এনহেদুয়ান্নাঃ প্রথম কবি
প্রবন্ধ
ফুটনোটে জলছাপ
আমি তোমার এবং সব সময় তোমারই থাকব
তোমার হৃদয় আমার জন্যে শীতল হোক,
তোমার চেতনা, সমবেদনা আমার প্রতি
করুণার্দ্র হোক
তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ আমি উপলব্ধি করেছি।
(শ্লোক: ১২)
চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত, ঈষৎ
উত্তোলিত। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন। সূর্যাস্তের
এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর। প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান
যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হচ্ছে। তিনি বিড়বিড় করে আওড়িয়ে
যাচ্ছেন নিজেরই লেখা শ্লোক। তার পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য
লোকজন। চন্দ্র দেবীর কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনা, তিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত
থেকে রক্ষা করেন।
দৃশ্যটি আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তার নাম
এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। এনহেদুয়ান্না নামের অর্থ হল ‘স্বর্গীয় অলঙ্কারের প্রধান
পুরোহিত’। তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন দ্য গ্রেট (খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩৪ থেকে ২২৭৯), ও তার স্ত্রী রানি
তাশলুলতুমের মেয়ে। সারগনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা সন্তান, এনহেদুয়ান্না’র জন্ম হয়েছিল
ইরাকের মেসোপটেমিয়ায়, খ্রিস্টপূর্ব ২২৮৫ শতাব্দীতে। অনেকের মতে এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের মেয়ে
নন, রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়া। সেই সময়ে মেসোপটেমিয়ায় (অধুনা ইরাক, টার্কি ও সিরিয়া) যে সভ্যতা গড়ে
উঠেছিল, তা ছিল হাজার হাজার বছরের পুরনো। সে সময়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বেশিরভাগই ছিলেন বেদুইন
সম্প্রদায়ের। প্রথম সভ্যতার জয়ধ্বজা ওড়ে আধুনিক ইরাকের দক্ষিণ অঞ্চলে, যাকে তখন সুমের বলা হত।
সেখানে ছোট ছোট শহর ও রাজ্য গড়ে ওঠে, চাষবাস শুরু হয়। যদিও এইসব ছোট রাজ্যের রাজারা নিজেদের মধ্যে
অনবরত লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করতো। এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে তখনকার মাটির তৈরি ট্যাবলেটে।
১৯২৭ সালে সুমেরীয় সভ্যতার প্রধান শহর ‘উর’ এ বৃটিশ নৃতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলির দল
খননকার্যের ফলে ৫৮০০ বছরের পুরনো চুনাপাথরের এক স্বচ্ছ চাকতি বা ডিস্ক আবিষ্কার করেন। এই
চাকতিতেই প্রথম ‘এনহেদুয়ান্না’ বলে জনৈক মহিলার পরিচয় পাওয়া যায়। চাকতির একপিঠে তার পরিচয়
হিসেবে লেখা ছিল চন্দ্র দেবতা নান্নার স্ত্রী আর অন্যপিঠে লেখা ছিল রাজা সারগনের কন্যা। এই চাকতিতে
এনহেদুয়ান্নাকে শাস্ত্রীয় কর্মে রত অবস্থায় দেখা গেছে। তাকে উর শহরের সুমেরীয় চন্দ্রদেবতা নান্নার
প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। উর ছিল প্রথম লিখিত ভাষার উদ্ভাবক সুমেরীয়দের নাগরিক ও
সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সুমেরীয় ভাষা হল প্রাচীনতম ভাষা এবং সুমেরীয় সাহিত্য হল
প্রাচীনতম মানব সাহিত্য। এই প্রাচীন ভাষায় বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম পরিচিত কবি এবং লেখক আক্কাদিয়ান
রাজকন্যা এনহেদুয়ান্নাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি স্যাফোর ১৭০০ বছর, হোমারের ১৫০০ বছর এবং
বাইবেলের পিতৃপুরুষ আব্রাহামের প্রায় ৫০০ বছর আগে বেঁচে ছিলেন। তিনি আনুমানিক ২৩১৫ থেকে ২৩৫০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
এনহেদুয়ান্না নিজেকে স্বর্গীয় ক্ষমতার ধারক হিসেবে দেখতেন। তিনি নান্নার কন্যা ইনান্নাকে নিজের পূজ্য
দেবী ও রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে বেছে নেন। ইনান্না হলেন যুদ্ধ, যৌনতা আর উর্বরতার দেবী। এনহেদুয়ান্না
পিতার সাম্রাজ্য জুড়ে ইনান্নাকে ধর্মীয় স্বীকৃতি দান করার কাজ শুরু করেন এবং মানুষের মধ্যে ইনান্নার
প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন। ইনান্নাকে নিয়ে অনেক স্তোত্র লিখেছিলেন এনহেদুয়ান্না, যার মধ্যে ‘ইনান্নার
মহিমান্বয়ন’ (The Exaltation of Inanna, বা ‘nin me šara’) কে সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা হিসেবে
স্বীকৃতি দিয়েছেন ঐতিহাসিকরা। সেরকম একটা স্তোত্র বা কবিতার অনুবাদ করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়,
তাঁর জন্য দিনটা ভালোই ছিল, মহার্ঘ পোশাকে সজ্জিত ছিলেন তিনি
তাঁর পোশাকে ছিল নারী সৌন্দর্যের সুষমা।
উদিত চন্দ্রের আলোর মতো,
কী চমৎকার ছিল তাঁর আভরণ।
যদিও পৃথিবীর প্রথম কবিকে নিয়ে অনেকের মুখে অনেক রকমের বক্তব্য শোনা যায় কিন্তু এনহেদুয়ান্নার
আগে আর কোন কবি পৃথিবীতে এসেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পায়নি গবেষকরা। সে
সময় নারীসমাজ ততটা অগ্রসর হয়ে ওঠেনি। শিক্ষাদিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা ছিলেন পুরুষদের তুলনায়
অনেকখানি পিছিয়ে। কিন্তু এনহেদুয়ান্না তার প্রজ্ঞা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে নিজেকে অন্যদের তুলনায় সম্পূর্ণ
আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সমগ্র নারীজাতির গৌরবের প্রতীকে পরিণত হন।
২
সুমেরীয় মন্দিরগুলিতে যারা বংশ পরম্পরায় পৌরোহিত্য করতেন, তাদের বলা হতো এনলিল। যদিও এই
এনলিলদের অবস্থান ছিল অস্থায়ী। সম্রাটের ইচ্ছানুসারে তাদের নিয়োগ করা হতো। সম্রাট সারগন ক্ষমতা
কায়েম রাখার জন্য এনলিলদের উচ্ছেদ করে এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত
করেন। এই পদটি রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ ছিল। এনহেদুয়ান্না ছিলেন প্রথম ‘এন’ উপাধিপ্রাপ্ত নারী,
যিনি ছিলেন রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। সম্রাট সারগনের সাম্রাজ্যের দক্ষিণ
সীমান্তে উর শহরের অবস্থান। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমে এই এলাকায় সারগন নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে
পেরেছিলেন। কিন্তু এনলিলরা খুব সহজে এটা মেনে নেননি। তারা তাদের ক্ষমতা হ্রাস এবং একজন নারীকে
প্রধান পুরোহিতের পদে বসানো মেনে নিতে পারেননি, বিশেষকরে সেই সময়ের নিরিখে। এরফলে এনলিলরা
বিদ্রোহ করে এনহেদুয়ান্নাকে উৎখাত করেন। এনলিলরা সাময়িকভাবে ফিরে এসে সাধারণ মানুষের থেকে
অতিরিক্ত কর, ভর্তুকি, উপঢৌকন আদায় করতে থাকেন।
এনহেদুয়ান্না এনলিলদের তাড়িয়ে দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে নিজের যোগ্যতায় প্রধান পুরোহিতের পদ
ফিরে পান। এনহেদুয়ান্না ‘The Exaltation of Inanna’ or ‘nin me šara’ এবং ‘The Curse of Akkade’-এ
এই সময়কার যন্ত্রণা ও লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সারগনের মৃত্যুর পরে তার পুত্র রামিস সম্রাট
হলেও এনহেদুয়ান্না স্বপদে বহাল থাকেন।
এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী মানুষ; এক নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে
তৎকালীন সমাজ তাকে দেবী হিসেবে পূজা করতো। তার লেখা শ্লোক বা স্তোত্র বা প্রার্থনা সঙ্গীত সুর করে
উচ্চারণ করা হতো তাই তাকে প্রথম গীতিকারও বলা যেতে পারে। এনহেদুয়ান্না যে পদ্ধতিতে লিখতেন, সেই
পদ্ধতিকে বলা হতো কিউনিফর্ম পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মেসিপটেমিয়ার অধিবাসীরা ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
থেকে লিখতে শুরু করে। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে উদ্ধার
করা হয়। এ ছাড়া তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে আরও বেশ কিছু শ্লোক রচনা করেন। যেমন,
দেবরাজ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বাতাসের দেবী
এই মহাবিশ্বকে করেছে তোমার দিকে ধাবমান
হে দেবীদের দেবী ইনানা, তোমার পদতলে
অর্পিত মহাবিশ্ব
তুমিই নির্ধারণ করো রাজকন্যাদের ভাগ্য।
(শ্লোক: ১৮)
এনহেদুয়ান্নার পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে রাজকন্যারা রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হিসাবে নির্বাচিত হতেন।
এইভাবে অন্যদের মধ্যে আক্কাদের নরাম সিন, লাগাশের উর-বাউ, উর-নাম্মু, শুলগি, ইসিনের ইশমে-দাগান এবং
কুদু-মাবুকের কন্যাদের খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাবিলনের শেষ রাজা নবনিদাস তার কন্যা এনিগাল্ডি-নান্নাকে উর-
এ চাঁদ দেবতার পুরোহিত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেদিক থেকে সম্রাট সারগন এই সিদ্ধান্তের
পথপ্রদর্শক বলা যেতে পারে। প্রধান পুরোহিতদের কাজ ছিল দেবতাদের উদ্দেশ্য করে স্তোত্র, গান ও কবিতা
লেখা। এনহেদুয়ান্নার ইনান্নাকে স্মরণ করে লেখা স্তোত্রগুলি মাটির ট্যাবলেটে ছুঁচলো দণ্ড দিয়ে লেখা হতো।
সুমেরীয় ভাষায় একশোর বেশি এরকম ট্যাবলেট পাওয়া গেছে যেগুলো এনহেদুয়ান্নারই লেখা। কারণ সারগন
শুধুমাত্র আক্কাদীয় ভাষা লিখতে জানতেন। এনহেদুয়ান্নার অন্তত ছ’টি বিভিন্ন ধারার লেখা খুঁজে পাওয়া গেছে।
যার মধ্যে ‘The Exaltation of Inanna’-ই সব থেকে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ, যার পুরোটাই অনুদিত হয়েছে।
ভূতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা এই স্তোত্রের প্রথম লাইন থেকে পুরো লিপির নামকরণ করেছেন। এই
স্তোত্রটিতে ১৫৩ লাইন রয়েছে, যার প্রথমার্ধে লেখা রয়েছে ইনান্নার বৈশিষ্ট্য ও গুণগান। আর দ্বিতীয়ার্ধে
রয়েছে যুদ্ধের দেবতা ইনান্নার ক্ষমতা। তৃতীয় অংশে রয়েছে তার নিজের যন্ত্রণার কথা। একসময়ে লুগালরা
(তৃতীয় পদাধীকারী সেনা অফিসার) তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সেই সময়ে এনহেদুয়ান্নাকে উর বা উরুক
থেকে দূরে কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। সেই সব দিনের গ্লানিকর স্মৃতি তাকে লিখতে
উদ্বুদ্ধ করেছিল। নিজের কথা লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে নারী হিসেবে তাকে কি ধরণের বাধা-বিঘ্নের
সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেসব উল্লেখ করেন এই তৃতীয় অংশে। The Exaltation of Inanna থেকে কিছু অংশ,
‘প্রিয় দেবী, তোমার যুদ্ধ-মুখরতায়, বিদেশের ভূমি নত হয়। যখন মানবিকতা নিঃশব্দ চরণে তোমার সামনে এসে
দাঁড়ায়, প্রবল তেজস্বিনী (ঝড়ের উত্থান) তুমি সমস্ত স্বর্গীয় ক্ষমতার প্রয়োগ কর। তোমারই কারণে অশ্রুর
অভিমুখ (দরজা) খুলে যাবে, আর মানুষ বিলাপের পথে হেঁটে যাবে একা (কান্নায় বা দুঃখে)। যুদ্ধক্ষেত্রে
তোমারই সামনে সব থেমে যাবে। দেবী, তোমার ক্ষমতাবলে, দাঁতের জোরে অগ্নিপ্রস্তর ভাঙা সম্ভব। তুমি
সামনে এগিয়ে যাবে উত্থিত ঝড়ের মতো। ঝড়ের সঙ্গে তুমি গর্জন করবে, লুকুরের (ঝড়ের দেবতা) সঙ্গে
অবিরাম বজ্র হানবে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শ্রান্তি ছড়িয়ে দেবে তুমি, যদিও তোমার নিজের পা থাকবে
অক্লান্ত। বিলাপমান বালাজ ড্রামের সঙ্গে এক বিলাপ শুরু হবে’।
৩
রানি যে বড় কাজগুলো করেন তা নিজের জন্য
তিনি জড়ো করেন নিজের স্বর্গ-মর্ত্য
তিনি মহান দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বী।
(শ্লোক: ১৬)
সুমেরু ভাষার ইনান্নাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার, পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত
করে এবং রোমানরা তাকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনান্নার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ
এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা/সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের
কাজ করেছেন। তার ওপর সম্রাট সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি রাজ্য নিষ্কণ্টক
রাখার জন্য এর প্রয়োজনে সুমেরু দেব-দেবীদের জায়গায় আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার
কাজটি করেছিলেন। এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে
আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায়
অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তার সমসাময়িককালে
আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। পার্শি বি শেলি বলেন, কবিতা একটি
ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার। তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।
এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পল ক্রিওয়াসজেক বলেন, ‘তার কম্পোজিশন, যদিও এই
আধুনিককালেই কেবল পুনরুদ্ধার করা হলো, সর্বকালের অনুনয়মূলক প্রার্থনার মডেল। ব্যাবিলনীয়দের
মাধ্যমে এর প্রভাব হিব্রু বাইবেলে এবং প্রাচীন গ্রিক প্রার্থনাসংগীতেও এসে পড়েছে। ইতিহাসের প্রথম কবি
এনহেদুয়ান্নার ভীরু শ্লোকগুলোর প্রভাব প্রথম দিকের খ্রিষ্টান চার্চেও শোনা যেত।’
শার্লট ডিংগেল লিখেছেন, এতদিন প্রথম নারী সমপ্রেমী বা লেসবিয়ান কবি হিসেবে আমরা স্যাফোর নাম শুনে
এসেছি। কিন্তু এই তথ্যও সঠিক নয়। তার মতে এনহেদুয়ান্নার লেখা পড়লে পাঠক নিজেই বুঝতে পারবেন
সত্যটি কী! Inanna and Ebih, Lady of Largest Heart এবং The Exaltation of Inanna এই তিনটি কবিতা
বা স্তোত্র পড়লেই ইনান্নার প্রতি এনহেদুয়ান্নার প্রেম স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এনহেদুয়ান্না লিখছেন,
“Bride of yours. I am a captive”। ইনান্নার প্রতি লিখিত তার রোম্যান্টিক ইচ্ছাগুলিকে অস্বীকার করা
যায় না কিছুতেই। এমনকি নান্নার সেবিকা হয়েও তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, “I have not said this of
Nanna, I have said this of YOU!” ইনান্না বাস্তব চরিত্র না হলেও তার প্রতি এনহেদুয়ান্নার প্রেম ও
যৌনতা ছিল গভীর।
এনহেদুয়ান্না তার লেখায় তার মতো করে ছুঁয়ে গিয়েছেন রূপান্তরকামনা বা ট্রান্সজেন্ডার ডিজ়ায়ার-এর আদি
তত্ত্বকে, “To turn man into woman, woman into man, are yours Inanna,” Lady of Largest Heart
এ এই নিবেদন ছিল তার ইনান্নার প্রতি। তিনি আরও বলছেন, “The women adorn their right side with
men’s clothing,” এবং “The men adorn their left side with women’s clothing”। সেই সময়ের সমাজে যে
উভকামী ধারণার প্রচলন ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ সেই অঞ্চল থেকে ভূতাত্ত্বিকরা খননকার্যের ফলে
অনিশ্চিত লিঙ্গধারী কিছু খোদাইকার্যও পেয়েছিলেন।
৪
অনেকগুলি ধাপ বা সিঁড়ি সমন্বিত মন্দির ‘জিগুরাত’ ছিল খুব উঁচু। গড়ে দেড়শো ফিট উচ্চতার। প্রত্যেক জিগুরাত
মেসোপটেমিয়ার এক একজন অথবা একদল দেবতা বা দেবীর নামে চিহ্নিত থাকতো। প্রধান দেবতা ছিলেন
আকাশের দেবতা আন, ঝড় ও পৃথিবীর দেবতা এনলিল, জলের দেবতা হলেন ইয়া, যাকে আবার জ্ঞানের দেবতাও
বলা হত। এই তিনজনের পরেই গুরুত্ব পেতেন চন্দ্রদেব নান্না, সূর্যদেব উতু, এবং যুদ্ধ, যৌনতা ও উর্বরতার
দেবী ইনান্না। উরের মন্দির নান্নার নামে সম্মানিত হয়েছিল। সুমেরীয় সময়ের সাংস্কৃতিক শহর উরুক ছিল
ইনান্না ও আনের নামে। পুরোহিতরা এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে ছুটে ছুটে কার্যভার সামলাতেন। সাধারণ
মানুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না মন্দিরে। তখনকার প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক প্রার্থনা মানুষের মধ্যে
মানবতাবোধ তৈরিতে সহায়ক ছিল। রাজ্যে ও সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যদিও
দেব-দেবীরা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন, অর্থাৎ রাজা বা গোত্রপ্রধানগণ ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারিতও
করতেন। তা সত্ত্বেও ধর্মই মানুষের অস্থির চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় ছিল। সেই দিক থেকে
পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে একটি নতুন দিগন্ত
উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য। তার লেখা একটা প্রার্থনা শ্লোক,
আমার দেবী, আমি ভূমণ্ডলে তোমার মহানুভবতা ও মহিমা ঘোষণা করছি
আমি চিরকাল তোমার মহানুভবতার
গুণগান করে যাব।
(শ্লোক: ১৩)
একাধারে রাজকন্যা ও পুরোহিত, এই দুই ভূমিকাই এনহেদুয়ানা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। সুমেরীয় দেবতাকে
নিজের স্বামী হিসেবে স্বীকার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল তার ও তার পিতার। ইনান্না তার পিতার
আরাধ্যা দেবী, সেই ইনান্নাকে মেসোপটেমিয়ায় মূল দেবী হিসেবে প্রচারিত করেছিলেন। পিতার মন ও মান
রেখেছিলেন এভাবে। আর নিজেকে মেলে ধরার জন্য নিজের ক্ষোভ, দুঃখ লিখেছিলেন উজাড় করে। যদিও তার
মৃত্যুর পরেই তার মেধা, পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিয়েছিল পৃথিবী।
স্যার লিওনার্ড উলি খননকার্যের সময় পাথরের গায়ে খোদাইকৃত বেশ কিছু কবিতা পান যেগুলোর নিচে
এনহেদুয়ান্নার স্বাক্ষর ছিল। সব মিলিয়ে ৪২টা মন্ত্র লিখেছিলেন এনহেদুয়ান্না। সবকটিই নান্না এবং
ইনান্না-কে উদ্দেশ্য করে লেখা। এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে সেগুলো। তার মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ তে,
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী
গ্রহণ করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন কীনা এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা
অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি
জড়াননি। পৃথিবীর কোন পুরুষের সঙ্গে তিনি সংসার পাতেননি। কিন্তু কবিতার সঙ্গে যে সংসার পেতেছিলেন,
বংশ-পরম্পরায় তা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে পৃথিবীতে,
মহীয়সী, তুমি সুমহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ
ইনানা তুমি মহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ
আমার দেবী, তোমার মহানুভবতা উদ্ভিন্ন
আমার দোহাই তোমার হৃদয় ফিরে যাক যথাস্থানে।
(শ্লোক: ১৯)
অসামান্য মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠার গুণে, সর্বোপরি দেবালয় নেতৃত্ব দেয়ার বদৌলতে তৎকালীন
আক্কাদিয়ানরা তাকে দেবীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এমনকি একসময় তাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত
হিসেবেও গণ্য করা হতো, পুরুষশাসিত বিশ্বে একজন নারী হিসেবে এটা ছিল তার ঐতিহাসিক বিজয়।
এনহেদুয়ান্না জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপন মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আজ থেকে কয়েক
হাজার বছর আগে একজন নারীর কাছ থেকেই প্রথম লেখনী পেয়েছিল বিশ্ব। উপলক্ষ্য আর সংখ্যা যাই হোক
না কেন, সেটা তো নিজের তাগিদ থেকেই লিখেছিলেন এনহেদুয়ান্না। ২০১৫ সালে তাকে সম্মান জানিয়ে বুধ
গ্রহের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় ‘এনহেদুয়ান্না’।
হদিসঃ
১। এনহেদুয়ানা- সালেক আল মাহমুদ
২। ব্রোঞ্জ সভ্যতার ইতিহাস- খন্দকার মাহ্মুদুল হাসান
৩। বিশ্বসভ্যতা- এ কে এম শাহনাওয়াজ
৪। কবি কাজী জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ
৫। ইন্টারনেট
পোস্ট ভিউঃ
14