কবি জয়দেব এবং পদ্মাবতীঃ গীতগোবিন্দ’র আলোকে দেবতার মানবায়ন

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
কবি জয়দেব এবং পদ্মাবতীঃ গীতগোবিন্দ’র আলোকে দেবতার মানবায়ন

মেঘৈর্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামান্তমালদ্রুমৈ

নর্ক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।

ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং

রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ।।

উপরের লাইনগুলো গীতিকাব্য শ্রীগীতগোবিন্দ থেকে নেয়া, লিখেছেন কবি জয়দেব। জয়দেবের বিখ্যাত রচনা

গীতগোবিন্দ। এটি একটি সংস্কৃত গীতিকাব্য এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই এর মুখ্য বিষয়। মোট ৮০টি শ্লোক

এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১২ সর্গে এটি রচিত। এদের মধ্যে ৭৭টা শ্লোক বিভিন্ন বৃত্তছন্দে, একটি শ্লোক

জাতিছন্দে, অবশিষ্ট ২টি শ্লোক এবং ২৪টি গীত অপভ্রংশ ছন্দে লেখা হয়েছে। বর্ণিত বিষয়ের

তত্ত্বনির্দেশক বারোটি ভিন্ন ভিন্ন নামে সর্গগুলির নামকরণ করা হয়েছে, যেমন-সামোদ-দামোদর, অক্লেশ-

কেশব, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ-পুন্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ, নাগর-নারায়ণ, বিলক্ষ-

লক্ষ্মীপতি, মুগ্ধ-মুকুন্দ, মুগ্ধ-মাধব, সানন্দ-গোবিন্দ এবং সুপ্রীত-পীতাম্বর।কাব্যের নায়ক-নায়িকা রাধা-

কৃষ্ণ হলেও তাঁদের প্রতীকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেমই মুখ্য বিষয় হিসেবে

উঠে এসেছে।

উপরের চারটি লাইনে বর্ণনীয় বিষয় বাসন্ত রাস, যেখানে রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমের বর্ননা ফুটে উঠেছে।

কবি বর্ণনা করেছেন, আকাশ মেঘে মেদুর, বনভূমি তমালে শ্যামল, তার উপর আবার রাত্রিকাল, ভীরু

শ্রীকৃষ্ণকে সাথে নিয়ে হে রাধা তুমি ঘরে যাও। এই শ্লোকের অন্যতম রহস্য শ্রীরাধাকৃষ্ণের গোলোক লীলায়

নিত্য স্বকীয়া ও মর্ত্ত্য বৃন্দাবন লীলায় পরকীয়া ভাবের ইঙ্গিত। পিতা যেভাবে কন্যা সম্প্রদান করেন

সেভাবে ব্রম্মা কর্তৃক বিধি অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের হাতে শ্রীরাধাকে সম্প্রদান উভয়ের দাম্পত্য ধর্মকেই

প্রতিষ্ঠিত করলেও লীলাচ্ছলে পরকীয়া ভাবের আরোপ না করা হলে অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধা

নায়িকার বর্ণনা করা যায় না এবং এরফলে কাব্যের রসপুষ্টি হয়না। তাই কাব্যাংশে পরকীয়া ভাব নেয়া হয়েছে।

কেউ কেউ বলেন জয়দেব নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাদের গুরু শিষ্য পর্যায়ে একজন জয়দেবের নাম


পাওয়া যায়, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের আচার্য্যদের মতে এই জয়দেবই কবি জয়দেব। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের

আগে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ভিতরে শ্রীরাধাকে কৃষ্ণের সাথে অভিন্নভাবে পরম উপাস্য বলে গৃহীত হতে দেখা

যায়। নিম্বার্ক একজন তৈলঙ্গ ব্রাহ্মণ ছিলেন। এই সম্প্রদায় সনকাদি বা হংস সম্প্রদায় নামেও খ্যাত।

নিম্বার্ক দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ হলেও বৃন্দাবনে বাস করতেন, সম্ভবত একারণেই কৃষ্ণশক্তিরূপে গোপিনী

রাধিকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নিম্বার্কের ‘দশশ্লোকী’র পঞ্চম শ্লোকে দেখতে পাওয়া যায়,

অঙ্গে তু বামে বৃষতানুজাং মুদ্রা

বিরাজমানামনুরূপসৌভোগাম।

সখীসহস্রৈঃ পরিষেবিতাং সদা

স্মরেম দেবীং সকলেষ্টকামদাম।।

তবে কবি জয়দেব রাধা প্রেমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। এই রাধা প্রেমের মহিমা কীর্ত্তন বা শৃঙ্গার রস বর্ণনা

করতে যেয়ে তিনি লিখেছেন,

রাধাসঙ্গে যদাভাতি তদা মদনমোহনঃ ।

অন্যথা বিশ্বমোহোহপি স্বয়ং মদন-মোহিতঃ ।।

ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট লক্ষ্মণসেন ১০৯১ শকাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার মানে আলোচ্য কবি

জয়দেব শকাব্দের একাদশ শতকের শেষভাগে বর্তমান ছিলেন। সেন রাজারা কর্ণাটক থেকে এই বাংলায়

এসেছিলেন, তারা ছিলেন হিন্দু এবং সংস্কৃত ছিল দেবভাষা, জয়দেব তাই সে ভাষাতেই কাব্য রচনা করতেন। তবে

তাঁর কাব্যে সংস্কৃতের ছাপ থাকলেও, এই কাব্য আসলে দেশী ভাষায় রচিত হয়েছিল। সংস্কৃত ছন্দে রচিত

বর্ণনামূলক শ্লোকগুলো বাদ দিলে, যে রাগমূলক পদাবলী গীতগোবিন্দের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সেগুলোর ভাষা ও

ছন্দের ভঙ্গী যতোটা প্রাকৃত বা দেশী ভাষা ও ছন্দের মত ততটা সংস্কৃতের মত নয়। এমনকি পদাবলী শব্দটিও

যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তাও সংস্কৃত নয়। আসলে গীতগোবিন্দ যে সময়ে লেখা হয়েছে সে সময়টা প্রাচীন

সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় শেষ বা অবনতির যুগ, এবং অপভ্রংশ বা দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের উম্মেশ

পর্ব। সে জন্যই এই সময়ে লেখা ভাষা ও সাহিত্য পুরাতন সংস্কৃত কাব্যের নিয়মের দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত

নয়, আবার নতুন দেশীয় সাহিত্যের পূর্ণ বিকাশও তখন লাভ করে নাই। এটা দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের ওপর

সংস্কৃতের প্রভাবের ফল না, বরং সংস্কৃতের ওপরে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবের নিদর্শন।

প্রাচীন বাংলা সাহিত্য প্রধানত দুই ধারায় বিভক্ত। এরমধ্যে একটা ধারা হলো পদাবলী, আর অন্যটা হলো

মঙ্গলকাব্য। শ্রীগীতগোবিন্দকে এই দুই ধারার উৎসস্থল বলা যেতে পারে। আচার্য্য হরপ্রসাদ বৌদ্ধচর্য্যা

গানগুলোকে বাংলা ভাষার আদি রচনা বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা এই গানগুলোর রচয়িতা এবং টীকাকার রা

বাঙালি ছিলেন। টীকাকার রা এই গানগুলোকে পদ বলে উল্লেখ করেছেন। বাঙালি মঙ্গলকাব্যের রচয়িতারা সবাই

কবি জয়দেবের পরবর্তী। জয়দেব নিজে তার রচিত সাহিত্যকর্মকে পদাবলী বা ‘মধুর-কোমলকান্ত-পদাবলী’

এবং মঙ্গলউজ্জ্বলগান বা ‘মঙ্গলমুজ্জ্বল গীতি’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এজন্যই জয়েদেবকে পদাবলী এবং

মঙ্গলকাব্যের আদিকবি বলা যেতে পারে। পদাবলী মূলত ভাবপ্রধান, কোন প্রতীক বা রূপকের আশ্রয়ে

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাংখা, হৃদয়াবেগের অভিব্যক্তি। আর মঙ্গলকাব্য হলো দেবতার সাথে মানুষের

সম্বন্ধ ও বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের ঘটনা-প্রধান বাস্তব বর্ণনা।

শ্রীগীতগোবিন্দের মধ্যে এই দুই ধারার আদি সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই দুটি ধারাই পাশাপাশি

প্রবাহিত হয়েছে। বিগত প্রায় ৮০০ বছর ধরে শ্রীগীতগোবিন্দের উপরে অসংখ্য টিকা-ব্যাখ্যা লেখা হয়েছে।

ডক্টর শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘শ্রীজয়দেব কবি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গীতগোবিন্দ রচয়িতা কবি

শ্রীজয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি এবং সংস্কৃত ভাষায় সর্ব্বাপেক্ষা মধুর গীতিকবিতার


কবি বলিয়া তিনি সর্ব্ববাদী সম্মতিক্রমে সম্মানিত হইয়া আছেন। সংস্কৃত ভাষায় শ্রেষ্ঠ প্রাচীন কবিগণের

নাম উল্লেখ করিতে হইলে সহজেই তাঁহার নাম আসিয়া পড়ে, অশ্বঘোষ, ভাস, কালিদাস, ভর্ত্তৃহরি, ভারবি,

ভবদূতি, মাঘ, ক্ষেমেন্দ্র, সোমদেব, বিহ্লন, শ্রীহর্ষ, জয়দেব। বাস্তবিক নিখিল ভারত ব্যাপিয়া যাহাদের যশ

বিস্তৃত, সেই শ্রেণীর প্রধান সংস্কৃত কবিদের মধ্যে জয়দেবকে অন্তিম কবি বলিতে হয়’। এছাড়াও শিখদের

ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে (ষোল’শ শতক) জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে।

প্রথম- শ্রীজৈদেব-জীঊ কা পদা (রাগ গুঞ্জরী) ।।

পরমাদি পুরুখ মনোপিমং সতি আদি ভাব-রতং।

পরমদ্ভুতং পরক্রিতিপরং জদি চিন্তিসরব-গতং।।১।।

রহাঊ-

দ্বিতিয়- বাণী জৈদেব জীউকী (রাগ মারূ) ।।

চন্দ সত ভেদিয়া নাদ সত পূরিয়া সূর সত খোড়সা দত্তু কীয়া।

অবল বল তোড়িয়া, অচল চল থপ্পিয়া, অঘড় ঘড়িয়া, তঁহা আপিউ

দক্ষিণ ভারতের অন্যতম সাধক কবির নাম ত্যাগরাজ। তার সময়কাল ১৭৬৭/ ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দ। বাঙালি সমাজে

লালন ও রবীন্দ্রনাথের যে স্থান ও সম্মান, দক্ষিণভারতের সমাজেও ত্যাগরাজের স্থানও অনুরুপ। তার রচিত

‘প্রহলাদ বিজয়ম’ এর ভূমিকায় ত্যাগরাজ বাঙালি কবি জয়দেবকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সুদূর মহারাষ্ট্র

এবং দক্ষিণ ভারতে এখনো জয়দেবের গীত প্রচলিত আছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বিশেষ বিশেষ দিনে

দেবদাসীদের কণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দ গীত গাওয়া হয় বলে জানা যায়।

ষোড়শ শতকের সন্ত কবি নাভাজি দাস তাঁর ভক্তমাল গ্রন্থে কবি জয়দেবের প্রশংসা করে লিখেছেন,

জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ, খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আনি কবি।।

প্রচুর ভয়ো তিঁহু লোক গীতগোবিন্দ উজাগর।

কোক-কাব্য নবরস-সরস-শৃঙ্গার-কো আগার।।

অষ্টপদী অভ্যাস করৈ, তিহি বুদ্ধি বঢ়াবৈ।

রাধারমণ প্রসন্ন হাঁ নিশ্চৈ আবৈ।।

সন্ত-সরোরুহ-খণ্ড-কৌ পদুমাবতি-সুখ-জনক রবি।

জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ, খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আনি কবি।।

(কবি জয়দেব হচ্ছেন চক্রবর্তী রাজা, অন্য কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর মাত্র। তিন লোকে গীতগোবিন্দ প্রচুর

ভাবে উজ্জ্বল হয়েছে। এটা একাধারে কোকশাস্ত্র, কাব্য, নবরস ও সরস শৃঙ্গারের আগার স্বরূপ। যে এই

গ্রন্থের অষ্টপদী অভ্যাস করে তার বুদ্ধি বর্ধিত হয়; রাধারমণ প্রসন্ন হয়ে শুনেন এবং নিশ্চয় সেখানে এসে

বিরাজিত হন। সন্তরূপ কমলদলের পক্ষে তিনি পদ্মাবতী-সুখ-জনক রবি। কবি জয়দেব চক্রবর্তী রাজা, অন্য

কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর মাত্র।)

হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেকশুভোদয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থে এবং প্রচলিত জনশ্রুতিতে জয়দেব ও পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা

কাহিনী প্রচলিত আছে। সেকশুভোদয়া প্রায় পাঁচশত বছর পুর্বে রচিত হয়েছে। হলায়ূধ মিশ্রের লেখায় জয়দেব

এবং পদ্মাবতী সম্পর্কে অলীক কাহিনীটা এরকম, ‘’সম্রাট লক্ষণ সেনের সভায় একদিন একজন গুণী আসিয়া

বলিলেন- আমার নাম বুড়ণ মিশ্র। সঙ্গীত এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে আমার সমান পাণ্ডিত্য। আমি উড়িষ্যা জয়

করিয়া রাজা কপিলেন্দ্র দেবের নিকট হইতে জয়পত্র লইয়া আসিয়াছি। সেক জলালউদ্দীন সম্রাট সভায়


উপস্থিত ছিলেন। তিনি বুড়ণ মিশ্রের কথায় বলিলেন, একটা রাগ আলাপ করুন তো শুনি। মিশ্র পঠমঞ্জুরী রাগ

আলাপ করিলেন; অমনি নিকটবর্তী অস্বত্থবৃক্ষের পাতাগুলি সব ঝরিয়া পড়িল। লোকে ধন্য ধন্য করিয়া

উঠিল। বাজনা বাজিতে লাগিল, সম্রাট জয়পত্র দিতে উদ্যত হইলেন। পদ্মাবতী গঙ্গাস্নানে যাইতেছিলেন,

বাজনা শুনিয়া সভায় আসিয়া বলিলেন, আমি এবং আমার স্বামী বর্তমান থাকিতে সঙ্গীতে জয়পত্র লইবে কে?

আপনারা আমার স্বামীকে সংবাদ দিউন। সেক বলিলেন, তাঁহার কথা পরে হইবে, এখন আপনিই একটা রাগ

আলাপ করুন। সেকের অনুরোধে পদ্মাবতী গান্ধার রাগ আলাপ করিলেন, গঙ্গায় যত নৌকা নোঙর করা ছিল, সব

উজানে বহিল। সকলেই বলিল, কি আশ্চর্য্য, গাছ তো তবু সজীব, মিশ্রের গানে তাহার পাতা ঝরিয়াছে। আর এ যে

নির্জ্জীব নৌকা উজান বহিয়া চলিয়া গেল। সেক বলিলেন-আপনাদের দুই জনের মধ্যে কে জিতিয়াছেন, শাস্ত্র

বিচারে তাহা নির্দ্ধারিত হউক। মিশ্র বলিলেন- আমি স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিচার করিতে চাহি না। এ রাজ্যে

দেখিতেছি পুরুষেরা মূর্খ। এই কথা শুনিয়া পদ্মাবতী দাসী পাঠাইয়া দিলেন। সংবাদ পাইয়া কবি জয়দেব আসিয়া

সভায় উপস্থিত হইলেন।

আদ্যোপান্ত শুনিয়া জয়দেব বলিলেন, গাছের পাতা ঝরিয়া পড়িল এ আর আশ্চর্য কি? বসন্তকালে গাছের পাতা

তো আপনি ঝরিয়া পড়ে। সেক বলিলেন, তা পড়ে, কিন্তু একদিনে একসঙ্গেই তো সবপাতা ঝরিয়া পড়ে না। উত্তরে

জয়দেব বলিলেন, আচ্ছা, ঐ গাছটায় নূতন পাতা যাহাতে গজায়, মিশ্র তাহার ব্যবস্থা করুন। মিশ্র বলিলেন,

আমি পারিব না। সেক কবিকে বলিলেন, আপনি পারেন? জয়দেব বলিলেন, পারি। এই বলিয়া তিনি বসন্ত রাগ

আলাপ করিলেন, অমনি গাছটি নূতন কচি পাতায় ভরিয়া উঠিল। মিশ্র পরাজয় স্বীকার করিলেন, সভায় জয়দেবের

খুব প্রশংসা হইল’। বসন্ত রাগ এর একটা উদাহরণ,

গীতম্ ।।১৪।।

বসন্তরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে।–

স্মরসমরোচিতবিরচিতবেশা ।

গলিতকুসুমদরবিলুলিত কেশা ।।

কাপি মধুরিপুণা বিলসতি যুবতিরধিকগুণা ।। ১৩।। ধ্রুবম্ ।

হরিপরিরম্ভণবলিতবিকারা ।

কুচকলসোপরি তরলিতহারা ।। ১৪ ।।


কে এই জয়দেব?

বীরাভূঃ কামকোটী স্যাৎ প্রাচ্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা।

আরণ্যকং প্রতীচ্যন্তু দেশো দার্ষদ উত্তরে।

বিন্ধ্যপাদোদ্ভবা নদ্যঃ দক্ষিণে বহবাঃ সংস্থিতাঃ ।।

বীরভূমির প্রাচীন নাম কামকোটী। সেকালে পূর্বে গঙ্গা, পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের গভীর অরণ্য, উত্তরে রাজমহলের

পার্বত্য এলাকা এবং দক্ষিণে বিন্ধ্যপাদোদ্ভবা বহু নদ-নদী দ্বারা এর চতুর্দিকের সীমানা বোঝাত। প্রাচীন

এই এলাকা সুক্ষ্ম দেশের অন্তর্গত ছিলো। শকাব্দের পঞ্চম শতাব্দীতে এটি কর্ণ-সুবর্ণের অধীনে আসে।

পরবর্তীতে পাল রাজা এবং সেন রাজাদের অধিকারে আসে। আমাদের আলোচ্য কবি জয়দেব এই বীরভূমের কবি।

তিনি লক্ষ্মণসেনের (১১১৯-১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম, রাজকবি ছিলেন। লক্ষ্মণ

সেনের রাজদরবারের অপর চারজন কবি হলেন গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও উমাপতিধর। শ্লোকে যেমনটা

দেখা যায়,

গোবর্দ্ধনশ্চ শরণো জয়দেব উমাপতিঃ


কবিরাজশ্চ রত্নানি পঞ্চৈতে লক্ষ্ণণস্য চ ।।

কারো কারো মতে তিনি কিছুদিন উৎকল রাজেরও সভাপন্ডিত ছিলেন। জয়দেব এর আবির্ভাবের অনেক আগেই

বৌদ্ধ সহজযানের সাধনতত্ত্ব রাঢ়দেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের একটি শাখা

নিত্যানন্দের প্রভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তারা তাদের আপন সাধন পদ্ধতি পুরোপুরি

ত্যাগ করেনি। এরাই বৈষ্ণব সহজিয়া নামে পরিচিত এবং কবি জয়দেবকে তাদের আদি গুরু বলে মনে করে।

সহজযানের উৎপত্তি সম্পর্কে ডক্টর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, “বুদ্ধদেবের তিরোধানের অত্যল্প দিন

মধ্যেই তাঁহার শিষ্য-প্রশিষ্যগণ দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়েন; তাহারই একভাগ নানা শাখা-প্রশাখায়

রূপান্তরিত হইয়া কালে সহজযান সম্প্রদায়ে পরিণতি লাভ করে। প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বে বৌদ্ধদের

মধ্যে যে দুইটি দলের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার একটির নাম মহাস্থবির এবং অপরটির নাম মহাসাঙ্ঘিক। খের-

বাদিগণ বলেন বুদ্ধ আগে, তাহার পরে ধর্ম্ম এবং সঙ্ঘ। সাঙ্ঘিক দল বলেন, -না, ধর্ম্ম আগে, বুদ্ধ এবং

সঙ্ঘের স্থান তাহার পরে। লক্ষ্য করিবার বিষয়, বৌদ্ধগণ ধর্ম্মকে নারীরূপে কল্পনা করিয়া থাকেন!

শকাব্দের প্রথম শতাব্দীতে নাগার্জ্জুনের নেতৃত্বে মহাসাঙ্ঘিক দলের একাংশ লইয়া মহাযান সম্প্রদায় গঠিত

হয়। ইহারা প্রজ্ঞা (ধর্ম্ম), উপায় (বুদ্ধ), বোধিসত্ত্বের (সঙ্ঘ) উপাসক। শকাব্দের পাঁচ কি ছয় শতাব্দীতে

এই ত্রিদেবতারা, নিত্যবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বরূপে কল্পিত হন। ইহার পর ব্রজযান নামে অন্য এক সম্প্রদায়ের

সৃষ্টি হয়। শকাব্দের সপ্তম শতাব্দীতে উড়িষ্যার রাজা ইন্দ্রভূতি-স্বীয় পুত্র পদ্মসম্ভব, কন্যা

লক্ষ্মীঙ্করা এবং জামাতা শান্তরক্ষিতের সহযোগিতায় –এই সম্প্রদায়ের প্রবর্ত্তন করেন। ইঁহাদের উপাস্য

পদ্ম, বজ্র এবং বোধিসত্ত্ব। ইহারই অন্যতম শাখার নাম সহজযান। রাঢ় দেশের আচার্য্য নাড়পণ্ডিত,

পণ্ডিতপত্নী নিগু বা জ্ঞান-ডাকিনী প্রভৃতি এই সম্প্রদায়ের প্রবর্ত্তক। শূন্য, বজ্র ও বোধিসত্ত্ব ইঁহাদের

উপাস্য। শকাব্দের সপ্তম হইতে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে এই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছিল। নরনারীর মিলন-

সুখই ইঁহাদের মতে চরম ও পরম সুখ। এই সুখ-সম্ভোগের জন্য দেহতত্ত্ব লইয়া সাধনা করিয়া ইঁহারা বহুবিধ

উপায়ে সিদ্ধ হইয়া ছিলেন।” তার মতে কবি জয়দেব এই সহজিয়াদের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। সহজিয়ারা নর-নারীর

যে মিলন-সুখকে একমাত্র কাম্য বলে গ্রহণ করেছিল কবি জয়দেব শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলনকে সেই সুখের

আশ্রয়রূপে বর্ণনাপূর্ব্বক নিজেকে তার দর্শকরূপে কল্পনা করেছেন।

তার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে। কেউ কেউ তাকে

মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলে মনেকরলেও প্রকৃত সত্য হলো, তার গ্রাম কেন্দুবিল্বতে আজো প্রতিবছর

পৌষ সংক্রান্তিতে ‘জয়দেব মেলা’ বসে। এ মেলায় বাউলদের সমাবেশ এবং বাউল আখড়াসমূহ বিশেষ আকর্ষণীয়

বিষয়। শ্রীগীতগোবিন্দ হতে জানা যায় যে, তার পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী এবং তার স্ত্রীর নাম

পদ্মাবতী।

পদ্মাবতীর জন্ম দক্ষিণ ভারতে। তাকে ছোটবেলায় সংগীত ও নৃত্য শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। সেকালে গুণী কন্যাকে

দেবালয়ে উৎসর্গ করার চল থাকায় তার মা-বাবা তাকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে থাকা কালে

পদ্মাবতীর মা-বাবা দৈববানী শুনতে পান যে, জয়দেব হবেন পদ্মাবতীর স্বামী। এই প্রসঙ্গে এরকম একটা

প্রবাদ আছে, ‘দক্ষিণদেশীয় এক ব্রাহ্মণ দম্পতি বহুদিন অনপত্য থাকিয়া নিতান্ত সন্তপ্তচিত্তে

শ্রীধামপুরুষোত্তমে আসিয়া শ্রীজগন্নাথদেবের নিকট প্রার্থনা করেন, আমাদের পুত্র জন্মিলে তাহাকে

আপনার সেবকরূপে এবং কন্যা জন্মিলে আপনার সেবিকারূপে চিরতরে দান করিব। এই ঘটনার দ্বাদশ বৎসর

পরে কন্যা পদ্মাবতীকে লইয়া শ্রীজগন্নাথদেবের করে সমর্পণ মানসে ব্রাহ্মণদম্পতি পুরীধামে উপস্থিত হন।

নীলাচলনাথ তাঁহাদিগকে স্বপ্নাদেশ দেন, তোমরা কেন্দুবিল্বে গিয়া আমার অংশস্বরূপ ব্রাহ্মণ জয়দেবের করে

কন্যা-সম্প্রদান কর’। বনমালী দাস লিখেছেন-

জগন্নাথ বলিলেন-

তাহারে দেখিয়া মনে ঘৃণা না করিবে।

যেমত আমাকে জান তেমতি জানিবে।।


বাস্তবে তাই হয়েছিল। গীত ও নৃত্যপটিয়সী পদ্মাবতী জীবনভর তাই স্বামীর সঙ্গে গান গেয়েছেন এবং নেচেছেন।

ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞগণ আচার্য্য পরম্পরায় জয়দেবের নাম শ্রদ্ধা সহকারে উচ্চারণ করে থাকেন। নৃত্যগীতে

নিপুণা বলে কবি-পত্নী পদ্মাবতীর নাম সগৌরবে উল্লেখিত হয়। কবি পদ্মাবতীকে খুব ভালোবাসতেন। সংস্কৃত

ভক্তমালে বর্ণিত আছে,

উভৌ তৌ দম্পতি তত্র একপ্রাণৌ বভূবতুঃ ।

নৃত্যন্তৌ চাপি গায়ন্তৌ শ্রীকৃষ্ণাচর্চনতৎপরৌ ।।

শকাব্দ পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত কোচবিহারের কবি রাম সরস্বতীর জয়দেব কাব্যেও ভক্তমালের এই

উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়,

জয়দেব মাধবর স্তুতিক বর্ণাবে।

পদ্মাবতী আগন্ত নাচত ভঙ্গিভারে।।

কৃষ্ণর গীতক জয়দেবে নিগদতি।

রূপক তালর চেবে নাচে পদ্মাবতী।।

বীরভূমে কেন্দুবিল্ব গ্রাম আজও বর্তমান। আজও প্রতি পৌষ-সংক্রান্তিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার নরনারী

কেন্দুবিল্বে সমবেত হয়ে কবির পুণ্য-স্মৃতির উদ্দেশ্যে অন্তরের ভক্তি নিবেদন করেন। চক্রদত্ত সংস্কৃত

ভক্তমাল, নাভাজীকৃত হিন্দী ভক্তমাল এবং বীরভূমের কবি বনমালী দাসের জয়দেব-চরিত্র প্রভৃতি গ্রন্থে

জয়দেবের জীবনকাহিনী বর্ণিত আছে। অজয় নদীর একটা ঘাটকে লোকজন আজও কদম্বখণ্ডীর ঘাট বলে

থাকে। জয়দেব এই ঘাটেই রাধামাধব বিগ্রহ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কবি এই ঘাটেই অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। এই

ঘাটের বর্ণনায় বনমালী লিখেছেন,

অজয়ের তরঙ্গ বহে অতি সুশোভন।

কিনারে পুষ্পের শোভা গন্ধে হরে মন।।

বনমালী দাস ‘জয়দেব চরিত্রে’ লিখেছেন,

ভিক্ষা মেগে খায় সদা হরিনাম জপে।

হাসে কাঁদে নাচে গায় শিবের মণ্ডপে।।

কেউ কেউ বলেন কবির আরেকজন স্ত্রী ছিলেন, তার নাম রোহিণী। আবার কেউ কেউ বলেন রোহিণী আসলে

পদ্মাবতীরই আরেক নাম। তবে সহজিয়ারা বলেন রোহিণী কবির পরকীয়া।

জয়দেব মহাকবি জগতে পূজিত।

কৃষ্ণলীলা রস স্বাদু রসেতে ভূষিত।।

পদ্মাবতী সহোদরা রোহিণী নামেতে।

তারে গুরু কৈল (গোসাঞ্চী) রস আস্বাদিতে।।

তার বাক্য অনুসারে সেই সব জানি।

নহিলে জানিব কোথা অতি ক্ষুদ্র প্রাণী।।

অথবা-

‘কেন্দুবিল্ব-সমুদ্র-সম্ভব-রোহিণী রমণেন-‘


‘কেন্দুবিল্ব গ্রাম আমার সমুদ্র সমানা।

সমুদ্র সম্ভব চন্দ্র তৈছে সম জানা।।

রোহিণী নামেতে হয় চন্দ্রের বনিতা।

রোহিণী রমণ আমি হই গুপ্ত কথা।।

আবত হী যমুনা ভরে পানী।

শ্যাম বরণ কাহু কো ঢোঁটা নিরাখ বদন ঘর গঈ ভুলানী।।

উন মো তন মৈঁ উন তন চিতয়ো তবহী তে উন হাথ বিকানী।

উর ধকধকী টকটকী লাগী তনু ব্যাকুল মুখ ফুরত ন বানী।।

(যমুনায় এসেছিলাম জল ভরতে। শ্যামবর্ণ কার ছেলে, মুখখানি দেখে ঘর ভুলে গেলাম। সে আমার সর্ব তনুতে,

সমস্ত তনু ভাবিয়ে তুলল-সে থেকে তার হাতে বিকিয়ে গেলাম; আমার বুক ধকধকী-আঁখি স্থির-তনু ব্যাকুল-মুখে

স্ফুরে না বাণী!)

আবার-

সুন্দর বোলত আবত বৈন।

না জানৌ তেহি সময় সখীরী সব তন শ্রবন কি নৈঁন।

রোম রোম মেঁ শব্দ সুরতি কী নখ শিখ জ্যোঁ চখনঐন।

যেতে মান বনী চংচলতা সুনী ন সমুঝী সৈন।

তবতকি জকি হ্বৈ রহী চিত্র সী পল ন লগত চিত চৈন।

সুনহু সুর যহ সাঁচ, কী সংভ্রম সপন কিধৌ দিন রৈন।।

‘সুন্দর বচন বলে সে আসেনা;

চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১২৯ খৃস্টাব্দে মানসোল্লোস বা অভিলষিতার্থচিন্তামণি

নামে একটি সংস্কৃত কোষগ্রন্থ রচিত হয়েছিল, এই গ্রন্থের গীতবিনোদ অংশে ভারতবর্ষের সমসাময়িক

সমস্ত স্থানীয় ভাষায় রচিত কিছু কিছু গানের দৃষ্টান্ত সঙ্কলিত হয়েছে, এরমধ্যে কয়েকটা প্রাচীনতম বাংলা

ভাষায় রচিত গানও আছে। এই গানগুলোর বিষয়বস্তু গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা। এসব গানে

কয়েকটি নামের যে বিবর্তিত নাম দৃষ্টিগোচরে আসে, যেমন- কৃষ্ণ বা কাহ্ন-কানু বা কানাই, রাধিকা-রাহী-রাই,

কংস-কাংস, নন্দ-নান্দ, অভিমন্যু-অহিবণ্ণু বা অহিমণ্ণু-আইহণ, আইমন-আয়ান, নামের এই বিবর্তনের

মধ্যে বা সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের কাহিনীও সাহিত্যরূপে

আশ্রয় নিয়ে কামরূপ ও প্রাচীন বাংলায় যে প্রসার লাভ করেছিল তা বোঝা যায়।

কবিজয়দেব আপন দাম্পত্য প্রেমের মধ্য দিয়ে মানব-মানবীর ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ, সার্থক ও সুন্দরতম

প্রেমের সন্ধান পেয়েছিলেন। পদ্মাবতীই তাকে সেই প্রেমের সন্ধান দিয়েছিলেন। পদ্মাবতীর পতিপ্রেম এতই

প্রগাঢ়, এতই পবিত্র, এমনি নিষ্ঠাপূর্ণ যে ঈশ্বর তাকে জয়দেবরূপে দর্শন দিয়ে তার নারীত্বের সাধনাকে

সার্থক করেছিলেন। আসলে গীতগোবিন্দ পাঠ করলে নারী-পুরুষের মাঝে পরকীয়াভাবের স্বরূপ উপলব্ধি হয়না,

বরং অজয় নদীর তীরে আপনভোলা এক প্রণয়ী দম্পতির মধুময় চিত্র উপলব্ধি হয়। আমরা তাই অজয়

তীরবর্তী নিরালা কুঞ্জের অপূর্ব সৌন্দর্যের মাঝে দেখতে পাই প্রেমে মাতোয়ারা কবি দম্পতি- জয়দেব ও

পদ্মাবতী। অনুরাগ, অভিমান, বিরহ, মিলনের অপরূপ ঘাতপ্রতিঘাতে দম্পতি জীবন প্রণয়লীলার মধুময় ভঙ্গিমা

যেন গীতগোবিন্দের ছন্দে শ্লোকে লীলায়িত হয়েছে। আবার এরপরই মনেহয়, এ যেন অজয় নদী নয়, এ তো

কালিন্দী! কালিন্দী নদীর তীরে এ তো কেন্দুবিল্ব নয়, এ হচ্ছে বৃন্দাবন! আমরা গীতগোবিন্দ পাঠ করতে করতে


কোথায় যেন কবি দম্পতিকে হারিয়ে ফেলি, আমরা দেখি কুঞ্জে কুঞ্জে শ্রীরাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাভিনয়!

‘মনেহয় মেঘে আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছে, তমাল তরুনিকরে শ্যামায়মান বনভূমি ধীরে ধীরে গাঢ় হইতে গাঢ়তর এক

স্নিগ্ধ কৃষ্ণতায় আত্মগোপন করিতেছে, আর সেই সৌগন্ধেভরা অন্ধকার বনপথে কে যেন গাহিয়া ফিরিতেছে-

… নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃপ্রত্যধবকুঞ্জদ্রুমং

রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ।

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘রাধাকৃষ্ণের ধ্যান-কল্পনা বোধ হয় এই পর্বের বাঙলাদেশেরই সৃষ্টি

এবং কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ-গ্রন্থেই বোধ হয় প্রথম এই ধ্যান-কল্পনার সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রচলিত রুপ

আমরা দেখিতেছি’। তার মানে দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের লেখাতেই প্রথম বাস্তব রূপ পেলেন শ্রীরাধিকা।

রাধা-কৃষ্ণের প্রচলিত যুগল মূর্তিকে দেখলে তার পিছনে পদ্মাবতীর প্রভাব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জয়দেবের

দক্ষিণ ভারতীয় স্ত্রী পদ্মাবতীর অনুকরণেই হয়তো তৈরি রাধার নৃত্য মূর্তি, যেখানে কৃষ্ণ স্বয়ং কবি

জয়দেব। অর্থাৎ ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে তথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জয়দেবই প্রথম দেবতার দিক

থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের দিকে তাকালেন। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় তাই লিখেছেন, ‘অলৌকিক দেবতাদের

মানবীকরণের ইঙ্গিত তিনিই প্রথম দেন’। এ কারণেই জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দের গানগুলিকে বলা হয় মানুষের

গান। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘রাধাকৃষ্ণের বিরহ-মিলন কাহিনী অবলম্বনে রচিত জয়দেবের

গীতগোবিন্দ কাব্যটি সমধিক পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাব্যটির ওপর ৪০টিরও অধিক টীকা

রচিত হয়েছে। তা থেকে এর সর্বভারতীয় খ্যাতির পরিমাপ করা যায়।’ করুণাময় গোস্বামী লিখেছেন, ‘বাংলা

গানের ইতিহাসে, এবং বলতে গেলে ভারতবর্ষের সংগীত ও নৃত্যকলার ইতিহাসে এক অতুলনীয় স্থান অধিকার

করে আছে গীতগোবিন্দ গ্রন্থটি।’ গীতগোবিন্দম-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে চরণশেষে অন্তমিল

অনুসৃত হয়েছে, যা সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুর্লভ। এর ভাষা সহজ-সরল এবং প্রায় বাংলার কাছাকাছি।

সংস্কৃত ও বাংলার যুগসন্ধিক্ষণে রচিত বলে গ্রন্থটির ভাষা এরূপ সহজ ও বাংলার অনুগামী হয়েছে।


হদিসঃ

১। কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ- শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়

২। বাঙ্গালির ইতিহাস (আদি পর্ব) - নীহাররঞ্জন রায়

৩। শ্রী রাধার ক্রমবিকাশ (দর্শনে ও সাহিত্যে) - শশিভূষণ দাশগুপ্ত

৪। মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

৫। দেবতার মানবায়ন- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

৬। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (২য় খন্ড) - সুনীল চট্টোপাধ্যায়

৭। বাংলা গানের বিবর্তন- করুণাময় গোস্বামী

৮। ইন্টারনেট

পোস্ট ভিউঃ 11

আপনার মন্তব্য লিখুন