একজন বোহেমিয়ান কবির প্রতিচ্ছবিঃ গোলাম সাবদার সিদ্দিকী
প্রবন্ধ
ফুটনোটে জলছাপ
এ কথা তো ঠিকই
ফেরার সময় হলে যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবো।
কিন্তু তার আগে এই অন্ধকার
আলোর ভিতরে আলো
সমাজের ভালো মানুষের সমস্ত জমকালো খেলা
নারীর নিকটে গিয়ে এক আধরাত্রিবেলা
ভালোবাসা, জীবনযাপন!
.....................
পৃথিবীর কোথাও এখন আর যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, ক্ষয়ক্ষতি নেই
তাহলেই হাসতে হাসতে যে যার আপন ঘরে
আমরাও ফিরে যেতে পারি!
হাসতে হাসতে যে যার গন্তব্যে আমরা ফিরে যেতে পারি!
বোহেমিয়ান কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে নিয়ে ‘ফেরার আগে’ কবিতাটা লিখেছিলেন আরেক বোহেমিয়ান
কবি আবুল হাসান। গোলাম সাবদার সিদ্দিকী সত্যিকার অর্থে একজন বোহেমিয়ান কবি। জার্মানির বোহেমিয়া
প্রদেশের লোকদের স্বভাব হলো ঘুরে বেড়ানো। স্বভাবে যাযাবর শ্রেণীর এই মানুষদের থেকেই বোহেমিয়ানিজম
নামের ‘ইজম’-এর সৃষ্টি হয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, গায়ক সবার পালেই এই বোহেমিয়ানিজমের হাওয়া
লেগেছে। তারা মনেকরেন লিখতে, আঁকতে বা গাইতে হলে ঘর ছাড়তে হবে। মুক্ত চিন্তাবোধের উম্মেষ
বোহেমিয়ানা ছাড়া বোঝা যায়না। তারা তাদের ছন্নছাড়া- উদ্বাস্তু লাইফস্টাইলে মারিজুয়ানা, গাঁজা, এলএসডি,
এমফেটামিন ইত্যাদি মাদকদ্রব্যে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সালের দিকের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের সামনে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার নিয়ে কবি সাবদার আপত্তিকর মন্তব্য করলে
ছাত্রলীগের কর্মীরা রাগান্বিত হয়ে কবিকে কলাভবনের বারান্দায় ছাত্রলীগের কর্মীদের সাথে আলাপরত শেখ
কামালের কাছে নিয়ে যায়। তিনি কবিকে ভিড় থেকে বের করে গাড়ির পেছনে বসিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে নিয়ে যান
এবং গাড়ি থেকে নামার সময় হাতে টাকা দিয়ে বলেন, ‘এত সুন্দর কবিতা লিখেন, গাঁজা খান কেন?’ সত্তুরের
দশকে এ এক নতুন ফ্যাশন, একটা নতুন কবিতা চাই, তার সাথে চাই একটু নেশা।
তার প্রথম কবিতা ১৯৬৫ সালে সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দেশাত্মবোধক কবিতা সংকলন 'অনন্য স্বদেশ'-এ
ছাপা হয়, সে হিসেবে তিনি ষাটের দশকের কবি। দেশের উল্লেখযোগ্য কাব্যসংকলনে তিনি আজও উপেক্ষিত
হলেও তিনি আপাদমস্তক একজন প্রকৃত কবি ছিলেন। 'পা', 'গুটি বসন্তের সংবাদ', 'সোনার হরিণ' নামের
কয়েকটি ক্ষুদে কবিতা সংকলন ছাড়া তার শক্ত বাঁধাই ও পুরো মলাটের কোনো কবিতাগ্রন্থ নেই। যদিও এসব
ক্ষুদ্র কবিতা সংকলনের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সাবদার সিদ্দিকি, হয়ে উঠেছিলেন বাংলা
কবিতার নতুন এক কণ্ঠস্বর।
২
মধ্যরাতে দাঙ্গার মাতাল চীৎকার
নিঃসঙ্গ প্রদীপের মতো
কেঁপে ওঠা আমার কিশোর কলকাতা
তুমি কেমন ছিলে ইদানীং
আজকাল কেমন আছ?
কলকাতা তোমার মনে নেই? মনে নেই?
পঞ্চাশের কলকাতা?
দাঙ্গামথিত শহরের বাতাসে ধ্বনিত বিবেকের মতো তোমার, আমার জন্ম চীৎকার?
কিংবা '৬৪ দাঙ্গামথিত শহরের নগ্নভঙ্গ মৌলালীর উলঙ্গ দরগাহ
অথবা
রাজপথে নিঃসঙ্গ সুনীল ভগ্ন শঙ্খের
নিঃশব্দ নিনাদ?
.....................
তুমি আজ মুখ লুকাতে চাও কোন মুখে?
বুক পকেটে চীৎকার নিয়ে
তোমার যাদুঘরে সংরক্ষিত মমির মতো
বড়ই নিঃসঙ্গ আমি আজ।
হাওড়া ব্রীজ যেন লোহার ব্রেসিয়ার তোমার
কলকাতা, যন্ত্রের সমান বয়সী তুমি
কলকাতা, তোমার ইতিহাস
বাইবেলের পিছনে গাদাবন্দুক
বাংলা গদ্যের সমান বয়সী
আমার কিশোর কলকাতা
সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মত নিস্পৃহ তুমি আজ।
মিছিলে
ব্লডব্যাঙ্কে
টিয়ার গ্যাসের মুখোমুখি
তুমি বারবার কেঁদেছ
আমিও কেঁদেছি কলকাতা
ইয়ং বেঙ্গলের হুররে হাহহা
কলকাতা।
কবিতার নাম ‘কোলকাতা, আমি এক তরুণ মহাপুরুষ’। কলকাতার দাঙ্গা ও তৎপরবর্তী আন্দোলন সংগ্রাম
ফুটে উঠেছে আটাত্তর লাইনের দীর্ঘ কবিতায়। তীব্রভাবে প্রথাবিরোধী একজন নাগরিক কবি হিসেবে তার
পরিচিতি হয়। খুব অল্প বয়সে তার মধ্যে ঢুকেছে কবিতার ভূত। তাই প্রতিষ্ঠার হাতছানি উপেক্ষা করে
স্বেচ্ছায় বেছে নেন উপেক্ষিত কবি জীবন। কবিতায় তিনি ছিলেন খুবই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। তাই পুঁজিবাদি
সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন, নাগরিক ভণ্ডামি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন
কিছুই বাদ পড়েনি তার কবিতার বিষয় থেকে।
তিনি খালি পায়ে হাঁটতেন, পানি খাওয়ার গ্লাস সাথে রাখতেন। তিনি বিপ্লব ও সাম্যবাদের কথা বলতেন।
আক্ষরিক অর্থে তিনি সর্বহারার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। জিন্স পরতেন কিংবা পাটের চট কেটে আলখেল্লা
বানিয়ে পরতেন। কবি সাবদারকে তার সমসাময়িক ভোগি ও প্রতিষ্ঠানমুখি কবিরা এড়িয়ে চলতেন। তার লেখা
কয়েকটা কবিতার লাইন,
(১)
বলো তুমি, বলো
কোন সে অধঃপতনের দিকে
আমি এগিয়ে যাবো
দিগ্বিজয়ীর মতো।
(কোন সে অধঃপতন, পা ও অন্যান্য)
(২)
তোমার রক্ত দিয়ে ধুয়ে দাও
তোমার একান্ত ভঙ্গিতে ধুয়ে দাও
আমার আজন্ম পাপ।
আমি আসন্ন বিপ্লবের শহীদ মিনার
তোমার রক্ত দিয়ে আমায় পূত পবিত্র করে তোলো।
(তোমার রক্ত দিয়ে ধুয়ে দাও, পা ও অন্যান্য)
(৩)
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
এক একটি স্বাধীনতার সনদ।
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
পোস্টারে উৎকীর্ণ
আগ্নেয় ভাষা।
(প্রত্যেকটা কবিতাই যেনো, পা ও অন্যান্য)
৩
১৯৫০ সালে কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকী জন্ম নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার বশিরহাটে। বাবা
গোলাম মাওলা সিদ্দিকী ছিলেন আইনজীবী, তাই পরিবারের ঠিকানা ছিল মহানগর কলকাতাতে। সাবদার
সিদ্দিকীর শৈশব-কৈশোর সেখানেই কেটেছে। ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তার বাবা পুরো পরিবার নিয়ে
সাতক্ষীরায় চলে আসেন কিন্তু ১৯৭১ সালে কলকাতায় ফিরে যান।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে জাতীয়তাবাদীরা ও জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টদের একটি অংশ ভারতে
চলে যায়। কিন্তু ইপিসিপি এমএল, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল, সর্বহারা পার্টিসহ কমিউনিস্টদের
একটি বড় অংশ বাংলার জনগনের ওপর নির্ভর করে পৃথক পৃথক গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে পাকিস্তানী বাহিনীকে
দেশের বিভিন্নস্থানে আক্রমণ করে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে তারা এভাবেই গেরিলা লড়াই
গড়ে তুলেছিলেন। কবি সাবদার প্রথমে ইপিসিপি এমএলের সাথে সাতক্ষীরায় যুদ্ধে অংশ নেন। পরে তিনি তার
কমরেডদের পূর্ববাংলায় রেখে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পত্রিকা বের করেন। পত্রিকার নাম
ছিল স্বদেশ, তিনি সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে কবি সাবদার দেশে ফিরে আসেন।
কবি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৪ বছর। ১৯৯৪ সালে ঘুরতে ঘুরতে দিল্লীতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর
কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে সাতক্ষীরা সীমান্তে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানেই নাম না জানা এক গ্রামে তাকে
সমাহিত করা হয়। কবি চলে গেছেন কিন্তু তিনি পাঠকের মনে রয়ে গেছেন, কবি তার ‘স্কাইল্যাব, পা ও অন্যান্য’
কবিতায় যেমনটা লিখেছেন,
অথচ আমার ঘরে কোনো ক্যালেন্ডার নেই
কোনো ঘড়ি কাঁটা কম্পাস নেই
তালা নেই, চাবি নেই
শুধু আছি আমি আর আমার মায়াকান্না।
হদিসঃ
১। রুম নাম্বার ১৪৬- শওকত আহসান ফারুক
২। ইন্টারনেট
পোস্ট ভিউঃ
12