৩০ লক্ষ শহীদ মিথ!নাকি বাস্তবতা!
৭
'ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অফ দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার'
শর্মিলা বসু একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদ। তার 'ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অফ দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার' বইটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে লেখা। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে তিনি একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন। তার যুক্তি, যুদ্ধের ইতিহাস বিজয়ীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয় এবং এতে পরাজিত পক্ষের বক্তব্য বা অপরাধগুলো প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। তিনি এই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, যেখানে কেবল পাকিস্তানি বাহিনীকে দোষারোপ করা হয়। তার দাবি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীকৃত হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের সংখ্যা অনেকাংশে অতিরঞ্জিত। তিনি যুক্তি দেখান যে, ৩০ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার যে সংখ্যাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই এবং এটি একটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ। তিনি যুক্তি দেখান যে, এত কম সময়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করা সামরিকভাবেও অসম্ভব। বিভিন্ন ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি সঠিক সংখ্যা নিরূপণে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনেকরেন।
শর্মিলা বসু তার বইটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা অবাঙালি বিহারি এবং কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা’’র দাবি করেছেন। শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনাও তিনি বইটিতে তুলে ধরেছেন। নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার মত হলো, এটি কেবল একটি পক্ষের নৃশংসতার যুদ্ধ ছিল না, বরং উভয় পক্ষেই সহিংসতা হয়েছিল।
'ডেড রেকনিং' বইয়ের জন্য শর্মিলা বসু মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৭০ জনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাদের মধ্যে বাঙালি, অবাঙালি (বিহারি), পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা এবং সাধারণ নাগরিক উভয়ই ছিলেন। তাদের স্মৃতিকথা, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত নথি এবং বিদেশি সংবাদ প্রতিবেদনগুলো গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। অনেক সমালোচক অবশ্য তার গবেষণা পদ্ধতিকে পক্ষপাতদুষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিযুক্ত করেছেন। তাদের মতে, শর্মিলা বসু ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানি পক্ষের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বাঙালি ভুক্তভোগীদের বর্ণনাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। অনেক ইতিহাসবিদ এবং গবেষক তার কাজকে "ঐতিহাসিক নেতিবাচকতা" (historical negationism) ও "গণহত্যা অস্বীকার" (genocide denial) বলে সমালোচনা করেছেন।
শর্মিলা বসু ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ‘‘গৃহযুদ্ধ’’ বলে বর্ণনা করেছেন, যা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচলিত ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন যে, এটি দুই স্বাধীন দেশের মধ্যে যুদ্ধ ছিল না, বরং একই রাষ্ট্রের (পাকিস্তান) দুটি অংশের মধ্যেকার সংঘাত। বইটি ভারত ও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হবার সম্ভাব্য কারণ,
ক। পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ। তিনি পাকিস্তানি পক্ষের বক্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বাঙালিদের বর্ণনাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের দেয়া বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করলেও, বাঙালি ভুক্তভোগীদের স্মৃতিচারণকে 'অতিরঞ্জিত' বলে বাতিল করেছেন।
খ। গবেষণা পদ্ধতি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তথ্য যাচাইয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেননি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন যা তার পূর্বনির্ধারিত যুক্তির পক্ষে কাজ করে।
গ। যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে যাওয়া। সমালোচকরা মনে করেন তিনি যুদ্ধের মূল যে প্রেক্ষাপট, অর্থাৎ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণকে প্রায় পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। এই শোষণই যে যুদ্ধের মূল কারণ ছিল, তা তিনি তার বইয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
৮
শহিদের সংখ্যা ২০০০!
ক। ১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে পিনাকী ভট্টাচার্য তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ‘‘বিস্ফোরক তথ্য: ১৯৭১ এর শহিদের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম কম’’ প্রতিবেদনে বিতর্কিত মন্তব্যটা করেন। ২,০০০ জন শহিদের তথ্যটা তিনি নিয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক উইলিয়াম ড্রামন্ড-এর ৬ জুন ১৯৭২ তারিখে দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। উইলিয়াম ড্রামন্ড একজন প্রশংসিত এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিক ছিলেন। তার সাংবাদিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্যতাও বেশ উচ্চ। তিনি বার্কলেতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ জার্নালিজমে শিক্ষকতা করেছেন এবং দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ও এনপিআর-এর মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জাতিগত বৈষম্য, নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, যা তাকে সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিতি এনে দিয়েছে। তার প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘‘The missing millions’’। প্রতিবেদনটিতে ড্রামন্ড লিখেছেন যে, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিদর্শকের কার্যালয় মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তদন্ত শুরু করার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার প্রায় ২,০০০টি অভিযোগ পেয়েছে। এই তথ্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ হওয়ার যে সংখ্যাটি সাধারণভাবে প্রচলিত, তার থেকে ভিন্ন।
খ। উইলিয়াম ড্রামন্ডের প্রতিবেদনটির বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন,
(১) প্রতিবেদনের সময়কাল এবং প্রেক্ষাপট। সাংবাদিকতা হলো তাৎক্ষণিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা। অন্যদিকে ইতিহাস হলো সময়ের সাথে সাথে প্রাপ্ত সকল তথ্য, গবেষণা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করা। প্রতিবেদনটি ১৯৭২ সালের জুনে প্রকাশিত হয়েছিল। সেসময়ে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে তখনো সম্পূর্ণ ও নির্ভুল পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২,০০০ সংখ্যাটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সরকারি দপ্তরে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিদর্শকের কার্যালয়) জমা পড়া অভিযোগের ভিত্তিতে ছিল, যা মোট হতাহতের সংখ্যাকে প্রতিফলিত করে না।
(২) সাংবাদিকের উদ্দেশ্য। উইলিয়াম ড্রামন্ডের লেখাটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন ছিল না, বরং যুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ। তিনি নিজেই তার প্রতিবেদনে ‘‘the missing millions’’ শিরোনাম ব্যবহার করে শহিদের সংখ্যা নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন।
(৩) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বিতর্ক। উইলিয়াম ড্রামন্ডের প্রতিবেদনটি পরবর্তীকালে কিছু গোষ্ঠী ৩০ লাখ শহিদের সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত করেছে। পিনাকী ভট্টাচার্য তার অনুষ্ঠানে যেমনটা করেছেন। এই প্রতিবেদনটি নিজে থেকে ৩০ লাখ সংখ্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করে না। এটি কেবল সেই সময়ের সরকারি নথিতে রিপোর্ট হওয়া অভিযোগের সংখ্যা তুলে ধরেছিল। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২,০০০ সংখ্যাটি যেমন একটি বিশেষ সময়ের সরকারি নথির উপর ভিত্তি করে, তেমনি ৩০ লাখ শহিদ হওয়ার সংখ্যাটি প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া এবং এটিই বাংলাদেশে সরকারিভাবে ও সাধারণভাবে স্বীকৃত। অনেক ঐতিহাসিক, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাও ৩০ লাখ শহিদের সংখ্যাকে সমর্থন করে থাকেন, যা ইতিপুর্বে রেফারেন্সসহ উল্লেখ করেছি। উইলিয়াম ড্রামন্ডের প্রতিবেদনটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের একটি বিশেষ তথ্যের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এবং এটি সেসময়ের একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরে। এটি ৩০ লাখ শহিদের যে প্রতিষ্ঠিত ও বহুল স্বীকৃত সংখ্যা, তার সত্যতাকে বাতিল করে না।
৯
নিহতের সংখ্যা নিয়ে মতভিন্নতা।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে নিহত ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র এবং গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি আনুমানিক চিত্র দেয়া হলো,
ক। পাকিস্তান সেনাসদস্য হতাহতের সংখ্যা। যুদ্ধের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন সরকার যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় সম্পর্কে তদন্ত করতে হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করেন। তদন্ত শেষে কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে এবং ডিক্লাসিফায়েড অংশ জনসাধারণের জানার স্বার্থে উম্মুক্ত করে। ‘‘৩০ লাখ শহিদ’’ সংক্রান্ত বিষয়ে সেখান থেকে জানা যায়, ‘‘বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের মতে ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যা ও দু’’লাখ পূর্ব পাকিস্তানি নারী ধর্ষণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী দায়ী, এই সংখ্যাগুলো যে পরিষ্কারভাবে অতিরঞ্জিত তা বুঝতে আর বিস্তারিত যুক্তিতর্কের প্রয়োজন নেই। এমনকি অন্যকোন কিছু যদি নাও করতে হতো তাও পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করেও এ ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হতো না।’’ কমিশন নিজে শহিদের সংখ্যা দিয়েছে এভাবে, ‘সর্বশেষ বিবৃতি দিয়ে সেনা সদর দপ্তর থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২৬,০০০ জন নিহত হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল হেড কোয়ার্টারে বিভিন্ন সময়ে দাখিলকৃত ঘটনা সম্পর্কিত প্রতিবেদন (SITREP)-এর উপর ভিত্তি করে এ সংখ্যাটি পাওয়া গেছে।’’ SITREP হলো ঘটনার দালিলিক প্রমাণ তবে কমিশন ২৬,০০০ জন শহিদের সংখ্যাটিকেও অতিরঞ্জন বলে মনেকরে বলেছে, ‘‘এটা হতে পারে যে এমনকি এ সংখ্যাতেও হয়তো অতিরঞ্জিত কোনো বিষয় রয়েছে, কেননা সেসময় বিদ্রোহ দমনে নিচের দিককার ইউনিটগুলো তাদের অর্জনকে আরো বাড়িয়ে প্রকাশ করার মানসিকতা পোষণ করতো।’’ তবে ‘‘অন্যকোন নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে’’ কমিশন ২৬,০০০ মৃতের সংখ্যাকে ‘‘যুক্তিসহ সঠিক’’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
অপরপক্ষে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন অনুমান প্রচলিত আছে। কিছু উৎস মতে তাদের প্রায় ১,৬০০ থেকে ২,৩০০ জন নিহত হয়েছিল। আবার আরেকটা সূত্র মতে প্রায় ৮,০০০ থেকে ৯,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য পশ্চিমা সূত্র এবং গবেষণায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ৫,৮৬৬ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের মতে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ৪,৫০০ জন নিহত এবং ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ২,২৬১ জন নিহত অর্থাৎ সর্বমোট ৬,৭৬১ জন নিহত। জেনারেল নিয়াজি অবশ্য ০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪,০০০ জন বলেছেন।
খ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মৃত্যু সংখ্যা। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,৬০০ ভারতীয় সেনা সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। কিছু সূত্র অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ৩,৮৪৩ পর্যন্তও হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১৬ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে ১,৬৬১ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে এই শহীদদের সম্মাননা জানানোর জন্য প্রতি পরিবারকে ক্রেস্ট এবং আর্থিক অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লে জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের মতে শুধু ডিসেম্বর মাসেই ভারতের হতাহতের সংখ্যা ছিল ১,৪২১ জন এবং ৫৬ জন মিসিং। তবে ডিসেম্বরের আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার বিষয়টা আমলে নিলে এই সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যাবে। পাকিস্তান অবশ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যাকে সবসময়ই বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করে থাকে। তাদের বিভিন্ন সামরিক বিশ্লেষক এবং কিছু প্রকাশনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মৃত্যুর সংখ্যা ২,০০০ থেকে ৪,০০০ এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
গ। মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা। শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর কতজন সদস্য শহীদ হয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়নি। কারণ এটি একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর মতো ছিল না এবং বহু বেসামরিক মানুষও এতে অংশ নিয়েছিল। আবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, কারণ তারা এটিকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করত। তারপরও বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী ১০,০০০-এর বেশি সদস্য নিহত এবং প্রায় ২০,০০০ আহত হয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি শুধু নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের জন্য, যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কতজন মারা গিয়েছিল তার সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, কারণ সেই সময়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল ছিল এবং শরণার্থীরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটিয়েছিল। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদনে শরণার্থীদের মৃত্যুর আনুমানিক সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ৫,৬২,৯১৫ জনের ‘‘অতিরিক্ত মৃত্যু’’ হয়েছিল। অতিরিক্ত মৃত্যু হলো সাধারণ পরিস্থিতিতে যে পরিমাণ মৃত্যু প্রত্যাশিত, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যু। এই সংখ্যাটি ৩,২৩,৫৬২ থেকে ৮,০২,২৬৮-এর মধ্যে হতে পারে বলে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিসেফ-এর একটি অনুমান অনুযায়ী, শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টির কারণে প্রায় ৫ লাখ শিশু ও বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো ইঙ্গিত করে যে, ১৯৭১ সালের শরণার্থী সংকট শুধুমাত্র একটি মানবিক বিপর্যয় ছিল না, বরং এতে অসংখ্য মানুষের জীবনহানিও ঘটেছিল, যা যুদ্ধ এবং গণহত্যার বাইরে একটি ভিন্ন ধরনের ট্র্যাজেডি।
১০
একটা যৌক্তিক সমাধানের জন্য অপেক্ষা।
ক। শর্মিলা বসু’’র গবেষণা গ্রন্থ ‘‘ডেড রেকনিং’’-এর তথ্য, উপ-পুলিশ প্রধান আব্দুর রহিমের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং অন্যান্য সূত্রের হিসেব আমলে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঙালি-বিহারী, হিন্দু-মুসলমান, যোদ্ধা-অযোদ্ধা, ভারতীয়-পাকিস্তানি মিলে সংখ্যাটা ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ জন কিংবা সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের রেফারেন্সে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ৩ লাখ হতে পারে।
খ। হামুদুর রহমান কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ২৬,০০০ জন সংখ্যাটা যেমন প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে তেমনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে রেসকোর্সের ভাষণে শেখ মুজিবের উচ্চারিত ৩০ লাখ শহিদ প্রকৃত সংখ্যার অতিরঞ্জন। তবে শেখ মুজিব হয়তো তখন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা নয়, বরং গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য ‘‘৩০ লাখ’’ এর মতো একটি বিশাল সংখ্যা ব্যবহার করেছিলেন।
গ। মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতা সত্ত্বেও, এটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল, যা লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। আর তাই উইলিয়াম ড্রামন্ড-এর রেফারেন্স দিয়ে ১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে পিনাকী ভট্টাচার্য’’র দাবীকৃত ২,০০০ জন শহিদের সংখ্যা সত্যের অপলাপ এবং প্রকৃত ইতিহাসের অবমাননা।
ঘ। ৩০ লাখ শহিদের সংখ্যাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের বিশাল আত্মত্যাগ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার প্রতীক হিসেবেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে একাত্তরে গণহত্যার জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি পেতে চাইলে শহিদের সংখ্যাকে একটা বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এই কাজ পক্ষপাতদুষ্ট মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কিংবা মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবির টাইপের জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে হবে না। এরজন্য প্রয়োজন আবেগ বিবর্জিত এবং যুক্তিনির্ভর একদল নিবেদিতপ্রাণ তরুণ। তাদের হাতেই হয়তো একদিন মীমাংসিত হবে এই ঐতিহাসিক বিতর্ক। আমাদের কিছু জহির রায়হান প্রয়োজন।
©সুমন সুবহান
পোস্ট ভিউঃ 11