ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ তোমার মদির মায়া অনাদরে, অবহেলায়

প্রবন্ধ অনুগামিনীগন
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ তোমার মদির মায়া অনাদরে, অবহেলায়

১,আমি আকাশে পাতিয়া কান

শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ, ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে, ওগো বিদেশিনী॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫ সালের অক্টোবরে শিলাইদহে বসে এই গানটা যখন লিখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তখন ৫
বছরের শিশু। তাদের দেখা হয়েছিল ২৯ বছর পরে, কবিকে যখন স্বাস্থ্যগত কারণে আর্জেন্টিনায় যাত্রা বিরতি নিতে হয়
তখন তাঁর বয়স ৬৩ আর ওকাম্পো ৩৪ বছরের তরুণী। অথচ এই গানের কলি শুনলে মনেহয় যেন ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যেই
তাঁর প্রথম নিবেদনের কবিতাটা লিখে ফেলেছেন। হয়তো তরুণ বয়স থেকেই তাঁর মাঝে ঘুমিয়ে ছিল একটা ইচ্ছে, সেই সুপ্ত
ইচ্ছেকে উসকে দিয়েছে কোন এক বিদেশিনীর জন্য তাঁর কল্পনা। আর্জেন্টিনায় যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি গানটির
ইংরেজি অনুবাদ তুলে দিয়েছিলেন ওকাম্পোর হাতে। তিনি লিখেছেন,
‘কোনো রহস্যসিন্ধুর পরপারে ঘাটের উপরে তাহার বাড়ি, তাহাকেই শারদপ্রাতে মাধবীরাত্রে ক্ষণে ক্ষণে দেখিতে পাই,
হৃদয়ের মাঝখানেও মাঝে মাঝে আভাস পাওয়া গেছে, আকাশে কান পাতিয়া তাহার কণ্ঠস্বর কখনও বা শুনিয়াছি।’
এভাবেই রবীন্দ্রহৃদয়ে তৈরি হয় তৃষ্ণা অচেনা বিদেশিনীর জন্য। এই গান তোমারই জন্য লিখেছি, এই বার্তাটা ২৯ বছর
পরে ভিক্টোরিয়ার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে, ভিক্টোরিয়ার দেখা পাওয়ার
কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘প্রথম বয়সের বাতায়নে বসে তুমি তোমার দূরের বঁধুর উত্তরীয়ে সুগন্ধি হাওয়া পেয়েছিলে। শেষ বয়সের পথ পেরিয়ে
গোধূলিরঙের রাঙা আলোতে তোমার সেই দূরের বঁধুর সন্ধানে নির্ভয়ে চলে যাও। লোকের ডাকাডাকি শুনো না।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা পাননি, কিন্তু দূরের বঁধু যে তাঁর জন্যই কোথাও অপেক্ষা করছেন,
সেই বার্তা উদ্ভাসিত তাঁর অন্তরে।
১৯২৪ সালের নভেম্বর মাস। পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরকে বহনকারী জাহাজ ‘আন্ডেজ’ চলছে পেরুর দিকে, হঠাৎ হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়ায় কবি অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ইংরেজ সহকারী লিওনার্ড কে এলম্হার্স্ট কবির এরকম শারীরিক অবস্থায় বুয়েনোস আইরেস হয়ে পেরুর রাজধানী লিমায়
যাওয়া বিপদজনক ভেবে কিছুদিনের জন্য বুয়েনোস আইরেস শহরেই বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ নভেম্বর
বৃহস্পতিবার জাহাজ বন্দরে ভিড়লে অসুস্থ অবস্থাতেই কবিকে প্লাজা হোটেলে নেয়া হয়। খবর পেয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো
এলেন কবির সাথে দেখা করতে। হোটেলে গিয়ে দেখা মিললো কবির ইংরেজ সহকারী লিওনার্ড কে এলম্হার্স্ট-এর সাথে,
তিনি ওকাম্পোর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর কবির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলেন। কবির দিকে
তাকিয়েই তিনি মুগ্ধ, প্রথম সাক্ষাতের মুহুর্তটা তিনি লিখেছেন এভাবে,
‘আমার বাবার বয়েসের কাছাকাছি তাঁর বয়স। অথচ নির্ভাঁজ কপাল। রেখা পড়েনি একটিও। কী শান্ত লাবণ্যময় তাঁর
হিরণ্ময় শরীর। শ্বেত কেশগুচ্ছ উপচে পড়েছে তাঁর দৃঢ় সুগঠিত গ্রীবা পর্যন্ত। তাঁর দীর্ঘ দেহ, দীপ্ত মুখমণ্ডল, ঘন আঁখি
পল্লব, তাঁর বাঙময় দুটি হাত- এই মানুষটির সান্নিধ্যে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল।’
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো হোটেল প্লাজায় গিয়েছিলেন কেবল কাছে থেকে এক ঝলক দেখার আশায়, কিন্তু প্রিয়কবি অসুস্থ
জানতে পেরে ৬দিনের মধ্যেই তার বাবার বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’ থেকে কয়েক ব্লক দূরে এক আত্মীয়ের বেশ বড়সড় একটা
বাড়ি কবির বসবাসের জন্য ভাড়া করে ফেললেন। রিও ডি প্লাতা নদীর পাশেই ঝকঝকে সাদা রঙের বাড়িটার নাম ছিল
‘মিরালরিও’, যার অর্থ নদীরেখা। এই সুন্দর বাড়িটার ভাড়া এবং আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহনের জন্য ওকাম্পো তার হীরের
টায়রা’টা বিক্রি করে দিলেন। ১১ নভেম্বর ছিল ‘মিরালরিও’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম দিন, কবি লিখলেন,
‘স্বর্ণসুধা ঢালা এই প্রভাতের বুকে

যাপিলাম সুখে
পরিপূর্ণ অবকাশ করিলাম পান।’
সেই বাসায় ওঠার পর ওকাম্পোর অনুভূতিটা ছিল এরকম,
‘সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ংকর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র
ভাস্বর-কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ,
আর এতেই আরো তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেণির সবুজ আভা। ঊর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই
ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের
উইলো গাছগুলো খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায়।
ঘরে ঢুকতেই ওঁকে নিয়ে এলাম অলিন্দে, বললাম: নদীটি দেখতেই হবে। সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে
উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল পরম রমণীয়। আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন প্রতিফলক সাজিয়ে
ধরেছে আকাশে।’
পরের দিন, ১২ নভেম্বর ১৯২৪ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উদ্দেশে নিবেদিত হলো কবির হৃদয়ের প্রথম অর্ঘ্য। তাঁর
আদর আদায় করার বহু ব্যবহৃত অস্ত্রটা তিনি ব্যবহার করলেন আবারও,
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম--
"কী তোমার নাম',
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধালেম "বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো',
হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে "জানি না, জানি নাকো'।
বুঝিলাম তবে
শুনিয়া কী হবে
থাকো কোন্ দেশে।
যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে
তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,
আর কোথা নাই।
হে বিদেশী ফুল, আমি কানে কানে শুধানু আবার,
"ভাষা কী তোমার।'
হাসিয়া দুলালে শুধু মাথা,
চারি দিকে মর্মরিল পাতা।
আমি কহিলাম, "জানি, জানি,
সৌরভের বাণী
নীরবে জানায় তব আশা।
নিশ্বাসে ভরেছে মোর সেই তব নিশ্বাসের ভাষা।'
হে বিদেশী ফুল, আমি যেদিন প্রথম এনু ভোরে
শুধালেম, "চেন তুমি মোরে?'
হাসিয়া দুলালে মাথা, ভাবিলাম তাহে একরতি
নাহি কারো ক্ষতি।
কহিলাম, "বোঝ নি কি তোমার পরশে
হৃদয় ভরেছে মোর রসে।
কেউ বা আমারে চেনে এর চেয়ে বেশি,

হে ফুল বিদেশী।'
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে শুধাই "বলো দেখি
মোরে ভুলিবে কি',
হাসিয়া দুলাও মাথা; জানি জানি মোরে ক্ষণে ক্ষণে
পড়িবে যে মনে।
দুই দিন পরে
চলে যাব দেশান্তরে,
তখন দূরের টানে স্বপ্নে আমি হব তব চেনা--
মোরে ভুলিবে না।
ঠিক ৩ দিন পর, ১৫ নভেম্বর ১৯২৪ সালে ‘অতিথি’ কবিতায় কবি নিবেদন জ্ঞাপনে আরও সরাসরি,
প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,
মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা; নির্জন এ বাতায়নে
একেলা দাঁড়ায়ে যবে চাহিলাম দক্ষিণ-গগনে
ঊর্ধ্ব হতে একতানে এল প্রাণে আলোকেরই বাণী--
শুনিনু গম্ভীর স্বর, "তোমারে যে জানি মোরা জানি;
আঁধারের কোল হতে যেদিন কোলেতে নিল ক্ষিতি
মোদের অতিথি তুমি, চিরদিন আলোর অতিথি।'
তেমনি তারার মতো মুখে মোর চাহিলে, কল্যাণী--
কহিলে তেমনি স্বরে, "তোমারে যে জানি আমি জানি।'
জানি না তো ভাষা তব, হে নারী, শুনেছি তব গীতি--
"প্রেমের অতিথি কবি, চিরদিন আমারই অতিথি।'
কবি ১৬ নভেম্বরে লিখেছেন ‘অন্তর্হিতা’, ১৭ নভেম্বরে ‘আশঙ্কা’, ২১ নভেম্বরে ‘শেষ বসন্ত’ কবিতা লিখেছেন। এসব
কবিতায় প্রেমের অভিব্যক্তি এতটাই বেশি ছিল যে কবি নিজেও বিব্রতবোধ করেছিলেন। এগুলো দেশে ছেলে বা পুত্রবধূদের
কাছে পাঠানো ঠিক হবে কি না ভাবছিলেন। ইংরেজ সহকারীকে বললেন, ‘বেশি কিছু তো বলা যাবে না। ওরা খুব বিচলিত হয়ে
পড়বে। আমার এইসব কবিতার কোন মানে করতে পারবে না ওরা। ওদেরকে পাঠিয়ে দাও চিঠিগুলো আর খবরের কাগজের
কাটিংগুলো, কিন্তু কবিতাগুলো পাঠিও না।’ কবির চোখে খেলা করে যাওয়া ‘দুষ্টু ঝিলিক’ আর ‘হাসির বন্যা’ এলমহার্স্টের
নজর এড়ায়নি।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে পরিচিত হবার আগে রানুর সাথে সম্পর্কের জটিলতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে
চারদিকে বেশ বদনাম রটে। এক পর্যায়ে কবি রানুর সাথে সম্পর্কের বন্ধন আলগা করে দিতে বাধ্য হন, রানু চিঠি লিখছেন
তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেসব চিঠির উত্তর দিচ্ছেন না। এরকম সময়ে রবীন্দ্রনাথ হয়তো নতুন সম্পর্কের জন্য
তৃষ্ণার্ত, তিনি তাই লিখেছেন,
‘আমারে যে ডাক দেবে এ জীবনে তারে বারংবার
ফিরেছি ডাকিয়া।
সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার
থাকিয়া থাকিয়া।
দীপখানি তুলে ধ'রে, মুখে চেয়ে, ক্ষণকাল থামি
চিনেছে আমারে।
তারি সেই চাওয়া, সেই চেনার আলোক দিয়ে আমি
চিনি আপনারে।
সহস্রের বন্যাস্রোতে জন্ম হতে মৃত্যুর আঁধারে

চলে যাই ভেসে।
নিজেরে হারায়ে ফেলি অস্পষ্টের প্রচ্ছন্ন পাথারে
কোন্ নিরুদ্দেশে।
নামহীন দীপ্তিহীন তৃপ্তিহীন আত্মবিস্মৃতির
তমসার মাঝে।
কোথা হতে অকস্মাৎ কর মোরে খুঁজিয়া বাহির
তাহা বুঝি না যে।’
কিন্তু কে সেই নারী যার জন্য কবির এই অন্বেষণ?
এখানেই আসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র কথা। তার জন্ম ১৮৯৯ সালের ৭এপ্রিল তারিখে, বুয়েনোস আইরেসের এক
সম্ভ্রান্ত পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৯ বছরের ছোট।
ওকাম্পো’র সাথে কবি’র যখন দেখা হয় কবি তখন ৬৩ আর ওকাম্পো ৩৪ বছরের। বুয়েনোস আইরেসে সাতদিন থাকার কথা
ছিল, অথচ দেখতে দেখতে সেখানে ৫২ দিন কেটে গেল। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ততদিনে কবির দেয়া ভালবাসার নাম পেয়ে
গেছেন, ‘বিজয়া’। যদিও কবির সাথে দেখা হবার ১২ বছর আগে, ১৯১২ সালে ওকাম্পো ভালোবেসে বার্নাডো এস্ত্রাদা’কে
বিয়ে করেছিলেন। তবে তার সেই সংসার জীবন সুখের হয়নি, ১৯২১ সালে নিজের দীর্ঘ ৯ বছরের অসুখী দাম্পত্যজীবন ছিন্ন
করে স্বামীর এক আত্মীয় জুলিয়েন মার্তিনেথের সাথে ওকাম্পো ‘সমাজ অস্বীকৃত’ এক ধরণের অবৈধ প্রেমের সম্পর্কে
জড়িয়ে একসাথে বসবাস শুরু করেন। ঠিক এরকম অস্বস্তিকর সময়েই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী তার জীবনে খানিকটা
প্রশান্তি নিয়ে এসেছিল। ইতিমধ্যেই অবশ্য লেখক হিসেবে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। মাতৃভাষা
স্প্যানিশ হলেও ফরাসী এবং ইংরেজি ভাষাতেও তিনি সমানতালে সাহিত্যচর্চা করতে শুরু করেন। তিনি এমনকি ফরাসি
ঔপন্যাসিক প্রুস্তের রচনার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করে ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ শিরোনামে একটা আর্টিকেল
লিখে ফেলেন।
দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আধুনিকতা আনয়ন এবং নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় ওকাম্পোর যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
তিনি ত্রিশের দশকেই ‘সুর’ নামে একটা পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তী ৪০ বছর ধরে এর সম্পাদক
হিসেবে কাজ করেছেন। বুয়েনোস আইরেস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকাটা পঞ্চাশ থেকে শুরু করে
সত্তরের দশক পর্যন্ত সারা দক্ষিণ আমেরিকাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস
মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিঁত্যা, পল ক্লোদেল, সিমোন অয়াইল, আঁর্দ্রে জিদ, এজরা পাউন্ডসহ সারা
পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকরা সেই পত্রিকায় লিখতেন।
১৯২৪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ওকাম্পোর যখন পরিচয় ঘটে তখন তিনি নিজে ততটা পরিচিতমুখ না হলেও ১৯১৩ সালে
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হবার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯১৪ সালেই আঁদ্রে জিদের
অনুবাদ করা ‘গীতাঞ্জলী’ ওকাম্পোর হাতে পৌঁছেছিল এবং সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের সংকট কালে
‘গীতাঞ্জলী’ পাঠ করে তিনি মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। আর তাই রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো
লিখলেন,
‘Reading Tagore, thinking of Tagore, waiting for Tagore.’
সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের সাথে ওকাম্পোর নিগূঢ় বন্ধন থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনের যে সংকট কিংবা নিঃসঙ্গতা তা
থেকে মুক্তি পেতে মার্সেল প্রুস্ত, রাস্কিন কিংবা গান্ধী কারও লেখাই তাকে সাহায্য করলো না। এই বিপন্নতাবোধ থেকে
মুক্তি পেতেই তিনি যেন মুখ ফেরালেন রবীন্দ্রনাথের দিকে। তার বিশ্বাস যদি কেউ তাকে পথ দেখাতে পারে, হারানো
বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে বা অস্তিত্বের যন্ত্রণার উপরে ঘটাতে পারে মধুর রসের ধারাপাত, তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। আর সেজন্যই কয়েক বছরের মধ্যেই যখন পরম আরাধ্য রবীন্দ্রনাথের বুয়েনোস আইরেসে আসার খবর পেলেন
তিনি তখন দ্বিতীয়বার না ভেবেই তাকে নিয়ে গেলেন আপন আশ্রয়ে। প্লাজা হোটেলে ১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১০
নভেম্বর পর্যন্ত থেকে ১১ নভেম্বর ১৯২৪ থেকে ২জানুয়ারি ১৯২৫ তারিখ পর্যন্ত তিনি থাকলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর
সান্নিধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসলে ওকাম্পোর সান ইসিদ্রোর বাড়িতে থাকার কথা ছিল সাত দিন, কিন্তু তিনি
থাকলেন ৫২ দিন। সান ইসিদ্রোর বাড়িটা ওকাম্পো’র এক কাজিনের, তার বাবা’র বাড়ি থেকে কয়েক ব্লক দূরে, নাম

‘মিরালরিও’। নিজের হীরার টায়রা বিক্রি করে তিনি সেই বাড়িটা ভাড়া নিলেন এবং কবির সার্বক্ষনিক দেখাশোনার জন্য
নিজের পরিচারিকা ফ্যানিকে দায়িত্ব দিলেন। বাড়ির সামনে বিস্তৃত বাগান আর পাশ দিয়ে বয়ে চলছে প্লাতা নদী। তিনতলার
জানালা বা দোতলার হলরুম থেকে কূলকুল শব্দে বয়ে যাওয়া নদী দেখা যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সান ইসিদ্রোতে সুন্দর
কুয়াশা পড়ে। একজন কবির থাকবার এবং সাহিত্য চর্চা করবার জন্য উপযুক্ত জায়গা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুশী করার জন্য ওকাম্পো অজস্র টাকা খরচ করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে কাছের মানুষ করে চান
ওকাম্পো, যাকে স্পর্শ করা যায়, আদর করা যায় কিন্তু রবীন্দ্র সরে থাকেন পেলব কোমল রোম্যান্টিকটায়। তিনি
প্রেমিকের মতো উষ্ণ নন অথচ বিজয়ার জন্য মধুর রসের কবিতা লেখেন কিংবা একই বাড়িতে থেকে চিঠি লেখেন
ওকাম্পোকে। সামনে থাকলেও তাঁকে মনেহয় কত দূরের! বাসার পাশের বাগানে তিপা গাছের নিচে রবীন্দ্রনাথ বসেন
উচ্চাসনে, তাঁর পায়ের কাছে বসেন ওকাম্পো। যেন এটাই স্বাভাবিক, প্রতিমা দেবী লিখেছেন,
‘তিনি (ওকাম্পো) যখন নতজানু হয়ে বাবা মশায়ের পায়ের কাছে বসতেন, মনেহত ক্রাইস্টের পুরোনো কোনো ছবির পদতলে
তাঁর হিব্রু ভক্ত মহিলার নিবেদন-মূর্তি।’
রবীন্দ্রনাথ যেন চান গুরুর সম্মান, চান সম্ভ্রমের দুরত্ব আবার তিনিই ওকাম্পোর জন্য লেখেন প্রেমের কবিতা।
ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের মনের এই দোলাচল বুঝতে পারেননা, তবুও একদিন এল সেই চরম মুহুর্ত!
‘একদিন বিকেলে কবির ঘরে আমি ফুল সাজাতে গেলাম। দেখলাম কবি মাথা নীচু করে লিখছেন। আমি একটু নীচু হয়ে তাঁর
সামনে দাঁড়ালাম। একটি হাত বাড়িয়ে মানুষ যেভাবে গাছের একটি ফল কে ধরে ঠিক তেমনি ভাবে কবি আমার একটি স্তনের
ওপর হাত রাখলেন।’
ওকাম্পো এই ঘটনায় প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও পরে অনুভব করেছিলেন পবিত্র ভাললাগা। ওকাম্পো লিখেছেন, ‘ঐ
একদিনই। আর কোনদিন নয়। শুধু প্রতিদিন কবি আমার গালে ও মস্তকে চুম্বন করতেন...’
রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে যে কয়েকটি বাংলা শব্দ লিখতে শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি হলো ‘ভালবাসা’। কবি
ওকাম্পোকে মোট ৩২টি চিঠি লিখেছেন তবে চিঠির নীচে নিজের নাম লিখতেন না, লিখতেন শুধু ‘ভালবাসা’। কখনও রোমান
হরফে ‘bhalobasa’, কবি তাঁর জীবনে আর কাউকে এভাবে কখনো চিঠি লেখেননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজীবন এক নারী থেকে অন্য নারীতে, এক প্রেম থেকে অন্য প্রেমে ক্রমান্বিত। তিনি আজীবন
প্রেমের অতিথি, কেন এই অক্লান্ত নারী অন্বেষণ? ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা এক চিঠিতে তিনি নিজেই দিয়েছেন সে
উত্তর,
My market price has been high and my personal value has been obscured. This value I seek to realize
with an aching desire which constantly pursues me. This can be had only from a woman’s love and I have
been hoping for a long time that I do deserve it.
I feel today that this precious gift has come to me from you and that you are able to prize me for what I
am and not for what I contain.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচয়ের দিন সাতেকের মাঝেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে উপরের চিঠিটা লিখেছিলেন। তাঁর লেখা এই
চিঠিতে ভিক্টোরিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর জীবনে আগত অন্যসব নারীদের ভালোবাসা
যেন ভেসে গেল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে পরিচিত হবার পর। ওকাম্পো নিজেও যেন ভেসে গেলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
প্রতি তিনি তার প্রেম নিবেদন করলেন এভাবে,
Nothing that is you can be taken away from me. While you stay here, joy will be with me, when you will
go, pain must come. But at the roots of my being nothing can be changed. Your staying or going can’t
deprive me of you.
রবীন্দ্রনাথের জন্য আবেগ তাড়িত হয়ে ওকাম্পো যে নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন সে কথা জানাতে তার কোন কুণ্ঠা নেই,
I can’t sleep…. The nearest being to me in earth does not understand me. My heart is full of thorns. Take
out those thorns of misunderstanding….be my friend.

বোঝা যায় ভুল বোঝাবুঝি বা মান-অভিমানের পালা চলছিল রবীন্দ্রনাথ আর ওকাম্পোর মাঝে, তারই কাঁটা ফুটেছে
ওকাম্পোর হৃদয়ে। কীসের জন্য এই কষ্ট, অভিমান, ‘ফিরে এসো’ ডাক? রবীন্দ্রনাথ কেন হঠাৎ দূরে সরে গিয়েছিলেন?
ওকাম্পো ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেষ্টা করলেন,
Thus I came, little by little, to know Tagore and his moods. Little by little he partly tamed the young
animal, by turn wild and docile, who did not sleep, dog-like, on the floor outside his door, simply because
it was not done.
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর এই স্বীকারোক্তির মাঝে তার বন্য ভালোবাসার ইঙ্গিত রয়েছে, তিনি নিজেকে ‘ইয়ং’ এবং
‘ওয়াইল্ড’ অ্যানিম্যাল বলে অভিহিত করেছেন। অথচ ৬৩ বছরের রবীন্দ্রনাথের মাঝে এই বন্য জাগরণ সম্ভব না, তাই
তিনি নিজেই তার মাঝে থাকা বন্য আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে ফেললেন। ওকাম্পোর শরীরী উচ্ছ্বাস কুণ্ঠিত, বিব্রত করেছে
রবীন্দ্রনাথকে। তিনি এই তীব্রতার সাড়া দিতে পারেননি, আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন আপাত নির্লিপ্তির মাঝে।
এ কী তীব্র প্রেম, এ যে শিলাবৃষ্টি নির্মম দুঃসহ-
দুরন্ত চুম্বন-বেগে তব
ছিঁড়িতে ঝরাতে চাও অন্ধ সুখে, কহ মোরে কহ,
কিশোর কোরক নব নব।
এই তীব্র প্রেমিকাকে বলতে বাধ্য হলেন, ‘দয়া করো, দয়া করো, আরণ্যক এই তপস্বীরে/ধৈর্য ধরো, ওগো দিগঙ্গনা।’
তাঁর প্রেমিকা ধৈর্য ধরেছিলেন। নিজের বন্য আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে তিনি ক্রমেই শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর একদিন
প্রথমবারের মত ‘গুরুদেব’ সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখলেন তার বঞ্চিত বাসনার কথা,
I have gone through such joy and such sufferings all these days. Joy because I felt near you; sufferings,
because you ignored my nearness.
রবীন্দ্রনাথের উদাসীনতা এবং অনাগ্রহ ক্রমেই জুড়িয়ে দিয়েছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। তিনি আস্তে আস্তে মিলিয়ে
গেলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে। নিজেই পর্দা টেনে দিয়ে অন্তরালে চলে গেলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাম্পোর
জীবনে খুব বড় কোন অধ্যায় ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তার জীবনে জুলিয়েন মার্তিনেজ, জ্যাক লাকান, ইগোর
স্ত্রাভিনস্কিসহ অনেক বিখ্যাত লোকজন এসেছিলেন। ওকাম্পো তাদের কাউকে কাউকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয়
দিয়েছিলেন, কারো কারো সাথে স্বল্পস্থায়ী সম্পর্কেও জড়িয়ে ছিলেন। তবে ওকাম্পোর জীবনে রবীন্দ্রনাথ খুব বড়
অধ্যায় না হলেও এই সময়টুকুকে মূল্যহীন বলা যাবে না। রবিঠাকুরের ওপর ১৯৬১ সালে তার লেখা ‘তাগোর এন্ লাস্
বার্রাংকাস দে সান ইসিদ্রো’ নামের বইটাই তার প্রমাণ। ওকাম্পোর চোখে রবিঠাকুর ছিলেন, ‘মিতবাক, স্নেহপরায়ণ,
উদাসীন, পরিহাসপ্রিয়, গম্ভীর, আধ্যাত্মিক, খামখেয়ালি, প্রশ্রয় দিতে ওস্তাদ, উৎফুল্ল, কঠিন, কোমল,
নৈর্ব্যক্তিক, সুদূর, বিবেকী এবং আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তনশীল’ এক মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময়টুকু যেন উপভোগ্য হয়ে ওঠে সেজন্য তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছুই
করেছেন। একটা সাজানো ঘর, কবিতা লেখার উপযোগী পরিবেশ, দর্শনার্থীদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের ব্যবস্থা
করা, সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, পছন্দের জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবই করেছেন। এসব করতে গিয়ে
তাকে প্রচুর খরচ হয়েছে। কবির যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্য তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফ্যানিকে ২৪ ঘণ্টা তদারকি
করতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এরফলে ফ্যানির সাথেও কবিগুরুর একধরণের সখ্য গড়ে উঠেছিল। ওকাম্পো তার স্মৃতিচারণ
করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘.......তবে ওদের কথাবার্তাটা ঠিক কোন ভাষায় চলত, তা দুজনের একজনও আমাকে কখনো বুঝিয়ে
বলতে পারেননি, কারণ একজন তো আদৌ ইংরেজি বলতে পারতেন না, অন্যজনের স্প্যানিশও ছিল তথৈবচ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু ওকাম্পোর দূরে সরে যাওয়ার ঘটনায় দুঃখ পেয়েছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালে
শান্তিনিকেতনে বসে লিখলেন সেই গভীর অনুভূতির কথা,
ফাল্গুনের রঙিন আবেশ
যেমন দিনে দিনে মিলিয়ে দেয় বনভূমি

নীরস বৈশাখের রিক্ততায়,
তেমনি করেই সরিয়ে ফেলেছ হে প্রমদা, তোমার মদির মায়া
অনাদরে অবহেলায়।
একদিন আপন হাতে আমার চোখে বিছিয়েছিলে বিহ্বলতা,
রক্তে দিয়েছিলে দোল,
চিত্তে ভরেছিলে নেশায়, হে আমার সাকী,
পাত্র উজাড় ক'রে
জাদুরসধারা আজ ঢেলে দিয়েছ ধুলায়।
আজ উপেক্ষা করেছ আমার স্তুতিকে,
আমার দুই চক্ষুর বিস্ময়কে ডাক দিতে ভুলে গেলে;
আজ তোমার সাজের মধ্যে কোনো আকুতি নেই;
নেই সেই নীরব সুরের ঝংকার
যা আমার নামকে দিয়েছিল রাগিণী
শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে
ছিল হাওয়ার আবর্ত।
তখন ছিল তার রঙের শিল্প,
ছিল সুরের মন্ত্র,
ছিল সে নিত্য নবীন।
দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল
আপন লীলার প্রবাহ।
কেন ক্লান্ত হল সে আপনার মাধুর্যকে নিয়ে।
আজ শুধু তার মধ্যে আছে
আলোছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব --
ফোটে না ফুল,
বহে না কলমুখরা নির্ঝরিণী।
সেই বাণীহারা চাঁদ তুমি আজ আমার কাছে।
দুঃখ এই যে, এতে দুঃখ নেই তোমার মনে।
একদিন নিজেকে নূতন নূতন ক'রে সৃষ্টি করেছিলে মায়াবিনী,
আমারই ভালোলাগার রঙে রঙিয়ে।
আজ তারই উপর তুমি টেনে দিলে
যুগান্তের কালো যবনিকা
বর্ণহীন,ভাষাহীন।
ভুলে গেছ যতই দিতে এসেছিলে আপনাকে
ততই পেয়েছিলে আপনাকে বিচিত্র করে।
আজ আমাকে বঞ্চিত করে
বঞ্চিত হয়েছ আপন সার্থকতায়।
তোমার মাধুর্যযুগের ভগ্নশেষ
রইল আমার মনের স্তরে স্তরে --
সেদিনকার তোরণের স্তুপ,
প্রাসাদের ভিত্তি,
গুল্মে-ঢাকা বাগানের পথ।
আমি বাস করি
তোমার ভাঙা ঐশ্বর্যের ছড়ানো টুকরোর মধ্যে।
আমি খুঁজে বেড়াই মাটির তলার অন্ধকার,
কুড়িয়ে রাখি যা ঠেকে হাতে।
আর তুমি আছ
আপন কৃপণতার পাণ্ডুর মরুদেশে,
পিপাসিতের জন্যে জল নেই সেখানে,

পিপাসাকে ছলনা করতে পারে
নেই এমন মরীচিকারও সম্বল।
১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি তারিখে কবি তাঁর ইংরেজ সহকারীসহ আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ওপরে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন প্রভাব ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির পিছনেও ওকাম্পোর প্রভাব ছিল অসামান্য।
তুলনামূলক বিচারে এই প্রভাব ওকাম্পোর ওপর প্রভাবের চেয়ে কম ছিল না, বরং হয়তো খানিকটা বেশিই ছিল।
আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে কবিগুরু প্রায় ৩০টি কবিতা রচনা করেন, সবগুলোই ওকাম্পোকে মাথায় রেখেই লেখা।
কবিতাগুলো ১৯২৫ সালে আর্জেন্টিনা থেকে ফিরে আসার মাসখানেকের মধ্যেই প্রকাশিত ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত
হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। বইটার উৎসর্গপত্রে
লেখা ছিল কেবল দুটি শব্দ –‘বিজয়ার করকমলে’। কবি বইটা প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালের ২৯
অক্টোবর তারিখে তিনি ওকাম্পোকে চিঠি লেখেন,
‘বাংলা কবিতার একটা বই তোমায় পাঠাচ্ছি, যেটা তোমার হাতে নিজে তুলে দিতে পারলেই খুশি হতুম। বইখানা তোমায়
উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না। এই বইয়ের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছিল সান
ইসিদ্রোয় থাকার সময়ে।’
অনেকপরে, ১৯৪০ সালের জুন মাসে ওকাম্পো চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কবি, যে বইটি তুমি আমাকে উৎসর্গ করেছিলে
তার নাম কী?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মৃত্যুর ১৩ মাস আগে ১৯৪০ সালের ১০ জুলাই তারিখে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, ‘যে
বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম তার নাম জানতে চেয়েছ। এর নাম পূরবী; মানে পূর্বদিক- স্ত্রী লিঙ্গে।’
১৯৩০ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বিপুল আয়োজন এবং অর্থব্যয়ে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হলো। কবি
হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল বিশ্বব্যাপী, ভিক্টোরিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিল্পী রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি
ছড়িয়ে পড়লো ইউরোপব্যাপী। কবির ভাষায়,
‘ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনি ঘটে- অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে সে আমাদের পক্ষে
অসাধ্য……ভিক্তোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে। এখানকার সমস্ত বড়ো বড়ো গুণীজনদের ও জানে, ডাক দিলেই তারা আসে।
ভিক্তোরিয়া যদি না থাকত তাহলে ছবি ভালোই হোক মন্দই হোক কারো চোখে পড়ত না।’
ওকাম্পোর কর্তব্য শেষ, রবীন্দ্রর কাছ থেকে এবার বিদায় নেবার পালা। তাদের শেষ দেখা হলো প্যারিসের Gare du
Nord রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন ছেড়ে দিলে ওকাম্পোর মনেপড়লো, সান ইসিদ্রোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাকে
অনেকগুলো বাংলা শব্দ শিখিয়েছিলেন। অথচ তারমধ্যে কেবল একটি বাংলা শব্দই তার সেমুহুর্তে মনেপড়ছে, ‘ভালবাসা’।
অথচ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ক্রমশই সরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাম্পোর
সাথে কেবল প্লেটোনিক ধরণের ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াননি কিংবা ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেই আর্জেন্টিনা
অধ্যায় শেষ করেননি, বরং পূরবী পরবর্তী বহু কবিতা-গল্প-উপন্যাসে ওকাম্পোর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। ওকাম্পোর
প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি পাওয়া যায় তাঁর অনেক চিত্রকর্মেও। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এই ঘোর তিনি কাটিয়ে উঠতে
পারেননি। প্যারিসের চিত্র প্রদর্শনীর ৬ বছর পরে কিংবা মৃত্যুর ৪ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘তেমনি করেই সরিয়ে ফেলেছ হে প্রমদা তোমার মদির মায়া অনাদরে, অবহেলায়?’
হদিসঃ
১। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
২। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন
৩। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো- এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে- অভিজিৎ রায়
৪। পুরবী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫। ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ- শঙ্খ ঘোষ
৬। রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে- কেতকী কুশারী ডাইসন

পোস্ট ভিউঃ 11

আপনার মন্তব্য লিখুন