লুসি স্কটঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপনচারিণী

প্রবন্ধ অনুগামিনীগন
লুসি স্কটঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপনচারিণী

লুসি স্কটঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপনচারিণী

ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়

তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়।

পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়

কী জানি কিসেরই লাগি প্রাণ করে হায়-হায় ।।

গানের মধ্যে কীরকম একটা হাহাকার, না পাওয়ার বেদনা এবং রিদম আছে, পিয়ানো ছাড়া এই গানের সুরটা যেন কানে বাজে

না। তাই হয়তো ঘরের এক কোণে লুসি পিয়ানোতে সুর তোলেন আর তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিয়ানোর সেই সুরের সাথে

বাংলা শব্দ মিলিয়ে ১৮৮২ সালে এই গানটা লিখেছেন। ১৭৯১ সালে স্কটল্যান্ডের দুন নদীর পাড়ে বসে স্কটিশ কবি রবার্ট

বার্নস ‘Ye Banks and Braes’ নামে মূল গানটা লিখেছিলেন। তিনি এই গানটার ০৩টি সংস্করণ লিখেছিলেন। তার সেই

গানের সুর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বিলাতি ভাঙা' রাগে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানটি লিখেছিলেন। ইন্দিরা

দেবীর দেয়া হিসেব থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২২৭টা ভাঙ্গা গানের মধ্যে ১২টা গানের সুর নেয়া হয়েছে স্কচ

এবং আইরিশ গান থেকে। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলের মূল স্কচ গানের কথাগুলো এরকম,

Ye banks and braes o' bonnie Doon,

How can ye bloom sae fresh and fair?

How can ye chant, ye little birds,

And I sae weary, fu' o' care!

Thou'll break my heart, thou warbling bird,

That wantons thro' the flowering thorn:

Thou minds me o' departed joys,

Departed never to return.

Aft hae I rov'd by bonnie Doon,

To see the rose and woodbine twine:

And ilka bird sang o' its Luve,

And fondly sae did I o' mine.

Wi' lightsome heart I pu'd a rose,

Fu' sweet upon its thorny tree!

But may fause Luver staw my rose,

And ah! She left the thorn wi' me.

Robert Burns-এর মূল স্কটিশ পাণ্ডুলিপি থেকে অরূপ ব্যানার্জী ভাবানুবাদ করেছেন এভাবে,

এই অপূর্ব দুন নদীর ঢালু তটে,

এতো উজ্জ্বল সতেজ পুষ্প কীভাবে ফোটে?

কীভাবে বিহঙ্গম অপূর্ব গান গায়?

লালিত্যে যেন তার, জীবন ক্লান্তিময়!


হৃদয় চূর্ণ হয় মোর, ওই পাখির কূজনে,

ফুলের কাঁটার মাঝে ওদের বিচরণেঃ

স্মরিয়া দিতেছে মোরে বিগত প্রণয়

চলে গেছে- কভু আর ফিরবেনা, হায়!

অপরূপ দুন এর পাশে নিত্য আমি আসি,

দেখি লতানো বুনোফুল গোলাপের পাশাপাশি;

প্রতিটি পাখি গায় ভালোবাসার গান তার,

অনুরক্ত হই আমি নিজেই আমার।

উদ্বেল হৃদয়ে আমি গোলাপের কাছে যাই,

কাঁটাভরা গাছ থেকে মধুর পূর্ণতা পাই!

আমার মিথ্যা প্রণয়িনী গোলাপটা নিয়ে গেছে,

আহা! আমার জন্য শুধু কন্টক রেখেছে!

সত্যেন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু বিখ্যাত ব্যারিস্টার তারকনাথ পালিত ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথের পড়াশুনায় সন্তুষ্ট না হয়ে

তাকে লন্ডনে এনে প্রথমে একটি বাড়িতে একা থাকার বন্দোবস্ত করেন। কিছুদিন পর তাকে নিয়ে আসা হলো মি.

বার্কারের পরিবারে। তারপর তিনি যান টার্কিতে। কিছুদিন পর আবার লন্ডনে—সেটা জুন ১৮৭৯। এবার রবীন্দ্রনাথ

আশ্রয় পেলেন ডাক্তার স্কট নামে একজন গৃহস্থের বাড়িতে। ডঃ স্কট, মিসেস স্কট তাঁদের ছয়জন ছেলেমেয়ে এবং কুকুর,

এই ছিল পরিবারের সদস্যসংখ্যা। অবশ্য দু-তিনজন কাজের লোকও ছিল। এই পরিবারে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ‘গৃহসুখ’

পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘মিসেস স্কট আমাকে আপন ছেলের মতোই স্নেহ করিতেন।’ তিনি আরো লিখেছেন,

‘আমরা বলিয়া থাকি এবং আমিও তাহা বিশ্বাস করিতাম যে আমাদের দেশে পতিভক্তির একটা বিশিষ্টতা আছে, য়ুরোপে

তাহা নাই। কিন্তু আমাদের দেশের সাধ্বী গৃহিনীর সঙ্গে মিসেস স্কটের আমি তো বিশেষ পার্থক্য দেখি নাই। স্বামীর

সেবায় তাহার সমস্ত মন ব্যাপৃত ছিল।’

বস্তুতঃ মাতৃস্নেহের পরিপূর্ণ আশ্বাস তিনি মিসেস স্কটের কাছেই পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তি

দ্বিধাহীন। হবারই কথা। যে ছেলেটা শৈশবে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি যদি মিসেস স্কটের মধ্যে সেই স্নেহ

পেয়ে থাকেন, সেটা স্বীকার করতে দ্বিধাই বা থাকবে কেন?

এতদ্বারা এটাও কি বোঝা যায় না যে, রবীন্দ্রনাথ ইতিপূর্বে আর কোন রমনীর কাছ থেকে এই মাতৃস্নেহ পান নি? এবং

যাঁরা বলেন, সারদাদেবীর মৃত্যুর পর কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথকে মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, তারা কিঞ্চিৎ

অতিশয়োক্তি করেছেন? যাইহোক এখানে পড়াকালীনই রবীন্দ্রনাথ হেনরি মরলির মত শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন,

যাঁর শিক্ষণ শৈলী—তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষকতার ওপর হেনরি মরলির ছাপ

পড়ে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে প্রথম বিদেশী নারী, লুসি স্কটের সাথে কবির পরিচয় ১৮৭৯ সালে এখানেই, লন্ডনে ডাক্তার

স্কট-এর পরিবারের সাথে অবস্থান কালে। ১৮ বছরের তরতাজা যুবক রবি তখন স্কট পরিবারের অতিথি। ডক্টর এবং

মিসেস স্কটের চার মেয়ে, বড় মেয়ে মিস ‘কে’, মেজো মেয়ে মিস ‘জে’, সেজো মেয়ে মিস ‘এ’ এবং ছোট মেয়ে মিস ‘এল’। এই

চারজনের মধ্যে ছোট দুই মেয়ে মিস ‘এ’ এবং মিস ‘এল’ একইসাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমে পড়েন। তবে কবি বেছে

নিলেন ছোট মেয়ে মিস ‘এল’ বা লুসি স্কটকে। কবি তাঁর ব্যবহারে দুই বোনকেই মুগ্ধ করে রাখলেও লুসি হয়ে উঠলেন লন্ডনে

তার একান্ত আপন কেউ, তাঁর গোপনচারিণী। তার সাথে গোপনে চোখের ইশারায় কবি কথা বলেন এবং তার জন্যই কবিতা

লিখে ইংরেজিতে অনুবাদ করে আবৃত্তি করেন, ইংরেজি সুরে বাংলা গান লেখেন। শুধু লুসি নন, এই ইংরেজ পরিবারের সবার


সাথে রবির সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই পরিবারের দুই শিশু, এথেল এবং টমের কাছে রবি ‘আংকেল আর্থার’। রবি নিজেই

লিখেছেন ডাক্তার পরিবারের সাথে তাঁর আনন্দঘন সময়ের কথা,

‘আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরেজি গান শিখেছি। আমি গান করি। মিস কে- বাজান। মিস-কে আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন।

কিন্তু প্রায় সন্ধ্যাবেলায় আমাদের একটু আধটু পড়াশুনো হয়। আমরা পালা করে ছ-দিনে ছ-রকমের বই পড়ি। বই পড়তে

পড়তে এক একদিন প্রায় সাড়ে এগারোটা বারোটা হয়ে যায়।’

এই সাহিত্যচর্চা করতে করতে আরও কি ঘটতো তা জানা যায় কবি ভাষায়, ‘সে পড়া ক্লাসের পড়া নয়। সাহিত্যের সঙ্গে

সঙ্গে মানুষের মনের মিলন।’ আর তাইতো লুসি রবির প্রেমে ভিজে আর্দ্র, রবি কবিতার ভাষায় লিখেন,

এমন ক’দিন কাটে আর!

ললিত গলিত হাস, জাগরণ, দীর্ঘশ্বাস,

সোহাগ, কটাক্ষ, মান, নয়নসলিলধার,

মৃদু হাসি- মৃদু কথা-আদরের, উপেক্ষার-

এই শুধু, এই শুধু, দিনরাত এই শুধু-

এমন ক’দিন কাটে আর!

কটাক্ষে মরিয়া যায়, কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে,

হাসিতে হৃদয় জুড়ে, হাসিতে হৃদয় টুটে,

ভীরুর মতন আসে দাঁড়ায়ে রহে গো পাশে,

ভয়ে ভয়ে মৃদু হাসে, ভয়ে ভয়ে মুখ ফুটে,

একটু আদর পেলে অমনি চরণে লুটে,

অমনি হাসিটি জাগে মলিন অধরপুটে,

একটু কটাক্ষ হেরি অমনি সরিয়া যায়—

অমনি জগৎ যেন শূন্য, মরুভূমি-হেন,

অমনি মরণ যেন প্রাণের অধিক ভায়।

প্রণয় অমৃত এ কি? এ যে ঘোর হলাহল—

হৃদয়ের শিরে শিরে প্রবেশিয়া ধীরে ধীরে

অবশ করেছে দেহ, শোণিত করেছে জল।

কাজ নাই, কর্ম নাই, বসে আছে এক ঠাঁই,

হাসি ও কটাক্ষ লয়ে খেলেনা গড়িছে যত,

কভু ঢুলে-পড়া আঁখি কভু অশ্রুভারে নত।

দূর করো, দূর করো, বিকৃত এ ভালোবাসা

জীবনদায়িনী নহে, এ যে গো হৃদয়নাশা।

কবি জানেন একদিন তাকে ফিরে যেতে হবে। সেদিন লুসির সাথে তার সুখস্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে, এরপর হয়তো আর কখনই

তাদের দেখা হবেনা। তাই কবি লিখেন,

আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান

তার বদলে আমি চাইনি কোনো দান।।

ভুলবে সে গান যদি নাহয় যেয়ো ভুলে

উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগর কূলে

তোমার সভায় যবে করব অবসান

এই ক’দিনের শুধু এই ক’টি মোর তান।।

তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে

সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে?

সেই কথাটি কবি পড়বে তোমার মনে

বর্ষামুখর রাতে ফাগুন-সমীরণে

এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান

ভুলতে সে কি পার ভুলিয়েছ মোর প্রাণ।।


লুসি ছাড়াও আরও ০৩জন বিলিতি নারী রবির প্রতিভা, সৌন্দর্য এবং সৌজাত্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েন। মিস লং, মিস

ভিভিয়ান এবং মিস মূল-এর উষ্ণ আহ্বানে চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটলেও মনের ইচ্ছে মনের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখেন। তাদের

কেউ ছড়িয়ে দেন চাপল্যের মাধুর্য, কেউ চান রোম্যান্টিক উষ্ণতা, মগ্ন পরিবেশ। কেউ চান রবির সাথে নদীর ধারে বা

বনের পথে ঘুরতে, কেউ চান তার সাথে গাইতে, নাচতে। আবার কেউ চান শুধুই স্পর্শ সুখ। এদের মধ্যে মিস মূল রবির জন্য

ভীষণ পাগল। তিনি রবিকে ডাকেন মিস্টার ‘টি’ বলে, আবার কখনো আদর করে রবি-কে ডাকেন ‘রবিন’ নামে। রবীন্দ্রনাথ

ঠাকুর নিজেই লিখেছেন সেসব অভিজ্ঞতার কথা,

‘অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে ভাল না লাগলেও, যাদের সঙ্গে বিশেষ আলাপ আছে, তাদের সঙ্গে

নাচতে আমার মন্দ লাগে না। .........যেদিকে পা বাড়াই বিবিদের গাউন। যেদিকে চোখ ফেরাই চোখ ঝলসে যায়। সকলের মুখে

হাসি, মন অধিকার করবার যত প্রকার গোলাগুলি আছে বিবিরা তাহা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছেন। এখানে ঘর যত

পিছল হয়, ততই নাচবার উপযুক্ত হয়, পা কোনো বাধা পায় না, আপনাআপনি পিছলে আসে।’

মেয়েদের সান্নিধ্যে থেকে রবির লজ্জা ভাঙে, দ্বিধা ঘুচে যায়, মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রচনায় তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে

ওঠেন। রবির ভাষায়,

‘দুঃখের কথা বলব কি, আমার এই চেহারাটা যে নেহাৎ অচল নয় একথা আমি প্রথম টের পাই কোথায় জান তো? বিলেতে।

এতই লাজুক এবং মুখচোরা ছিলাম সে সময়ে যে তরুণীমহলে এরকম প্রতিষ্ঠার কানাঘুষো শুনেও ওদিকে ভিড়তে সাহস

পাইনি। আসলে আমার বয়েস হয়েছিল দেরিতে।’

মেয়েদের সান্নিধ্যে মুখচোরা হলেও কবিতায় তিনি ভীষণ রকমের সাহসী,

প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ তরে।

প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন

হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে

মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ ‘পরে।

তোমার নয়ন-পানে ধাইছে নয়ন,

অধর মরিতে চায় তোমার অধরে।

তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে

তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন।

হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে,

চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন।

সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে

দেহের রহস্য-মাঝে হইব মগন।

আমার এ দেহ মন চির রাত্রিদিন

তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন॥

গানে কবিতায় সংলাপে লুসির বাড়িতে রবির সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে গেল। একসময় এলো বিদায় নেবার পালা। লুসির মা,

মিসেস স্কট রবির দু’হাত ধরে বিদায় বেলায় বলেছিলেন, ‘এমন করিয়াই যদি চলিয়া যাইবে, তবে এত অল্পদিনের জন্য তুমি

কেন এখানে আসিলে?’। বিদায়ের মুহুর্তে লুসির কণ্ঠস্বর, কান্নায় ভাঙা-ভাঙা কণ্ঠে, ‘You are really going, aren't

you?’ রবি প্রতিশ্রুতি দেন কোনদিন ভুলবেন না, ‘এ দু দিন তার শত বাহু দিয়া, চিরটি জীবন মোর রহিবে বেষ্ঠিয়া।’ ১৯২৪

সালের ৬ অক্টোবর তারিখে হারুনা-মারু জাহাজের ডেকে বসে কবি হয়তো লুসি স্কটের কথাই ভাবছিলেন,

ভেবেছিনু গেছি ভুলে; ভেবেছিনু পদচিহ্নগুলি

পদে-পদে মুছে নিল সর্বনাশী অবিশ্বাসী ধূলি।

আজ দেখি সেদিনের সেই ক্ষীণ পদধ্বনি তার

আমার গানের ছন্দ গোপনে করেছে অধিকার;

দেখি তারি অদৃশ্য অঙ্গুলি


স্বপ্নে অশ্রুসরোবরে ক্ষণে ক্ষণে দেয় ঢেউ তুলি।

বিরহের দূতী এসে তার সে স্তিমিত দীপখানি

চিত্তের অজানা কক্ষে কখন্ রাখিয়া দিল আনি।

সেখানে যে বীণা আছে অকস্মাৎ একটি আঘাতে

মুহূর্ত বাজিয়াছিল; তার পরে শব্দহীন রাতে

বেদনাপদ্মের বীণাপাণি

সন্ধান করিছে সেই অন্ধকারে-থেমে-যাওয়া বাণী।


রবির পক্ষে সম্ভব হয়নি আনা, লুসি, লং, মূল, ভিভিয়ানদের ভুলে যাওয়া। তাঁর কৈশোরের লীলাসঙ্গিনীরা, যারা উসকে

দিয়েছিলেন কবির জীবনের প্রথম বসন্তকে। প্রায় ৭০ বছর বয়সে ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের

কথা লিখেছেন,

‘কিশোর বয়সে যাঁরা আমাকে কাঁদিয়েছিল, হাসিয়েছিল, আমার কাছ থেকে আমার গান লুট করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলেছিল, আমার

মনের কৃতজ্ঞতা তাদের দিকে ছুটল। তারা মস্ত বড় কিছু নয়, তারা দেখা দিয়েছে কেউ বা বনের ছায়ায়, কেউ বা নদীর ধারে,

কেউ বা ঘরের কোণে, কেউ বা পথের বাঁকে। আমি তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললুম, “আমার জীবনে যারা সত্যিকার ফসল

ফলিয়েছে, সেই আলোর, সেই উত্তাপের দূত তোমরাই। প্রণাম তোমাদের। তোমাদের অনেকেই এসেছিল ক্ষণকালের জন্য,

আধো সুপ্ত, আধো জাগার ভোরবেলায়, শুকতারার মতো, প্রভাত না হতেই অস্ত গেল।’

১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে কবি তাঁর ৬৩ বছর বয়সে বুয়েন্স আয়ার্সে বসে ‘কিশোর প্রেম’ কবিতায় তাদেরকে

স্মরণ করেছেন,

অনেক দিনের কথা সে যে অনেক দিনের কথা;

পুরানো এই ঘাটের ধারে

ফিরে এল কোন জোয়ারে

পুরানো সেই কিশোর প্রেমের করুণ ব্যাকুলতা?

সে যে অনেক দিনের কথা।

আজকে মনে পড়েছে সেই নির্জন অঙ্গন।

সেই প্রদোষের অন্ধকারে

এল আমার অধর-পারে

ক্লান্ত ভীরু পাখির মতো কম্পিত চুম্বন।

সেদিন নির্জন অঙ্গন।

তখন জানা ছিল না তো ভালোবাসার ভাষা --

যেন প্রথম দখিন বায়ে

শিহর লেগেছিল গায়ে,

চাঁপাকুঁড়ির বুকের মাঝে অস্ফুট কোন্ আশা,

সে যে অজানা কোন্ ভাষা।

সেই সেদিনের আসাযাওয়া, আধেক জানাজানি,

হঠাৎ হাতে হাতে ঠেকা,

বোবা চোখের চেয়ে দেখা,

মনে পড়ে ভীরু হিয়ার না-বলা সেই বাণী --

সেই আধেক জানাজানি।

এই জীবনে সেই তো আমার প্রথম ফাগুন মাস।

ফুটল না তার মুকুলগুলি,

শুধু তারা হাওয়ায় দুলি

অবেলাতে ফেলে গেছে চরম দীর্ঘশ্বাস --


আমার প্রথম ফাগুন মাস।

ঝরে-পড়া সেই মুকুলের শেষ-না-করা কথা

আজকে আমার সুরে গানে

পায় খুঁজে তার গোপন মানে,

আজ বেদনায় উঠল ফুটে তার সেদিনের ব্যথা --

সেই শেষ-না-করা কথা।

পারে যাওয়ার উধাও পাখি সেই কিশোরের ভাষা,

প্রাণের পারের কুলায় ছাড়ি

শূন্য আকাশ দিল পাড়ি,

আজ এসে মোর স্বপন-মাঝে পেয়েছে তার বাসা --

আমার সেই কিশোরের ভাষা।

কাউকে ভালবাসলে তার বাড়ির ইট-পাথরগুলোকেও যেন আপন মনেহয়, ভাললাগে। একই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রবির

বেলাতেও। কলকাতায় ফিরে লুসির জন্য কবির কিশোর মন হু-হু করে ওঠে। এমনকি স্কট পরিবারের কুকুর টবির কথাও তাঁর

মনেপড়ে যায়। কবি তাই লিখেছেন কুকুর টবির কথা,

‘ছোট্ট কুকুরটি। তার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া রোঁয়া। রোঁয়াতে চোখমুখ ঢাকা। সকালবেলায় ব্রেকফাস্টের সময় তার তিনটি বিস্কুট

বরাদ্দ আছে। সে বিস্কুটগুলি নিয়ে খাবার ঘরে বসে থাকে, যতক্ষণ না আমি গিয়ে বিস্কুটগুলি নিয়ে তার সঙ্গে খানিকটা

খেলা করি, একবার তার মুখের থেকে কেড়ে নিই, একবার গড়িয়ে দিই, ততক্ষণ তার খাওয়া হয় না। আমাকে সে বড়

ভালবাসে। আগে আগে যখন আমার উঠতে দেরি হত, সে তার বরাদ্দ বিস্কুট নিয়ে আমার শোবার ঘরের কাছে বসে ঘেউ ঘেউ

করত। কিন্তু গোল করলে আমি বিরক্ত হতুম, সে এখন আর ঘেউ ঘেউ করে না। আস্তে আস্তে পা দিয়ে দরজা ঠেলে;

যতক্ষণ না আমি দরজা খুলে দিই চুপ করে বাইরে বসে থাকে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোলেই সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে লেজ নেড়ে

সুপ্রভাত সম্ভাষণ করে; তারপরে একবার বিস্কুটের দিকে চায়, একবার মুখের দিকে চায়।’

লুসি স্কটের কাছ থেকে বিদায় নেবার মুহুর্তে রবির মনেহয়েছিল এই বিচ্ছেদই চিরবিচ্ছেদ, ‘আর কি রে এ জীবনে ফিরে

আসা হবে?’ তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডনের সেই বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন ১১ বছর পরে, ১৮৯০ সালে। ১০

সেপ্টেম্বরে লন্ডনে পৌঁছে পরেরদিনই কবি গিয়েছিলেন লুসির বাড়িতে, তবে সেই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। কবির ভাষায়,

‘প্রথমে লন্ডনের মধ্যে আমার সর্বাপেক্ষা পরিচিত বাড়ির দ্বারে গিয়ে আঘাত করা গেল। যে দাসী এসে দরজা খুলে দিল

তাকে চিনিনে। তাকে জিজ্ঞেস করলুম আমার বন্ধু বাড়িতে আছেন কিনা। সে বললে তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। জিজ্ঞাসা

করলুম কোথায় থাকেন? সে বললে, আমি জানি নে, আপনারা ঘরে গিয়ে বসুন, আমি জিজ্ঞাসা করে আসছি। পূর্বে যে ঘরে

আমরা আহার করতুম সেই ঘরে গিয়ে দেখলেম সমস্ত বদলে গেছে- সেখানে টেবিলের উপর খবরের কাগজ এবং বই- সে ঘর

এখন অতিথিদের প্রতীক্ষাশালা হয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে দাসী একটি কার্ডে লেখা ঠিকানা এনে দিলে। আমার বন্ধু এখন

লন্ডনের বাইরে কোনো এক অপরিচিত স্থানে থাকেন। নিরাশ হৃদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরোলুম।’

১৮৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা

দিয়েছেন। তাঁর নিরাশ হৃদয়ে সেদিন একটা বাসনাও জেগেছিল,

‘একবার ইচ্ছে হল, অন্তঃপুরের সেই বাগানটা দেখে আসি; আমার সেই গাছগুলো কত বড় হয়েছে। আর সেই ছাতের উপরকার

দক্ষিণমুখো কুঠরি, আর সেই ঘর এবং সেই আর একটা ঘর!’

সেই আর একটা ঘরের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বিশেষ টান ছিল তা উপরের লেখা থেকেই অনুমান করা যায়। হয়তো

সেই ঘরেই লুসির কাছে রবি ইংরেজি গান শিখতেন কিংবা অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন। তাঁর সেই প্রিয় সঙ্গিনী লুসি

স্কটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কোন দিনই খুঁজে পাননি। তাঁর সেই খুঁজে না পাওয়ার ব্যথা কবি লিখেছেন এভাবে, ‘এই

ডাক্তার পরিবারের কেহ বা পরলোকে কেহ বা ইহলোকে কে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন, তাহার কোন সংবাদই জানি না, কিন্তু

সেই গৃহটি আমার মনের মধ্যে চিরপ্রতিষ্ঠিত হইয়া আছে।’


১৯২৯ সালের কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কানাডায়। কবিগুরু ততোদিনে ৭০ বছর বয়সে পা দিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে

একটা চিঠি এলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে। এক ইংরেজ ভদ্রলোক রবার্ট, চিঠিতে জানিয়েছেন লুসি সম্পর্কে

তার আন্টি হন। তিনি তার আন্টির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানেন। রবার্ট চিঠিতে

জানান লুসি বিয়ে করেননি এবং এখনও রবির জন্য চোখের জল ফেলেন। বর্তমানে তিনি বৃদ্ধা, দরিদ্র এবং অসুস্থ। তিনি

জানতে চান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আন্টির অগোচরে চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য করতে পারেন কিনা! অসহায়,

দরিদ্র এবং অসুস্থ লুসি স্কটের সাথে রবির আর দেখা হয়েছিল কিনা জানা যায় না। রবি ঠাকুর এই বৃদ্ধার প্রতি ততোদিনে

কোন টান অনুভব করতেন কিনা তাও জানা যায় না। কেননা লুসির পর, ১৯১৬ সালে ২০ বছর বয়সী জাপানি তরুণী তোমি

ওয়াদা এবং ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনার ৩৪ বছর বয়সী নারী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে কবির পরিচয় ঘটেছে, কবি যাকে

‘বিজয়া’ বলে ডেকেছেন।

এখনও ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়’ গানটা যখন শুনি তখন কল্পনায় ভেসে ওঠে লন্ডনের এক ডাক্তার

পরিবারের বাসার ছাদের উপরে দক্ষিণমুখী এক কুঠুরি এবং বিশেষ একটা ঘর, যেখানে মাথা দুলিয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছেন এক

ইংরেজ তরুণী আর তার সাথে সুর মিলিয়ে গান গাইছেন এক বাঙালি তরুণ, আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মানসপটে ভেসে ওঠে এক দরিদ্র, অসুস্থ বৃদ্ধার কথা যিনি হয়তো জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত প্রিয় রবির জন্য চোখের

জল ফেলেছেন।

হদিসঃ

১। গোপনচারিণী- রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

২। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন

৩। পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪। য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৫। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৬। জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পোস্ট ভিউঃ 10

আপনার মন্তব্য লিখুন