সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস- প্রথম পর্ব

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস- প্রথম পর্ব

`বউঠাকরুনের ব্যবহার ছিল উল্টো। কোনোকালে আমি যে লিখিয়ে হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না। কেবলই খোঁটা দিয়ে বলতেন, কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারব না। আমি মনমরা হয়ে ভাবতুম, তার চেয়ে অনেক নীচের ধাপের মার্কা যদি মিলত তাহলে মেয়েদের সাজ নিয়ে তার খুদে দেওর-কবির অপছন্দ অমন উড়িয়ে দিতে তার বাধ সাধত।`   

 

কথাগুলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বিলেত থেকে ফিরে ঠাকুরবাড়িকে কবিতায় গানে সাহিত্যচর্চায় ভরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লেখেন, সুর দেন আর জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্থাৎ নতুন দা বাজান পিয়ানো। উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন দার পিয়ানোর সাথে গান করেন। আর  নতুন বউঠান টিপ্পুনি কেটে বলেন রবীন্দ্রনাথকে, যতোই লেখ না কেন, বিহারীলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা সম্ভব না কখনই। রবীন্দ্রনাথ বউঠানের মন পাওয়ার জন্য বিহারীলালের অনুকরণ করেও লিখলেন কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হলো না। কবে বউঠান তার লেখার প্রশংসা করবেন, সেদিন বোধহয় সকল কিছু পাওয়া হয়ে যাবে একজন তরুন কবির। তবু কঠোর সমালোচক কাদম্বরী দেবীকেই রবীন্দ্রনাথ তার সব লেখা পড়ে শোনাতেন, সাহিত্য আলোচনা করতেন এবং তার লেখা গান গেয়ে শোনাতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে নিচের গানে,   

 

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা

এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা

 

তবে নতুন বউঠান যে শুধু চোখ বন্ধ করে তার লেখার পাঠ শুনতেন তা নয়, তিনি ছিলেন তার তীব্র সমালোচক। তিনি আসলে মনেপ্রাণে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি প্রতিভা যেন ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। হয়তো রবীন্দ্রনাথ বউঠানের মনের খবর রাখেননি তাই সারাজীবন এক আফসোস বোধ নিয়ে কাটিয়ে গেছেন। এখন প্রশ্ন হলো কে এই বিহারীলাল চক্রবর্তী? যার প্রসঙ্গ তুলে নতুন বউঠান তার দেবরকে খোঁচা দিতেন!  

 

আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার স্রষ্টা বিহারীলাল চক্রবর্তী ১৮৩৫ সালের ২১ মে কলকাতার নিমতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। মাত্র চার বছর বয়সেই বিহারীলাল মা-হারা হন।

বাল্যকালে বিহারীলালের পড়াশোনায় বিশেষ মনোযোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তার বাল্যজীবন এবং কৈশোর বাড়িতেই কেটেছে। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই লেখাপড়া করেছেন এবং সংস্কৃত,  ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিন বছর সংস্কৃত কলেজে, এবং কিছুদিন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন অর্থাৎ স্কটিশ চার্জ কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৫৪ সালে তার বাড়ির কাছে বসবাসকারী কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের কন্যা অভয়াদেবীকে তিনি ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের চার বছর পর তার স্ত্রী এক মৃত সন্তান প্রসব করে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর মৃত্যু তার মনে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে `বন্ধু বিয়োগ` কাব্যের `সরলা` সর্গে তার সে বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে গতানুগতিক বিষয়-বস্তুর বাইরে নিজের স্ত্রী এবং দাম্পত্য জীবন নিয়ে কাব্যচর্চার প্রথম প্রয়াস তার মাধ্যমেই দেখা যায়। ১৮৫৯ সালে বিহারীলাল`পূর্ণিমা` পত্রিকার সাথে যুক্ত হলে পত্রিকায় তার অনেকগুলো কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে `সাহিত্য সংক্রান্তি`নামে একটি মাসিক পত্রিকায় আরো কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৮৬০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। গীতিকবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গুরু হিসেবে খ্যাত বিহারীলালের কবিতায় প্রথম বিশুদ্ধভাবে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও গীতোচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়। বিহারীলালের কবিতায় রয়েছে আত্মময়তা, রোমান্টিকতা, সাংগীতিক দোলা, ছন্দ-অলংকারের অভূতপূর্ব ব্যবহার ও অনুভূতির সূক্ষ্মতা, যা বাংলা কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। তার রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) ও সারদামঙ্গল (১৮৭৯)। এ ছাড়া স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮), সঙ্গীতশতক (১৮৬২), বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০), সাধের আসন (১৮৮৮-৮৯), ধূমকেতু (১৮৯৯) ইত্যাদি। `সারদামঙ্গল` কাব্য পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হন। রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্যে বিহারীলালের প্রভাব সুষ্পষ্ট। বিহারীলাল কাব্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। পূর্ণিমা (১৮৫৯), সাহিত্য সংক্রান্তি (১৮৬৩), অবোধ বন্ধু (১২৭৫) ইত্যাদি তার সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা। বিহারীলালের সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী রোমান্টিক যুগের প্রবর্তক এবং গীতিকবি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের `আত্মবিলাপ` (১৯৬১) ও `বঙ্গভূমির প্রতি` (১৮৬২) কবিতা দুটি বাদ দিলে বিহারীলালই প্রথম সার্থক গীতিকবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ `সংগীত শতক` ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে ১৮৭৭ সালে তখন `ভারতী` পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে, তার অনেক আগে থেকেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে। সেই সুবাদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। তখন থেকেই ঠাকুরবাড়িতে তার যাতায়াত শুরু। বিহারীলাল সম্বন্ধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার স্মৃতিকথায়  বলেছেন, `যখন কোন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে অথবা গম্ভীর বিষয়ে চিন্তা করিতেন, তখন তামাক টানিতে টানিতে তাঁহার চক্ষু দুইটি বুজিয়া আসিত, তিনি আত্মহারা হইয়া যাইতেন।` `সাধের আসন` কাব্যটি তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর অনুরোধে রচনা করেছিলেন সে কথা ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। বিহারীলালের কবিধর্মে ছিল অনন্যসাধারণ স্বকীয়তা।

 

`সারদামঙ্গল` এবং `সাধের আসনে`র মধ্যেই বিহারীলালের কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই দুই কাব্য রচনার সূত্রেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সূচনা। তাই `সারদামঙ্গল` কাব্যে কাদম্বরী দেবীর সেই বিখ্যাত জিজ্ঞাসা, 

 

                                 হে যোগেন্দ্ৰ যোগাসনে

                                  ঢুলু ঢুলু দুনয়নে

                                  বিভোর বিহ্বল মনে

                                  কাঁহারে ধেয়াও?

 

সূচিমুখে `স্বরচিত` আসনে প্রশ্নটি লিপিবদ্ধ করে কাদম্বরী দেবীর কবিকে দেয়া আসন উপহারের সঙ্গে যে উত্তর দানের অনুরোধ ছিল, বিহারীলাল `সাধের আসন` কাব্যে তারই উত্তর দিয়েছিলেন,   

 

                                   ধেয়াই কাহারে দেবি নিজে আমি জানিনে।

                                   কবি-গুরু বাল্মীকির ধ্যান-ধনে চিনিনে।

                                   মধুর, মাধুরী বালা,

                                   কি উদার করে খেলা।

                                   অতি অপরূপ রূপ।

                                   কেবল হৃদয়ে দেখি, দেখাইতে পারিনে।

 

আপন কাব্যাদর্শ সম্পর্কে এই অনিশ্চয়তা এর আগে বাংলা কাব্যে ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তিনি প্রথম `নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন...সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখী সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল, সে সুর তাহার নিজের।`এই `ভোরের পাখি` বিহারীলাল।

তিনি `সারদামঙ্গল` কাব্য সমাপ্ত করেন ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, `মৈত্রীবিরহ, প্রীতিবিরহ, সরস্বতীবিরহ, যুগপৎ ত্রিবিধ বিরহে উন্মত্তবৎ হইয়া আমি সারদামঙ্গল সংগীত রচনা করি।`

বিরহ ও মিলনের মধ্যে কবি বিরহকেই ভালোবাসেন, কারণ বিরহের মধ্য দিয়েই মানসলক্ষ্মীর বিচিত্র রূপিণী সত্তা প্রকাশ পেয়েছে। বিহারীলালের রোমান্টিক কবি পরিচয় শুধু তার দূরাভিসার বা বিষণ্ণতা নয় কিছুটা শুধু হৃদয়াবেগের দ্বারা চিহ্নিত এবং প্রকাশভঙ্গির বিশিষ্টতায় রোমান্টিক। বিহারীলাল ১৮৯৪ সালের ২৪ মে কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

 

হদিসঃ

১। নতুন বৌঠান- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

২। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩। কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৪। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন  

৫। কলঙ্কিত ঠাকুরবাড়ি- পৃথ্বীরাজ সেন     

৬। রবীন্দ্রনাথের কাছে কাদম্বরী দেবীর শেষ চিঠি- মামুনুর রহমান

৭। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব 

৮। সারদামঙ্গল- বিহারীলাল চক্রবর্তী

৯। গীতিকবি বিহারীলাল – আবুল কাশেম

১০। গ্রিক মিথলজি- আদি থেকে অন্ত- এস এম নিয়াজ মাওলা 

 

 

 

 

 

 

পোস্ট ভিউঃ 61

আপনার মন্তব্য লিখুন