একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে

ব্লগ ইতিহাস, সাহিত্য ও ঐতিহ্য
একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে

‘‘একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে

সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’’

 

২০২৪ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন একসময় রূপ নেয় এক দফার গণআন্দোলনে। কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন একসময় সীমাবদ্ধ ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের মধ্যে, তা একপর্যায়ে দেশব্যাপী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার মতোই ভীষণ রাগে ‘‘যুদ্ধ’’ হয়। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের অধিকাংশই ভাবে না যে তারা একদিন বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেবে। তাদের বেশীরভাগই বিদেশমুখী, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের চাকরি কিংবা নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। সরকারি চাকরি কিংবা কোটা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের মতো তেমন কনসার্ন না হয়েও শুধুমাত্র ‘‘আমি শিক্ষার্থী এবং আহত শিক্ষার্থীরা আমার ভাই’’, এটা ভেবেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে। এবং সেটা ৩ জুলাই ২০২৪ তারিখে হাইকোর্টের রায়ে ‘‘৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল’’ করার দিনগুলো থেকেই।  

 

১৪ জুলাই তারিখেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপথে নামার ঘোষণা দেয় এবং ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। তারা ১৫, ১৬ ও ১৭ জুলাই তারিখে ঢাকার উত্তরা, প্রগতি সরণি, নতুনবাজার-ভাটারা, রামপুরায় বিক্ষোভ কর্মসূচি, প্রতিবাদ ও রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখ রাতে ইউজিসি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ফাঁকা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ অভিযানের নামে প্রতিটি ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। এভাবে ১৮ জুলাই ২০২৪ তারিখ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ফাঁকা হলে আন্দোলনে নাটকীয় মোড় আসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের হাত ধরে। আর এটা শুরু হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের একটা ঘটনা থেকে।

 

সেদিন সকালে উত্তরায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট আসিফ শহীদ হন, পুলিশ পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করে তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার কাছাকাছি সময়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একইরকম আরেকটা ঘটনা ঘটে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদেরকে সাহায্য করার জন্য ইম্পেরিয়ালের স্টুডেন্টরা সেদিন ব্র্যাকের সামনে এসেছিল। তাদের একজন স্টুডেন্ট, জিল্লুর ব্র্যাকের স্টুডেন্টদেরকে জানায়, ‘‘আমরা তো ইউনিফর্মে আছি, আমাদের দেখলে গুলি করবে না’’। কিন্তু ওই অবস্থায় পুলিশ তাকে গুলি করে এবং সে মারা যায়। স্টুডেন্টরা তার লাশ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভেতরে নিয়ে গেলে ‘‘আমার ভাইকে মাইরা ফেলছে’’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন একজন ফিমেইল স্টুডেন্ট। সেই ভিডিওটা সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা আন্দোলনের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর করতে ভূমিকা রাখে। একারণেই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ঘটনাটা ব্র্যাকের সামনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয় বলে অনেকেই মনেকরেন।  

 

রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি, শুরু থেকে ১৮ জুলাই ২০২৪ তারিখ বিকেলে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা আন্দোলনের প্রতিটি তথ্য, ছবি ইত্যাদি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আপলোড করে সাধারণ স্টুডেন্টদের মনোবল চাঙ্গা রাখে। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার পর বিদেশে অবস্থানরত তাদের ফেসবুকের অ্যাডমিনরা সঠিক তথ্য এবং বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা দেশের বাইরের মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তাদের এই অবদান কেউই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। আসলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা সেদিন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে না তুললে ৩৬ জুলাই সহসাই আসতো না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের ব্যাপক অংশগ্রহণ না হলে এই আন্দোলন ‘‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’’-এর পর্যায়েই থেকে যেত বলে মনেকরি।

 

বণিক বার্তার অনুসন্ধানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭জন স্টুডেন্ট শহীদ হবার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে আরেকটা সূত্রে সংখ্যাটা ২৩ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ মারা যান নি। ১৮ জুলাইকে ‘‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস’’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের অবদান স্মরণে রাজধানীর হাতিরঝিলে আজ শুক্রবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হয়েছে ‘‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস’’। হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। লেখা শেষ করবো কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘‘একটা ফুলকির জন্যে’’ কবিতার শেষ দুটো লাইন দিয়ে।

 

‘‘একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে

সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’’

 

 

 

 

 

 

 



পোস্ট ভিউঃ 17

আপনার মন্তব্য লিখুন