রাইনের মারিয়া রিলকেঃ গোলাপের কাঁটার আঘাতে যার মৃত্যু, কবিতার মতো!

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
রাইনের মারিয়া রিলকেঃ গোলাপের কাঁটার আঘাতে যার মৃত্যু, কবিতার মতো!

রাইনের মারিয়া রিলকেঃ গোলাপের কাঁটার আঘাতে যার মৃত্যু, কবিতার মতো!

‘যদি একবার আমাদের দেখা হতো ল্যু!’

অস্ট্রীয় কবি রাইনের মারিয়া রিলকে’র জীবনের অন্তিম মুহূর্তে লেখা চিঠির এই লাইনে প্রকাশ পেয়েছে

বান্ধবী ল্যু’র সাথে সাক্ষাতের আকুলতা। জার্মান মা ও রাশান বাবার সন্তান ল্যু’র পুরোনাম ল্যু আন্দ্রিয়াস

সালোমে। মৃত্যুর আগে তিনি যে দু’জন বান্ধবীকে নিজ হাতে চিঠি লিখে তার অন্তিম সময়ের খবর জানিয়েছেন,

তার মধ্যে ল্যু একজন। ফ্রয়েডের চোখে ল্যু ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট নারী। ল্যুর ব্যক্তিত্ব এবং

সৌন্দর্যের মোহে প্রথম দেখাতেই নিৎসে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় দেখাতেই বিয়ের প্রস্তাব

দিয়েছিলেন। পরিচয়ের পরে নি্ৎসে ল্যুকে বলেছিলেন, ‘কোন নক্ষত্র থেকে খসে পড়ে বলো আমরা এসেছি

পৃথিবীতে, পরস্পরের সঙ্গে দেখা করতে?’ আসলে সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান

ব্যক্তিত্বই ল্যুর অনুরাগী ছিলেন। ল্যু একাধারে রিলকের প্রেমিকা, শিক্ষক, অভিভাবক ছিলেন। ছন্নছাড়া এবং

গভীর নির্জনতা প্রিয় রিলকের ওপরে একমাত্র তিনিই কর্তৃত্ব করতে পেরেছিলেন। কবির চেয়ে ১৪ বছরের বড়

ল্যু রিলকের জীবনের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী নারী।

‘নিবিয়ে দাও চোখ: আমার তবু তুমি দৃশ্য;

বন্ধ করো কান, শুনতে পাই তবু তোমাকে;

পা যদি না-ও থাকে, তোমার দিকে আমি চলমান;

জিহবাহীনভাবে তোমাকে অবিরাম ডাকছি।

দাও না ভেঙ্গে বাহু; হৃদয় দেবো আমি বাড়িয়ে,

হাতের মতো তা-ই তোমাকে ফের কাছে টানবে;

হৃদয় থেমে যাক, জাগবে চিন্তায় স্পন্দন;

এবং দাও যদি দগ্ধ ক’রে মস্তিষ্ক,

আমার শোণিতেই তোমাকে ব’য়ে নেবো চিরকাল।’

[প্রহর-পুঁথি (DAS STUDENBUCH) - দ্বিতীয় খণ্ড]

জোসেফ দম্পতি ১৮৭৫ সালের ৪ ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া শিশুটির নাম রেখেছিলেন রেনে কার্ল ভিলহেলম জোহান

জোসেফ মারিয়া রিলকে, আমরা যাকে কবি রাইনের মারিয়া রিলকে নামে চিনি। কবির পিতৃপ্রদত্ত নামের এই

সংক্ষিপ্তরূপ দেন বান্ধবী ল্যু। একসময় তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে তার নিষেধের তোয়াক্কা

না করে ভাস্কর ক্লারা হেবফস্টফকে ১৯০১ সালে বিয়ে করেন ঠিকই কিন্তু তার সেই সংসার জীবন সুখের

হয়নি। তিনি এমনকি তার কন্যা রুথ রিলকের সাথেও কখনো যোগাযোগ রাখেননি। রিলকের অসুস্থতার খবর শুনে

ক্লারা আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন এলেও দেখা হবেনা। তারপরও এলে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে

অন্য কোথাও চলে যাবেন। আসলে রিলকে কখনই ল্যু’র ব্যক্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তার

কবিতায় যেমন,

‘পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শুন্য থেকে ঝ’রে প’ড়ে যায়,

যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ’লো অনেক বাগান;

এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।

এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,

নক্ষত্রশৃংখল ছিঁড়ে-নিঃসঙ্গতায়।


আমরাও ঝ’রে যাই। এই হাত-তাও পড়ে ঝ’রে।

দ্যাখো অন্য সকলেরে: সকলেই এর অংশিদার।

তবু আছে একজন, যার হাত, কোমল, নির্ভার,

এই সব পতনেরে অন্তহীনভাবে রাখে ধ’রে।’

জীবনের সব আনন্দ-বেদনা-হতাশা-ব্যর্থতা রিলকে বান্ধবী ল্যুর সাথেই ভাগাভাগি করেছেন। রিলকের জীবনে

ল্যু কীরকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তা বোঝা যায় ১৮৯৭ সালে মিউনিখ থেকে ল্যু-কে লেখা চিঠিতে,

‘তুমি সেই অসাধারণ নারী যে আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। যার কথা, অনুপ্রেরণা আমার লেখক জীবনে

আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমার সব মহৎ স্বপ্ন, কবিতা নিয়ে আমার প্রত্যাশা তাদের সব ভালো ও মন্দ দিক

সত্ত্বেও বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।’

সিগমণ্ড ফ্রয়েডের শিষ্য ও বন্ধু ল্যু নিজেও লেখালেখি করতেন, তিনি ১২টা উপন্যাস, অনেক গল্প, স্মৃতিকথা,

দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখেছেন। রিলকেকে নিয়ে ল্যু’র লেখা অনবদ্য স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ

‘ইউ অ্যালোন আর রিয়েল টু মি’ থেকে ল্যু-রিলকের সম্পর্কের ধরন বোঝা যায়।

‘ডুয়িনো এলিজি’ ও ‘সনেটস টু অর্ফিয়ুস’ শেষ করার পর রিলকের মনেহলো নতুন কিছু করা দরকার যাতে নিজেকে

নতুনভাবে প্রকাশ করা যায়। তবে তা নতুন ভাষায়, যেন ইউরোপের পাঠকরা অনুবাদ ছাড়াই তার কবিতার স্বাদ

আস্বাদন করতে পারে। তিনি বেছে নিলেন ফরাসী ভাষা। ছেলেবেলা মায়ের কাছে শেখা এই ভাষা তার হৃদয়ে শেকড়

গেড়েছিল। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি গোলাপ নিয়ে ‘অ্যাফেকশনেট টু মাই ফ্রান্স’ শিরোনামে লিখলেন

২৭টি কবিতা। একটি কবিতায় বলেছেন,

‘গোলাপ, তুমি যেন আধ খোলা কোন বই,

সুখের প্রাচুর্যে ভরা, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উম্মুক্ত-

তবুও আমাদের পড়া হবে না কখনো।

এক একটি পৃষ্ঠা বাতাসের স্পর্শে খুলে যায়,

আবার পরমুহুর্তেই বন্ধ হয়,

প্রপজাপতিরা যেখান থেকে একই ধারণা

পেতে বিভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করে।’

গোলাপ নানাভাবে এসেছে রিলকের কবিতায়। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘নিউ পোয়েমস’ কাব্যগ্রন্থের শেষ

কবিতাটার নাম ‘গোলাপের পাত্র’। সেখানে কবি গোলাপের পাপড়িতে পৃথিবীর সব সমৃদ্ধি, বিশুদ্ধ সত্তা,

আত্মমগ্নতা আবিষ্কার করেছেন। গোলাপ নিয়ে রিলকের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এলিয়ট ও ইয়েটস।

ভারতীয় সাহিত্যে পদ্ম যেমন, ইউরোপের সাহিত্যে গোলাপ তেমন এসেছে প্রেম, ভক্তি আর সৌন্দর্যের

প্রতীক হিসেবে। রিলকে গোলাপকে কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গের সাথে জড়াননি। তার কাছে গোলাপ ঘুমন্ত চোখের

পাতার প্রতীক। ১৯০০ সালে ওয়ার্পসবেদেতে ক্লারা ও পাউলার সাথে পরিচয়ের পর তাদের গোলাপ উপহার

দিয়েছিলেন। সেসময় ডায়েরীতে লিখেছেন,

‘আমি একটি নতুন ধরনের স্নেহস্পর্শ আবিষ্কার করেছি। চোখ বুজে চোখের পাতায় একটি গোলাপ আলতোভাবে

রেখে দেই। অনুভব করি এর নরম, কোমল স্পর্শ; যতক্ষণ না এই শীতলতা মিলিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত।

চোখের পাতায় কোমল পাপড়িরা বিশ্রাম নেয়, যেন তারা ঘুমিয়ে আছে, সকালে ফোটার আগ পর্যন্ত যেভাবে

ঘুমিয়ে থাকে গাছে।’


‘সনেটস টু অর্ফিয়ুস’ তার প্রথম এবং একমাত্র সনেটগুচ্ছ, সেখানেও আছে গোলাপের প্রসঙ্গ। সেখানে

গোলাপকে কবি রিলকে বলেছেন সম্পূর্ণ, নিঃশেষ ও অক্ষয়।

‘তুলো না স্মরণস্তম্ভ। গোলাপেরা হবে প্রস্ফুটিত

তারই জন্য, প্রতি গ্রীষ্মে ফিরে-ফিরে, অফুরান।

কেননা সে অর্ফিয়ুস। সে-ই হয় রূপান্তরিত

এতে কিংবা ওতে। অন্য কোন নামের সন্ধান

আমাদের অকর্তব্য। একবার, চিরকাল ধ’রে

গান যদি জাগে তা-ই অর্ফিয়ুস। সে আসে, এবং চ’লে যায়।

তা-ই কি পর্যাপ্ত নয়, মাঝে-মাঝে, গোলাপেরও পরে

সে যদি কয়েকদিন আমাদের সংসর্গে কাটায়?’

থ্রেশীয় রাজপুত্র অর্ফিয়ুস ছিলেন একাধারে কবি ও সুরকার। তিনি এত সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন যে বনের

পশুপাখিরাও কান পেতে তার গান শুনতো। বিয়ের দিন সখীসহ বাসরঘরে যাবার পথে বিষাক্ত সাপের কামড়ে

স্ত্রী ইউরিদিকে’র মৃত্যুর পর তিনি স্ত্রীকে খুঁজতে পাতালে যান। সেখানে জীবিতদের যাওয়া নিষেধ কিন্তু

অর্ফিয়ুস বীণায় সুরের ঝঙ্কার তোলামাত্র দ্বাররক্ষীরা পথ ছেড়ে দেয়। তবে পাতালের রাজা হৈদিস ও রানী

পের্সেফোনি’র দেয়া শর্ত লঙ্ঘন করায় ইউরিদেকেকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তিনি পাতাল থেকে সন্তপ্ত

চিত্তে পৃথিবীতে ফেরার পর তিন বছর বেঁচেছিলেন। এই সময় তার কাছে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়া

থ্রেসীয় নারীদের হাতে তার করুন মৃত্যু ঘটে। রিলকে তার সনেটে রহস্যময় জ্ঞানকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের

তীর্থে পরিণত করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটা সনেট,

‘গোলাপ, মুকুটমণি, পুরাকালে ছিলে পরিচিত

সরল কানার পানপাত্র ব’লে, কিন্তু আজ আমাদের মনে হয়

তুমি সেই কুসুম, যা সম্পূর্ণ ও সংখ্যাতীত,

সেই এক সামগ্রী, যা নিঃশেষ, অক্ষয়।

এত ঋদ্ধ, তুমি যেন স্তরে-স্তরে সংলগ্ন বসন

কোনো দ্যুতিসর্বস্ব তনুতে;

অথচ তোমার কোনো পাতা নেই, যা মানে গুণ্ঠন,

কিংবা চায় নিজেকে লুকোতে।

অনেক শতাব্দী ধ’রে তোমার সুবাস

নিজের মধুরতম নামশব্দে আমাদের ডাক দিয়ে গেছে;

হঠাৎ, যশের মতো, তাকে দেয় আশ্রয় বাতাস।

কিন্তু তবু তার নাম জানি না- কখনো তা হয় অনুমেয়-

আর স্মৃতি ফিরে-ফিরে আসে তার কাছে

সেই লুপ্ত কাল থেকে, এখানো যা প্রত্যানয়নীয়।’

১৯২৬ সালের শেষের দিকে মিশরীয় এক ভক্ত পাঠিকা নিমেট এলুয়ি বে কবির সাথে পরিচিত হতে আসেন।

মিশরের এক সুলতানের রাজকর্মচারীর এই মেয়ের সাথে কবির কিছুটা সখ্য হয়। ১৯১০ সালে প্রকাশিত

আত্মজৈবনিক গ্রন্থ বা উপন্যাস ‘দা নোটবুক অভ মাল্টে লউরিডজ ব্রিগগে’ ভক্ত এই পাঠিকা একদিন তার


এক বান্ধবীকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের এক গ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা শত্য দ্য মুজৎ নামের বাড়িতে

আসেন। অতিথিদের সম্মানে বাগান থেকে নিজ হাতে গোলাপ তুলতে গিয়ে বাম হাতের আঙুলে একটা বড় কাঁটা

ফোটে। দ্রুত সেই ব্যথা সংক্রামিত হয়, দশ দিন পর অবস্থার অবনতি হয় এবং তার ইনফ্লুয়েঞ্জা ও জ্বর

দেখা দেয়। চিকিৎসকরা জানান গোলাপের কাঁটার আঘাতে লিউকিমিয়া হয়েছে, যা থেকে কবির আর মুক্তি

মেলেনি। রিলকের ভাষায়, ‘দিনরাত নরকের মধ্যে বসবাস’, মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে ল্যু-কে জানান সে দুর্বিষহ

অবস্থার কথা,

‘ল্যু তোমাকে বোঝাতে পারবো না কিসের মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছি, কী সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। তুমি জানো

শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই আমি এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত।

কিন্তু এখন তা আমাকে কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দিনরাত জীবনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলছে। এ অবস্থায়

আমি কোথায় সাহস পাব বল?’

চিঠির শেষে রাশান ভাষায় স্বাক্ষর করেন, ‘ফেয়ারওয়েল মাই লাভ।’

১৯২৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরে ভালমন্ট হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ১৯২৭ সালের ২ জানুয়ারি তার শেষ ইচ্ছে

অনুযায়ী রেরন গ্রামের গির্জার পাশে তের শতকের এক সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়। সমাধির ওপর

রাখা হয় তার লেখা বিখ্যাত এপিটাফ। এপিটাফটা কবি ১৯২৫ সালের ২৯ অক্টোবরে লিখে রেখেছিলেন,

‘Rose on the pure Contradiction,

Delight of Being No one’s Sleep under so Many Lids.’

এপিটাফে গোলাপ যেন ঘুমের প্রতীক, গোলাপের পাপড়ি যেন বন্ধ চোখের পাতা, জেগে থাকার সুখ গোলাপের রঙ

আর সুগন্ধের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।

কি সৌভাগ্য রিলকের! একদম কবির মতোই মৃত্যু! কেননা তিনি এমন এক কবি, যিনি সর্বতোভাবে কবি হতে

চেয়েছিলেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে কবি। দৈনন্দিন জীবনের অর্থহীনতম মুহুর্তেও। ভ্রমণে ও মননে, বাক্যে,

ব্যবহারে, পত্ররচনায়। যখন তিনি কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না, তখনও। যখন তিনি অসুস্থ, বা

হতাশ, বা মনঃক্ষুণ্ণ, তখনও। তিনি এমন একজন সন্তান যিনি তার বাবার মৃত্যুশয্যায় শেষবারের মতো দেখতে

যাওয়ার প্রয়োজন মনেকরেননি, এমন প্রেমিক যিনি প্রেমিকার সঞ্চয় ভাঙিয়ে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ

করেছেন, এমন এক স্বামী যিনি বিয়ের পরের বছরেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন। অবশ্য ক্লারা বিয়ের

পরপরই বুঝে গিয়েছিলেন এই সংসারবিরাগী মানুষটার সাথে তার দাম্পত্য জীবনের ভবিষ্যৎ পরিণতি। রিলকে

এমন এক বাবা যিনি সারাজীবন মেয়ের সাথে বলতে গেলে দেখা করেননি, রুথ একবার বাবার কাছে আসতে

চাইলেও নানা অজুহাতে তাকে নিবৃত্ত করেছেন। কখনো মেয়ের সংসার দেখতে যাননি, এমনকি জামাতা কার্ল

শিবারের সাথে তার কখনো দেখা হয়নি। তার পুরোটা জীবন কবিতার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। সমাজ-সংসার থেকে

বিচ্ছিন্ন হয়ে কবিতায় মগ্ন থাকার ফলে তার আত্মীয়স্বজনরা বঞ্চিত হলেও লাভবান হয়েছে কবিতার

ইতিহাস। ব্যক্তি রিলকের সব ব্যর্থতা কবি রিলকের কালজয়ী সৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। কবিতার কারণেই তো

গুরুত্বপূর্ণ কবির জীবন, কবিতার কারণেই রিলকেকে অতিক্রম করতে হয়েছে সবকিছু, প্রথাগত সবকিছুকে

তুচ্ছ করে বেছে নিতে হয়েছে সৃষ্টির বেড়াজাল। তার মৃত্যুও তাই কবিতার মতোই, গোলাপের কাঁটার আঘাতে। কেউ

কখনো ভেবেছে! এভাবেও কারো মৃত্য হয়! তার জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সময়ে এক নতুন জাতের গোলাপের

নামকরণ করা হয়েছিল, ‘রাইনার মারিয়া রিলকে’। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রিলকের সমাধিতে লেখা এপিটাফের

অনুবাদ করেছেন এভাবে,

‘বিশুদ্ধ বিরোধাভাস, হে গোলাপ,

সকলের চোখের পাতায়


রাজো, তবু নও কারো ঘুম নও ।

সেই বুঝি সুখ’

হদিসঃ

১। রাইনের মারিয়া রিলকে-র কবিতা- বুদ্ধদেব বসু

২। রিলকে- নৈঃশব্দ্যে ও নিঃসঙ্গতায়- জাহানারা পারভীন

৩। ইন্টারনেটরাইনের মারিয়া রিলকেঃ গোলাপের কাঁটার আঘাতে যার মৃত্যু, কবিতার মতো!

‘যদি একবার আমাদের দেখা হতো ল্যু!’

অস্ট্রীয় কবি রাইনের মারিয়া রিলকে’র জীবনের অন্তিম মুহূর্তে লেখা চিঠির এই লাইনে প্রকাশ পেয়েছে

বান্ধবী ল্যু’র সাথে সাক্ষাতের আকুলতা। জার্মান মা ও রাশান বাবার সন্তান ল্যু’র পুরোনাম ল্যু আন্দ্রিয়াস

সালোমে। মৃত্যুর আগে তিনি যে দু’জন বান্ধবীকে নিজ হাতে চিঠি লিখে তার অন্তিম সময়ের খবর জানিয়েছেন,

তার মধ্যে ল্যু একজন। ফ্রয়েডের চোখে ল্যু ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট নারী। ল্যুর ব্যক্তিত্ব এবং

সৌন্দর্যের মোহে প্রথম দেখাতেই নিৎসে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় দেখাতেই বিয়ের প্রস্তাব

দিয়েছিলেন। পরিচয়ের পরে নি্ৎসে ল্যুকে বলেছিলেন, ‘কোন নক্ষত্র থেকে খসে পড়ে বলো আমরা এসেছি

পৃথিবীতে, পরস্পরের সঙ্গে দেখা করতে?’ আসলে সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান

ব্যক্তিত্বই ল্যুর অনুরাগী ছিলেন। ল্যু একাধারে রিলকের প্রেমিকা, শিক্ষক, অভিভাবক ছিলেন। ছন্নছাড়া এবং

গভীর নির্জনতা প্রিয় রিলকের ওপরে একমাত্র তিনিই কর্তৃত্ব করতে পেরেছিলেন। কবির চেয়ে ১৪ বছরের বড়

ল্যু রিলকের জীবনের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী নারী।

‘নিবিয়ে দাও চোখ: আমার তবু তুমি দৃশ্য;

বন্ধ করো কান, শুনতে পাই তবু তোমাকে;

পা যদি না-ও থাকে, তোমার দিকে আমি চলমান;

জিহবাহীনভাবে তোমাকে অবিরাম ডাকছি।

দাও না ভেঙ্গে বাহু; হৃদয় দেবো আমি বাড়িয়ে,

হাতের মতো তা-ই তোমাকে ফের কাছে টানবে;

হৃদয় থেমে যাক, জাগবে চিন্তায় স্পন্দন;

এবং দাও যদি দগ্ধ ক’রে মস্তিষ্ক,

আমার শোণিতেই তোমাকে ব’য়ে নেবো চিরকাল।’

[প্রহর-পুঁথি (DAS STUDENBUCH) - দ্বিতীয় খণ্ড]

জোসেফ দম্পতি ১৮৭৫ সালের ৪ ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া শিশুটির নাম রেখেছিলেন রেনে কার্ল ভিলহেলম জোহান

জোসেফ মারিয়া রিলকে, আমরা যাকে কবি রাইনের মারিয়া রিলকে নামে চিনি। কবির পিতৃপ্রদত্ত নামের এই

সংক্ষিপ্তরূপ দেন বান্ধবী ল্যু। একসময় তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে তার নিষেধের তোয়াক্কা

না করে ভাস্কর ক্লারা হেবফস্টফকে ১৯০১ সালে বিয়ে করেন ঠিকই কিন্তু তার সেই সংসার জীবন সুখের

হয়নি। তিনি এমনকি তার কন্যা রুথ রিলকের সাথেও কখনো যোগাযোগ রাখেননি। রিলকের অসুস্থতার খবর শুনে

ক্লারা আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন এলেও দেখা হবেনা। তারপরও এলে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে

অন্য কোথাও চলে যাবেন। আসলে রিলকে কখনই ল্যু’র ব্যক্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তার

কবিতায় যেমন,

‘পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শুন্য থেকে ঝ’রে প’ড়ে যায়,

যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ’লো অনেক বাগান;

এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।

এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,

নক্ষত্রশৃংখল ছিঁড়ে-নিঃসঙ্গতায়।


আমরাও ঝ’রে যাই। এই হাত-তাও পড়ে ঝ’রে।

দ্যাখো অন্য সকলেরে: সকলেই এর অংশিদার।

তবু আছে একজন, যার হাত, কোমল, নির্ভার,

এই সব পতনেরে অন্তহীনভাবে রাখে ধ’রে।’

জীবনের সব আনন্দ-বেদনা-হতাশা-ব্যর্থতা রিলকে বান্ধবী ল্যুর সাথেই ভাগাভাগি করেছেন। রিলকের জীবনে

ল্যু কীরকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তা বোঝা যায় ১৮৯৭ সালে মিউনিখ থেকে ল্যু-কে লেখা চিঠিতে,

‘তুমি সেই অসাধারণ নারী যে আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। যার কথা, অনুপ্রেরণা আমার লেখক জীবনে

আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমার সব মহৎ স্বপ্ন, কবিতা নিয়ে আমার প্রত্যাশা তাদের সব ভালো ও মন্দ দিক

সত্ত্বেও বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।’

সিগমণ্ড ফ্রয়েডের শিষ্য ও বন্ধু ল্যু নিজেও লেখালেখি করতেন, তিনি ১২টা উপন্যাস, অনেক গল্প, স্মৃতিকথা,

দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখেছেন। রিলকেকে নিয়ে ল্যু’র লেখা অনবদ্য স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ

‘ইউ অ্যালোন আর রিয়েল টু মি’ থেকে ল্যু-রিলকের সম্পর্কের ধরন বোঝা যায়।

‘ডুয়িনো এলিজি’ ও ‘সনেটস টু অর্ফিয়ুস’ শেষ করার পর রিলকের মনেহলো নতুন কিছু করা দরকার যাতে নিজেকে

নতুনভাবে প্রকাশ করা যায়। তবে তা নতুন ভাষায়, যেন ইউরোপের পাঠকরা অনুবাদ ছাড়াই তার কবিতার স্বাদ

আস্বাদন করতে পারে। তিনি বেছে নিলেন ফরাসী ভাষা। ছেলেবেলা মায়ের কাছে শেখা এই ভাষা তার হৃদয়ে শেকড়

গেড়েছিল। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি গোলাপ নিয়ে ‘অ্যাফেকশনেট টু মাই ফ্রান্স’ শিরোনামে লিখলেন

২৭টি কবিতা। একটি কবিতায় বলেছেন,

‘গোলাপ, তুমি যেন আধ খোলা কোন বই,

সুখের প্রাচুর্যে ভরা, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উম্মুক্ত-

তবুও আমাদের পড়া হবে না কখনো।

এক একটি পৃষ্ঠা বাতাসের স্পর্শে খুলে যায়,

আবার পরমুহুর্তেই বন্ধ হয়,

প্রপজাপতিরা যেখান থেকে একই ধারণা

পেতে বিভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করে।’

গোলাপ নানাভাবে এসেছে রিলকের কবিতায়। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘নিউ পোয়েমস’ কাব্যগ্রন্থের শেষ

কবিতাটার নাম ‘গোলাপের পাত্র’। সেখানে কবি গোলাপের পাপড়িতে পৃথিবীর সব সমৃদ্ধি, বিশুদ্ধ সত্তা,

আত্মমগ্নতা আবিষ্কার করেছেন। গোলাপ নিয়ে রিলকের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এলিয়ট ও ইয়েটস।

ভারতীয় সাহিত্যে পদ্ম যেমন, ইউরোপের সাহিত্যে গোলাপ তেমন এসেছে প্রেম, ভক্তি আর সৌন্দর্যের

প্রতীক হিসেবে। রিলকে গোলাপকে কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গের সাথে জড়াননি। তার কাছে গোলাপ ঘুমন্ত চোখের

পাতার প্রতীক। ১৯০০ সালে ওয়ার্পসবেদেতে ক্লারা ও পাউলার সাথে পরিচয়ের পর তাদের গোলাপ উপহার

দিয়েছিলেন। সেসময় ডায়েরীতে লিখেছেন,

‘আমি একটি নতুন ধরনের স্নেহস্পর্শ আবিষ্কার করেছি। চোখ বুজে চোখের পাতায় একটি গোলাপ আলতোভাবে

রেখে দেই। অনুভব করি এর নরম, কোমল স্পর্শ; যতক্ষণ না এই শীতলতা মিলিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত।

চোখের পাতায় কোমল পাপড়িরা বিশ্রাম নেয়, যেন তারা ঘুমিয়ে আছে, সকালে ফোটার আগ পর্যন্ত যেভাবে

ঘুমিয়ে থাকে গাছে।’


‘সনেটস টু অর্ফিয়ুস’ তার প্রথম এবং একমাত্র সনেটগুচ্ছ, সেখানেও আছে গোলাপের প্রসঙ্গ। সেখানে

গোলাপকে কবি রিলকে বলেছেন সম্পূর্ণ, নিঃশেষ ও অক্ষয়।

‘তুলো না স্মরণস্তম্ভ। গোলাপেরা হবে প্রস্ফুটিত

তারই জন্য, প্রতি গ্রীষ্মে ফিরে-ফিরে, অফুরান।

কেননা সে অর্ফিয়ুস। সে-ই হয় রূপান্তরিত

এতে কিংবা ওতে। অন্য কোন নামের সন্ধান

আমাদের অকর্তব্য। একবার, চিরকাল ধ’রে

গান যদি জাগে তা-ই অর্ফিয়ুস। সে আসে, এবং চ’লে যায়।

তা-ই কি পর্যাপ্ত নয়, মাঝে-মাঝে, গোলাপেরও পরে

সে যদি কয়েকদিন আমাদের সংসর্গে কাটায়?’

থ্রেশীয় রাজপুত্র অর্ফিয়ুস ছিলেন একাধারে কবি ও সুরকার। তিনি এত সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন যে বনের

পশুপাখিরাও কান পেতে তার গান শুনতো। বিয়ের দিন সখীসহ বাসরঘরে যাবার পথে বিষাক্ত সাপের কামড়ে

স্ত্রী ইউরিদিকে’র মৃত্যুর পর তিনি স্ত্রীকে খুঁজতে পাতালে যান। সেখানে জীবিতদের যাওয়া নিষেধ কিন্তু

অর্ফিয়ুস বীণায় সুরের ঝঙ্কার তোলামাত্র দ্বাররক্ষীরা পথ ছেড়ে দেয়। তবে পাতালের রাজা হৈদিস ও রানী

পের্সেফোনি’র দেয়া শর্ত লঙ্ঘন করায় ইউরিদেকেকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তিনি পাতাল থেকে সন্তপ্ত

চিত্তে পৃথিবীতে ফেরার পর তিন বছর বেঁচেছিলেন। এই সময় তার কাছে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়া

থ্রেসীয় নারীদের হাতে তার করুন মৃত্যু ঘটে। রিলকে তার সনেটে রহস্যময় জ্ঞানকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের

তীর্থে পরিণত করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটা সনেট,

‘গোলাপ, মুকুটমণি, পুরাকালে ছিলে পরিচিত

সরল কানার পানপাত্র ব’লে, কিন্তু আজ আমাদের মনে হয়

তুমি সেই কুসুম, যা সম্পূর্ণ ও সংখ্যাতীত,

সেই এক সামগ্রী, যা নিঃশেষ, অক্ষয়।

এত ঋদ্ধ, তুমি যেন স্তরে-স্তরে সংলগ্ন বসন

কোনো দ্যুতিসর্বস্ব তনুতে;

অথচ তোমার কোনো পাতা নেই, যা মানে গুণ্ঠন,

কিংবা চায় নিজেকে লুকোতে।

অনেক শতাব্দী ধ’রে তোমার সুবাস

নিজের মধুরতম নামশব্দে আমাদের ডাক দিয়ে গেছে;

হঠাৎ, যশের মতো, তাকে দেয় আশ্রয় বাতাস।

কিন্তু তবু তার নাম জানি না- কখনো তা হয় অনুমেয়-

আর স্মৃতি ফিরে-ফিরে আসে তার কাছে

সেই লুপ্ত কাল থেকে, এখানো যা প্রত্যানয়নীয়।’

১৯২৬ সালের শেষের দিকে মিশরীয় এক ভক্ত পাঠিকা নিমেট এলুয়ি বে কবির সাথে পরিচিত হতে আসেন।

মিশরের এক সুলতানের রাজকর্মচারীর এই মেয়ের সাথে কবির কিছুটা সখ্য হয়। ১৯১০ সালে প্রকাশিত

আত্মজৈবনিক গ্রন্থ বা উপন্যাস ‘দা নোটবুক অভ মাল্টে লউরিডজ ব্রিগগে’ ভক্ত এই পাঠিকা একদিন তার


এক বান্ধবীকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের এক গ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা শত্য দ্য মুজৎ নামের বাড়িতে

আসেন। অতিথিদের সম্মানে বাগান থেকে নিজ হাতে গোলাপ তুলতে গিয়ে বাম হাতের আঙুলে একটা বড় কাঁটা

ফোটে। দ্রুত সেই ব্যথা সংক্রামিত হয়, দশ দিন পর অবস্থার অবনতি হয় এবং তার ইনফ্লুয়েঞ্জা ও জ্বর

দেখা দেয়। চিকিৎসকরা জানান গোলাপের কাঁটার আঘাতে লিউকিমিয়া হয়েছে, যা থেকে কবির আর মুক্তি

মেলেনি। রিলকের ভাষায়, ‘দিনরাত নরকের মধ্যে বসবাস’, মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে ল্যু-কে জানান সে দুর্বিষহ

অবস্থার কথা,

‘ল্যু তোমাকে বোঝাতে পারবো না কিসের মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছি, কী সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। তুমি জানো

শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই আমি এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত।

কিন্তু এখন তা আমাকে কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দিনরাত জীবনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলছে। এ অবস্থায়

আমি কোথায় সাহস পাব বল?’

চিঠির শেষে রাশান ভাষায় স্বাক্ষর করেন, ‘ফেয়ারওয়েল মাই লাভ।’

১৯২৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরে ভালমন্ট হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ১৯২৭ সালের ২ জানুয়ারি তার শেষ ইচ্ছে

অনুযায়ী রেরন গ্রামের গির্জার পাশে তের শতকের এক সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়। সমাধির ওপর

রাখা হয় তার লেখা বিখ্যাত এপিটাফ। এপিটাফটা কবি ১৯২৫ সালের ২৯ অক্টোবরে লিখে রেখেছিলেন,

‘Rose on the pure Contradiction,

Delight of Being No one’s Sleep under so Many Lids.’

এপিটাফে গোলাপ যেন ঘুমের প্রতীক, গোলাপের পাপড়ি যেন বন্ধ চোখের পাতা, জেগে থাকার সুখ গোলাপের রঙ

আর সুগন্ধের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।

কি সৌভাগ্য রিলকের! একদম কবির মতোই মৃত্যু! কেননা তিনি এমন এক কবি, যিনি সর্বতোভাবে কবি হতে

চেয়েছিলেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে কবি। দৈনন্দিন জীবনের অর্থহীনতম মুহুর্তেও। ভ্রমণে ও মননে, বাক্যে,

ব্যবহারে, পত্ররচনায়। যখন তিনি কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না, তখনও। যখন তিনি অসুস্থ, বা

হতাশ, বা মনঃক্ষুণ্ণ, তখনও। তিনি এমন একজন সন্তান যিনি তার বাবার মৃত্যুশয্যায় শেষবারের মতো দেখতে

যাওয়ার প্রয়োজন মনেকরেননি, এমন প্রেমিক যিনি প্রেমিকার সঞ্চয় ভাঙিয়ে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ

করেছেন, এমন এক স্বামী যিনি বিয়ের পরের বছরেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন। অবশ্য ক্লারা বিয়ের

পরপরই বুঝে গিয়েছিলেন এই সংসারবিরাগী মানুষটার সাথে তার দাম্পত্য জীবনের ভবিষ্যৎ পরিণতি। রিলকে

এমন এক বাবা যিনি সারাজীবন মেয়ের সাথে বলতে গেলে দেখা করেননি, রুথ একবার বাবার কাছে আসতে

চাইলেও নানা অজুহাতে তাকে নিবৃত্ত করেছেন। কখনো মেয়ের সংসার দেখতে যাননি, এমনকি জামাতা কার্ল

শিবারের সাথে তার কখনো দেখা হয়নি। তার পুরোটা জীবন কবিতার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। সমাজ-সংসার থেকে

বিচ্ছিন্ন হয়ে কবিতায় মগ্ন থাকার ফলে তার আত্মীয়স্বজনরা বঞ্চিত হলেও লাভবান হয়েছে কবিতার

ইতিহাস। ব্যক্তি রিলকের সব ব্যর্থতা কবি রিলকের কালজয়ী সৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। কবিতার কারণেই তো

গুরুত্বপূর্ণ কবির জীবন, কবিতার কারণেই রিলকেকে অতিক্রম করতে হয়েছে সবকিছু, প্রথাগত সবকিছুকে

তুচ্ছ করে বেছে নিতে হয়েছে সৃষ্টির বেড়াজাল। তার মৃত্যুও তাই কবিতার মতোই, গোলাপের কাঁটার আঘাতে। কেউ

কখনো ভেবেছে! এভাবেও কারো মৃত্য হয়! তার জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সময়ে এক নতুন জাতের গোলাপের

নামকরণ করা হয়েছিল, ‘রাইনার মারিয়া রিলকে’। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রিলকের সমাধিতে লেখা এপিটাফের

অনুবাদ করেছেন এভাবে,

‘বিশুদ্ধ বিরোধাভাস, হে গোলাপ,

সকলের চোখের পাতায়


রাজো, তবু নও কারো ঘুম নও ।

সেই বুঝি সুখ’

হদিসঃ

১। রাইনের মারিয়া রিলকে-র কবিতা- বুদ্ধদেব বসু

২। রিলকে- নৈঃশব্দ্যে ও নিঃসঙ্গতায়- জাহানারা পারভীন

৩। ইন্টারনেট

পোস্ট ভিউঃ 12

আপনার মন্তব্য লিখুন