মান্ধাতার আমল শুনেছেন, এই রাজা যে পিতৃগর্ভে জন্মেছিলেন জানেন?
চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন অনেক কিছুই সম্ভব
হচ্ছে। এখন শুধু মহিলারাই নন,
সন্তানের
জন্ম দিতে পারছেন পুরুষও। ২৮ জুন ২০০৮ সালে মার্কিন নাগরিক Thomas
Beatie প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যে পদ্ধতিতে মহিলাদের ‘‘উম্ব
ট্রান্সপ্ল্যান্ট’’ করা হয়ে থাকে,
সেই
একই পদ্ধতি পুরুষদের উপর প্রয়োগ করে ‘‘উম্ব ট্রান্সপ্ল্যান্ট’’ বা গর্ভ রোপনের
মাধ্যমে এখন পুরুষরাও অন্তঃসত্ত্বা হতে এবং সন্তানের জন্ম দিতে পারছেন। তবে বিশ্বের
শীর্ষস্থানীয় প্রজনন বিশেষজ্ঞরা আধুনিক কালে এসে যে কাজটা করতে সক্ষম হলেন ভারতবর্ষের
মুনি-ঋষিরা কিন্তু সেই পৌরাণিক আমলেই এই কাজটি সেরে ফেলেছেন। চিকিৎসা
বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখন আসি পৌরাণিক
আমলের সেই মজার গল্পে।
আমরা জানি একটি ভাষার প্রবাদ-প্রবচন সে ভাষার একান্ত নিজস্ব
সম্পদ। এই সম্পদ হস্তান্তর বা অনুবাদ করে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
প্রতিটি
প্রবাদ বা প্রবচনের পেছনে রয়েছে নানা চিত্র,
কাহিনী
বা গল্প। গল্প-কাহিনীগুলোর কোনটা পৌরাণিক,
কোনটা
ঐতিহাসিক আবার কোনটা আধুনিক কালের। পুরনো কিছু দেখলেই অনেক সময় আমাদের মুখে এসে
যায় মান্ধাতার আমলের জিনিস। পুরোনো ধাঁচের ডিজাইন দেখলেই কেউ বলে ওঠে, মান্ধাতার কালের ডিজাইন। এখন প্রশ্ন হলো, কে এই মান্ধাতা? তিনি কবে এই পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিলেন?
মান্ধাতার কাল আসলে কখন তা আমাদের জানা নেই। তবে মান্ধাতার
আমল বা কাল প্রবচনের পেছনে রয়েছে একটা মজার পৌরাণিক কাহিনি। জানা যায় যে, মান্ধাতা
ছিলেন সূর্যবংশের এক রাজা। স্বয়ং রামচন্দ্রও পরে এই সূর্যবংশেই জন্ম নেন। তাই বলা
যেতে পারে মান্ধাতা ছিলেন রামের পূর্বসূরী। মান্ধাতার জন্মগ্রহণের ঘটনাটা বেশ
অদ্ভুত, কারণ মাতৃগর্ভ নয়, পিতৃগর্ভে জন্মেছিলেন
মান্ধাতা। এই সূর্যবংশের একজন রাজা যুবনাশ্বের কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। সন্তান
লাভের আশার তিনি জঙ্গলে সাধুদের আশ্রমে গিয়ে তপস্যা শুরু করেন। তার সাধনায়
সন্তুষ্ট হয়ে ঋষিরা একসময় যুবনাশ্বের পুত্রসন্তান কামনায় যজ্ঞ শুরু করেন। তারা যজ্ঞ
শেষ হওয়ার পর এক কলসি মন্ত্রপুত জল রানির জন্য রেখে দেন, যা পান করলে রানির
পুত্রলাভ হবে। তবে রানির মন্ত্রপুত জল পান সংক্রান্ত চিকিৎসার বিষয়ে যুবনাশ্ব
জানতেন না। এরফলে রাতে তৃষ্ণা পাওয়ায় ওই
কলসির জল তিনি নিজেই পান করে ফেলেন।
পরদিন সকালে কলসির জল কোথায় গেল তা ভেবে অবাক হন ঋষিরা। যুবনাশ্ব
বলেন যে কলসির জল তিনিই পান করেছেন। তখন তাকে সব ঘটনা জানিয়ে ঋষিরা বলেন, মন্ত্রপুত
জল পান করায় যুবনাশ্বের গর্ভেই এবার পুত্র সন্তান হবে। অবশ্য মুনি-ঋষিরা নারীর গর্ভধারনের কষ্ট থেকে যুবনাশ্বকে
মুক্তি দিলেন। এর ১০০ বছর পর যুবনাশ্বের
পেটের বাম দিক বিদীর্ণ করে ভূমিষ্ঠ হন মান্ধাতা, তখনো অবশ্য তাকে কোন নাম দেয়া
হয়নি, নামকরণের সে গল্পে পরে আসছি।
যেভাবেই হোক পুত্র সন্তানের তো জন্ম হলো, কিন্তু মায়ের
গর্ভে জন্ম না নেয়ায় সন্তান কার দুধ খেয়ে বড় হবেন? এ নিয়ে জটিল সমস্যা দেখা দিলে শিশুকে বাঁচাতে
এগিয়ে আসেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি তার নিজের তর্জনী সন্তানের মুখে পুরে দিয়ে বলেন, 'মাম ধাস্যতি'। অর্থাত্ আমাকে পান করো। সেখান থেকেই পুত্রটির নাম রাখা
হয় মাম-ধাতা বা মান্ধাতা।
ইন্দ্রের সেই আঙুলটি ছিল অমৃতক্ষরা। অমৃতের গুণে এক দিনেই
বড় হয়ে যান মান্ধাতা, অস্ত্রবিদ্যায় বেশ পারদর্শিতা অর্জন করেন তিনি। পিতা
যুবনাশ্বের মৃত্যুর পর সুশাসক হিসেবে মান্ধাতা বেশ সুনাম অর্জন করেন। এরপর তিনি দিগ্বিজয়ে
বের হয়ে বহু দেশ জয় করেন এবং ভ্রমণ করতে করতে সুমেরু পর্বত শিখরে উপস্থিত হন। সেখানে
রাক্ষসরাজ রাবণের সাথে তার ভীষণ যুদ্ধ হয়, কিন্তু জয়-পরাজয় স্থির না হওয়াতে উভয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এভাবে যুদ্ধ
করে সারা পৃথিবীই জয় করে ফেললেন মান্ধাতা। সারা পৃথিবী যিনি জয় করেছেন তিনি কি আর
স্বর্গজয় বাদ রাখবেন! সুতরাং তিনি চললেন স্বর্গজয়ে। কিন্তু ইন্দ্র জানালেন, তার পুরো
পৃথিবী জয় তখনও শেষ হয়নি কারণ মধুর পুত্র লবনাসুর মান্ধাতার অধীনতা মেনে নেয়নি।
সুতরাং লবনাসুরকে হারিয়ে তবেই স্বর্গজয়ের যুদ্ধ করবেন বলে মান্ধাতা মনস্থির করলেন।
কিন্তু তার সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। দেবরাজ ইন্দ্রের কৌশলে মান্ধাতা লবনাসুরের সাথে
যুদ্ধে নিহত হন।
বেচারা মান্ধাতা! সারা পৃথিবী জয় করেছেন, দীর্ঘকাল শাসন করেছেন কিন্তু এতকাল পরে লোক কেবল জানে তার নাম, জানে না কে তিনি আর তার শাসন আমলটা ঠিক কোন সময়ে। ভারতীয় পুরাণের এই রাজার নাম
থেকেই বাংলা প্রবচন বা বাগধারায় মান্ধাতার আমল বা কাল কথাটি এসেছে।
© সুমন সুবহান
হদিসঃ
১। বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস- ড. মোহাম্মদ আমীন
২। ইন্টারনেট
পোস্ট ভিউঃ 14