চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা
প্রবন্ধ
ছিটেফোঁটা
চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা:
কোটা সুবিধার বেনিফিসিয়ারি তিন পাহাড়ি সম্প্রদায়
১
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রথমবারের মতো কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। তখন সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ মেধায় ২০%, জেলা কোটায় ৪০%, নারী কোটায় ১০% এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০% কোটা সংরক্ষণ করা হয়। তবে ১৯৭৬ সালে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিধি সংশোধন করে জেলা কোটা ৪০% থেকে ২০% কমিয়ে সাধারণ মেধাকোটা ২০% থেকে ৪০%-এ উন্নীত করা হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১৯৭২
সালের মতোই, ৩০% এবং নারীদের জন্য ১০% কোটা সুবিধা বহাল রাখা হয়।
পৃথিবীর অনেক দেশে পিছিয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে শিক্ষা, চাকুরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু আছে। সে লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে সরকার ১৯৭৬ সালে সংস্কারকৃত কোটা ব্যবস্থা পুনরায় সংস্কার করে। তবে যথাযথভাবে পরিসংখ্যান বা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ না করেই তা করা হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সেবছর পূর্বেকার কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা সংস্কার করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সাধারণ মেধা কোটা ৫% বাড়িয়ে ৪০% এর জায়গায় ৪৫% করা হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের মতোই ৩০% এবং নারীদের কোটা ১০% বহাল রাখা হলেও জেলা কোটা ২০% থেকে কমিয়ে ১০% করা হয়। সাশ্রয়কৃত ১০% কোটা থেকে ৫% পূর্বে উল্লেখিত সাধারণ মেধাকোটার জন্য এবং প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫% কোটা সুবিধা চালু করা হয়। আমার আপত্তি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত এই ৫% কোটা সুবিধা নিয়েই। কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোটা ব্যবস্থার এ বিভাজন তৈরি করা হয়নি বলেই আমি মনেকরি। শুধু তাই নয়, কোটায় প্রার্থী না থাকলে কোটার বাইরে থেকে কাউকে শূন্যপদে নিয়োগ দেয়া, সেটাও করা হয়নি।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ কোটি, এরমধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫% কোটা সংরক্ষণ করায় তাদের জনসংখ্যা ন্যুনতম ৪০ লাখ হলে বিষয়টা যৌক্তিক হতো, অথচ গত ৪০ বছরেও সংখ্যাটা তার কাছাকাছিও যেতে পারেনি। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ অর্থাৎ তাদের জন্য বরাবরই ৫% এর পরিবর্তে ১% কোটা সুবিধাই পর্যাপ্ত ছিল। এভাবে সরকারিভাবেই বাংলাদেশের বৃহৎ নৃগোষ্ঠী বাঙালি সম্প্রদায়, যারা মোট জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশেরও বেশি, তাদেরকে সুবিধা বঞ্চিত করা হয়েছে। জনসংখ্যার মাত্র ১% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মোট কোটা সুবিধার ৫% ভোগ করেছে। এখানেও আরেকরকম বৈষম্য বিরাজ করছে , কেননা আজ পর্যন্ত কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থার পুরো সুবিধাটা ভোগ করে আসছে পাহাড়ে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা (টিপরা) সম্প্রদায়। এক বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তে কয়েক শত বছর ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের যেমন এই সুবিধার আওতায় রাখা হয়নি। তেমনি দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
২
বাংলাদেশ ভূখন্ডের জনসংখ্যার অধিকাংশ বৃহৎ নৃগোষ্ঠী বাঙালি, এছাড়াও অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাহাড় -সমতল মিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ৪৭টা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যাটা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন বা প্রায় ১৭ লাখ, সমগ্র নৃগোষ্ঠীর প্রায় এক শতাংশের মতো (০.৯৯%) । তাদের মধ্যে সর্ববৃহৎ নৃগোষ্ঠী হলো চাকমা। এছাড়া রয়েছে গারো, মারমা, ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরী ইত্যাদি। অথচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৯.২৯% চাকমা, ১৩.৫৯% মারমা এবং ৯.৪৯% ত্রিপুরা মিলে ৫২.৩৭% কোটা সুবিধার প্রায় পুরোটাই ভোগ করে।
বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত মোট ৩ হাজার ১০৮টি আসনের অর্ধেকের চেয়ে বেশি, ৫৬% এককভাবে চাকমা শিক্ষার্থীরা অধিকার করেছে। অথচ চাকমারা বাংলাদেশের মোট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যার শতকরা ২৯.২৯ ভাগ। একইভাবে মারমা সম্প্রদায় মোট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৩.৫৯% হলেও তারা মোট সংরক্ষিত কোটা আসনের ১৪%, ত্রিপুরা সম্প্রদায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যার ৯.৪৯% হলেও কোটা আসনের ৭% আসনে ভর্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও কোটাসুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। সাঁওতাল সম্প্রদায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যার ৭.৮২% হলেও তারা মাত্র ৩% কোটা সুবিধা লাভ করতে সক্ষম হয়। প্রায় ৪৭টা ক্ষুদ নৃগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে কোটার ১৮% সুবিধা নিতে পেড়েছে যদিও তারা মোট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যার ৪৭.৬৩%। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, সেই চাকমা সম্প্রদায় কোটাব্যবস্থার মূল সুবিধাভোগী। এই সুবিধায় দেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়ে তারাই পরবর্তীতে বৈষম্যের নামে দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে দেশ বিরোধী বক্তব্য রাখে। রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ কিংবা শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে তারাই আছে।
চাকমা সম্প্রদায়ের দেশ বিরোধী ভূমিকা এবারই প্রথম না, ইতিহাসে সবসময়ই তারা মুসলিম বা বাঙালি বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমানরা যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত চাকমা রাণী কালিন্দি (১৮৪৪-১৮৭৩ সাল) তখন ব্রিটিশদের পক্ষে ছিলেন। ১৮৫৭ সালে বাঙালিরা যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লবে জড়িত চাকমা সম্প্রদায় তখন সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। রানী কালিন্দী স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক সিপাহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন। সিপাহী বিদ্রোহের পলাতক সৈনিকদের বিরুদ্ধে এরকম দায়িত্ব পালনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে রানী কালিন্দীকে বার্ষিক ১১৪৩ টাকা কর্ণফুলী নদীর বার্ষিক জলকর মওকুফ করে। এছাড়াও ১৮৭২ সালে কালিন্দী রাণীর নির্দেশে ইংরেজদের লুসাই অভিযানের সময়ে হরিশ্চন্দ্র ইংরেজ সরকারকে সহায়তা করায় ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব অর্জন করে। ১৯৪৭ সালে তারা ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং পতাকা উড়ায়। ১৯৭১ সালে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া ৮-১০ জনের একটা মুক্তিযোদ্ধাদলকে চাকমা সার্কেল রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে চাকমা রাজাকাররা হত্যা করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দালাল আইনে রাজা ত্রিদিব রায়ের নাম আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বন্ধ করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের প্রেসক্রিপশনে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (Chittagong Hill Tracts Peace Accord) নামে একটা অসম চুক্তি করা হয়। এই চুক্তির ধারা বলে পাহাড়ের ট্যাক্স রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়না অথচ সমতলের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকমা সম্প্রদায় শিক্ষা লাভ করে দেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এমনকি অস্ত্রধারণ করতেও দ্বিধা করেনা। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী ৭.৮২% সাঁওতাল এবং ৫.২০% ওঁরাও সম্প্রদায় বরাবরই কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) তে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
৩
২০১৮ সালে কোটা সুবিধা বাতিলের কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ চাকমা সম্প্রদায়কে কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সেভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি কারণ দেশের বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর অনুভূতি তারা কখনও ধারণ করে না। তারা বরাবরই একটা রাষ্ট্রদ্রোহী নৃগোষ্ঠী, একারণে ৫ আগস্ট তারিখের পর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া গ্রাফিতি আন্দোলনে যোগ দিয়ে পাহাড়ী জনপদের অলিগলিতে তথাকথিত সেনাশাসনের অপসারণ, কল্পনা চাকমার মুক্তি, পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে।
সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার সেদিকে শ্রদ্ধা রেখে বলছি, এপর্যন্ত কোটা সুবিধার বেনিফিসিয়ারি চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা সম্প্রদায় (৫২.৩৭%) কে কোটা সুবিধার বাইরে রেখে প্রকৃতপক্ষে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (যেমন-৩.১৮% মুরং, ৪.৬৬% গারো, ৩.৬৫% মুন্ডা, ০.৭৫% খাসিয়া, ০.৮৩% কোচ, ০.৮০% বোম প্রভৃতি) দেরকে কোটা সুবিধা বরাদ্দ করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সবাইকে গণহারে একই ছাতার তলে না এনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করে কোটা ব্যবস্থা বন্টন করা হলে প্রকৃত অনগ্রসর নৃগোষ্ঠী কোটা সুবিধার আওতায় আসবে বলে মনেকরি। উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার ভালোমন্দ দিকগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে চরমভাবে অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও বঞ্চিত পার্বত্য বাঙালিদেরকেও কোটার আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন
পোস্ট ভিউঃ
13