“দ্য এপিক অফ গিলগামেশ”- এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প।

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
“দ্য এপিক অফ গিলগামেশ”- এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প।

“তিন হাত বিস্তৃত ছিল তার পায়ের পাতা, পা ছিল তার সাড়ে পাঁচ হাত।

প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল তার ছয় হাত পরিমাপে,

......হাত পরিমাপ ছিল তার সামনের অংশের...

তার চিবুক ছিল শ্মশ্রুমন্ডিত, যেমন......

[যব খেতের মতো] ঘন নিবিড় হয়ে জন্মাতো তার মাথার চুল।

যখন দীর্ঘ হয়ে উঠেছিলেন তিনি তখন তার সৌন্দর্য ছিল নিখুঁত, 

পৃথিবীর মানদন্ডে তিনি ছিলেন সুন্দরতম পুরুষ”। 

 

কবিতায় যার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তিনি ছিলেন উরুকের রাজা, আজ থেকে সাড়ে চারহাজার বছর আগে তিনি প্রাচীন উরুক রাজ্য শাসন করেছেন। তার নাম গিলগামেশ, সুমেরীয় ভাষায় বিলগামেশ। তাকে   নিয়েই প্রায় ২১০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন লোকেরা প্রজন্মান্তরে লিখে গেছেন “এপিক অফ গিলগামেশ”। ধারণা করা হয় এর লেখক হয়তো একজন নয়। উদাহরণ স্বরূপ, বাল্মীকি রামায়ণ লিখলেও তিনি কিন্তু একাই এর রচয়িতা নন। যুগযুগ ধরে মানুষের মুখে ঘুরেফিরে এসব গল্প, আর তাতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মিলে ধীরে  ধীরে তৈরি হয় একেকটা মহাকাব্য। একই কথা হোমারের ইলিয়াড এবং ওডিসির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুগে যুগে একাধিক কবি, সভ্যতা ও সময়ের হাতে হাত রেখে রচনা করেছেন এই মহাকাব্য দুটি। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো একসময় সর্বপ্রথম তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ব্যাবিলনের  অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো যে, “এপিক অফ গিলগামেশ” বা গিলগামেশের মহাকাব্যটি গড়ে উঠেছিল শিন-লায়িক-উন্নিন্নি নামে এক ব্যক্তির নিষ্ঠা ও তত্ত্বাবধানে। গিলগামেশের কাহিনী সর্বপ্রথম পাঁচটি সুমেরীয় কবিতার মাধ্যমে শুরু হয় যা, উরুকের রাজাকে ঘিরে আবর্তিত। পরবর্তিতে পাঁচটি পৃথক কবিতার উপর ভিত্তি করে একটি মহাকাব্য রচিত হয়। মহাকাব্যের প্রথম টিকে থাকা সংস্করণ যা “পুরনো ব্যাবিলনীয়” সংস্করণ নামে পরিচিত, সেটা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি, এর অল্পকিছু ফলক টিকে আছে। পরবর্তী প্রাপ্ত সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব ১৩ থেকে ১০ শতাব্দীর। ১২ ফলকের এই সংস্করণের দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ধার হয়েছে। সবচেয়ে ভালো কয়েকটি প্রতিলিপি রাজা আশুরবানিপালের গ্রন্থাগারের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেছে।

 

প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই বিভিন্ন লেখকদের কলমে প্রাচীন অ্যাসিরীয় সভ্যতার কথা উঠে এসেছে। জানা যায় যে, সেই বিশাল সাম্রাজ্যের শেষ রাজা সার্দানাপলাস বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও অনেক দাসী পরিবেষ্টিত অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বলেন, সেই রাজার নাম আশুরবানিপাল। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্যমতে, স্বয়ং স্রষ্টার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে গেছে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য। অভিযাত্রী থেকে শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক, সবাই খুঁজে ফেরেন সেই সভ্যতা। অবশেষে ১৮৪৯ সালে উত্তর ইরাকের মসুল শহরের কাছাকাছি হারিয়ে যাওয়া এক শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সেই শহরের নাম নিনেভ, অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। ব্রিটিশ মিউজিয়াম পরবর্তী চার বছর ধরে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চালায়, প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক অস্টিন হেনরি লায়ার্ড। একসময় তিনিই আবিষ্কার করেন রাজা আশুরবানিপালের হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন গ্রন্থাগার। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্যানুযায়ী, এই আবিষ্কারের ফলে ৩০,০০০ ট্যাবলেট উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ১২টি ট্যাবলেট মিলে লেখা হয়েছে গিলগামেশ মহাকাব্য, যার ১১তম টিতে মহাপ্লাবন-এর কথার উল্লেখ আছে। ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মমতে যা নূহ (আঃ) এর সময়  হয়েছিল। এছাড়াও ট্যাবলেটগুলোতে এনুমা এলিশ—ব্যাবিলনবাসিদের দৃষ্টিতে পৃথিবী, স্বর্গ ও নরক সৃষ্টির উপাখ্যান লেখা আছে।

 

ঐতিহাসিকরা মনে করেন গিলগামেশ ২৯০০-২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সুমেরীয় শহর উরুকে রাজত্ব করেছিলেন। প্রাচীন প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্টেফানি ডেলি”র মতে ২৮০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি রাজত্ব করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে টুমাল ইন্সক্রিপশন আবিষ্কৃত হয়। এই ইন্সক্রিপশনের ভাষ্যমতে, গিলগামেশ উরুকের চারপাশে একটি দেয়াল তুলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গিলগামেশ মহাকাব্যে এই দেয়াল নির্মাণ এবং এই সময় প্রজাদের প্রতি তার অত্যাচারের (অতিরিক্ত কাজ করানো, চাপ দেয়া ইত্যাদি) কথা বলা হয়েছে। গিলগামেশের সমসাময়িক কিশ-এর রাজা এন্মেবারাগেসিও গিলগামেশকে উরুকরাজ বলেছেন। কিশ হলো সুমেরের এক পার্বত্য রাজ্য। এছাড়া পাথরে খোদাই করা সুমেরিয়ান রাজাদের তালিকায়ও গিলগামেশের নাম পাওয়া যায়। এই তালিকা মতে গিলগামেশ ১২৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী তার মৃত্যুটা ছিল ইচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া। তার নির্দেশে ইউফ্রেতিস নদীর প্রবাহ আটকে নদীর বুকে পাথরের সমাধিগৃহ তৈরি করে সেখানে মৃত্যুর অপেক্ষায় একটা বিশাল পাথরের ওপরে তাকে জীবিত অবস্থায় শোয়ানো হয়েছিল। তারপর সমাধিটা বন্ধ করে নদীর জল ছেড়ে দেয়া হয়েছিল এবং সেভাবেই তার সলীল সমাধি হয়। ওটাই ছিল উরুকে পাওয়া একমাত্র পাথরের ঘর।

 

গিলগামেশ মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসির প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে যা রচিত হয়েছিল। এই মহাকাব্য আবর্তিত হয়েছে প্রাচীন নগরী উরুকের রাজা, গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুকে ঘিরে। দেবতা, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক ও অমরত্বের সন্ধান ইত্যাদি উঠে এলেও, এই মহাকাব্যের মূল কথা দু”জন প্রায় দেবতা ও প্রায় বনমানবের মানুষ হয়ে ওঠা নিয়ে। বন্ধুত্বের জন্য মৃত্যুকে পরাজিত করার প্রচেষ্টা নিয়ে। কিন্তু মৃত্যুকে কি হারানো যায়? মানুষ কি পেতে পারে অমরত্ব? এই মহাকাব্যে উঠে এসেছে একটি সভ্যতা ও সমাজের জীবনদর্শন, মানবিকতা, শুভ ও অশুভের ব্যবধান ইত্যাদি।

 

প্রাচীন দক্ষিণ মেসপটেমিয়া অঞ্চলে ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে উরুক রাজ্য গড়ে উঠেছে। ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টপূর্ব ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে এই নগরীর পত্তন হয়েছে। এই রাজ্যের রাজা গিলগামেশ। তিনি প্রচণ্ড সাহসী, সুপুরুষ এবং বীরযোদ্ধা। তার দুই- তৃতীয়াংশ দেবতা এবং এক-তৃতীয়াংশ মানুষ।

 

“কে বলতে পারতো দাঁড়াতে তার রাজোচিত অবস্থানের প্রতি?

কে বলতে পারতো গীলগামেশের মতো, “দেখো, এই আমি হলাম রাজা”?

জন্মের প্রথম দিন হতে তার নাম ছিল গিলগামেশ

তার দুই তৃতীয়াংশ ছিল দেবতার এবং এক তৃতীয়াংশ মানবের।

মহাদেবতাদের অঙ্কনশিল্পীরা এঁকেছিল তার দেহকাঠামো,

স্বর্গের নাদিম্মাদ করেছিল নিখুঁত তার শরীরকাঠামো”।

অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার দেবদেবীদের মতো সুমেরীয় দেবদেবীগণও মানুষের সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হতে দ্বিধাবোধ করতেন না। মানুষের শরীরে জন্ম দেয়া বা জন্ম পাওয়া নিজেদের সন্তানদেরকে আংশিক দেবত্ব বিতরণ করতেও কার্পণ্য করতেন না। গিলগামেশ-এর বাবা উরুকের ধর্মযাজক লুগালাবান্দা আর মা দেবী নিনসাল। মায়ের দিক থেকে তার দেহে দেবত্বের ধারাটি এসেছে বলে মানুষ হয়েও তিনি অমর ও অপ্রতিরোধ্য। প্রজারা তাকে রাজ্য রক্ষা ও সুনাম ধরে রাখার জন্য রাজা হিসেবে পছন্দ করলেও তার খামখেয়ালি ও অত্যাচারে তাদের জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। বলা হয় যে, কেউ বিয়ে করতে চাইলে নববধূকে আগে রাজার সাথে কিছুদিন কাটাতে বা তার সেবা করতে হতো। রাজা সন্তুষ্ট হলেই কেবল বধূ ফিরে যেতে পারতো নিজের সংসারে।

 

কোনও প্রচেষ্টা ছাড়াই তিনি নাকাল করতেন উরুকের তরুণদের,

কোনও পুত্রকেই মুক্তভাবে পিতার কাছে যেতে দিতেন না গিলগামেশ।

দিনে ও রাতে তার একনায়কত্ব হয়ে উঠেছিল কঠোরতর,

গিলগামেশ, [বর্ধিষ্ণু মানুষজনের পথ প্রদর্শক!]

উরুক রাজ্যের রক্ষাকর্তা এক মেষপালক ছিলেন তিনি,

[কিন্তু গিলগামেশ] কোনও বালিকাকেই [মুক্তভাবে যেতে দিতেন না ওদের] মায়ের কাছে।

[ওদের কান্না] মহিলাদের, [এক যন্ত্রণা হয়ে দেখা দিয়েছিল দেবীদের কাছে]

[ওদের অভিযোগের ডালা] নিয়ে এসেছিল ওরা [তাদের সামনে]

[যদিও শক্তিমান, ও অবিসংবাদী] কুশলী ও মহাপরাক্রমশালী,

[গিলগামেশ] কোন তরুণীকেই কুমারী হয়ে ওর [হবু বরের কাছে] যেতে দিতেন না।

বীরযোদ্ধাদের কন্যারা, তরুণ যুবকের জন্য মনোনীত কনে,

সবার অভিযোগের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেন দেবীগণ।   

 

গিলগামেশ মহাকাব্য অনুযায়ী, দেবরাজার নাম আনু। তার মন্দির ছিল উরুকে। রাজ্যের প্রজারা সেখানে গিয়ে তার কাছে বিচার চাইলে তিনি দেবী অরুরুকে ডাকলেন। দেবী অরুরু তাকে তৈরি করেছিলেন, তাই তাকেই গিলগামেশের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করতে বলা হলো।

 

অরুরুকে ডেকে আনে ওরা, ওই মহান জনকে:

“আপনি, হে অরুরু, সৃষ্টি করেছিলেন [মানবসভ্যতা]

এখন আবার সাজিয়ে দিন ওভাবে, যা প্রত্যাশা করেছিলেন দেবতা অনু!

“তার হৃদয়-ঝড় প্রশমণের জন্য একজন জুড়ি দিন তাকে,

প্রতিযোগিতা করুক তারা, যেন শান্তি পায় উরুক!”

দেবী অরুরু শোনেন ওদের সব কথা,

প্রত্যাশা করে যা সাজিয়েছিলেন দেবতা অনু তার ভেতর।

 

অরুরু গিলগামেশের মতো করে তৈরি করলেন এক বনমানুষ, এনকিদু। পার্থক্য বলতে, এনকিদুর সারা শরীর পশুদের মতো লোমে ঢাকা। তাকে তিনি ছেড়ে দিলেন বনে। বিশাল অরণ্যে প্রকৃতি ও পশুদের সঙ্গে সবার চোখের আড়ালে এনকিদু বড় হতে থাকলো। কিন্তু এনকিদুকে এক শিকারী দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যান। তবে তিনি বুঝতে পারেন, প্রাণীটি মানুষ হলেও সে তার “মানুষ” পরিচয় জানেনা।

 

রাজা গিলগামেশের কাছে এনকিদু”র খবরটা পৌঁছে যায় কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস করলেন না। এনকিদু”কে প্রলোভিত করে শহরে আসার জন্য প্ররোচিত করা হয়।  

 

“তুমি খুব সুন্দর, এনকিদু, এক দেবতার মতো তুমি! 

কেন ওই পশুদের সঙ্গে বুনোভাবে ঘুরে বেড়াও তুমি?

এসো, তোমাকে নিয়ে যাব আমি ওই মেষখামার উরুকে,

পবিত্র মন্দিরে, অনু ও ইস্তারের ঘরে,

“যেখানে গিলগামেশ শক্তিমত্তায় একেবারে খাঁটি,

বুনো ষাঁড়ের মতো প্রভুত্ব করে সে মানুষের ওপর।”  

ওভাবে কথা বলে সে ওর সঙ্গে এবং ওগুলো গ্রহণ করে এনকিদু,

প্রকৃতিগতভাবে সে জানতো, একজন বন্ধু খোঁজা দরকার ওর।

 

এনকিদু শহরে এসে লোকমুখে গিলগামেশের অত্যাচারের কথা জানতে পারে। এক লোক বিয়ে করতে চাচ্ছিলো, তিনিই নববধূর ব্যাপারে গিলগামেশের নিয়মের কথা এনকিদুকে জানালেন। বললেন, তিনি বাধ্য হয়ে উরুকে রাজার অনুমতি নিতে যাচ্ছেন। সবটা শুনে এনকিদু তার সাথে উরুকে এসে গিলগামেশের মুখোমুখি হলেন। তাদের মাঝে প্রচণ্ড লড়াই বেঁধে গেল। একসময় তারা বুঝলেন, তারা দেখতে প্রায় একইরকম, সাহস ও বীরত্বেও তাই।

 

ওরা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে এবং ......

ওদের হাত দুটো [আঁকড়ে ধরে] ...

গিলগামেশ ...

এনকিদুকে একটি কথা [বলে]

“কেন, বন্ধু আমার, [তোমার চোখ দুটো] ভরে উঠেছে [অশ্রুতে]

তোমার বাহু দুটো ঝুলে পড়েছে, [উবে গেছে তোমার শক্তিমত্তা?]”

এনকিদু ওকে বলে, [গিলগামেশকে]

“আমার বন্ধু, আমার হৃদয় সন্তপ্ত... 

“দুঃখ-যন্ত্রণায় [আমার পা দুটো] কাঁপছে,

আমার হৃদয়ে ভীতি প্রবেশ করেছে।”

 

তাদের মাঝে লড়াই থেমে গেল এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। যে বন্ধুত্বের জন্য গিলগামেশ একদিন পাড়ি দেবেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, জানতে পারবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যটির কথা।

 

বন্ধু এনকিদুকে নিয়ে গিলগামেশ বের হলেন অভিযানে। গিলগামেশ তার মুখ খোলেন, এনকিদুকে বলেন,

 

“...... দুধর্ষ হুম্বাবা,

......[এসো] ওকে ণীঢোণ করি আমরা, [যাতে ওর ক্ষমতা] আর না থাকে!

“সিডার বনে, [যেখানে হুম্বাবা] দ্বৈতযুদ্ধে লড়ে,

চল ওকে আতঙ্কিত করি আমরা ওর আশ্রয়স্থলে!”

 

তিনি দৈত্য হুম্বাবাকে হত্যা করে নিজের কীর্তি রেখে যেতে চান। এই দৈত্যকে অরণ্য রক্ষায় নিয়োজিত করেছিলেন দেবতারা। গিলগামেশ সেসবের তোয়াক্কা না করে দেবী মায়ের সাহায্যে সূর্যদেবের আশীর্বাদ আদায় করে নিয়ে হুম্বাবাকে হত্যা করলেন। 

 

এ সময় দেবী ইনান্না বা ইস্তার তাকে বিয়ের প্রস্তাব ও প্রলোভন দেখান। কিন্তু উরুক নগরের যোদ্ধাদের নেতৃত্বে থাকা রাজা গিলগামেশ এতটাই আত্মম্ভরী হয়ে উঠেছিলেন যে ওই সময়ে ইয়ান্না মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী ইনান্নার কাছে নৈবেদ্য প্রদান করতে গেলে দেবী ইনান্না বা ইস্তার গিলগামেশের কাছে প্রণয় প্রস্তাব দিলে দেবীকে গিলগামেশ অপমান করেন।

 

“আসো, আমাকে বলতে দাও [তোমাকে ওই কাহিনীগুলো] তোমার প্রেমিকদের-

যার ...... বাহুতে।

ডুমুসি, তোমার যৌবনকালের প্রেমিক”

বছরের পর বছর, তোমার শোক বহনের দন্ড দিয়েছ ওকে।

“তুমি ভালোবেসেছিলে ফুটিফুটি আল্লাল্লু-পাখিকে,

অথচ ওকে আঘাত করে নিচে নামিয়ে এনেছ এবং ওর পাখা ভেঙ্গে দিয়েছ-

             ..............................

“তুমি ভালোবেসেছিলে ইসুল্লানুকে, তোমার পিতার মালিকে,

যে তোমার কাছে নিয়ে আসতো ঝুড়ি ভরতি খেজুর,

তোমার প্রতিদিনের খাবার টেবিলকে করতো তৃপ্তিকর।

তোমার চোখে রেখেছিলে ওকে এবং গিয়েছিলে ওর সঙ্গে মিলিত হতে।   

 

ইনান্না মন্দিরের পুরোহিতদের সমঝোতা প্রস্তাব, ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়া, গিলগামেশের সাথে ইনান্নার বৈবাহিক প্রস্তাব ইত্যাদি উদ্যোগ ব্যর্থ হলে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে দেবী ইস্তার গিলগামেশকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। দেবী ইস্তার রেগে তার পিতা দেবরাজ আনুর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে,

 

দেবী ইস্তার [শোনে] ওই কথাগুলো,

সে [উঠে যায়] স্বর্গে এক হিংস্র উম্মত্ততা নিয়ে। 

[কাঁদতে কাঁদতে] সে যায় ওর পিতা, অনুর কাছে,

ওর মা, অন্তুর কাছে, তার চোখ থেকে ঝরছিল সকরুণ অশ্রুধারা:

“হে পিতা, বারবার আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে গিলগামেশ,

বলেছে নোংরা কলঙ্কের এক কাহিনী,

কলঙ্কে ঘিরেছে আমাকে, এবং তিরস্কারেও।” 

অনু ওর মুখ খোলে বলার জন্য,

দেবী ইস্তারের কাছে বলার জন্য-

“আহ, কিন্তু ওটা কি তুমি ছিলে না যে রাজা গিলগামেশকে প্ররোচিত করেছিল,

যেন সে নোংরা কলঙ্কের এক কাহিনী বলে,

কলঙ্ক দেয় তোমাকে ঘিরে এবং দেয় তিরস্কারও?”

 

ইস্তার ওর মুখ খোলে বলার জন্য,

ওর বাবা, অনুর কাছে বলার জন্য-

“আমার পিতা, দয়া করে দাও আমাকে, স্বর্গের ওই ষাঁড়টিকে,

যেন আমি বধ করতে পারি গিলগামেশকে ওর বসবাসের জায়গায়!

 

দেবী ইস্তার গিলগামেশকে শায়েস্তা করার জন্য পিতা অনুর কাছে স্বর্গীয় ষাঁড় চাইলেন। কিন্তু গিলগামেশকে আক্রমণ করার সময় এনকিদু স্বর্গীয় ষাঁড়টি হত্যা করলো। একারণে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে দেবতারা গিলগামেশকে শাস্তি দেয়ার জন্য তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষটিকে মেরে ফেললো।

 

“[আমাদের যৌথ শক্তিতে আমরা বেয়ে উঠেছিলাম] পর্বতগুলোর চড়াই,

[ধরাশায়ী] ও হত্যা করেছিলাম স্বর্গের [বৃষভটিকে]

[ধ্বংস করেছিলাম হুম্বাবাকে, যে] দ্বৈত যুদ্ধে নেমেছিল সিডার [অরণ্যে।]

হত্যা করেছিলাম [পর্বতে যাতায়াতের পথের সিংহগুলোকে]”

“[আমার বন্ধু, যাকে আমি ভালোবাসতাম এত প্রিয়ভাবে]

[যে আমার সঙ্গে ছিল] প্রতিটা বিপদে,

“[আমার বন্ধু, যাকে আমি ভালোবাসতাম এত প্রিয়ভাবে]

[যে আমার সঙ্গে] ছিল প্রতিটা বিপদে-

[“সর্বনাশা মরণশীলতা পরাস্ত করেছে তাকে।]

[ছয়দিন] ও [সাত রাত্রি] ধরে আমি কেঁদেছি ওর জন্য।

[আমি ওর শরীর সমাহিত করার জন্য] তুলে দেইনি,

[যে-পর্যন্ত না একটা কীট বেরিয়ে এসেছিল] ওর [নাক থেকে।]

“[তখন আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম যে আমাকেও মরে যেতে হবে]

ভয়ার্ত [হয়ে উঠেছিলাম] আমি মৃত্যুতে, [এবং এভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি] বনে-জঙ্গলে।

 

প্রকৃত বন্ধু এনকিদুর মৃত্যুতে গিলগামেশের মানসিক শক্তি ভেঙ্গে পড়েছিল এবং তিনি নিজেও মৃত্যুভীতিতে মুষড়ে পড়েন। কেননা দেবীর গর্ভজাত হলেও তিনি মরণশীল মানুষ। মূলত বন্ধু এনকিদুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রথম পর্ব শেষ হয়।  

 

দ্বিতীয় পর্বে প্রিয়বন্ধুকে পুনর্জীবিত করতে গিলগামেশ পথে নামলেন। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে উতা-নাপিস্তি  নামে এক জ্ঞানী বৃদ্ধলোক থাকেন যিনি মহাপ্লাবনেও মারা যাননি বলে তিনি শুনেছেন। তিনি নাকি অমরত্বের রহস্য জানেন। তার কাছ থেকে এই রহস্য জানতে শুরু হলো গিলগামেশের দীর্ঘ এক যাত্রা। বিশাল অরণ্য, পাতাল থেকে শুরু করে আকাশ ছোঁয়া মাশুপর্বত পেরিয়ে তিনি পৌঁছলেন মৃত্যুসায়রের পাড়ে। সেই বৃদ্ধ উতা-নাপিস্তি”র নৌকার মাঝি উর-শানাবি ছাড়া আর কেউ এই নদী পেরোতে পারেনা। উর-শানাবি বললেন, তিনি ওকে পার করাবেন না। ভেলা ও বৈঠা তৈরি করে তাকে নিজেকেই পার হতে হবে। তবে যে বৈঠা একবার পানি স্পর্শ করবে, তা আর ওঠানো যাবে না। এরপর অনেক কষ্ট করে গিলগামেশ উতা-নাপিস্তির কাছে হাজির হলো কিন্তু জ্ঞানী বৃদ্ধ জানালেন, মৃত্যু থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।  মহাপ্লাবনের সময় শুধুমাত্র দেবতা ইয়ার দয়ায় তিনি বেঁচে গেছেন। উতা-নাপিস্তি গিলগামেশ-এর কাছে মহাপ্লাবন এবং মহাপ্লাবন শেষে তিনি কিভাবে বেঁচে গেছেন সে গল্প বলেন,  

 

ছয় দিন ও [সাত] রাত্রি

ঝড়ো বাতাস বইছিল, আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি,

ঘূর্ণিবাত্যা, মহাপ্লাবন, স্থলভূমির সবকিছু সমতল করে দিয়েছিল।

“কিন্তু যখন সপ্তম দিন যখন আসে,

ঝড়োবাতাস থেমে যায়, মহাপ্লাবনের সমাপ্তি ঘটে।

মহাসমুদ্র শান্ত হয়ে ওঠে, সন্তান জন্ম দেওয়া প্রসূতির মতো,

ঝঞ্ঝা স্থির হয়ে যায়, মহাপ্লাবনের সমাপ্তি ঘটে।

“আমি আবহাওয়ার দিকে তাকাই, ওটা ছিল শান্ত ও স্থির,

কিন্তু সকল মানুষ পরিবর্তিত হয়েছিল কাদামাটিতে।

বন্যার উপরিতল ছিল একটা ঘরের ছাদের মতো সমতল।

একটা ঘুলঘুলি খুলি আমি, আমার চিবুকে সূর্যালোক আছড়ে পড়ে।

             .....................

এক দিন ও দ্বিতীয় দিন, নৌকাটিকে নিমুশ পর্বত শক্ত করে ধরে রাখে,

ওটাকে আর নড়তে দেয় না।

তৃতীয় দিন ও চতুর্থ দিন, নৌকাটিকে নিমুশ পর্বত শক্ত করে ধরে রাখে,

ওটাকে আর নড়তে দেয় না।

পঞ্চম দিন ও ষষ্ঠ দিন, নৌকাটিকে নিমুশ পর্বত শক্ত করে ধরে রাখে, 

ওটাকে আর নড়তে দেয় না।

সপ্তম দিন আসে যখন,

একটা ঘুঘু বের করে আনি আমি, ওটাকে ছেড়ে দিই-

ঘুঘুটা উড়ে চলে যায় কিন্তু ফিরে আসে আবার,

ওর বসার মতো কোনও জায়গা ছিল না তাই সে ফিরে আসে আমার কাছে।

একটা সোয়ালো পাখি বের করে আনি আমি, ওটাকে ছেড়ে দিই-

সোয়ালোটা উড়ে চলে যায় কিন্তু ফিরে আসে আবার,

ওর বসার মতো কোনও জায়গা ছিল না তাই সে ফিরে আসে আমার কাছে।

একটা দাঁড়কাক বের করে আনি আমি, ওটাকে ছেড়ে দিই-

দাঁড়কাকটা উড়ে চলে যায়, ওটা দেখতে পায় পানি কমছে,

খাবার খুঁজে পায় সে, আকাশে ওঠানামা করতে থাকে, এবং আর ফিরে আসে না আমার কাছে।

একটা নৈবেদ্য সাজিয়ে আনি আমি, চতুর্বাছুর প্রতি উৎসর্গ করার জন্য, 

পর্বতের চূড়ায় সুগন্ধি রাখি আমি।

 

বন্ধুর শোকে কাতর গিলগামেশকে দেখে উতা-নাপিস্তির স্ত্রী”র ভীষণ মায়া হলো। তিনি স্বামীকে তিরস্কার করায় উতা-নাপিস্তি একসময় গিলগামেশকে বলেন কিভাবে সমুদ্রের গভীর তলদেশে এক বৃক্ষসদৃশ প্রবাল জন্মায়, যেটার রয়েছে পুনর্জীবন দেয়ার গুণাবলী। তিনি বললেন,

 

“তুমি এখানে এসেছ, হে গিলগামেশ, অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে,

কী দেবো তোমাকে আমি তোমার বাড়ি ফেরার পথে?

প্রকাশ করতে দাও আমাকে, হে গিলগামেশ, খুব গোপন একটা বিষয়,

তোমার কাছে [বলবো] আমি [দেবতাদের] একটা রহস্য।

একটা গাছ আছে যেটা [দেখায়] এক বাক্স-কাঁটার মতো,

এর কাঁটাগুলো বুনো গোলাপের কাঁটার মতো, এবং কাঁটার [খোঁচা খাবে যে এটা তুলবে।]

কিন্তু এ গাছটা যদি তোমার কাছে থাকে,

[তুমি আবার ওই অবস্থা ফিরে পাবে যেমন ছিলে তুমি যৌবনে।]

 

গিলগামেশ বন্ধুকে পুনর্জীবিত করার জন্য তৎক্ষণাৎ বৃক্ষসদৃশ প্রবাল সংগ্রহ করেন,

 

যেই মাত্র গিলগামেশ শুনেছে যা তিনি বলেছেন,

তিনি খোলেন একটা [পথ] ...

[পায়ে] বাঁধেন তিনি ভারী পাথর,

এবং ওটা নামিয়ে নেয় তাকে নিচের দিকে ... মহাসাগরের তলদেশে।

গাছটা পেয়ে যান তিনি, ওটাকে টেনে [উপড়ে ফেলেন, এবং উপরে উঠিয়ে আনেন]

[তার পা হতে] ভারী পাথরগুলো কেটে ফেলেন তিনি,

এবং সমুদ্র তাকে তীরে ছুড়ে দেয়।

 

এরপর গিলগামেশ এবং উর-শানাবি উরুকের পথে পা বাড়ালেন। ফেরার পথে এক দীঘির পাড়ে বৃক্ষসদৃশ প্রবাল রেখে গিলগামেশ গোসল করতে নামলেন। এমন সময় একটা সাপ এসে প্রবালটা খেয়ে ফেলে। গিলগামেশ গোসল সেরে উঠে দেখেন দীঘির পাড়ে সাপের মৃত খোলস পড়ে আছে, প্রবালটা খেয়ে নবযৌবন পেয়ে সেই সাপ চলে গেছে।

 

তখন গিলগামেশ বসে পড়েন ও কাঁদতে থাকেন,

তার চিবুকের নিচ দিয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিল।

... [তিনি বলেন] নৌ-চালক উর-শানাবির কাছে-

“[কার জন্য] উর-শানাবি, আমার বাহুগুলো এমন পরিশ্রান্ত,

কার জন্য আমার হৃদয়ের রক্ত শুকিয়ে গেছে?

নিজের জন্য তো কোনোও পুরস্কার খুঁজে পাইনি আমি,

“পৃথিবীর সিংহের” [জন্য] একটা অনুকম্পা করেছিলাম আমি!

 

ক্লান্ত, পরাজিত এবং পরিশ্রান্ত গিলগামেশ উরুক ফেরেন। পথে একজন উরুকবাসীকে এনকিদুর কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “কে সে?” গিলগামেশ বুঝতে পারেন তার বন্ধু মারা গেছেন এবং কেউ তাকে মনে রাখেনি। বিখ্যাত জার্মান কবি ও ঔপন্যাসিক রাইনের মারিয়া রিলকে গিলগামেশ মহাকাব্যকে বলেছেন, “epic about the fear of death”। অনন্ত জীবনের প্রতি মানুষের অশেষ আকুতি, মৃত্যুকে জয় করার জন্য একজন মানুষের অকল্পনীয় ও নির্ভীক সংগ্রাম, মরণশীলতাকে জানার জয় অভূতপূর্ব ও বীরোচিত সব কর্মকান্ড, সনাতন জীবনের গতিবিধি অনুসন্ধান, এবং চূড়ান্তে প্রত্যক্ষ করা যে, একজন মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে কেবল তার পেছনে রাখে যাওয়া ভাল কীর্তির মাধ্যমে। 

 

হদিস:

১। গিলগামেশ (অনুবাদ ও সংকলন) - কামাল রাহমান 

২। গিলগামেশ মহাকাব্য- মোহাম্মদ জামান

পোস্ট ভিউঃ 5

আপনার মন্তব্য লিখুন