পাঠ প্রতিক্রিয়া- বিশ

ব্লগ পাঠ প্রতিক্রিয়া
পাঠ প্রতিক্রিয়া- বিশ

পাঠ প্রতিক্রিয়া- বিশ  

 

বইয়ের নাম: আড়িয়াল খাঁ

লেখক: মাসরুর আরেফিন

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ  

প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২২     

দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০২২

মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা     

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৭৬    

সাইজ: ডেমি সাইজের হার্ড কভার বই  

গ্রন্থের প্রকৃতি: সমকালীন উপন্যাস 

প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল      

 

আমি ‘‘আড়িয়াল খাঁ’’ উপন্যাসের দ্বিতীয় মুদ্রণ কিনেছিলাম, সেটার ওপরই লিখতে যাচ্ছি। এর আগে লেখক মাসরুর আরেফিন-এর ‘‘আগস্ট আবছায়া’’ উপন্যাসের রিভিউ লিখেছিলাম, অনেকেই সেটা পছন্দ করেছেন। তবে এরমাঝে লেখকের ‘‘আন্ডারগ্রাউন্ড’’ উপন্যাসটা পড়লেও ব্যস্ততার কারণে রিভিউ করা হয়নি। লেখকের এটি সম্ভবত চতুর্থ উপন্যাস এবং এটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে জেনেছি। ওনার ‘‘আগস্ট আবছায়া’’ উপন্যাসে যেমন ১৫ আগস্টে শেখমুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীরভাবে আবিষ্ট একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপকের মনের অনুভূতির প্রকাশ দেখি। তেমনি ‘‘আড়িয়াল খাঁ’’ উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ ১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরের সন্ধ্যাকে ঘিরে আবর্তিত। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়কালকে ধারণ করেছে এই উপন্যাস। উপন্যাসের পাতায় নৌ-পুলিশ নৌকা থামিয়ে জাহেদকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘তুমি কি জানো দেশের পেরসিডেন্ট কোথায়? আর তিনি যদি নিহত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তার কবর কোথায়?’’ কারণ তার ধারণা প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রামে মারা যাননি। তিনি বৃষ্টির মধ্যে পালিয়ে এসেছেন তারই কাটা লাখুটিয়ার খালে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ ও ভাবনার প্রকাশে এভাবেই তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানব মনের জটিলতা উঠে এসেছে।  

 

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জাহেদের চোখে দেখা পৃথিবী ভীষণ বিপজ্জনক, সে তার বাবা কাশেম সাহেবের সাথে আড়িয়াল খাঁ নদীতে ভ্রমণে গিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসে এক নতুন উপলব্ধির মুখোমুখি হয়। কেননা নৌকায় ওঠার ঠিক আগে ফোরকান উদ্দিন নামের এক লোক তাকে বলেন, ‘‘ওই ঘটনাডা নৌকায় কাউরে বলছ তো, জানবা যে—তোমার বাবার লগে নদীতে আইজ রাতে তুমিও ফিনিশ।’’ কোন ঘটনা? বিদ্যুৎ বিশ্বাস নামে একজন তাকে বলেছেন, ‘‘ছুডো মিয়া, তাইলে বাপের লগে তুমিও মরতে যাও? ভরা বরোষায়?’’ উপন্যাসে মানবিক সম্পর্ক, ভয়, শঙ্কা, আশা এবং মানুষের ভেতরের নৈতিক সংকটকে তুলে ধরা হয়েছে।

 

 

জাহেদ তেরো বছরের এক কিশোর, সে তার বাবার সাথে বরিশালের হিন্দু-অধ্যুষিত ভাটিখানা থেকে আড়িয়াল খাঁ নদীর দিকে যাত্রা করে। তার এই যাত্রাপথে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের নানা দিক, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস, লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি উঠে আসে। জাহেদের মনোজগৎ দখল করে রাখা মালেক হুজুরের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার ফুটে উঠেছে। তিনি জাহেদকে বলেছেন, ‘‘তুমি নদীর জ্বলেন্ত পানি ধরবা আর কিছুই পাইবা না, পিরথিবি তো এত্তো ফালতু হয় নাই।’’ যাত্রাপথে তাই সে বোতল সাথে লুকিয়ে রাখে। আমরা দেখি লক্ষণ দাস সার্কাসের জোকার ঈমানের মতো কিছু মানুষের চাওয়া-পাওয়ার জগতটা খুবিই সীমিত। ওমর আলি, ফোরকানউদ্দিন, বামন হায়দার, পারভিন, নাঈম, রিকশাওয়ালা শামছু, রাজা ভক্তি মিশ্র, বিদ্যুৎ বিশ্বাস, জাকারিয়া কানিজ, লেনজা ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক উপন্যাসের পাতায় পাতায় একটা সময়কে দারুণভাবে ধারণ করেছেন। এই মুন্সিয়ানা দেখাতে লেখক তার নিজস্ব এক গদ্যশৈলী ব্যবহার করেছেন, এটা হয়তো সেরকম ঝরঝরে নয় তবে পাঠককে উপন্যাসের পাতায় আটকে রাখতে যথেষ্ট। তার ভাষা সরলবোধ্য হলেও গভীরতা সম্পন্ন এবং প্রতীকী। ‘‘আগস্ট আবছায়া’’ কিংবা ‘‘আন্ডারগ্রাউন্ড’’ উপন্যাসে প্রচুর রেফারেন্স ব্যবহার করে লেখকের জ্ঞানের গভীরতা দেখানোর বিষয়টা এই উপন্যাসে অনুপস্থিত। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার উপন্যাসে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।  

 

উপন্যাসে শিশু যৌন-নিপীড়ন, অবাধ যৌনতা, সমকামিতা এবং বিকৃত যৌনতার মতো সংবেদনশীল ও বিতর্কিত বিষয়গুলো উঠে এসেছে, যা বাংলা সাহিত্যে অনেকক্ষেত্রে অনুপস্থিত। অনেকেই হয়তো একারণে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন কিন্তু এই উপন্যাস বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষের অস্তিত্বসংকট, বাস্তবতার বিচিত্র রূপ এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এখানে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসটা শুধু একটি সময়ের দর্পণ নয়, বরং মানবিক সমাজের জটিলতাকে উন্মোচন করার একটি প্রচেষ্টা। 'আড়িয়াল খাঁ' মাসরুর আরেফিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা পাঠককে আমাদের দেশের  একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার মধ্যে টেনে নিয়ে যায় এবং একই সাথে গভীর দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। উপন্যাসের কিছুকিছু অংশে মানবজীবনের অর্থ-অনর্থের দর্শন বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে ভাবনার খোরাক জোগায়। এই ভাবনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সুন্দর প্রচ্ছদ উপন্যাসটিকে আকর্ষনীয় করেছে।  

   

বইয়ের বাঁধাই চমৎকার। ঝকঝকে প্রিন্ট প্রশংসার দাবী রাখে।

 

সবাই ভালো থাকবেন। হ্যাপি রিডিং।

শুভ কামনা নিরন্তর।

সুমন সুবহান।



পোস্ট ভিউঃ 18

আপনার মন্তব্য লিখুন