মঙ্গল কাব্যে ইতিহাস ও সমাজচিত্র

প্রবন্ধ ছিটেফোঁটা
মঙ্গল কাব্যে ইতিহাস ও সমাজচিত্র

মঙ্গল কাব্যে ইতিহাস ও সমাজচিত্র
নিধানী করিয়া খই তথি মহিষের দই
কুলি করঞ্জা প্রাণ হেন বাসি
যদি পাই মিঠা ঘোল পাকা চালিতার ঝোল
প্রাণ পাই পাইলে আমসি।
আমার সাধের সীমা ইঙ্গিচা পলতা গিমা
বোআলি ঘাটিয়া কর পাক
ঘন কাঠি খর জ্বালে শান্তলিবে কুট তৈলে
দিবে তায় পলতার শাক।
পুই ডগি থুপি কচু ফুলবড়ি দিবে কিছু
দিবে তায় মরিচের ঝাল
হরিদ্রা রঞ্জিত কাঞ্জি উদর পুরিয়া ভুঞ্জি
প্রাণ পাই পাইলে পাকা তাল।
লাইনগুলো মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল থেকে নেয়া। কবি তার মঙ্গল কাব্যে সাধভক্ষণের যে বর্ননা দিয়েছেন তাতে বাঙালির চিরায়ত সমাজ- সংস্কৃতি- লৌকিকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সেকালে বাঙালি সমাজে গর্ভবতী নারীকে চার মাসে সীমন্তোন্নয়ন, পাঁচ মাসে পঞ্চামৃত (দই, দুধ, ঘি, মধু এবং চিনি), ছয় মাসে পরমান্ন ভোজন, সাত মাসে সাধভক্ষণ, নয় মাসে নববস্ত্র পরিধানের রীতির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তা আর সেভাবে পালন করা হয়না। সাধভক্ষণের খাবার হিসেবে সাধারণত টক, ঝাল, পিঠা-পুলি, মাছ, শাক-সব্জি, ফলমূলসহ পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করা হতো। ডঃ আহমদ শরীফের ভাষায়, ‘মুকুন্দরাম মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। ষোল- সতেরো শতকের সন্ধিলগ্নের মুকুন্দরাম, সতেরো শতকের তৃতীয় পাদের আলাওল এবং আঠারো শতকের মধ্যকালের ভারতচন্দ্র- এ যুগের পাঠকের প্রিয় কবি’।
এ লেখায় কবি মুকুন্দরামের মঙ্গল কাব্যে ইতিহাস ও সমাজচিত্র নিয়েই বলবো। মুকুন্দরামের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার রায়না থানার দামুন্যা গ্রামে। হৃদয় মিশ্র ওরফে গুণরাজ মিশ্র এবং দৈবকীর তৃতীয় সন্তান হলেন মুকুন্দরাম। মুঘল আমলেও বাঙলার অর্থনীতির প্রাণ ছিল কৃষিকাজ এবং সম্রাটের আয়ের উৎস ছিল কৃষিভিত্তিক রাজস্ব। এই রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে সম্রাট এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে হলো প্রজা। এই দুইএর মাঝে রয়েছে জায়গীরদার, জমিদার, ডিহিদার, চৌধুরী, তালুকদার, শিকদার, সরকার ইত্যাদি পদবীর রাজস্ব সংগ্রহকারী গোষ্ঠী। এই ডিহিদার’রা রাজস্ব আদায়ের নামে প্রজাদের উপরে নির্মম অত্যাচার চালাতো। এরকম একজন ডিহিদার ছিলেন মাহমুদ শরীফ, যার অত্যাচারে কবিকে ঘর ছাড়া হতে হয়েছিল। তাই তিনি তার মঙ্গল কাব্যে লিখেছেন,
অধর্মী রাজার কালে প্রজার পাপের ফলে
খিলাত পাইল মামুদ সরিপ।
উজির হইল রায়জাদা বেপারি বৈশ্যের খদা
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের হইল ঐরি
মাপে কোণে দিয়া দড়া পনর কাঠায় কুড়া
নাঞি মানে প্রজার গোহাড়ি।
সরকার হইল কাল খিল ভূমি লিখে নাল
বিনি উবগারে খায় ধুতি।
পোতদার হইল যম টাকা আড়াই আনি কম
পাই লভ্য খায় দিন প্রতি।
এখানে কবি সম্রাট আকবরের ভূমিবন্টন ব্যবস্থায় অনিয়মের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি শোষণ- নির্যাতন ও দুর্নীতির মতো অপকর্মের কথা বলেছেন। মুকুন্দরাম তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে যে শাসন ব্যবস্থা ও জমিদারী শোষণের চিত্র এঁকেছেন সে হলো, সুলতানি আমলের অবসান এবং সম্রাট আকবরের অধিকার বিস্তারের প্রথমাবস্থার ছবি। পালযুগে বৈশ্য বণিকদের রাজোচিত উত্থান এবং পরবর্তী সেন যুগে শাসকদের অযাচিত হস্তক্ষেপে বাণিজ্যের প্রসারে ভাটা পড়া এমন ঐতিহাসিক সত্যের প্রেক্ষাপটটিই উত্তরকালে সম্রাট আকবরের অধীনে বাঙলার সুবেদারি শাসনামলে বলিষ্ঠভাবে ধরা পড়েছে। ১৫৯৪ সালে বাঙলায় রাজা মানসিংহ সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে (বাঙলা- বিহার- উড়িষ্যা) কোন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মুঘল- আফগান দ্বন্দ্বে এই গোটা অঞ্চল ছিল অস্থিতিশীল। মুঘল আমলে প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ের মতো ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও শের শাহের প্রচলিত রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য যেসব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেয়া হয় কালের আবর্তে তারাই পরিণত হয় ভূস্বামীতে। মুকুন্দরাম তাই লিখেছেন,
ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজভৃঙ্গ
গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ।
সে মানসিংহের কালে প্রজার পাপের ফলে
ডিহিদার মামুদ সরিপ।।
এই ডিহিদার- পোদ্দার- উজিরে মিলে রাজস্ব সংগ্রহের নামে প্রজাদের ঘর- বাড়ি জ্বালিয়ে দিতো, লুটপাট করতো গরু- ছাগল, শস্য এমনকি স্ত্রী- কন্যাদেরকেও। ব্যক্তিজীবনের এই দুঃখ- দূর্দশার উপলব্ধি থেকে তিনি এমন একটি আদর্শ জনপদের কল্পনা করেছেন যেখানে ডিহিদারদের অরাজকতা স্থান পাবেনা। এখানে তার সঙ্গে গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ভাবনায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ ছিলেন এই প্লেটো। প্লেটো অর্থনীতির বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন তার “The Republic” এবং “Laws” বইয়ে । বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে “The Republic” প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ‘ইউটোপিয়া’র মতো মুকুন্দরামও একটি আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছেন। তার কাব্যের নায়ক কালকেতু গুজরাটে নগর পত্তন প্রসঙ্গে বুলান মণ্ডলকে বলছে,
আমার নগরে বৈস যত ভূমি চাহ চষ
তিন সন বই দিও কর।
হাল পিছে এক তঙ্কা না করো কাহার শঙ্কা
পাট্টায় নিশান মোর ধর।।
খন্দে নাহি নিব বাড়ি রয়ে বসে দিও কড়ি
ডিহিদার না করিব দেশে।
সেলামী কি বাঁশগাড়ী নানা ভাবে যত কড়ি
না লইব গুজরাট বাসে।।
এত সামাজিক অনাচার-শোষণ-বঞ্চনার মধ্যেও সেই সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছিল সুন্দর সহাবস্থান। মুকন্দরামের কাব্যে তাই মুসলমানদের সমাজের চিত্রও বাদ যায়না, তিনি লিখেছেন,
ফজর সময়ে উঠি বিছাই লোহিত পাটি
পাঁচ বেরি করয়ে নমাজ
সোলেমানী মালা ধরে জপে পীর পেগম্বরে
পিরের মোকামে দেই সাজ।
মোল্লা পড়াইয়া নিকা দান পায় সিকা সিকা
দোয়া করে কলিমা পড়িআ।
ডঃ হুমায়ুন আজাদ মুকুন্দরাম প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস। তিনি জীবনের বাস্তব দিক এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে বিস্মিত হতে হয়। তিনি ছিলেন একজন বড় দর্শক । তাঁর চারপাশে তিনি যা দেখতে পেতেন, তাই লিখতেন। এ জন্যে তাঁর কাব্যে বাস্তবের বর্ণনা খুব পরিচ্ছন্ন । মুকুন্দরামের বড় বৈশিষ্ট্য তিনি নির্বিকার। এ হচ্ছে একজন উৎকৃষ্ট ঔপন্যাসিকের গুণ’। মুকুন্দরাম তার কাব্যে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সব ধরণের লোকাচার- ঐতিহ্যের চিত্র আন্তরিকতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন শিল্পী, সমাজের প্রতি শতভাগ দায়িত্বশীল এবং মানবতার প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ- দারিদ্র্য দ্বারা তাড়িত হয়ে বাঙালির চিরায়ত অভিশপ্ত সমাজ জীবনের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন, তা তার নির্মাণ কুশলতায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছে, বর্তমান সময়েও তাই তার উপস্থিতি দেখা যায়, হয়তো কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে।
©সুমন সুবহান
হদিসঃ
১। কবি মুকুন্দরাম– ক্ষেত্র গুপ্ত
২। মঙ্গলকাব্যে বাঙালির আর্থ- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের রূপায়ণ- মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
৩। চন্ডীমঙ্গল- ডঃ অভিজিৎ মজুমদার
৪। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে লোকজীবনের স্বরূপ- আবদুল খালেক
৫। লাল-নীল-দীপাবলি- ডঃ হুমায়ুন আজাদ

পোস্ট ভিউঃ 12

আপনার মন্তব্য লিখুন