চিরকুট- এগারো
১
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের সভ্যতা সবখানে সমান ভাবে বিকশিত হয়নি। একসময় পৃথিবীতে ক্রো-ম্যাগনন,
নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষ, হোমো সেপিয়েন্সরা যেমন একসাথেই বিভিন্ন অঞ্চলে বাস
করেছে তেমনি পৃথিবীর একপ্রান্তে নিওলিথিক যুগের সমাজব্যবস্থা চালু থাকলেও
অন্যপ্রান্ত ততদিনে হয়তো তাম্র বা ব্রোঞ্জ যুগে প্রবেশ করেছে। আবার লৌহ যুগের
সূচনা পৃথিবীর সব জায়গায় একসাথে ঘটেনি। আরব পেনিনসুলা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে লৌহ
যুগে প্রবেশ করলেও খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ অব্দের দিকে মিশর, খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দের
দিকে গ্রীস ও ইউরোপের কিছু অংশ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে ব্রিটেন লৌহ যুগে
প্রবেশ করে। আসলে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবেই পৃথিবীর সব জায়গায় সামাজিক বিপ্লব সমান
ভাবে হয়নি। উদ্বৃত্ত ফসল ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে আন্তঃদেশীয় বা আন্তর্জাতিক ব্যবসা-লেনদেন
শুরু হয়েছে ব্রোঞ্জ যুগে অথচ কৃষিব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে আরও আগে, সেই নিওলিথিক
যুগেই।
প্যালিওলিথিক যুগের হান্টার-গ্যাদারার্স সোসাইটিতে মানুষ দলবদ্ধভাবে থাকতো খাদ্য ও জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনে। নিওলিথিক যুগে এসে সেটা আরও পরিশীলিত বা উন্নত রূপ ধারণ করে ধীরে ধীরে কৌমভিত্তিক মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এখনও বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া ও গারো নৃগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার মিনানকাবাও, চীনের মোসুও, স্পেনের বাস্কোস, দক্ষিণ আফ্রিকার চরোকি, চক্টো, গিটস্কান, হাইডা, হপি, ইরোকুইস, উত্তর আমেরিকার লিঙ্গট, পশ্চিম সুমাত্রা, মালেশিয়ার নিজারে সিম্বিলান, কেরালার নায়ার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চাম সম্প্রদায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা লালন করে। তবে আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবার বা বিয়ের ধারণাটা তখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যৌন আচরণের দিক থেকে সমাজটা তখনো অজাচার যুগেই ছিল। এজন্য সন্তান পরিচিত হতো মায়ের পরিচয়ে। কাবিল আর আকলিমার ভাইবোন বিয়ে এই বিয়েপ্রথার একদম প্রাথমিক স্তরের ধারণা। মর্গানের ‘‘আদিম সমাজ’’ বইটা পড়লে এসম্পর্কে আরও পরিস্কার ধারণা লাভ করা সম্ভব।
২
মাতৃতান্ত্রিক সমাজে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো কৃষিকাজের
আবিষ্কার। প্রথমদিকে এই কাজটি মেয়েদের অধীনেই ছিল, ছেলেরা শিকারে গেলে মেয়েরা অনেক
সময় ক্ষুধার্ত থাকতো। তখন ফলমূল সংগ্রহ করে তারা খিদে মেটাতো, আর এটা করতে যেয়েই বীজ থেকে গাছ
হওয়ার ঘটনাটি আবিষ্কৃত হয়। এভাবেই আবিষ্কার হয় কৃষিকাজের।
মর্গানের এই থিওরি মার্কস-এঙ্গেলসও মেনে নিয়েছেন। হান্টার-গ্যাদারার্স সমাজ বা শিকারি
সমাজ ছিল স্থিতিশীল, অপরিবর্তনশীল
অথচ উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতার কারণে কৃষিজীবি সমাজ ছিল গতিশীল এবং সভ্যতার
জন্মদাতা। এরপর কৃষিকাজের পাশাপাশি বনের নিরীহ পশুকে পোষ মানাতে শিখলো মানুষ। কৃষির
ফলে উৎপন্ন ফসল খাইয়ে তাদের পালন করা যেত সহজেই। বাড়তি মানুষের মুখে আহার যোগাতে অধিক ফসল উৎপাদনের দরকার
হয়ে পড়লো। এজন্য কৃষিতে ভূমি কর্ষণের জন্য লাঙ্গলের সাথে পশু ব্যবহার করা হতে
লাগলো। এভাবেই ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সমাজ হয়ে পড়লো পুরুষের অধীন। সেই সময় থেকে
আজো পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা চলছে।
সমাজে সম্পদের উপরে কর্তৃত্বের পালাবদলের পাশাপাশি পরিবারের রীতিনীতি-বিয়ে প্রথা এসবেও অনেক রূপান্তর ঘটে। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিয়ে বা পরিবার বর্তমান সময়ের রূপ লাভ করে। এই কিছুদিন আগেও পরিবারগুলো ছিল যৌথ পরিবার। সেখানে বাবা-চাচা-ভাই-বোন সবাই একসাথেই থাকতো, এক হাড়িতেই সবার জন্য রান্না হতো। একসাথে বেড়ে ওঠা, ক্ষেত-খামার-খেলাধুলা এসব করতে যেয়ে কেউ কখনো একাকী অনুভব করতো না। ঠাকুর মা’’র ঝুলির গল্পগুলোর এভাবেই উৎপত্তি।
নারী-পুরুষের ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ‘‘হান্টার-গ্যাদারার্স সোসাইটি’’ র
সংঘবদ্ধ ভাবে থাকার অভ্যাসটা তখন পর্যন্ত বহাল ছিল। কেননা এতে মানুষ
অর্থনৈতিক-সামাজিক-শারিরীকভাবে নিরাপত্তা খুঁজে পেত।
ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদের ক্রমশ বণ্টন হতে হতে তা সীমিত হয়ে আসা এবং সেই সাথে আরও অন্যান্য সামাজিক উপাদান যোগ হয়ে মানুষের মাঝে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যায়। শুধুমাত্র বাবা-মা-ভাই-বোনকে নিয়ে ছোট ছোট বাসায় ছোট ছোট পরিবার। একসময় বাসাগুলো হয়ে যায় ফ্ল্যাট। এখন ফ্ল্যাটগুলো হয়ে গেছে রুম এবং রুমগুলো হয়ে গেছে ১০ ইঞ্চি সাইজের স্মার্ট ফোন। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ এরচেয়ে একাকী কখনও হয়নি।
৩
আদিম মানুষের প্রথম আবিষ্কার যেমন আগুন তেমনি প্রথম
অভিজ্ঞতা হলো ভয়। হোমো সেপিয়েন্স মানুষের মাঝে আবারও নতুন করে ভয় এসে ভর করে,
প্রথম ভয়টা ছিল অজানার ভয় আর বর্তমান সময়ে এই ভয়টা হলো একাকীত্বের। অথচ বেঁচে
থাকতে হলে কথা বলার জন্য একটা মানুষ খুব দরকার। কারণ সমাজবদ্ধভাবে থাকা মানুষের
প্রথম অভ্যাস, রক্তের মাঝে মানুষ সেই অভিজ্ঞতার অনুভূতি বহন করে চলছে আজো। এজন্যই
মানুষ যে কারণেই একা হোক না কেন, সবসময়ই চেয়েছে তার পাশে কেউ একজন থাকুক। কেউ একজন
থাকুক যার সাথে কথা বলা যায়। টম হ্যাঙ্কসের ‘‘Cast Away’’ সিনেমাটা দেখলে
একাকীত্বের যন্ত্রণা খানিকটা উপলব্ধি করা যায়।
এজন্যই সবসময়ই একটা সম্পর্কের মাঝে থাকুন, সম্পর্কটার ধরণ যেরকমই হোক না কেন। কথা বলুন মন খুলে। মনের ভিতরের যে অনুভূতি সেটা রাগ-অনুরাগ-ভালোবাসা বা ক্ষোভ যাই হোক না কেন তার প্রকাশ হতে দিন। পাশের মানুষটা রাগ করলে একটু নীরব থাকুন, রাগ এমনিতেই নেমে যাবে, তারপর কথা বলুন। আমার এক কলিগ এবং বন্ধু, একদিন কোন একটা কারণে আমার উপরে ভীষণ রেগে গিয়ে বললো তার অফিস থেকে চলে যেতে। কিন্তু আমি চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম এবং তার রাগটা প্রশমিত হতে দিলাম। সে ঠাণ্ডা হওয়ার পর তার রুম থেকে চলে এলাম। পরে একদিন তাকে বললাম, আমার সাথে সেদিন তার খারাপ আচরণ করা ঠিক হয়নি। সে তার ভুলটা বুঝতে পেরেছিল। সে আমার খুবই কাছের একজন বন্ধু। অথচ আমি যদি সেদিন রাগের মাথায় তার অফিস থেকে চলে আসতাম তাহলে আমি জানি তার সাথে আমার সম্পর্কটা আর থাকতো না। অথচ আমি তার সাথে আমার সম্পর্কটা ধরে রাখতে চেয়েছি।
আমাদের আসলে সম্পর্কগুলো ধরে রাখতে হলে তার নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। সম্পর্ক অনেকটা চারাগাছের মতো, যত্নে বিকশিত হয় আর অযত্নে আগাছা জমে একসময় মরে যায়। মানুষ একাকীত্ব দূর করতে অনেকসময় পোষা প্রাণীর কাছে আশ্রয় খুঁজে নিলেও কথা বলার অভাব তো পুরণ হয়না। তাই কথা বলার জন্য একান্তই কেউ যদি না থাকে তাহলে কথা বলুন খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে। আপনার উচ্চারিত কথাগুলোকে প্রতিধ্বনি হয়ে আপনার কাছে ফিরে আসতে দিন। সেটাও সম্ভব না হলে কথা বলুন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের সাথে, তবুও কথা বলুন। এটা খুব দরকার। শুধুমাত্র মনের কথাটা বলতে না পারার বা শুনবার মতো মানুষের অভাবে পৃথিবীতে কতশত লোক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, কেউ তার হিসেব রাখেনি। এই ক্ষেত্রে ‘‘লুসি’’ র ফসিলটার কথা খুব মনেপরে।
৪
আজ ১০ সেপ্টেম্বর,
ভেঙে
যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগানোর দিন,
ইন্টারন্যাশনাল
মেক–আপ ডে। পুরনো ক্ষত মুছে ফেলুন। প্রিয় মানুষটার কাছে ফিরুন, সম্পর্কের কাছে ফিরুন। অযত্নে অবহেলায় কত
বন্ধুত্ব ফুরিয়ে গেছে ছোট বেলায় বা বড় হবার পরেও। অনেকসময় অদ্ভুত সব কারণে বা
সামান্য ইগো থেকেও ছিন্ন হয়ে গেছে নির্মল সম্পর্ক। কত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তৈরি
হয়েছে মুখ না দেখাদেখির দূরত্ব। ছিঁড়ে গেছে সম্পর্কের সুতো অথচ আমাদের জীবনটা কত
ছোট! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রিয় মানুষটার সাথে সম্পর্কে চিড় ধরে
থাকলে তাতে কার কতটুকু দোষ ছিল, আপনার দায়
কতটুকু, এসব ভাবনা নাহয় থাক।
আপনিই নাহয় হাতটা বাড়িয়ে দিন। তিক্ত অতীত ভুলে যান, সম্পর্ক ভাঙায় যার ভূমিকা
যতটুকুই থাকুক না কেন, জোড়া লাগানোয় মূল ভূমিকাটা আপনারই হোক। আমাদের ধর্মও তো
তাইই বলে।
৫
একাকীত্ব কখনো কখনো ভীষণ যন্ত্রণার, এর ভার সবাই বইতে পারেনা।
ভালো থাকবেন।
সবার জন্য শুভ কামনা।
পোস্ট ভিউঃ 7