চিরকুট- দশ

ব্লগ চিরকুট
চিরকুট- দশ

চিরকুট- দশ

কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম বিশেষত ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট, কমেন্টস,  আলোচনার ধরণ দেখে মনেহচ্ছে সমাজে সূক্ষ্ম এবং গভীরভাবে মেরুকরণ ঘটছে। এই মেরুকরণের চাপে উদারপন্থী গ্রুপটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সে যায়গায় স্থান নিচ্ছে বিভিন্ন ফর্মেটের উগ্রবাদ, আস্তিক-নাস্তিক সবাই এই উগ্রবাদের সাথে জড়িত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত গ্রুপটাই মূলত দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে বা সমাজ সচেতনতায় সব দিক থেকে এগিয়ে। অথচ বর্তমানে এই গ্রুপটা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ছে যেন।  মেরুকরণ ঘটছে।

 

উচ্চবিত্ত শ্রেণীর দেশের কোন ইস্যুতে তেমন মাথা ব্যাথা নেই, সেরকম কিছু হলে তারা মালয়েশিয়া,  কানাডা, দুবাই, আমেরিকা বা ইউরোপে পাড়ি দিবে। বিদেশের ব্যাঙ্কে টাকা আছে, ইনভেস্টমেন্ট আছে, পাসপোর্টে ভিসা বা দ্বৈত নাগরিকত্ব নেয়া আছে, কাজেই তাদের সমস্যা নেই। উচ্চবিত্তদের একটা গ্রুপ এমনিতেই সামাজিক অস্থিরতা বা নিরাপত্তাহীনতার কারণে সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়ছেন। নিম্নবিত্ত বা অন্ত্যজশ্রেনীর এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। তাদের শিক্ষা আদব লেহাজ এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই। আসলে পেটের চিন্তাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় চিন্তা, তাদের পেটের ধান্দা শেষ তো রিপুর ধান্দা শুরু। কারণ বস্তির ঘুপচিতে বসে-শুয়ে হাতের কাছে বিনোদনের এরচেয়ে বড় কোন মাধ্যম নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে আগের মত আর সেই তোরজোর নেই, কারণ তারা হচ্ছে  মানবসম্পদ নামে সমাজের ক্রীতদাস। পৃথিবীর ইতিহাসে সব বিখ্যাত সভ্যতা এমনকি হালের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ক্রীতদাস ভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধাভোগী। শিল্প বিপ্লব দাস শ্রমিকদের রক্তে-ঘামে হয়েছে, মান্না-সালওয়া’’র মতো টুপ করে পড়েনি।

 

বস্তির ঘুপচিতে রাতভোর প্রজনন হবে, তারপর জৈবিক নিয়মে বাচ্চা হবে এবং আঠারো পেরোতেই তাদের একটা অংশ সবুজ পাসপোর্ট হাতে বিদেশে যাবে, একটা অংশ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মরে যাবে আর বাকীরা দেশে রেমিটেন্স পাঠাবে। সমাজ তাদের জন্য পোশাকি নাম ঠিক করেছে, রেমিটেন্স যোদ্ধা। যে অংশটা দেশে থাকছে তাদের একটা অংশ ডাণ্ডিতে বুঁদ হয়ে থাকলেও বড় অংশটা কারখানা-দোকানপাট  বিভিন্ন জায়গায় আয়-রোজগারের জন্য যোগ দিবে কারণ একটাই, সেই পেটের ধান্দা। এখান থেকে একটা অংশ ছিনতাইকারী,চুরি,ডাকাতি,কুখ্যাত খুনি এবং আপন কর্ম গুনে কেউ কেউ মাদক ব্যবসায়ী বা গড ফাদার হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হবে। তার পুরো জীবন চক্রে পড়াশোনা বা নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারটা অনুপস্থিত। কেউ কেউ মাদ্রাসায় গেলেও তাদের অনেকেই সমাজের আগাছা হিসেবেই বের হচ্ছে। যারা বিদেশে যাচ্ছে, তারা কয়েকবছর ডলার কামিয়ে দেশে ফিরে বিয়ে করে, সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার টাকার ধান্দায় বছরের পর বছর বিদেশে কাটাবে। তাদের ক’’জনইবা দেশে ছুটিতে আসার সুযোগ পায় বা ছুটিতে আসে! এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন ক্রাইম। বিদেশ থেকে পাঠানো ডলারের কারণে অনেকের হাতে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে স্মার্টফোন। এভাবে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত এবং নৈতিক শিক্ষা বিবর্জিত একটা শ্রেণির হাতে মোবাইল পৌঁছে যাওয়ায় নতুন আরেক ধরণের ক্রাইমের জন্ম দিচ্ছে। তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, অচেনা কারো স্ট্যাটাসে কমেন্টস করে, আপন গণ্ডির বাইরের ইস্যুতে মতামত দেয় এবং তার আপন মানদণ্ডে একজনকে জাজ করে বসে। এই ভাসমান গ্রুপটা আবার জঙ্গি উৎপাদনের উর্বর ক্ষেত্রও বটে।

 

উচ্চবিত্তদের নিয়ে সঙ্গতকারণেই কিছু বলার নেই, কারণ তাদের পালানোর পথ আছে। যেকোন সামাজিক  অস্থিরতায় যে গ্রুপটা বেশি ভুগে থাকে এখন তাদের কথায় আসি। মধ্যবিত্ত গ্রুপটাতে নানাবিধ মিথস্ক্রিয়ার কারণে অশান্তি বেশি এবং আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে তারাই বেশি ভোগে। তাদের মাঝে অর্থসংকট এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রলোভন দুইই আছে। তারা নিম্নবিত্ত গ্রুপের সাপ্লাই করা মাদক সেবন করে উচ্চবিত্ত গ্রুপের দেখানো পথে হাঁটে এবং হোঁচট খায়। পেটের ধান্দার জন্য চাকরি দরকার কিন্তু চাকরি নেই। কারিগরি শিক্ষার অভাবে অন্যকিছু যে করবে সে উপায় নেই। নিম্নবিত্ত তাও পানের বা চায়ের দোকান দিয়ে পেটের ব্যবস্থা করতে পারবে কিন্তু তার সে উপায় নেই। এই গ্রুপ থেকে যারা বুদ্ধিমান তারা বাইন মাছের মতো এই সমাজেই সুন্দরভাবে বেরে উঠে বিদেশে পাড়ি দেয় অথবা উদ্যোক্তা হয়ে পুঁজিপতি হয়, উচ্চবিত্ত গ্রুপে ঢুকে রহমান হয়ে যায় রেহমান অথবা জরিনা হয়ে যায় জারিনা। নিম্নবিত্তদের টার্গেট এই মধ্যবিত্তরাই, কারণ হাতের নাগালেই পাওয়া যায়, আর উচ্চবিত্তরা এদের নিয়ে খেলে, কারণ এরা  তাদের জন্য ভোগের জ্বালানী দেয়।   

 

সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকট, অস্থিরতার কারণে তারা বিভিন্ন ননইস্যুতে পথে নামে, বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ট্রলিং করে, বডি শেমিং করে, কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত করে মজা পায়, আন্দোলন করে কারণ অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণের জন্য একটা কিছু নিয়ে তো থাকা দরকার। রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ আনছিনা কারণ ওটার প্রয়োজন এবং আবেদন নব্বইয়ের দশকেই ফুরিয়ে গেছে, এখন যা হয় তাকে এক কথায় তামাশা বলে। তা না হলে দ্রব্যমূল্য ইস্যু বাদ দিয়ে এখন পোশাকের ভিতরে কি পরা হবে তা নিয়ে বচসা করে! একটা সময় ছিল যখন ছাত্র-যুবকরা প্যালেস্টাইনে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেছে, সেটা বিভিন্ন গণমাধ্যমের দ্বারা দেশেবিদেশে মানুশ জানতে পেরেছে। এটাকে বলে সংহতি, আরেকজনের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো। এখনকার যুবক আইলানের  ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেয়, বক্তব্য ঐ পর্যন্তই। ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসনের প্রতিবাদে ঢাকায় ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি দুজন ছাত্র, মতিউল ইসলাম এবং মীর্জা কাদেরুল ইসলাম যে শহীদ হয়েছিলেন  সে খবর ক’’জন জানেন। এখন কেউ কি জানেনা ইউক্রেনে রাশিয়া কি করছে, সৌদি আরব ইয়েমেনে কি করছে, সিরিয়ার মেয়েদের বাঁচার অবলম্বন কেন বেশ্যাবৃত্তি? এখন এসব নিয়ে আন্দোলন হয়না কারণ ব্লাউজ পরা বা না পরার আন্দোলনে স্পাইস বেশি। কে বোরখা পরলো আর কার শরীরে খোলামেলা   পোশাক এসব নিয়েই এখন বেশি গবেষণা হয়। এখন একজন মানুশ তার পছন্দের পোশাক পড়লেও ট্রলিং এর শিকার হয়। যথাযথ জ্ঞান না থাকার পরও ধর্মীয় ইস্যুতে ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা দেয়া এখন ডালভাতের মতো ব্যাপার। যে কখনও নামাজ পড়ে না, কিংবা বছরে দু’বার নামাজ পড়ে, অথবা খ্রিস্টানদের মতো সপ্তাহে একদিন উপাসনালয়ে যায় তারাও কোরানের আয়াত নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়।       

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস দেখলাম, তার আফসোস কারণ তার জন্ম একাত্তরে হয়নি। তো হলে কি হতো! বর্তমানে যেরকম মূল্যবোধ নিয়ে জেনারেশনটা বেড়ে উঠছে তা দেখে মনেহয়, মুক্তিযুদ্ধটা একাত্তরে না হলে বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের উপনিবেশ থাকতো। কারণ তখন সমাজে জ্ঞানী লোক কম থাকলেও দেশপ্রেমিক প্রচুর ছিল। দেশের জন্য জীবন দিতে হলে জ্ঞান নয়, আবেগ লাগে, প্রেম লাগে। এখন প্রেম বলতে মানুশ দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর বোঝে। তাই আমার তো মনেহয় এদের একটা বড় অংশ রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাতো। আমার এই কথার সাথে যাদের ভিন্নমত থাকবে তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই, এই যে কয়েকদিন আগে মিয়ানমার বাংলাদেশের ভিতরে গোলা ফেললো। ঢাকার রাজপথে এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে কি! এটা কি ধরণের দেশপ্রেম! নাকি ব্লাউজের খবর রাখতে যেয়ে এই খবর নজর এড়িয়ে গেছে! অথচ কখনো কখনো এরকম মিছিল বা জনমত সরকারের হাতকে শক্তিশালী করে। আমি তো বলবো এরকম একটা ইস্যু, যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন সেখানে সরকারের পাশে কেউ ছিলনা। এরকম ইস্যুতে যদি সারাদেশ ধর্ম-মত নির্বিশেষে একাট্টা হতে না পারে তো কখন হবে! পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে যারা কথা বলেন, তারা এই সমস্যার কতোটা গভীরে গেছেন বা কতোটা জানেন! এই সেনাবাহিনী সেখানে কত রক্ত দিয়েছে তার হিসেব কেউ রেখেছেন! কেউ কি ক্লিয়ার ভাবে জানে এই ইস্যুতে রাষ্ট্রের অবস্থানটা কি এবং সেটা কেন!  

আসলে লাইব্রেরীতে বইএর পৃষ্ঠা না উল্টিয়ে বিছানায় শুয়ে ফেসবুকের টাইমলাইনে মাউস স্ক্রলিং করে কিছু শেখা যায়না।      

সবাইকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। 



পোস্ট ভিউঃ 8

আপনার মন্তব্য লিখুন