পাঠ প্রতিক্রিয়া- ষোলো

ব্লগ পাঠ প্রতিক্রিয়া
পাঠ প্রতিক্রিয়া- ষোলো

পাঠ প্রতিক্রিয়া- ষোলো  

 

বইয়ের নাম: ১৯৭১ শিলিগুড়ি সম্মেলন  

অনুবাদ: নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ      

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন  

প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা ২০২৪  

মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা   

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৮৮  

গ্রন্থের প্রকৃতি: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল    

 

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে দু’’টা সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় আর অন্যটা একই বছরের ৫ ও ৬ জুলাই তারিখে শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সম্মেলনে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়, আর দ্বিতীয় সম্মেলনে প্রবাসী সরকারের সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৪০০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রবাসী সরকার অনেক সংকট ও দ্বন্দ্বের সমাধান করে ক্ষমতা সুসংহত করা হয়। উভয়  সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সমন্বয় গতিময় করেছিল মুক্তিযুদ্ধকে। এই সম্মেলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ‘‘মুক্তিফৌজ’’ নাম পরিবর্তন করে ‘‘মুক্তিবাহিনী’’ নামকরণ। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে কর্নেল ওসমানী নাম পরিবর্তনের এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।   

 

শিলিগুড়ি কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক। কারণ শিলিগুড়ি কনফারেন্সেই আওয়ামী লীগ দলীয় নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ৭০-এর নির্বাচিত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্যগণ মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং অনুমোদন প্রদান করে। এই কনফারেন্সে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ঐতিহাসিক প্রস্তাবে অধিকৃত বাংলাদেশকে হানাদার বাহিনী মুক্ত করার লক্ষ্যে যে কোন কার্যকর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করার নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

 

৫ জুলাই তারিখে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ জুলাই তারিখে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে    

বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলে। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে তার বক্তৃতায় রাজনৈতিক নেতা এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য দূর করার উপরে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ওয়ার কাউন্সিল গঠন, বাংলাদেশকে কয়েকটা জোনে ভাগ এবং জোনগুলোকে সেক্টর ও সাবসেক্টরে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। তার সেদিনের তেজস্বী ভাষায় বক্তৃতা উপস্থিত শ্রোতাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তৃতায় বলেন স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে না, দেশ পরিচালনা করবে গণতান্ত্রিক সরকার। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর মিজানুর রহমান চৌধুরী তার বক্তব্যে প্রতিরক্ষা নীতিমালা ঢেলে সাজানোর এবং নিয়মিত বাহিনীর আদলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোমার প্রস্তাব দেন। একজন অসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে সামরিক বিষয়ের উপরে তার আলোচনা বেশ গুরুত্ব বহন করে। প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একান্তভাবে নিজেদের দায়িত্ব এবং নিজেদেরই তা অর্জন করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেন আওয়ামী লীগ প্রাথমিকভাবে সশস্রে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে যুদ্ধের আগে দলে সামরিক নেতৃত্ব ও সামরিক সংগঠনের কোন কাঠামো তৈরি করা হয়নি। সার্বিকভাবে বলতে গেলে শিলিগুড়ি সম্মেলনের সফল সমাপ্তিতে আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল ও কলহ আপাতদৃষ্টিতে শীতল হয়ে যায় এবং দলে ভাঙ্গন এড়ানো সম্ভব হয়। সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সরকারকে স্বস্তি এনে দেয় এবং দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি প্রদান করে। এই সম্মেলনে একটি ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর করে ঘোষণা করা হয় যে, অধিকৃত বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ তাদের নিজনিজ নির্বাচনী এলাকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে জনগণের নির্বাচিত এই প্রতিনিধিগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে এবং এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার। এই ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক দলিল। 

 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরকে শিলিগুড়ি সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের পক্ষ থেকে বাংলাভাষী ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্র সম্মেলনের প্রশাসনিক দিক দেকভাল করেছিলেন। এছাড়াও ৩৩ কোর সদর দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে কর্মরত লে কর্নেল কে এ মজুমদার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ৬৪৭ ফিল্ড সিকিউরিটি সেকশনে কর্মরত ক্যাপ্টেন এ ডি সুর্ভে

সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই সম্মেলন শেষে দাপ্তরিক প্রয়োজনে যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন এই বইয়ে সেসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে। সম্মেলন শুরু হওয়ার পূর্বমুহুর্তে মিজানুর রহমান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে ১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, ধারণা করা হয় যে সেটাই তিনি সম্মেলনে বিবৃতি আকারে পাঠ করেন। এই বইয়ে সেই বিবৃতিটাও সংযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক অন্যান্য বইয়ের সাথে এই বই নিঃসন্দেহে যেকোন লাইব্রেরীর র‍্যাককে সমৃদ্ধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের একটি সম্পূর্ণ অনালোচিত অধ্যায়কে এভাবেই পাঠকের সামনে তুলে ধরার কারণে প্রথমা প্রকাশকে ধন্যবাদ। এর আগে এভাবে এই সম্মেলনের নথিপত্র-তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য ছিল না।

 

বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা হিসেব করলে দামটা ২০০ টাকার মধ্যে হলে যুক্তিসঙ্গত হতো।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে মানানসই চমৎকার প্রচ্ছদ। প্রিন্টিং এবং বাঁধাই এর মান ভালো।

সংগ্রহে রাখার মতো একটা বই।

 

হ্যাপি রিডিং

শুভ কামনা নিরন্তর।

সুমন সুবহান।

 

 



পোস্ট ভিউঃ 17

আপনার মন্তব্য লিখুন