পাঠ প্রতিক্রিয়া-
উনিশ
বইয়ের নাম: আগস্ট
আবছায়া
লেখক: মাসরুর আরেফিন
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি
২০১৯
দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি
২০১৯
মুদ্রিত মূল্য: ৮০০
টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩২৮
সাইজ: রয়েল (বইয়ের
স্টান্ডার্ড সাইজ থেকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একটু বড়)
গ্রন্থের প্রকৃতি:
সমকালীন উপন্যাস
প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ
১
বর্তমানে বইটির কততম
মুদ্রণ চলছে তা জানা নেই তবে আমি দ্বিতীয় মুদ্রণ কিনেছিলাম। এরপর বইটা কয়েকবছর র্যাকে
পড়েছিল। অবশেষে এবারে চারদিনের পূজার ছুটি বইটা পড়ার সুযোগ করে দিল। এমনিতে ঐতিহাসিক
জনরার উপন্যাস পড়তে বেশি পছন্দ করি। ‘‘আগস্ট আবছায়া’’ নামটা পড়ে মনেহয়েছিল এটা হয়তোবা
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের উপরে লেখা। পড়ার পর এককথায় যেটা মনেহলো, এটা ১৫ আগস্টের
হত্যাকাণ্ডের উপরে লেখা একটা মেদবহুল উপন্যাস। উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসের নায়ক ঢাকার
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তার ভাবনার জগতে গাছপালা-পাখি-মানুষ-ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্য-কাফকা-রাজনীতি
ইত্যাদি যা যা খাপছাড়া ভাবে খেলা করে লেখক তাই প্রবন্ধের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। এরফলে
পাঠককে পড়ার সময় বারবার হোঁচট খেতে হয়। আমি নিজেও অনেকবার খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, উপন্যাস
নাকি সাহিত্য সমালোচনা নাকি প্রবন্ধ পাঠ করছি বলে বিভ্রম হয়েছিল। কেন যেন মনেহয় উপন্যাসের
নায়ক, অধ্যাপক সাহেবের মুখ দিয়ে লেখক আসলে পাঠককে জ্ঞান বিতরণ করেছেন।
মাসুদ রানা পড়া জেনারেশন
থ্রিলার বা ফিকশনের মাঝে তথ্য খুঁটিয়ে আহরণ করতে অভ্যস্ত, তবে তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত
নয় বলে সেসব থ্রিলার কখনো একঘেয়ে লাগেনা। একইকথা
ইয়ান ফ্লেমিং, ড্যান ব্রাউন বা সিডনি শেলডনের ফিকশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু এই
উপন্যাসে তথ্যগুলো এমনভাবে গলাধঃকরণের চেষ্টা করা হয়েছে যে তা একঘেয়ে লেগেছে। অনেক
তথ্যই এসেছে অযাচিতভাবে, যেন তথ্যটা দেয়ার জন্যই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। এরফলে
একজন পাঠক হিসেবে উপন্যাসের যে রস তা সঞ্চয় করতে বাধাগ্রস্থ হতে হয়। লেখক অনেকবার মূল
বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে গেছেন, খানিকক্ষণ রাশিরাশি মুক্তার মতন জ্ঞান ছড়িয়ে আবার আগের
জায়গায় ফিরে এসেছেন। এটা ভালো লাগেনি। পাঠক যখন তার হাতে কোন গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধের
বই হাতে নেন তখন তার মানসিক প্রস্তুতি সেরকমই থাকে বলে মনেকরি।
‘‘আগস্ট আবছায়া’’
উপন্যাসের মূল জায়গায় যদি আসি, পনেরো আগস্টের ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকে শুরু করে পরের
কয়েকটা দিনের ঘটনা এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। লেখক বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে যেভাবে
ঘটনার বর্ণনা করেছেন এবং সেসব দিনের পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া যেরকম নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ
করেছেন তা এককথায় অসাধারণ। এখানে লেখকের যে মুনশিয়ানা তা সাম্প্রতিক অনেক লেখকের লেখার
মাঝে খুঁজে পাইনা। বিশেষ করে বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে (২০৩-২৫১ পৃষ্ঠা) বর্ণনা করা ঘটনা
চোখের সামনে যেন সেলুলয়েডের ফিতেয় দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে, এখানে লেখক, উপন্যাসের
নায়ক এবং পাঠক যেন মিলেমিশে একাকার! যেন রুদ্ধশ্বাসের সাথে অপেক্ষমাণ প্রতিটি ঘটনার
পরম্পরা!
২
উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে
আমরা দেখি লেখকের মত অধ্যাপকের কাফকা গল্পসমগ্র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, দ্বিতীয়
খণ্ডের লেখালেখি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কাজে মুম্বাই গেলে ট্যাক্সি ড্রাইভার আইয়ারের
সাথে অধ্যাপকের পরিচয় ঘটে। কথাপ্রসঙ্গে আইয়ার তাকে ১৫ আগস্ট তারিখের হত্যাকাণ্ড নিয়ে
অনুভুতি ব্যক্ত করে। আইয়ারের মুখে মুম্বাইয়ের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দিনে মাত্র দু’’ঘণ্টা
ঘুমিয়ে সারাদিন রাতভর ছুটে চলার দুঃসহ গল্প, পাম ক্রিক বিচে দু’’দিন পরপর ভেসে ওঠা
লাশের ভীতিকর ঘটনা উপন্যাসের নায়ককে শিহরিত করে কিন্তু বিদায়ের মুহুর্তে আইয়ারকে বখশিস
না দেয়ায় তার মাঝে গ্লানিবোধ কাজ করে। এই গ্লানি তার মনে অপরাধবোধ জাগায়।
প্রতিবছর আগস্ট মাস
এলে অধ্যাপকের মানসিক জগতে একধরণের আচ্ছন্নতা কাজ করে। আসলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বপরিবারে
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তিনি এটা কোনোভাবেই মেনে
নিতে পারেন না। আগস্ট এলেই তার আচরণে ভিন্নতা আসে, তিনি দিকভ্রান্ত ঘুড়ির মত দিশেহারা
হয়ে পড়েন। এই টানাপড়েন কিংবা মানসিক অন্তর্দ্বন্দ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি তাকে
তাড়িয়ে ফেরে। মানসিক অন্তর্দ্বন্দের সাথে আইয়ারকে বখশিস না দেয়ার গ্লানি তার ভেতরটাকে
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দেশে ফিরে বন্ধু মাসুম ও নূর হোসেনকে মুম্বাই সফরের গল্প
বলতে গিয়ে আইয়ারকে মোটা অংকের বখশিস দেয়ার মিথ্যে কথা বলে তিনি গ্লানি থেকে নিস্তার
পেতে চাইলেও তা আসলে তার মাঝে প্রবল অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলে।
৩
উপন্যাসের পাতায় পাতায়
দর্শন-যুক্তিবিদ্যার গুমোট হাওয়ায় মাঝে মাঝেই একপশলা বৃষ্টির আমেজ নিয়ে আসে অধ্যাপকের
দুই প্রেমিকা। তাদের একজন অধ্যাপকের ছাত্রী মেহেরনাজ হায়দার, তেজস্বী এই মেয়েকে অধ্যাপক
ভালোবাসেন, কোনরকমের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তারা শারিরিকভাবে মিলিত হন। তবুও নিজের অবাধ
যৌনতা নিয়ে মেহেরনাজের অকপট স্বীকারোক্তি অধ্যাপককে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ করে
দেয়। মেহেরনাজ অধ্যাপককে তাড়া দেন কাফকা গল্পসমগ্রের অনুবাদ শেষ করতে, কিন্তু অনুবাদের
কাজে মনোযোগ না দিয়ে তিনি হাতে তুলে নেন ফরাসি সাহিত্যিক প্রুস্তকে। মানসিক প্রশান্তির
খোঁজে তিনি চিন্তার নানান সুতো ধরে চলে যান তুর্গেনেভে। অন্যদিকে সুরভী ছেত্রি, নেপালি
প্রেমিকার দীর্ঘ ইমেইল তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনেন। সুরভী একইসাথে প্রচণ্ড অভিমানী এবং
জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের মিশেলে প্রেমিকের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন নারী, অথচ অধ্যাপকের
মনে তার জন্য শারীরিক আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্যকোন অনুভূতি কাজ করেনা। অথচ বন্ধুর প্রাক্তন
স্ত্রী লুনা’’র আহবান তিনি অবলীলায় উপেক্ষা করতে পারেন। অধ্যাপক নিজের প্রেমিক সত্ত্বাকে
অস্বীকার করে তিনি নির্মোহ হতে চাইলেও প্রেমিকাদের জন্য তীব্র অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে
অক্ষম, চতুর্থ অধ্যায়ে যেটা ফুটে ওঠে। তারপরও আগস্ট কেন্দ্রিক আচ্ছন্নতা তাকে প্রতিনিয়ত
তাড়িয়ে বেড়ায়, যেন এ থেকে তার মুক্তি নেই।
৪
উপন্যাসের দ্বিতীয়
অধ্যায়ে ইব্রাহিমের আগমন অন্য মাত্রা যোগ করে। অধ্যাপক ইব্রাহিমকে ‘‘আদি পিতা’’ বলে
সম্বোধন করেন। রগচটা স্বভাবের এই মানুষটা একজন অস্ত্র বিক্রেতা হলেও প্রবল
ভাবে ইতিহাস সচেতন। ইব্রাহিম এবং অধ্যাপক, এই দু’’জনের পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত যুক্তি-তর্ক-বিতর্ক
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের নানাদিক পাঠকের সামনে উম্মোচিত করতে থাকে। লেখক ইব্রাহিমের
মুখ দিয়ে
হত্যার প্রেক্ষাপট
তুলে ধরেন। আর উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়ে হত্যাদৃশ্য চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই
অধ্যায়ে পরাবাস্তবতার স্পর্শে অধ্যাপকের চোখের সামনে, এবং এভাবেই পাঠকের সামনেও পরিষ্কার
হতে থাকে ১৫ আগস্টের ঘটনার পূর্ববর্তী মুহূর্তগুলো। অধ্যাপক এভাবেই ১৫ই আগস্ট তারিখে
শেখ মুজিব ও তার পরিবারের হত্যা এবং তার প্রেক্ষিতে ১৬ আগস্টে তারিখে গোটা দেশের সার্বিক
অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন।
আগেই বলেছি এই উপন্যাসের
জমাট এবং ঘোরলাগা অংশ তৃতীয় অধ্যায়। এই অধ্যায়ে অধ্যাপক পরাবাস্তব দৃষ্টিতে ১৯৭৫ সালের
আগস্ট মাসে চলে যান, বিশেষ করে আগস্টের ১৪ থেকে ১৬ তারিখ। মেজর ফারুক, রশিদ, ডালিম,
নূর, খন্দকার মোশতাকসহ অন্যরা মিলে কীভাবে হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট রচনা করেন তা অধ্যাপক
দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ
থেকে শুরু করে ঘটনার খুঁটিনাটি বিরাট ক্যানভাসে লেখা হয়েছে। শ্রমসাধ্য এই কাজটা করতে
গিয়ে লেখককে কি পরিমাণ বইপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রতিটা
চরিত্রের যার যেটা পাওনা তা বর্ণনায় কিংবা সংলাপের আবহে মিটিয়ে দিতে তিনি কার্পন্য
করেননি।
উপন্যাসের সবচেয়ে
স্পর্শকাতর অংশ শেখ মুজিব ও তার পরিবারকে ৩২ নাম্বারের বাড়িতে ঢুকে হত্যার ঘটনাটুকু।
লেখক মাসরুর আরেফিনের দুর্দান্ত লেখনীতে পাঠকের কাছে রীতিমতো দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিতে
বাধ্য হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা। তা যেমন মর্মস্পর্শী, তেমনি হৃদয় বিদারক। এরপর ১৬ আগস্ট
তারিখের সার্বিক পরিস্থিতি যথেষ্ট প্রজ্ঞার সাথে বর্ণিত হয়েছে। মেদবহুল এই উপন্যাসের
বাঁধন এই পর্যন্তই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু চতুর্থ অধ্যায়ে তা যেন মাত্রাছাড়া। হঠাৎ করেই
পরাবাস্তব জগত থেকে অধ্যাপক ফিরে আসেন কঠিন বাস্তবতায়, আরেক ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে
অধ্যাপকের বসবাসরত এলাকা বসুন্ধরা এক বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। তিনি এই শব্দকে সাধারণ
ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। একেকজন এই ঘটনাকে একেকভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রেমিকা মেহেরনাজ
এরসাথে নেপালের ভূমিকম্পের সংযোগ খোঁজেন। প্রসঙ্গ আসে আমেরিকা, ইসরাইল, কোরিয়া কিংবা
র বা আইএসআই-এর। বাস্তব-পরাবাস্তব জগত থেকে এই অধ্যায়ে সায়েন্স ফিকশনের জগতে ঢুকে পাঠকদের
নতুন আরেক আবহের মুখোমুখি হতে হয়। এ অধ্যায়ে নতুন যেসব চরিত্রের আগমন ঘটে তারা কেমন
যেন অস্পষ্ট, ভাসা-ভাসা। এরফলে কেমন খাপছাড়া অনুভুতি হয়। এজন্য উপন্যাসের পূর্বের তিন
অধ্যায়ের সাথে এই অধ্যায়ের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্বল এই অধ্যায়টা মানুষের টেইল
বোনের মত উপন্যাসের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে, অথচ তা না থাকলেও সমস্যা ছিল না। কারণ উপন্যাসের
২৫১ পৃষ্ঠার মধ্যেই যা বলবার তা বলা হয়ে গেছে, এরপরের ৭৭ পৃষ্ঠা পাঠকের পকেট খালি করা
ছাড়া কিছু করেনি। কেননা এই ৭৭ পৃষ্ঠা বাবদ আনুমানিক দু’’শ টাকা পাঠককেই বহন করতে হয়েছে।
৫
লেখক যে একজন ভালো
অনুবাদক তার ছাপ প্রথম অধ্যায়ে পাওয়া যায়, দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাস্তবতা এবং তৃতীয় অধ্যায়ের
পরাবাস্তবতা মিলে ‘‘আগস্ট আবছায়া’’ একটা আলাদা ধরণের উপন্যাস। উপন্যাসের কিছুকিছু অংশে
মানবজীবনের অর্থ-অনর্থের দর্শন বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে ভাবনার খোরাক জোগায়। এই ভাবনার
সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সুন্দর প্রচ্ছদ উপন্যাসটিকে আকর্ষনীয় করেছে।
প্রথমার বাঁধাই বরাবরের
মতই চমৎকার এবং বইয়ের ঝকঝকে প্রিন্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
সবাই ভালো থাকবেন।
হ্যাপি রিডিং।
শুভ কামনা নিরন্তর।
সুমন সুবহান।
পোস্ট ভিউঃ 16