একসময়ের জনপ্রিয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মুড়ির টিন এবং অন্যান্য

ব্লগ ইতিহাস, সাহিত্য ও ঐতিহ্য
একসময়ের জনপ্রিয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মুড়ির টিন এবং অন্যান্য

একসময়ের জনপ্রিয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ‘‘মুড়ির টিন’’ এবং অন্যান্য   

কোক স্টুডিও বাংলা সিজন-২ এর ‘মুড়ির টিন’’ গানটা যতবার শুনি ততবারই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনার ভাষায় গানটাতে ‘‘মুড়ির টিন’’ নামের পাবলিক বাসের পরিবেশ এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে তা সহজেই শ্রোতাকে নস্টালজিক করে তোলে ২০১৬ সালে বিশ্বখ্যাত অ্যাপ-ভিত্তিক ট্যাক্সি সেবা নেটওয়ার্ক ‘‘উবার’’-এর কার্যক্রম শুরুর আগে ঢাকার পাবলিক বাহন বা লোকাল বাস বলতে বিআরটিসি এবং কিছু প্রাইভেট কোম্পানি’’র বিভিন্ন রকম বাস সার্ভিস এবং সিএনজি, লেগুনা, ট্যাক্সি-ক্যাব, বিকল্প, মিশুক, ট্যাক্সি, টাউন সার্ভিস, রেন্ট-এ কার ইত্যাদিকেই বোঝাতো। তবে এসবেরও আগে অর্থাৎ ৭০ এর দশক পর্যন্ত ঢাকায় খুবই জনপ্রিয় বাহন ছিল ‘‘মুড়ির টিন’’ নামের বাসগুলো। তবে  ৪০এর দশক থেকেই ঢাকায় মোমিন কোম্পানির বাসগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। বাসগুলো যথেষ্ট মজবুত হওয়া সত্তেও ‘‘মুড়ির টিন’’ নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় যে বাসের আকৃতির কারণে এমন নামকরণ হয়েছিলএই বাসগুলো মূলত কাঠের বডির হতো এবং কাঠের বডির  ওপর পাতলা টিন দিয়ে মোড়ানো থাকতো। চালকের জন্য আলাদা কেবিন ছিল, তবে তার পাশে এক দুই জন যাত্রীকে বসানো যেত। এই বাসগুলো সেলফ স্টার্ট বা এখনকার গাড়ির মতো চাবি ঘুড়িয়ে স্টার্ট করা টাইপের না। বাংলা ‘‘দ’’ আকৃতির একটি লোহার দন্ডের এক মাথা ইঞ্জিনে প্রবেশ করিয়ে বেশ জোরে ঘুড়িয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়া হতো। ‘‘মুড়ির টিন’’ বাসে ইলেকট্রনিক বা হাইড্রোলিক হর্ন ছিল না, ড্রাইভারের ডান পাশে দরজার সাথে ভেপু বা হর্ন থাকতো। ড্রাইভার হাত দিয়ে সেটা চেপে হর্ন বাজাতো। ‘‘মুড়ির টিন’’-এর পাশাপাশি এই বাসগুলোকে মোমিন কোম্পানির বাস নামেও ডাকা হতো। এ বাসগুলো বাংলাদেশের সবখানে আন্তঃজেলা, এমনকি আঞ্চলিক রুটগুলোতেও চলাচল করতো। ছোটবেলা এরকম ‘‘মুড়ির টিন’’ গাড়িতে চেপে নানাবাড়ি যাওয়ার স্মৃতি খুব মনেপড়ে।          

 

‘‘মুড়ির টিন’’-এর মতো বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে এক ধরণের জনপ্রিয় বাহন হলো ‘চান্দের গাড়ি বা চাঁদের গাড়ি’’। মূলত টয়োটা কোম্পানির পিকআপের বডি মোডিফাই করে এগুলো বানানো হয়। ১৯৮৬ সালে সম্ভবত রাঙ্গামাটিতে প্রথমবার এবং এর অনেক পরে, ১৯৯৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরিকালে    এরকম গাড়ী দেখি, এখনও দুর্গম পার্বত্য এলাকাযাতায়াতের জন্য জনপ্রিয় বাহন হলো ‘‘চান্দের গাড়ি’’।     

 

২  

২০০১ সালে শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরা লিওনে গিয়ে আমাদের দেশের ‘‘চান্দের গাড়ি’’র মতো সেখানকার জনপ্রিয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ‘‘পোডা পোডা’’ দেখি। মোডিফায়েড মাইক্রোবাস বা কোস্টার জাতীয় সেসব গাড়িতে ‘‘Allah Nunnah’’, ‘‘I found that man again’’ ধরণের বিভিন্ন নীতিবাক্য লেখা থাকতো আমাদের দেশে যেমন ট্রাকের ফুয়েল ট্যাঙ্কের গায়ে ‘‘জন্ম থেকে জ্বলছি’’, গাড়ির পিছনে ‘‘দূরত্ব বজায় রাখুন’’ জাতীয় কথাগুলো লেখা থাকে। ২০১১ সালে জাঞ্জিবারের স্টোন টাউন টু ইস্ট কোস্ট রুটে এবং তানজানিয়ার রাজধানী দার-এস-সালাম শহরে ‘‘পোডা পোডা’’র মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট দেখি। সেখানে অবশ্য এগুলো ‘‘ডালা ডালা’’ নামে পরিচিত। তানজানিয়াতে মূলত বৈধ সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থার অভাবে ‘‘ডালা ডালা’’ দার-এস-সালামসহ অন্যান্য শহরে অবৈধ ট্যাক্সি হিসাবে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছিলএকইরকমের গাড়িগুলোকে কেনিয়ার নাইরোবি শহরে ‘‘মাতাতু’’, ঘানাতে ‘‘ট্রো ট্রো’’, গিনিতে ‘‘মাগবানা’’, নাইজেরিয়াতে ‘‘ডানফোর’’, সেনেগালে ‘‘কার রেপিড’’, ফিলিপাইনে ‘‘জিপনি’’, সাউথ আমেরিকাতে ‘‘কোলেক্টিভো’’ বলে ডাকে।  

 

২০১৫ সাল থেকে ঢাকায় রাইড শেয়ার কোম্পানি ‘‘পাঠাও’’ চালু হয়। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে নেপালেও এই মোটরসাইকেল রাইড কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে এটি বেশ জনপ্রিয় এবং দ্রুতগামী বাহন হিসেবে পরিচিতআমি ২০১০ সালে ঠিক একইরকম মোটর সাইকেল রাইড কোম্পানি প্রথম দেখি উগান্ডার এন্টেবি শহরে। ওখানে এটি ‘‘বোডা বোডা’’ নামে পরিচিত। সে সময়ে এন্টেবি থেকে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা শহরে যাওয়ার দ্রুততম এবং সাশ্রয়ী বাহন ছিল ‘‘বোডা বোডা’’এরপরে রুয়ান্ডার কিগালি এবং বুরুন্ডির বুজুম্বুরা শহরেও এদের দেখা পাই। ২০১৩ সালে কাম্পালা শহরে নাকি প্রায় ৩,০০,০০০ ‘বোডা বোডা’’ চলতো। এই মোটর সাইকেলগুলোর বৈধ কাগজপত্র তেমন থাকতো না এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সীমান্ত পর্যন্ত যেত বলে এদের প্রথম দিকে ‘‘বর্ডার টু বর্ডার’’ নামে ডাকা হতো, সেখান থেকেই একসময় ‘‘বোডা বোডা’’ নামের উৎপত্তি বলে জানা যায়। কেনিয়াতে এদের অবশ্য ‘‘পিকি পিকি’’ নামে ডাকা হয়।  

 

খানিকটা স্মৃতিচারণ এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। সবাই ভাল থাকবেন।          

 

 

 



পোস্ট ভিউঃ 16

আপনার মন্তব্য লিখুন