যে ভাব বিনিময় এটা আসলে প্লেটোনিক বা আত্মিক ভালোবাসার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।      

 

এখন প্রশ্ন আসে প্লেটোনিক বা আত্মিক বা বায়বীয় ভালোবাসা আসলে কি? প্লেটোনিক বা বায়বীয় ভালোবাসা হলো সেই শুদ্ধতম ভালোবাসা, যাতে কামনা বাসনার কোন স্থান নেই। এতে এমন ভালোবাসার কথা বলা হয় যাতে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রবেশ করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত। জার্মান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, `প্রেম বা ভালোবাসা যেন কামেরই আরেক নাম বা কামেরই ফলাফল।` অথচ ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব বা শারীরিক মিলনের বিষয়টিকে অস্বীকার করে যে সম্পর্কের মাঝে প্রেমের ষোলোআনা স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায়, এমন প্রেমকেই প্লেটোনিক বা বায়বীয় ভালোবাসা বলে। কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয়, বিনিময়ে নেয় না কিছুই। প্রেমের জন্য স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। প্রেমের এমন তীব্র রূপের নামই প্লেটোনিক ভালোবাসা। যেখানে প্রেমিকার শরীরের গন্ধই প্রেমিককে মোহিত করার জন্য যথেষ্ট, তার উপস্থিতির দরকার পড়ে না। এই অনুভুতির প্রকাশ দেখা যায় জনৈক উর্দু কবির কবিতায়। প্রিয়ার প্রেমে আকন্ঠ নিমজ্জিত কবির কণ্ঠ থেকে নিসৃত হচ্ছে একাকিত্বের পদাবলী,   

 

ইস্ তানহাই মে মুঝে রাহত দেতি হ্যায় হাওয়া

উসনে তেরি জিসমে চুমকর আয়ি হ্যায়

 

যার অর্থ হলো,

 

এই একাকীত্বের মাঝেও আমি একটু শান্তি পাচ্ছি

বাতাসের কাছ থেকে, কারণ-

সে যে তোমাকে ছুঁয়েই এসেছে!  

 

প্লেটোনিক ভালোবাসার যে সৌন্দর্যের কথা বলা হয় তা আসলে ইন্দ্রিয়াতীত। জার্মান লেখক Johann Wolfgang von Goethe এর ভাষায়, `One glance, one word from you gives more pleasure than all the wisdom of this world` তিনি প্রিয়ার একপলক চাহনী আর তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে তুলনা করেছেন পুরো দুনিয়ার জ্ঞান ভান্ডার এর সাথে।  

 

প্লেটোনিক ভালোবাসার এক অমর দৃষ্টান্ত চণ্ডীদাসের প্রসঙ্গ দিয়ে এই লেখা শেষ করবো। চণ্ডীদাসের সাথে রজকিনীর প্রেমের কথা আমরা সবাই জানি। সমাজ তাদের প্রেমকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে উৎপীড়ন করেছিল, অত্যাচারও কম করেনি! কেউ কেউ বলেন, সামাজিক ও বিত্তবৈভবের অসমতাই ছিলো তাদের প্রেমের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই তাদের প্রেম পরিণতির দিকে না গিয়ে বিচ্ছেদ-বিরহে রূপ নিয়েছে। তাদের ভাষায় এক প্রকার ব্যর্থ প্রেমের নায়ক হলেন চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেম কাহিনীকে উপলক্ষ্য করে নিন্দুকেরা যতোই তামাশা করুক না কেন চণ্ডীদাস কিন্তু কবিতায় ঠিকই তার প্রেমের ধরনটি আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছেন, 

রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম

কাম-গন্ধ নাহি তায়!

 

হদিসঃ

১। নতুন বৌঠান- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

২। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩। কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৪। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন  

৫। কলঙ্কিত ঠাকুরবাড়ি- পৃথ্বীরাজ সেন     

৬। রবীন্দ্রনাথের কাছে কাদম্বরী দেবীর শেষ চিঠি- মামুনুর রহমান

৭। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব 

৮। সারদামঙ্গল- বিহারীলাল চক্রবর্তী

৯। গীতিকবি বিহারীলাল – আবুল কাশেম

১০। গ্রিক মিথলজি- আদি থেকে অন্ত- এস এম নিয়াজ মাওলা  

পোস্ট ভিউঃ 56

আপনার মন্তব্য লিখুন