সখী, এসেছে তোমারি রবিঃ আনা-রবি উপাখ্যান
প্রবন্ধ
অনুগামিনীগন
১, শুন নলিনী, খোলো গো আঁখি—
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি!
দেখো, তোমারি দুয়ার-'পরে
সখী, এসেছে তোমারি রবি॥
শুনি প্রভাতের গাথা মোর
দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর,
জগত উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি।
তবে তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো,
আমি যে তোমারি কবি॥
প্রশ্ন হলো কে এই নলিনী? যার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি,
প্রতিদিন গান গাহি—
প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান
ধীরে ধীরে উঠ চাহি।
আজিও এসেছি, চেয়ে দেখো দেখি
আর তো রজনী নাহি।
আজিও এসেছি, উঠ উঠ সখী,
আর তো রজনী নাহি।
সখী, শিশিরে মুখানি মাজি
সখী, লোহিত বসনে সাজি
দেখো বিমল সরসীর-আরশির 'পরে অপরূপ রূপরাশি।
থেকে থেকে ধীরে হেলিয়া পড়িয়া
নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া
ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া শরমের মৃদু হাসি॥
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৮৭৮ সালে। রবি তখন ১৭ বছরের যুবক, কিন্তু ঐ বয়সেই তাঁর কিছু
কবি খ্যাতি হয়েছে। তবে পরিবারের ইচ্ছে কবি নয়, তাকে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরতে হবে। আর এজন্য তাঁকে
বিলেতের সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্যে ইত্যাদির সাথে পরিচিত করতে পাঠানো হলো বোম্বেতে ডাঃ আত্মারাম পান্ডুরঙ-এর
বাড়িতে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতীয় আইসিএস
অফিসার, থাকেন আমেদাবাদে। তিনি ভাবলেন বিলেতে যাওয়ার আগে সেখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতির সাথে পরিচয় আছে
এমন কোন পরিবারের সাথে কিছুদিন কাটালে রবি বিলেতের সংস্কৃতির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাটাও ভালো ভাবে আয়ত্ব
করতে পারবেন। আর ঘটনাটা ঘটলো সেই বাড়িতেই।
মারাঠি ভদ্রলোক ডাঃ আত্মারাম পান্ডুরঙ-এর তিন কন্যা, আন্না বা আনা, দুর্গা এবং মানিক। পরিবারটি বোম্বাই
অঞ্চলে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার তিনটি মেয়েই বিলেতে শিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের
শিক্ষার দায়িত্ব বর্তালো বড় মেয়ে অন্নপুর্ণা তড়খড়, ডাক নাম আন্না বা আনার ওপরে, কিন্তু তিনি ১৭ বছরের রবির
প্রেমে পড়লেন। বয়সে রবির ৩ বছরের বড়, ২০ বছর বয়সী এই মারাঠি সুন্দরী কিছুদিন হলো বিলেত থেকে ফিরেছেন।
সেখানে তাকে সবাই ‘আনা’ নামে ডাকলেও রবি প্রথম প্রেমিকার ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে নাম রাখলেন ‘নলিনী’। এরপর
থেকে কবিতা, গানে বারবার করে ‘নলিনী’ নামটা এসেছে। এই নামকরণ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন,
‘সেটা ভাল লাগল তাঁর কানে। ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতায় ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের
গাঁথুনিতে, শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে, বললেন, কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় আমার মরণ দিনের
থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি। এর থেকে বোঝা যাবে, মেয়েরা যাকে আদর জানাতে চায় তার কথা একটু মধু মিশিয়ে
বাড়িয়েই বলে, সেটা খুশি ছড়িয়ে দেবার জন্যেই। মনে পড়ছে তাঁর মুখেই শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ। সেই বাহানায়
অনেক সময় গুণপনা থাকত।’
আনা একদিন রবিকে বলেছিলেন, ‘আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না। তোমার মুখের
রূপ যেন কোনোদিন ঢাকা না পড়ে।’ রবি লিখেছেন, ‘তাঁর এই কথা আজ পর্যন্ত রাখা হয়নি সে-কথা সকলেরই জানা আছে।
আমার মুখের অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।’ আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনা’র সেই অনুরোধ
রাখতে পারেন নি, কিন্তু তিনি সেই মেয়েটিকে কখনো ভুলে যাননি। এক জায়গায় তিনি সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘আমার
জীবনে তারপর নানান অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন—কিন্তু আমি একটা কথা
বলতে পারি গৌরব করেঃ যে কোন মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনও ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি—তা সে ভালোবাসা যে
রকমই হোক না কেন।’ কেননা প্রতিটা মেয়ের ভালোবাসা তা সে যে রকম ভালোবাসাই হোক না কেন আমাদের মনের বনে
কিছু-না-কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায়, যে ফুল হয়তো পরে ঝরে যায় কিন্তু তার গন্ধ মিলিয়ে যায় না। এই মারাঠি
সুন্দরী রবিকে কীরকম ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়েছিলেন তা রবি ঠাকুরের লেখা থেকেই অনুমান করা যাক,
‘চাঁদনি রাত। চারিদিকে সে যে কী অপরূপ আলো-হাওয়া। কিন্তু আমিও তখন কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা। ভাল লাগছে না
কিছুই। মন কেমন করছে বাংলাদেশের জন্যে, আমাদের বাড়ির জন্যে, কলকাতার গঙ্গার জন্যে। সে এসে একেবারেই আমার
নেয়ারের খাটের উপরেই বসল। হঠাৎ বলল, আমার হাত ধরে টানো তো, টাগ অফ ওয়ারে দেখি কে জেতে।’
রবীন্দ্রনাথ কতটা ইংরেজি আনার কাছে শিখেছিলেন আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি
বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন আনা। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আনার মনে হয়েছিল, আমার মরণ দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে
জেগে উঠতে পারি। তারই অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ একটি নামও দিয়েছিলেন তাঁকে, নলিনী। সেই সময়কার কয়েকটি গানে
রবীন্দ্রনাথ নলিনী নামটা ব্যবহারও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও আনার সম্পর্কটি কেমন ছিল?
এই মারাঠি সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে রবি ঠাকুর অনেক বছর পরেও স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখান থেকে তাদের সম্পর্কের
ধরণটা আঁচ করা যায়। তিনি বলেছেন চুমু খাওয়ার লোভ দেখিয়েও আনা কবিকে দিয়ে যে তার দস্তানা চুরি করাতে পারেনি, সে
গল্প। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় গল্পটা এরকম,
“…আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মত কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু হায়রে, সেই হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না
ছিল কোননারকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।…..শেষে একদিন বলল তেমনি আচমকাঃ ‘জানো কোনো মেয়ে
ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?’ বলে খানিক
বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সে চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি
করেনি।”
আনা’র দস্তানা চুরি না করে প্রতিশ্রুত আদরের প্রলোভন থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনলেও এই অতৃপ্ত বাসনা কিন্তু তাকে
কখনই ছাড়েনি। কবিতায় রবি বলেছেন,
এইখানে থাক তুমি, ফিরিয়া আসিয়া পুনঃ
ওই মধুমুখখানি করিব চুম্বন।
এমনকি আনার মৃত্যুর পরও সেই বাসনা জাগরূক ছিল,
হৃদয়ে রাখিয়া তারে পাগলের মতো কবি
কহিল কাতর স্বরে ‘নলিনী’ ‘নলিনী’!
স্পন্দহীন, রক্তহীন অধর তাহার।
অধীর হইয়া ঘন করিল চুম্বন।
২
‘ভারতী’ পত্রিকায় তখন সবে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিকাহিনী’। রবি আনাকে ইংরেজিতে ‘কবিকাহিনী’ অনুবাদ
করে শোনাতেন। এই যেমন,
শুনো নলিনী খোলো গো আঁখি
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি
দেখো, তোমারই দুয়ার ‘পরে
সখি, এসেছে তোমারই রবি।
শুনি প্রভাতের গাথা মোর
দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর,
দেখো জগৎ উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি।
তবে তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো আমি যে তোমারই কবি।
রবির মুখে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ শুনে আনার দুচোখে কেবলই মুগ্ধতা, কেবলি বিস্ময়! রবি লিখেছেন,
প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি, প্রতিদিন গান গাহি-
প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান ধীরে ধীরে উঠো চাহি।
আজিও এসেছি, চেয়ে দেখো দেখি আর তো রজনী নাহি
সখি, শিশিরে মুখানি মাজি
সখি, লোহিত বসনে সাজি,
দেখো বিমলা সরসী-আরশির ‘পরে অপরূপ রূপ রাশি।
থেকে থেকে ধীরে হেলিয়া পড়িয়া
নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া
ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া শরমের মৃদু হাসি।
আনা ভাবেন, সতিকারে কাউকে গভীরভাবে ভাল না বাসলে এভাবে কি অনুভূতির কথা লেখা যায়! এভাবেই রবির মুখে
‘কবিকাহিনী’ শুনতে শুনতে আনা ক্রমশই মুগ্ধ। অথচ ১৭ বছরের রবি আর ২০ বছরের আনার মাঝে সম্পর্কটা হবার কথা
ছিল ছাত্র এবং শিক্ষকের। কথা ছিল আনার কাছে রবি ইংরেজি শিখবেন কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল আনা রবির কাছে বাংলা
শিখছেন। রবি আনাদের বাড়িতে প্রায় দু’মাস ছিলেন। এই দু’মাসে রবি তার আদর আদায় করার সবচেয়ে বড় মূলধনটাকে
ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন অথচ আনা তখন বাগ্দত্তা। বিলেতে থাকা অবস্থায় লিটলডেল-এর সাথে আনার পরিচয় রবির
সাথে পরিচয়ের বেশ আগে, ডাবলিনে। সেখানেই তাদের বিয়ের কথা পাকাপাকি হলেও আনা রবির আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে
পারেননি। রবি তার প্রথম প্রেমের কথা লিখেছেন এভাবে,
‘কিছুদিনের জন্যে বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম। সেই বাড়ির কোনো একটি এখনকার কালের
পড়াশোনাওয়ালা মেয়ে ঝকমকে করে মেজে এনেছিলেন তাঁর শিক্ষা বিলাত থেকে। আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলাফেলা
করলে দোষ দেওয়া যেতে পারত না। তা করেন নি। পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মত পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম
যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে। আদর আদায় করবার ঐ হল আমার সবচেয়ে বড় মূলধন। যাঁর কাছে নিজের এই
কবিআনার জানান দিয়েছিলাম, তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেন নি। মেনে নিয়েছিলেন।”
‘কবিকাহিনী’ বই হয়ে বের হবার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটা বই আনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন। আনা সেটা হাতে পেয়ে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন এভাবে,
Bombay
65 Kandevadi
Nov.26th, 1878
Dear Sir,
I have to apologise to you for having kept your kind letter of the 11th instant, with the copy of ‘কবিকাহিনী’
unacknowledged so long, but various causes, in the shape of illness, have combined to hinder me from
doing so, till the present moment, and even as I write this, I have fever upon me.
Thank you very much indeed for sending me this publication of ‘কবিকাহিনী’ though I have read the poem
myself in the numbers of ‘ভারতী’ in which it was first published, and which Mr. Tagore was good enough to
give me before going away and had it read and translated to me, till I knew the poem almost by heart.
You are under a misapprehension when you suppose that I have learnt Bengali. I was only a beginner, for
ill health has come in the way of my studies, and I have had to cease continuing them.
৩
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর ইংলন্ড যাত্রা করেন। কয়েকমাস পরে ডাঃ পান্ডুরঙ্গ দুই মেয়েকে নিয়ে
কলকাতা আসেন, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়। প্রশান্ত কুমার পাল তার রবিজীবনীর ২য় খণ্ডে লিখেছেন,
“কিন্তু আমরা একথা ভাবতে প্রলুব্ধ হই যে, নিছক কলকাতা পরিভ্রমণ ও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সৌজন্যমূলক
সাক্ষাৎকার তাঁর সকন্যা কলকাতা আগমনের উদেশ্য ছিল না, ‘রবি-অনুরাগিনী’ আনার হৃদয় দৌর্বল্য দেখে কন্যা বৎসল
ডঃ পান্ডুরঙ্গ হয়তো সেই অনুরাগকে সার্থক করার জন্য বিশেষ কোন প্রস্তাব নিয়েই কলকাতা এসেছিলেন। অবশ্য এটি
নিছক অনুমান, তাকে সপ্রমাণ করার মত কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।”
এই ঘটনার কিছুদিন পরই, ১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে বরোদার রাজকুমার কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারল্ড লিটলডেল
নামের এক আইরিশ যুবকের সাথে বোম্বেতে আনার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর তারা এডিনবারায় সংসার পাতেন। আনার দুই
কন্যা সন্তান হয়েছিল। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই তারিখে আনা মারা যান।
এরমাঝে তার বিয়েটাও ভেঙ্গে গিয়েছিল। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর ছেপেছিল এভাবে,
‘বোম্বাইয়ের সুপ্রসিদ্ধ সমাজ-সংস্কারক আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বিদুষী কন্যা গত ৫জুলাই তারিখে এডিনবরা নগরে
মানবলীলা সংবরণ করেন……যে সকল ভারতমহিলা পাশ্চাত্য শিক্ষায় সর্বপ্রথম সুশিক্ষিত হন, আনাবাই তাঁহাদিগের
মধ্যে একজন। তাঁহার পিতা সদালাপী, উন্নতমনা, মার্জিতবুদ্ধি, জ্ঞানী ও পরম ধার্মিক। ইনি বালিকা কন্যাকে
অধ্যয়নার্থে ইংলন্ডে প্রেরণ করেন। ইহাতে ইনি সমাজের বিরাগভাজন হন। কিন্তু কিছুতেই ভয় পান নাই; জাতিভেদের
বন্ধন উল্লঙ্ঘন করিয়া কিছুমাত্র দুঃখিত হন নাই। বুদ্ধিমতী আনা অলৌকিক শক্তির পরিচায়িকা। ষোড়শ বৎসরে তিনি
যেরূপ গুণবতী হইয়া উঠিয়াছিলেন সেরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। ডাক্তার আনন্দীবাই যে অসামান্য মনস্বিতার পরিচয় দেন, স্ত্রী-
কবি বঙ্গযুবতী কুমারী তরু দত্ত যে কবিত্বের লালিত্যে অখিল সভ্য জগতকে বিমুগ্ধ করেন, ইঁহারও সেই শক্তি ছিল,
বিকাশের সম্পূর্ণ সুযোগ হয় নাই। কলিকা প্রস্ফুটিত হইতে না হইতে কালের কঠিন করাঘাতে বিদলিত হইল! গীতবাদ্যে
তিনি সুনিপুণা ছিলেন। মাতৃভাষা মহারাষ্ট্রীয় ব্যতীত তিনি ইংরাজী, ফরাসী, জর্মন ও পর্তুগীজ ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ
করেন। এই সকল ভাষায় কথোপকথন করিতে পারিতেন। তিনি সংস্কৃতও কিছুকিছু জানিতেন। তাঁহার রীতিনীতি চালচলন এত
ভাল ছিল, তিনি এরূপ সদালাপিনী ছিলেন যে, একবার যিনি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছেন, তিনিই তাঁহার হৃদয়গ্রাহিতার
প্রশংসাবাদ না করিয়া থাকিতে পারিবেন না।
৪
রবি কখনো আনাকে ভুলতে পারেননি। একদিন আনা যখন রবিকে বললেন, একটা নতুন নাম দিতে পারো আমাকে, যে নামে শুধু
তুমিই আমাকে ডাকবে! রবি ভালোবেসে নাম দিলেন ‘নলিনী’। এরপর থেকে রবি ঠাকুরের গান, কবিতা ইত্যাদিতে নলিনী নামটা
বারবার ফিরে এসেছে। কখনো ইঙ্গিতে আবার কখনো স্পষ্ট স্বীকারোক্তির ঠঙে কৈশোরের প্রেম ফিরে এসেছে তাঁর
লেখায়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দিলীপকুমার রায়কে তিনি লিখেছেন,
‘সে মেয়েটিকে ভুলিনি, বা তার সে আকর্ষণকে কোন লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন। আমার জীবনে তারপর
নানান আভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন,
-কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে
দেখিনি, তা সে ভালবাসা যে-রকমই হোক না কেন।’
আনার বিয়ের দু’বছর পরে, ১৮৮১ সালে বিলেতে থাকাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্য লিখেন।
‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী যেন এক চপলস্বভাবের মেয়ে। আনার প্রগল্ভতা বা চাপল্য ভাল লেগেছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের।
‘ভগ্নহৃদয়’ এর দ্বাদশ সর্গে আনার মনই যেন ফুটে উঠেছে ‘নলিনী’র কথায়,
এসো মন, এসো, তোমাতে আমাতে
মিটাই বিবাদ যত!
আপনার হয়ে কেন মোরা দোঁহে
রহি গো পরের মত?
আমি যাই এক দিকে, মন মোর!
তুমি যাও আর দিকে—
যার কাছ হতে ফিরাই নয়ন
তুমি চাও তার দিকে!
তার চেয়ে এস দুজনে মিলিয়ে
হাত ধরে যাই এক পথ দিয়ে,
আমারে ছাড়িয়ে অন্য কোনোখানে
যেয়ো না কখনো আর!
পারি না কি মোরা দুজনে থাকিতে,
দোঁহে হেসে খেলে কাল কাটাইতে?
তবে কেন তুই না শুনে বারণ
যাস্ রে পরের দ্বার?
তুমি আমি মোরা থাকিতে দুজন,
বল্ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
অন্য সহচরে আর?
তুমি আমি মোরা থাকিতে দুজন,
বল্ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
অন্য সহচরে আর?
এত কেন সাধ বল্ দেখি, মন,
পর-ঘরে যেতে যখন তখন–
সেথা কি রে তুই আদর পাস্?
বল্ ত কত-না সহিস যাতনা?
দিবানিশি কত সহিস লাঞ্ছনা?
তবু কি রে তোর মিটে নি আশ?
আয়, ফিরে আয়, মন, ফিরে আয়–
দোঁহে এক সাথে করিব বাস!
অনাদর আর হবে না সহিতে,
দিবস রজনী পাষাণ বহিতে,
মরমে দহিতে, মুখে না কহিতে,
ফেলিতে দুখের শ্বাস!
শুনিলি নে কথা? আসিলি নে হেথা?
ফিরিলি নে একবার?
সখি লো, দুরন্ত হৃদয়ের সাথে
পেয়ে উঠিনে ত আর!
“নয় রে সুখের খেলা ভালবাসা!”
কত বুঝালেম তায়–
হেরিয়া চিকণ সোনার শিকল
খেলাইতে যায় হৃদয় পাগল,
খেলাতে খেলাতে না জেনে না শুনে
জড়ায় নিজের পায়!
বাহিরিতে চায়, বাহিরিতে নারে,
করে শেষে হায়-হায়!
শিকল ছিঁড়িয়ে এসেছে ক’বার,
আবার কেন রে যায়?
চরণে শিকল বাঁধিয়া কাঁদিতে
না জানি কি সুখ পায়!
তিলেক রহে না আমার কাছেতে
যতই কাঁদিয়া মরি,
এমন দুরন্ত হৃদয় লইয়া,
সজনি, বল্ কি করি?
আনার এরকম চপল স্বভাবের জন্যই রবি এতটা ভালবেসেছেন, তাকে সারাজীবন ভুলতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখনই তাঁর জীবনের পিছনে ফিরে তাকিয়েছেন তখনই তিনি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছেন তাঁর সৌভাগ্যের কাছে, আনার মতো
একজন নারী তাঁর জীবনে এসেছে, সে আগমন যত অল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন। কবি লিখেছেন,
‘জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড় করে দিয়ে যায়।
না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না। চলে যেতে যেতে বেঁচে থাকার চাদরটার উপরে ফুলকাটা
কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে।’
কবি প্রায় একইরকম কথা, তবে ভিন্ন ভাষায় দিলীপকুমার রায়কে বলেছেন,
‘প্রতি মেয়ের ভালবাসা, তা সে যে-রকমের ভালবাসাই হোক না কেন- আমাদের মনের বনে কিছু না কিছু অফোটা ফুল ফুটিয়ে
রেখে যায়। সে ফুল হয়তো পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে।’
চুমুর লোভ দেখিয়ে আনার দস্তানা চুরির কৌতুকী ঘটনা বা আনার কপট নিদ্রার ঘটনাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা
গানের মাঝেও আঁচ করা যায়,
‘তারি স্বপনে রয়েছি ভোর আমার স্বপন ভাঙ্গায়ো না
তাহারি স্বপনে আজি মুদিয়া রয়েছে আঁখি-
কখন আসিবে প্রাতে আমার সাধের পাখি,
কখন জাগাবে মোরে আমার নামটি ডাকি।’
নিচের কবিতায় নলিনীর কথা এসেছে,
‘যাহার মোহিনী মূর্তি হৃদয়ে হৃদয়ে
শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে,
যতকাল রব বেঁচে যার ভালবাসা
চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়,
সে বালিকা সে নলিনী সে স্বর্গপ্রতিমা,
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত
তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল?’
নলিনী মৃত্যুর পরেও রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে-মননে জায়গা পেতে রয়েছিলেন, কবি লিখেছেন,
দেহকারাগার মুক্ত সে নলিনী এবে
সুখে দুঃখে চিরকাল সম্পদে বিপদে,
আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ।
চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি,
আমারি মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া।
রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে
প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে।
এমন অন্তরে তাকে রেখেছি লুকায়ে,
মরমের মর্মস্থলে করিতেছি পূজা,
সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে
ভাঙ্গিবার এ জনমে সে মোর প্রতিমা,
হৃদয়ের আদরের লুকনো সে ধন।
বেঁচে থাকাবস্থায় আনাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি রবির প্রতি তার মুগ্ধতাকে। নলিনী নামের গৌরবকে তিনি অস্বীকার
করতে পারেননি কখনোই। ঐ নামেই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন। রবির প্রতি আনার মুগ্ধতাকে,
আনার অনুভূতি রবি বুঝতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে গভীর ভাবে অনুভব করতেন বলেই ‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী রবিকে কি
চোখে দেখতেন তার বর্ণনা দিতে পেরেছেন,
ওই যে এ দিকে আসিছে কবি!
কথা আজ মোরে কহিতে হইবে,
র’ব না বসিয়া অচল ছবি!
কি কথা বলিব? ভাবিতেছি মনে,
কিছুই ত ভেবে নাহিক পাই!
বলিব কি তারে– “তোমরা কবি গো,
তোমাদের ভাল বাসিতে নাই!
বুঝিতে পার না আপনার মন,
দিবানিশি বৃথা কর গো শোক!
ভালবাসা-তরে আকুল হৃদয়,
ভালবাসিবার পাও না লোক!
মনে তোমাদের সৌন্দর্য্য জাগিছে
ধরায় তেমন পাও না খুঁজে,
তবুও ত ভাল বাসিতেই হবে
নহিলে কিছুতে মন না বুঝে।
অবশেষে কারে পাও দেখিবারে
নেশায় আপনা ভুলি,
সাজাইয়া দেয় কলপনা তারে
নিজের গহনা খুলি।
আসি কলপনা কুহকিনীবালা
নয়নে কি দেয় মায়া,
কলপনা তারে ঢেকে রাখে নিজে
দিয়ে নিজে জ্যোতিছায়া।
কল্পনাকুহকে মায়া মুগ্ধ চোকে
কি দেখিতে দেখ কিবা,
অপরূপ সেই প্রতিমা তাহার
পুজ মনে নিশি দিবা!
যত যায় দিন, যত যায় দিন,
যত পাও তারে পাশে,
দেবীর জ্যোতি সে হারায় তাহার
মানুষ হইয়া আসে!
ভালবাসা যত দূরে চলি যায়
হাহাকার করে মনে,
কলপনা কাঁদে ব্যথিত হইয়া
আপনার প্রতারণে!
আমি গো অবলা– করিব প্রণয়
অত নাহি করি আশা,
আমি চাই নিজ মনের মানুষ
সাদাসিদে ভালবাসা!”
এমনি করিয়ে বাতাসের ‘পরে
মিছে অভিমান বাঁধি
অকারণে তার কবির লাঞ্ছনা
অভিমানে কাঁদি কাঁদি।
কিছুতে সান্ত্বনা না আমি মানিব,
দূরেতে যাইব চলে–
কাছেতে আসিতে করিব বারণ
করুণ চোখের জলে!
৫
‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথের প্রেমভাবনা জাত, যেখানে কবি তাঁর লীলাসঙ্গিনীকে অন্বেষণ করেছেন।
‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্য বা গীতিকাব্য রচনার ঠিক ৩বছর পর, ১৮৮৪ সালে কবির কলমে আনা’র চপলস্বভাবের প্রতিরূপ
হয়ে ‘নলিনী’ গদ্যনাট্য এসেছে। এই নাটকের একটা বিখ্যাত উক্তিতে ‘নলিনী’কে নিয়ে কবির রোমান্টিক ভাবনার প্রকাশ
ঘটেছে,
‘সে আমাকে হৃদয় দিক আর নাই দিক আমার তাতে কি আসে যায়? আমি তার যতটুকু মধুর তা উপভোগ করব না কেন? তার
মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা পেতে আপত্তি কি আছে!’
বিলেতে যাওয়ার আগে বোম্বাইয়ের প্রায় দু’টা মাস রবির মুহুর্তগুলো আনার মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা, প্রগলভ্তা, চাপল্য
দিয়ে রঙিন হয়ে ছিল। অথচ এরকম ‘ফ্লার্টিং’ বা রসতরঙ্গে কিশোর রবি অভ্যস্ত ছিলেন না। আনা রবীন্দ্রমানসে
আধুনিক নারী অভিজ্ঞতার উদ্বোধন ঘটালেন এভাবে,
‘আমার সঙ্গে সে প্রায় যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই যে ঘুরত আমার আনাচে-কানাচে। আমি বেশ টের পেতাম যে
ঘটবার মতন কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু হায়রে, সে হাওয়াটাকে উসকে দেবার দিকে আমার না ছিল তৎপরতা, না ছিল কোনো
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।’
আনা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বেশি তাড়াতাড়ি এসেছেন কিংবা রবীন্দ্রনাথ বেশি দেরিতে বড় হয়েছেন। তার নারী
অভিজ্ঞতার ম্যাচিউরিটি এলো বিলেতে যাওয়ার পর। বিলেতেই তিনি তাঁর শরীরী আকর্ষণের কথা প্রথম জানতে পারেন।
আনার প্রতি রবির এই যে এতো অনুভূতি, এতো প্রেম, ভালোবেসে আনাকে ‘নলিনী’ নামে ডাকা, ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যে
আনার প্রতিরূপে ‘নলিনী’ নামে একটা চরিত্র সৃষ্টি, এতকিছুর পরও তিনি ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যটা আনাকে উৎসর্গ
করেননি। ১৮৮১ সালে লেখা এই নাট্যকাব্যটা উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবনের আরেক গোপনচারিণী, ‘শ্রীমতী হে’-কে। ‘হে’
চরিত্রটির আড়ালে যে নারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সারাজীবন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তিনি আর কেউ নন, নতুন বৌঠান
কাদম্বরী দেবী, রবির বয়স তখন ২০ আর নতুন বৌঠান ২২ ছুঁয়েছেন। তবে ‘নলিনী’ নামের মায়া থেকে আনা কোনদিন
মুক্তিলাভ করেননি। অথচ তারা মাত্র দু’মাস একই বাড়িতে ছিলেন এবং এরপর তাদের আর কখনো দেখা হয়নি। আত্মারাম
পরিবারের সাথে কাটানো সেই দু’মাসে রবি আনাকে চুমু খাওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়া বা শরীরী যা কিছু কোনদিন মুখ
ফুটে আনাকে বলতে পারেননি তা যেন কবিতার ভাষায় অবলীলায় বলে গেছেন,
শিথিল বসন তার
ওই দেখ চারিধার
স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে,
যেথা যে গঠন আছে
পূর্ণভাবে বিকশিছে
যেখানে যা উঁচুনিচু প্রকৃতির বিধানে।
হদিসঃ
১। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
২। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন
৩। নলিনী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪। ভগ্নহৃদয়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫। ছেলেবেলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৬। রবিজীবনী- প্রশান্ত কুমার৩
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর ইংলন্ড যাত্রা করেন। কয়েকমাস পরে ডাঃ পান্ডুরঙ্গ দুই মেয়েকে নিয়ে
কলকাতা আসেন, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়। প্রশান্ত কুমার পাল তার রবিজীবনীর ২য় খণ্ডে লিখেছেন,
“কিন্তু আমরা একথা ভাবতে প্রলুব্ধ হই যে, নিছক কলকাতা পরিভ্রমণ ও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সৌজন্যমূলক
সাক্ষাৎকার তাঁর সকন্যা কলকাতা আগমনের উদেশ্য ছিল না, ‘রবি-অনুরাগিনী’ আনার হৃদয় দৌর্বল্য দেখে কন্যা বৎসল
ডঃ পান্ডুরঙ্গ হয়তো সেই অনুরাগকে সার্থক করার জন্য বিশেষ কোন প্রস্তাব নিয়েই কলকাতা এসেছিলেন। অবশ্য এটি
নিছক অনুমান, তাকে সপ্রমাণ করার মত কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।”
এই ঘটনার কিছুদিন পরই, ১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে বরোদার রাজকুমার কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারল্ড লিটলডেল
নামের এক আইরিশ যুবকের সাথে বোম্বেতে আনার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর তারা এডিনবারায় সংসার পাতেন। আনার দুই
কন্যা সন্তান হয়েছিল। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই তারিখে আনা মারা যান।
এরমাঝে তার বিয়েটাও ভেঙ্গে গিয়েছিল। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর ছেপেছিল এভাবে,
‘বোম্বাইয়ের সুপ্রসিদ্ধ সমাজ-সংস্কারক আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বিদুষী কন্যা গত ৫জুলাই তারিখে এডিনবরা নগরে
মানবলীলা সংবরণ করেন……যে সকল ভারতমহিলা পাশ্চাত্য শিক্ষায় সর্বপ্রথম সুশিক্ষিত হন, আনাবাই তাঁহাদিগের
মধ্যে একজন। তাঁহার পিতা সদালাপী, উন্নতমনা, মার্জিতবুদ্ধি, জ্ঞানী ও পরম ধার্মিক। ইনি বালিকা কন্যাকে
অধ্যয়নার্থে ইংলন্ডে প্রেরণ করেন। ইহাতে ইনি সমাজের বিরাগভাজন হন। কিন্তু কিছুতেই ভয় পান নাই; জাতিভেদের
বন্ধন উল্লঙ্ঘন করিয়া কিছুমাত্র দুঃখিত হন নাই। বুদ্ধিমতী আনা অলৌকিক শক্তির পরিচায়িকা। ষোড়শ বৎসরে তিনি
যেরূপ গুণবতী হইয়া উঠিয়াছিলেন সেরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। ডাক্তার আনন্দীবাই যে অসামান্য মনস্বিতার পরিচয় দেন, স্ত্রী-
কবি বঙ্গযুবতী কুমারী তরু দত্ত যে কবিত্বের লালিত্যে অখিল সভ্য জগতকে বিমুগ্ধ করেন, ইঁহারও সেই শক্তি ছিল,
বিকাশের সম্পূর্ণ সুযোগ হয় নাই। কলিকা প্রস্ফুটিত হইতে না হইতে কালের কঠিন করাঘাতে বিদলিত হইল! গীতবাদ্যে
তিনি সুনিপুণা ছিলেন। মাতৃভাষা মহারাষ্ট্রীয় ব্যতীত তিনি ইংরাজী, ফরাসী, জর্মন ও পর্তুগীজ ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ
করেন। এই সকল ভাষায় কথোপকথন করিতে পারিতেন। তিনি সংস্কৃতও কিছুকিছু জানিতেন। তাঁহার রীতিনীতি চালচলন এত
ভাল ছিল, তিনি এরূপ সদালাপিনী ছিলেন যে, একবার যিনি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছেন, তিনিই তাঁহার হৃদয়গ্রাহিতার
প্রশংসাবাদ না করিয়া থাকিতে পারিবেন না।
৪
রবি কখনো আনাকে ভুলতে পারেননি। একদিন আনা যখন রবিকে বললেন, একটা নতুন নাম দিতে পারো আমাকে, যে নামে শুধু
তুমিই আমাকে ডাকবে! রবি ভালোবেসে নাম দিলেন ‘নলিনী’। এরপর থেকে রবি ঠাকুরের গান, কবিতা ইত্যাদিতে নলিনী নামটা
বারবার ফিরে এসেছে। কখনো ইঙ্গিতে আবার কখনো স্পষ্ট স্বীকারোক্তির ঠঙে কৈশোরের প্রেম ফিরে এসেছে তাঁর
লেখায়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দিলীপকুমার রায়কে তিনি লিখেছেন,
‘সে মেয়েটিকে ভুলিনি, বা তার সে আকর্ষণকে কোন লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন। আমার জীবনে তারপর
নানান আভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন,
-কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে
দেখিনি, তা সে ভালবাসা যে-রকমই হোক না কেন।’
আনার বিয়ের দু’বছর পরে, ১৮৮১ সালে বিলেতে থাকাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্য লিখেন।
‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী যেন এক চপলস্বভাবের মেয়ে। আনার প্রগল্ভতা বা চাপল্য ভাল লেগেছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের।
‘ভগ্নহৃদয়’ এর দ্বাদশ সর্গে আনার মনই যেন ফুটে উঠেছে ‘নলিনী’র কথায়,
এসো মন, এসো, তোমাতে আমাতে
মিটাই বিবাদ যত!
আপনার হয়ে কেন মোরা দোঁহে
রহি গো পরের মত?
আমি যাই এক দিকে, মন মোর!
তুমি যাও আর দিকে—
যার কাছ হতে ফিরাই নয়ন
তুমি চাও তার দিকে!
তার চেয়ে এস দুজনে মিলিয়ে
হাত ধরে যাই এক পথ দিয়ে,
আমারে ছাড়িয়ে অন্য কোনোখানে
যেয়ো না কখনো আর!
পারি না কি মোরা দুজনে থাকিতে,
দোঁহে হেসে খেলে কাল কাটাইতে?
তবে কেন তুই না শুনে বারণ
যাস্ রে পরের দ্বার?
তুমি আমি মোরা থাকিতে দুজন,
বল্ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
অন্য সহচরে আর?
তুমি আমি মোরা থাকিতে দুজন,
বল্ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
অন্য সহচরে আর?
এত কেন সাধ বল্ দেখি, মন,
পর-ঘরে যেতে যখন তখন–
সেথা কি রে তুই আদর পাস্?
বল্ ত কত-না সহিস যাতনা?
দিবানিশি কত সহিস লাঞ্ছনা?
তবু কি রে তোর মিটে নি আশ?
আয়, ফিরে আয়, মন, ফিরে আয়–
দোঁহে এক সাথে করিব বাস!
অনাদর আর হবে না সহিতে,
দিবস রজনী পাষাণ বহিতে,
মরমে দহিতে, মুখে না কহিতে,
ফেলিতে দুখের শ্বাস!
শুনিলি নে কথা? আসিলি নে হেথা?
ফিরিলি নে একবার?
সখি লো, দুরন্ত হৃদয়ের সাথে
পেয়ে উঠিনে ত আর!
“নয় রে সুখের খেলা ভালবাসা!”
কত বুঝালেম তায়–
হেরিয়া চিকণ সোনার শিকল
খেলাইতে যায় হৃদয় পাগল,
খেলাতে খেলাতে না জেনে না শুনে
জড়ায় নিজের পায়!
বাহিরিতে চায়, বাহিরিতে নারে,
করে শেষে হায়-হায়!
শিকল ছিঁড়িয়ে এসেছে ক’বার,
আবার কেন রে যায়?
চরণে শিকল বাঁধিয়া কাঁদিতে
না জানি কি সুখ পায়!
তিলেক রহে না আমার কাছেতে
যতই কাঁদিয়া মরি,
এমন দুরন্ত হৃদয় লইয়া,
সজনি, বল্ কি করি?
আনার এরকম চপল স্বভাবের জন্যই রবি এতটা ভালবেসেছেন, তাকে সারাজীবন ভুলতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখনই তাঁর জীবনের পিছনে ফিরে তাকিয়েছেন তখনই তিনি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছেন তাঁর সৌভাগ্যের কাছে, আনার মতো
একজন নারী তাঁর জীবনে এসেছে, সে আগমন যত অল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন। কবি লিখেছেন,
‘জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড় করে দিয়ে যায়।
না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না। চলে যেতে যেতে বেঁচে থাকার চাদরটার উপরে ফুলকাটা
কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে।’
কবি প্রায় একইরকম কথা, তবে ভিন্ন ভাষায় দিলীপকুমার রায়কে বলেছেন,
‘প্রতি মেয়ের ভালবাসা, তা সে যে-রকমের ভালবাসাই হোক না কেন- আমাদের মনের বনে কিছু না কিছু অফোটা ফুল ফুটিয়ে
রেখে যায়। সে ফুল হয়তো পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে।’
চুমুর লোভ দেখিয়ে আনার দস্তানা চুরির কৌতুকী ঘটনা বা আনার কপট নিদ্রার ঘটনাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা
গানের মাঝেও আঁচ করা যায়,
‘তারি স্বপনে রয়েছি ভোর আমার স্বপন ভাঙ্গায়ো না
তাহারি স্বপনে আজি মুদিয়া রয়েছে আঁখি-
কখন আসিবে প্রাতে আমার সাধের পাখি,
কখন জাগাবে মোরে আমার নামটি ডাকি।’
নিচের কবিতায় নলিনীর কথা এসেছে,
‘যাহার মোহিনী মূর্তি হৃদয়ে হৃদয়ে
শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে,
যতকাল রব বেঁচে যার ভালবাসা
চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়,
সে বালিকা সে নলিনী সে স্বর্গপ্রতিমা,
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত
তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল?’
নলিনী মৃত্যুর পরেও রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে-মননে জায়গা পেতে রয়েছিলেন, কবি লিখেছেন,
দেহকারাগার মুক্ত সে নলিনী এবে
সুখে দুঃখে চিরকাল সম্পদে বিপদে,
আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ।
চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি,
আমারি মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া।
রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে
প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে।
এমন অন্তরে তাকে রেখেছি লুকায়ে,
মরমের মর্মস্থলে করিতেছি পূজা,
সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে
ভাঙ্গিবার এ জনমে সে মোর প্রতিমা,
হৃদয়ের আদরের লুকনো সে ধন।
বেঁচে থাকাবস্থায় আনাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি রবির প্রতি তার মুগ্ধতাকে। নলিনী নামের গৌরবকে তিনি অস্বীকার
করতে পারেননি কখনোই। ঐ নামেই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন। রবির প্রতি আনার মুগ্ধতাকে,
আনার অনুভূতি রবি বুঝতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে গভীর ভাবে অনুভব করতেন বলেই ‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী রবিকে কি
চোখে দেখতেন তার বর্ণনা দিতে পেরেছেন,
ওই যে এ দিকে আসিছে কবি!
কথা আজ মোরে কহিতে হইবে,
র’ব না বসিয়া অচল ছবি!
কি কথা বলিব? ভাবিতেছি মনে,
কিছুই ত ভেবে নাহিক পাই!
বলিব কি তারে– “তোমরা কবি গো,
তোমাদের ভাল বাসিতে নাই!
বুঝিতে পার না আপনার মন,
দিবানিশি বৃথা কর গো শোক!
ভালবাসা-তরে আকুল হৃদয়,
ভালবাসিবার পাও না লোক!
মনে তোমাদের সৌন্দর্য্য জাগিছে
ধরায় তেমন পাও না খুঁজে,
তবুও ত ভাল বাসিতেই হবে
নহিলে কিছুতে মন না বুঝে।
অবশেষে কারে পাও দেখিবারে
নেশায় আপনা ভুলি,
সাজাইয়া দেয় কলপনা তারে
নিজের গহনা খুলি।
আসি কলপনা কুহকিনীবালা
নয়নে কি দেয় মায়া,
কলপনা তারে ঢেকে রাখে নিজে
দিয়ে নিজে জ্যোতিছায়া।
কল্পনাকুহকে মায়া মুগ্ধ চোকে
কি দেখিতে দেখ কিবা,
অপরূপ সেই প্রতিমা তাহার
পুজ মনে নিশি দিবা!
যত যায় দিন, যত যায় দিন,
যত পাও তারে পাশে,
দেবীর জ্যোতি সে হারায় তাহার
মানুষ হইয়া আসে!
ভালবাসা যত দূরে চলি যায়
হাহাকার করে মনে,
কলপনা কাঁদে ব্যথিত হইয়া
আপনার প্রতারণে!
আমি গো অবলা– করিব প্রণয়
অত নাহি করি আশা,
আমি চাই নিজ মনের মানুষ
সাদাসিদে ভালবাসা!”
এমনি করিয়ে বাতাসের ‘পরে
মিছে অভিমান বাঁধি
অকারণে তার কবির লাঞ্ছনা
অভিমানে কাঁদি কাঁদি।
কিছুতে সান্ত্বনা না আমি মানিব,
দূরেতে যাইব চলে–
কাছেতে আসিতে করিব বারণ
করুণ চোখের জলে!
৫
‘ভগ্নহৃদয়’-এ নলিনী চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথের প্রেমভাবনা জাত, যেখানে কবি তাঁর লীলাসঙ্গিনীকে অন্বেষণ করেছেন।
‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্য বা গীতিকাব্য রচনার ঠিক ৩বছর পর, ১৮৮৪ সালে কবির কলমে আনা’র চপলস্বভাবের প্রতিরূপ
হয়ে ‘নলিনী’ গদ্যনাট্য এসেছে। এই নাটকের একটা বিখ্যাত উক্তিতে ‘নলিনী’কে নিয়ে কবির রোমান্টিক ভাবনার প্রকাশ
ঘটেছে,
‘সে আমাকে হৃদয় দিক আর নাই দিক আমার তাতে কি আসে যায়? আমি তার যতটুকু মধুর তা উপভোগ করব না কেন? তার
মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা পেতে আপত্তি কি আছে!’
বিলেতে যাওয়ার আগে বোম্বাইয়ের প্রায় দু’টা মাস রবির মুহুর্তগুলো আনার মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা, প্রগলভ্তা, চাপল্য
দিয়ে রঙিন হয়ে ছিল। অথচ এরকম ‘ফ্লার্টিং’ বা রসতরঙ্গে কিশোর রবি অভ্যস্ত ছিলেন না। আনা রবীন্দ্রমানসে
আধুনিক নারী অভিজ্ঞতার উদ্বোধন ঘটালেন এভাবে,
‘আমার সঙ্গে সে প্রায় যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই যে ঘুরত আমার আনাচে-কানাচে। আমি বেশ টের পেতাম যে
ঘটবার মতন কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু হায়রে, সে হাওয়াটাকে উসকে দেবার দিকে আমার না ছিল তৎপরতা, না ছিল কোনো
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।’
আনা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বেশি তাড়াতাড়ি এসেছেন কিংবা রবীন্দ্রনাথ বেশি দেরিতে বড় হয়েছেন। তার নারী
অভিজ্ঞতার ম্যাচিউরিটি এলো বিলেতে যাওয়ার পর। বিলেতেই তিনি তাঁর শরীরী আকর্ষণের কথা প্রথম জানতে পারেন।
আনার প্রতি রবির এই যে এতো অনুভূতি, এতো প্রেম, ভালোবেসে আনাকে ‘নলিনী’ নামে ডাকা, ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যে
আনার প্রতিরূপে ‘নলিনী’ নামে একটা চরিত্র সৃষ্টি, এতকিছুর পরও তিনি ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যটা আনাকে উৎসর্গ
করেননি। ১৮৮১ সালে লেখা এই নাট্যকাব্যটা উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবনের আরেক গোপনচারিণী, ‘শ্রীমতী হে’-কে। ‘হে’
চরিত্রটির আড়ালে যে নারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সারাজীবন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তিনি আর কেউ নন, নতুন বৌঠান
কাদম্বরী দেবী, রবির বয়স তখন ২০ আর নতুন বৌঠান ২২ ছুঁয়েছেন। তবে ‘নলিনী’ নামের মায়া থেকে আনা কোনদিন
মুক্তিলাভ করেননি। অথচ তারা মাত্র দু’মাস একই বাড়িতে ছিলেন এবং এরপর তাদের আর কখনো দেখা হয়নি। আত্মারাম
পরিবারের সাথে কাটানো সেই দু’মাসে রবি আনাকে চুমু খাওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়া বা শরীরী যা কিছু কোনদিন মুখ
ফুটে আনাকে বলতে পারেননি তা যেন কবিতার ভাষায় অবলীলায় বলে গেছেন,
শিথিল বসন তার
ওই দেখ চারিধার
স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে,
যেথা যে গঠন আছে
পূর্ণভাবে বিকশিছে
যেখানে যা উঁচুনিচু প্রকৃতির বিধানে।
হদিসঃ
১। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
২। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন
৩। নলিনী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪। ভগ্নহৃদয়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫। ছেলেবেলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৬। রবিজীবনী- প্রশান্ত কুমার পাল
পোস্ট ভিউঃ
10