পাঠ
প্রতিক্রিয়া- একুশ
থাংলিয়ানা:
একটি ঐতিহাসিক উপাখ্যান ও মানবিক দলিল
১
বইয়ের
নাম: থাংলিয়ানা
মূল
লেখক: লে. কর্নেল থমাস
হারবার্ট লুইন
বাংলা
অনুবাদ: হারুন রশীদ
প্রকাশক:
কথাপ্রকাশ
প্রথম
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মুদ্রিত
মূল্য: ৫০০ টাকা
পৃষ্ঠা
সংখ্যা: ২০০
গ্রন্থের
প্রকৃতি: স্মৃতিচারণ/ইতিহাস
প্রচ্ছদ:
সব্যসাচী হাজরা
১৮৮৫
সালে প্রকাশিত লে. কর্নেল লুইনের
স্মৃতিচারণমূলক মূল বইটার নাম
ছিল ‘‘আ ফ্লাই অন
দ্য হুইল অর হাউ
আই হেল্প গভর্ণ ইন্ডিয়া’’, ‘‘থাংলিয়ানা’’ নামটা বাংলা ভাষায় অনুবাদক হারুন রশীদের দেয়া। বইটা ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও আমি মে
২০২৪ সালে প্রকাশিত তৃতীয়
মুদ্রণের ওপরে আমার পাঠ
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে যাচ্ছি। অনুবাদক
মূল বইটার নির্বাচিত কিছু অংশের অনুবাদ
করে এই নামকরণ করেছেন।
'থাংলিয়ানা' বইটি কেবল একটি
অনুবাদ সাহিত্য নয়, বরং এটি
সাহিত্য ও ইতিহাসের এক
দারুণ সংমিশ্রণ। থমাস হারবার্ট লুইনের
মূল স্মৃতিকথাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা
এই বইটি উনিশ শতকের
পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন, প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে এক
নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে। ১৮৬৫
সালে চট্টগ্রাম শহরে পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব
নিয়ে আসেন তরুণ ব্রিটিশ
অফিসার হারবার্ট লুইন। কিন্তু লুইনকে আকৃষ্ট করছিল শহরের পূর্ব দিগন্তের পার্বত্য অঞ্চল। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে ১৮৬৬ সাল থেকে
শুরু করে ১৮৭২ সাল
পর্যন্ত পরিচালিত বিভিন্ন রোমাঞ্চকর অভিযানের স্মৃতিচারণের অনুবাদ এটি। তবে বইটা
নিছক তথাকথিত ভ্রমণকাহিনী নয়। লুইনের লেখায়
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার চোখে
দেখা পাহাড়ি জীবন, তাদের প্রথা, বিশ্বাস এবং সমাজব্যবস্থার এক
প্রাণবন্ত ছবি উঠে এসেছে।
২
লুইন
একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা হলেও তার লেখায়
ঔপনিবেশিক অহংকার বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের
মনোভাব খুব বেশি প্রকট
নয়। বরং তিনি স্থানীয়
লুসাই জনগোষ্ঠীকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের প্রথা
ও সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন। তার এই মানবিক
এবং নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিই বইটিকে অনন্য করে তোলে। লুসাইদের
সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক,
যা তাকে 'থাংলিয়ানা' উপাধি এনে দেয়, তা
বইয়ের মূল আকর্ষণ। লুইন
তাদের কাছ থেকে যে
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন,
তার বর্ণনা বইটিকে এক ভিন্ন মাত্রা
দিয়েছে। চট্টগ্রামে ১৭৬১ সাল থেকে
ব্রিটিশ শাসন জারির পর
যে অঞ্চলটা শাসনযোগ্য ছিল তার বাইরেও
পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চলের একটা বড় এলাকা
ব্রিটিশ শাসনের আওতার বাইরে ছিল। ১৭৯৮ সালে
ফ্রান্সিস বুখানন টেকনাফ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন এবং কর্ণফুলী নদী
ধরে বরকল এলাকা পর্যন্ত
গিয়েছিলেন। তবে সেই ভ্রমণ
ছিল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, কোম্পানির জন্য কফি কিংবা
মসলা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই। কিন্তু ক্যাপ্টেন লুইনের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিযান ছিল স্বতঃপ্রণোদিত। রোমাঞ্চপ্রিয়
এক কিশোরের মতোই তিনি বারবার
হারাতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের পাহাড়ে। ১৮৬৫ সালের নভেম্বরে
প্রথমবার পাহাড়ে গিয়ে তিনি মুখোমুখি
হন মুরংদের। এরপর ১৮৬৬ সালে
তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হলে নিজের
হেডকোয়ার্টার চন্দ্রঘোনায় স্থাপন করেন। এরপর বছরের পর
বছর ধরে কখনো তিনি
অভিযান চালিয়েছেন যুদ্ধবাজ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সেন্দুদের গ্রামে, কখনো ‘‘জাদুর ক্ষমতা’’ দেখিয়ে সমীহ আদায় করেছেন
দুর্ধর্ষ লুসাইদের কাছ থেকে।
উপন্যাসে
অভিযানের বর্ণনার সাথে আমি যেন
একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম, আমাকে
নস্টালজিক করেছিল। কেননা এই বর্ণনা আমাকে
ফিরে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৯৪-
১৯৯৭ সালের দিনগুলোয়। বান্দরবান রিজিয়নের আলিকদম জোনে নিয়োজিত থাকায়
আমাকে মিরিঞ্জা রেঞ্জ, চিম্বুক রেঞ্জের উভয় পার্শ্ব, থানচি-মাতামুহুরি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় বিভিন্ন সময় অভিযানে যেতে
হয়েছিল। সেসময়ে ঐ অঞ্চলটায় তখনও
সভ্যতার আলো এসে পৌঁছায়নি।
মুরং, খুমি, লুসাই, কুকি অধ্যুষিত এলাকার
জীবনধারণ পদ্ধতি কাছ থেকে দেখার
অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবে হারুন রশীদের
স্বচ্ছন্দ অনুবাদে লুইনের স্মৃতিকথা পড়তে গেলে কেবল
মনেপড়ে স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড রচিত অমর চরিত্র
অ্যালান কোয়ার্টারমেইনকে। কালো মানুষের আফ্রিকায়
একেকটি অভিযানে নেমে অ্যালান কোয়ার্টারমেইন
আমাদের যেমন শোনাতেন অরণ্যের
আদিবাসীদের উদ্ভট সব প্রথা কি
সংস্কৃতি, হারবার্ট লুইনও তেমনি সাদা চামড়ার প্রশাসকের
চেয়ার থেকে বহিরাগত মানুষের
দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা জাতির বিচিত্র
সব প্রথার বর্ণনা করেন। এটাও স্বীকার করতে
হয়, অ্যালানের আফ্রিকা-প্রেমের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের
সরল মানুষদের প্রতি লুইনের প্রেমও অকৃত্রিম। ঔপনিবেশিক শাসক হলেও বছরের
পর বছর নিজের কাজের
মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি
করতে পেরেছিলেন মানুষটি। সাদা মানুষ অ্যালানকে
আফ্রিকার আদিবাসীরা যেমন সম্বোধন করত
‘‘মাকুমাজান’’ নামে, থমাস লুইনও পার্বত্য
চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কাছে তেমনি হয়ে
উঠেছিলেন ‘‘থাংলিয়ানা’’—এমনকি চিরশত্রু লুসাইদের কাছেও!
৩
অ্যালান
কোয়ার্টারমেইনের ছকে ফেলা অভিযানের
মতোই লুইনের স্মৃতিকথাও শেষ হয়েছে এক
বিশাল যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে। ১৮৭২ সালে লুসাইদের
বিরুদ্ধে ইংরেজদের সেই যুদ্ধের রণনীতি
অনেকটাই নির্ধারণ করেছিলেন ততদিনে ওই এলাকা সম্পর্কে
বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা লুইন।
মজার ব্যাপার, সেই যুদ্ধের মূল
কারণও- অ্যালানের অভিজ্ঞতাগুলোর মতোই, একজন নারী! ১৮৭১
সালে এক চা-বাগানের
ম্যানেজারকে হত্যা করে তার ছয়
বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি
উইনচেস্টারকে অপহরণ করে নিয়ে যায়
লুসাই বিদ্রোহীরা। তখন চা-বাগানের
মালিকেরা এক হয়ে ব্রিটিশ
সরকারের ওপর যে চাপ
প্রয়োগ করে, তার ফলেই
১৮৭২ সালে লুসাইদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধে নামে ব্রিটিশরা। শেষ
পর্যন্ত সরকারি বাহিনী মেয়েটিকে উদ্ধারে সমর্থ হয়। আর লুসাইরাও
এক অর্থে চলে আসে ইংরেজ
শাসনের অধীনে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী রাজা বা রানিশাসিত
অঞ্চলগুলোতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে লুইনের স্মৃতিকথা
এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সব বাদ
দিলেও লেখক যে পর্যবেক্ষণগুলো
করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে, শুধু নৃতাত্ত্বিক কারণেই
সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। সাহিত্যিক মূল্যের পাশাপাশি এই বইটির ঐতিহাসিক
ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। উনিশ শতকের পার্বত্য
চট্টগ্রামের সমাজ, রাজনীতি, এবং বিভিন্ন আদিবাসী
গোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে এটি একটি
মূল্যবান দলিল। এটি সেই সময়ের
লুসাই বিদ্রোহ, ব্রিটিশদের দমননীতি, এবং পাহাড়ের মানুষের
জীবন-সংগ্রাম সম্পর্কে অনেক তথ্য দেয়।
তাই এটি কেবল সাহিত্যপ্রেমীদের
জন্য নয়, ইতিহাস ও
নৃবিজ্ঞান গবেষকদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
৪
হারুন
রশীদের অনুবাদশৈলী 'থাংলিয়ানা' বইটির সাহিত্যিক মূল্যায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
তিনি মূল রচনার মেজাজ
ও ভাষা অক্ষুণ্ন রেখে
জটিল পাহাড়ি জীবন ও আবেগকে
বাংলা ভাষায় দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার
সাবলীল ও কাব্যিক অনুবাদ
মূল ইংরেজি গ্রন্থটির সাহিত্যিক সৌন্দর্যকে বাংলায় এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যে এটি একটি
মৌলিক বাংলা সাহিত্যের মতোই মনে হয়।
এই অনুবাদ কর্মটি বাংলা সাহিত্য জগতে একটি মূল্যবান
সংযোজন।
সংক্ষেপে,
'থাংলিয়ানা' একটি ঐতিহাসিক পটভূমিতে
লেখা রোমাঞ্চকর ভ্রমণ উপাখ্যান, যা পাঠকের মনে
কৌতূহল ও উদ্দীপনা সৃষ্টি
করে। স্মৃতিচারণ মূলক ব্যতিক্রম এই
বইটার প্রিন্টিং এবং বাঁধাই এর
মানও ভালো। কলকাতার কফি হাউজের আড্ডাকেন্দ্রিক
গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই বিখ্যাত
গানটা এবং ঢাকার রেখায়নের
আড্ডাকেন্দ্রিক এই বইটা কোথায়
যেন একসুরে বাঁধা পড়েছে, কারণটা বোধহয় নস্টালজিয়া!
হ্যাপি
রিডিং
শুভ
কামনা নিরন্তর।
সুমন
সুবহান।
পোস্ট ভিউঃ 17