পাঠ প্রতিক্রিয়া-
সতেরো
বইয়ের নাম: রেখায়ন
সম্পাদনায়: শওকত আহসান
ফারুক, ফখরুল ইসলাম রচি এবং রেজা সেলিম।
প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি
২০২৩
মুদ্রিত মূল্য: ৭০০
টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৯২
গ্রন্থের প্রকৃতি:
স্মৃতিচারণ
প্রচ্ছদ: রাগীব আহসান
১
১৯৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের
‘‘দেশ’’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় ঢাকা শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাংলা নামকরণের উপরে
একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে ‘‘একটি সাইনবোর্ড লেখার দোকানের নাম রেখায়ন হলে তার
প্রশংসা না করে পারা যায় না!’’ লাইনটা যে প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে ছাপানো হয়েছিল তার নাম
‘‘রেখায়ন’’। কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইয়ের তালিকা ঘাঁটলে বিচিত্র
বিষয়ের উপরে লেখা বইয়ের উপস্থিতি চোখে পড়ে। যা শ্রেণিভেদে পাঠকের রুচি, চাহিদা এবং
অনুসন্ধিৎসু মনের ভাবনার খোরাক যোগায়। এদিক থেকে আমাদের দেশের প্রকাশনী হাউজগুলো যে
একটু পিছিয়ে আছে এটা স্বীকার করতেই হবে। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত
‘‘রেখায়ন’’ একটা ভিন্ন মাত্রার সংযোজন। শুধুমাত্র একটি নাম্বার প্লেট, সাইনবোর্ড, ব্যানারের
দোকানের নাম ‘‘রেখায়ন’’ নয়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কিছু তরুণদের ভাবনাবিলাস আর প্রথার
বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছু করার সাহসী পদক্ষেপ হলো রেখায়ন। শিল্প-সাহিত্যঘেষা এই প্ল্যাটফর্মের
আড্ডায় সেসময়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিত কোন মুখ বাদ যায়নি। আড্ডার অংশীদের আড্ডাস্মৃতিকে
মলাটবন্দি করার এই প্রয়াস অতুলনীয়। বইয়ের পাতায়-পাতায় নস্টালজিয়া, সেসময়ের কিছু তারুণ্যদীপ্ত
মানুষ, পরবর্তীতে যারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহীরুহে পরিণত হয়েছেন তাদের স্মৃতিকথা
ভিত্তিক এই বইটা একটা বিশেষ সময়কে ফ্রেমবন্দি করেছে।
২
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, এর মাত্র দশদিন পর, ২৬ ডিসেম্বরে রাগীব আহসান নামে একজন
টগবগে তরুণ সোয়া তিনটাকা দিয়ে একটা কালো এবং একটা সাদা রঙের কৌটা কিনে শাহবাগ বিপণি
বিতানের পশ্চিম পাশের ল্যাম্পপোষ্টে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ঢেউটিনে লেখা থাকে
‘‘এখানে বাংলায় গাড়ির নম্বর প্লেট লেখা হয়, ৩৪ শাহবাগ বিপণি বিতান’’, সেই থেকে রেখায়নের
যাত্রা শুরু। ১২ ফুট বাই ১৪ ফুটের একটা ছাপড়া দোকান, সেখানে বাসা থেকে আনা একটা চেয়ার
আর চায়ের টেবিল দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর পড়ার টেবিল, তিনটা কাঠের চেয়ার আর একটা টুল
সেখানে নতুন সংযোজন। পরবর্তীতে পার্টিশন দিয়ে দু’’ভাগ করে একটা ঝাপ লাগিয়ে নিলে ছাপড়াটা
দোকানের রূপ নেয়। যার সামনের অংশটা দোকান কেন্দ্রিক আড্ডাস্থল আর পেছনের অংশটা বিভিন্ন
তৈজসপত্র, রঙের কৌটা, নেমপ্লেট, টিন ইত্যাদি রাখার জন্য তৈরি হলেও সেটি বিশ্রাম, নিষিদ্ধ
ধোঁয়াটানা ও তরল পাগলা পানি উপভোগের জন্য ব্যবহৃত হতো। রেখায়নের কর্ণধার রাগীব আহসান
এসব খেতেন না তবে এই অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হতো। রেখায়নের আড্ডাটা এভাবেই প্রতিদিন
সকাল ৯টা থেকে পর্যায়ক্রমে রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত চলতো। পাশের মান্নানের রেস্টুরেন্ট
ছিল চা, সিগারেট, সিঙ্গারার অফুরন্ত উৎস। কেউ কখনো জানতে চায়নি বিলটা কিভাবে শোধ হচ্ছে।
তবে অধিকাংশ সময় রাগীব আহসানকেই সারাদিনের বিল পরিশোধ করতে হতো।
৩
সেসময়ে আব্দুল্লাহ
আবু সায়ীদ স্যারের বাসায় কণ্ঠস্বর কেন্দ্রিক আড্ডার বাইরে ঢাকার বিখ্যাত সাহিত্য বা
কবিদের আড্ডাগুলো পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং, স্টেডিয়ামের ম্যারিয়েটা, গুলিস্তানের
রেক্স রেস্তোরা, নিউমার্কেটের মনিকো রেস্তোরা,
শাহবাগ বিপণি বিতানের সিনোরিটা ও মৌলী নামের স্ন্যাক্সের দোকান, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন
ইত্যাদি কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু রেখায়নের আড্ডাটা ছিল সার্বজনীন, সব পেশা-নেশার গুণী
মানুষদের মিলনমেলা। রেখায়নের মর্যাদা, সুনাম এবং জনপ্রিয়তার কারণে সাপ্তাহিক বিচিত্রা
এবং রোববার ম্যাগাজিনে সেসময় প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। জনপ্রিয় অভিনেতা আফজাল হোসেন
বিটিভিতে ‘‘আপন প্রিয়’’ নামে তার উপস্থাপিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের একটা পর্বে রেখায়নের
ঈদকার্ড প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন। রেখায়নে মুখরোচক রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি সমকালীন
সাহিত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, টিভি, মঞ্চনাটক নিয়ে আড্ডা হতো। সেই আড্ডায় ভার্সিটির
তরুণ কবি-লেখক থেকে শুরু করে সদ্যখ্যাতিমান কবি, শিল্পী, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, শাহবাগস্থ
রেডিওর ঘোষক, খবর পাঠক, চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মী, নব্য ব্যবসায়ী, তরুণ ছাত্ররাজনীতিবিদ,
এনজিও কর্মী, এডফার্মের কপিরাইটার প্রমুখ অনেকেই যোগ দিতেন। আবার কেউ কেউ সিরিয়াসলি
কিছুই করেন না, স্রেফ আড্ডাবাজ ছিলেন। এই আড্ডাকে কবি সৈয়দ আহমাদ তারেক এভাবে সংজ্ঞায়িত
করেছেন, ‘‘সকালের ভার্সিটির ক্লাস শেষ হতে না হতেই শাহবাগের একখান বারান্দা মার্কেট
পিজি হাসপাতাল ঘেঁষা ‘‘সিনোরিটার’’ হামবার্গার খেয়ে, ‘‘সুপর্ণা’’ নামের মেয়েটির অনিন্দ্য
নামের দোকান, জিরাজ আর্ট গ্যালারি, ছোট্ট পোস্টাপিস ‘‘মৌলি’’ ও বাবুল রেডিও ইলেকট্রনিক্সে
আহমদ ছফা’’র নির্লিপ্ত মগ্নতায় সাঙ্গীতিক বৈভবে হয়ে উঠি চিন্তার পার্থক্যে, অস্থিরতাকে
নির্বাসন দিয়ে নৈরাজ্যের কথা ভেবে ভিন্ন ভাবনায় হে যুবক’’, আর ড. আলী রিয়াজের ভাষায়,
‘‘রেখায়ন ছিল আমাদের সময়ের বহুমতের অনন্ত কার্নিভাল। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের
মানুষ এক হয়েছে, বিতর্ক করেছে, বিষয়ান্তরে একমত হয়েছে; ‘‘সহিষ্ণু হতে হবে’’ এমন ভাবনা
জাগেনি, কেননা এর ভিন্ন আর কিছু আমাদের জানা ছিল না। আকারে ছোট্ট রেখায়ন এতটাই বড় ছিল
যে সব মত ও পথকে জায়গা দিতে পেরেছে অবলীলায়।’’ রেখায়নের প্ল্যাটফর্ম ভিন্ন মত আর পথকে
অবলীলায় একসাথে জায়গা দিতে পেরেছে, আমি এই বক্তব্যের সাথে একমত, বইয়ের ১৯৭ পৃষ্ঠায়
কবি শওকত আহসান ফারুকের লেখায় যেমনটা দেখি,
‘‘১৯৭২ সালের ২৩ জুলাই
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আর রাগীব যথারীতি রওনা হই সম্মেলনে যাবো, শাহবাগে থাকি বাসা
থেকে রমনা পায়ে হাঁটা পথ, যাবো রেসকোর্স, এমন সময় দেখি রাগীব নেই অন্যদিকে যাচ্ছে,
অন্য মিছিলে।
-
এই রাগীব,
কোথায় যাস্ সম্মেলন তো এদিকে।
-
না, আমি
রেসকোর্স যাবো না আমি যাবো পল্টনে।
সেদিন সকালে দু’’জনে
চলে যাই দু’’দিকে।’’
৪
ইতিপুর্বে মোটামুটি
একই বিষয়ের উপরে কবি শওকত আহসান ফারুক এর লেখা ‘‘রুম নাম্বার ১৪৬’’ বইটার রিভিউ করেছিলাম
(পাঠ প্রতিক্রিয়া-৯)। বলতে দ্বিধা নেই, আমি উভয় বই পাঠ করে স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক
বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সেসময়ের ঢাকার সর্বজন পরিচিত তিন বোহেমিয়ান
কবি আবুল হাসান, কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং সৈয়দ আহমাদ তারেক, জাত বোহেমিয়ান কবি সাবদার
সিদ্দিকী, কবি আবিদ আজাদ, কবি ফজল মাহমুদ, কবি হুমায়ুন কবির, কবি মুস্তফা আনোয়ার ছাড়াও
আহমদ ছফা, শামিম শিকদার, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, অমলেন্দু বিশ্বাস প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের
সম্পর্কে জানতে পেরেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে আলোচিত ব্যক্তিত্ব
এবং সমসাময়িক ঘটনাপঞ্জি সম্পর্কে যারা জানতে ইচ্ছুক তাদের মনের খোরাক ‘‘রেখায়ন’’ কিছুটা
হলেও পূরণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। আড্ডা যে সময়ের অপচয়ের পরিবর্তে প্রায় জাতীয়ভাবেই
সৃষ্টিশীলতার
স্ফুরণ ঘটাতে পারে, রেখায়ন তার প্রমাণ রেখেছে। ড. মাহবুব হাসানের মতে রেখায়নের আড্ডাটা
ছিল বহতা নদীর মতো। ঢেউগুলো ছিল আড্ডাবাজদের, পানি বয়ে যেতো ঢাকার রাজপথ ধরে নানা গলি-উপগলি
আর এলাকার ভেতর। রেখায়নের একজন আড্ডাবাজ রেজা সেলিমের বক্তব্য দিয়ে লেখা শেষ করবো,
‘‘বাংলাদেশের আড্ডার ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ কখনো কাজ করেন তো রেখায়ন প্রসঙ্গ আসবেই। আসবে
রাগীব আহসানের মতো এক দীর্ঘদেহী বীর পুরুষের কথা যিনি আমাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে পরিবার
বিচ্যুত নিঃসঙ্গ শিক্ষার্থী জীবনের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছেন। হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে দশ-বিশ
টাকা ধার নিয়েছি, কোনদিন ফেরত দিতে পারিনি। বলতেন, আমার তো মনে নেই, মনে না থাকলে আমি
নেই কেমন করে!’’
৫
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত
ছবিটা ২১শে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান সাংবাদচিত্রী রেখায়ন বন্ধু পাভেল রহমানের তোলা। ছবিটাকে
ব্যবহার করে মানানসই চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাগীব আহসান, রেখায়নের প্রাণ পুরুষ
এবং কর্ণধার। স্মৃতিচারণ মূলক ব্যতিক্রম এই বইটার প্রিন্টিং এবং বাঁধাই এর মানও ভালো।
কলকাতার কফি হাউজের আড্ডাকেন্দ্রিক গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই বিখ্যাত গানটা
এবং ঢাকার রেখায়নের আড্ডাকেন্দ্রিক এই বইটা কোথায় যেন একসুরে বাঁধা পড়েছে, কারণটা বোধহয়
নস্টালজিয়া!
হ্যাপি রিডিং
শুভ কামনা নিরন্তর।
সুমন সুবহান।
পোস্ট ভিউঃ 17