চিরকুট- বারো
১
২০০৮ সাল থেকে ফেসবুক ব্যবহার করছি। এরমধ্যে কত নতুন নতুন ফিচার
যোগ হলো, কিছু বাদ গেল।
ফেসবুক জীবন থেকে অনেক কর্মঘন্টা কেড়ে নেয় ঠিকই কিন্তু একটা
ফিচার খুব ভাল লাগে, সেটা হলো ফ্রেন্ডসদের জন্মতারিখটা এলেই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি বিশ্বাস করি
অনেক সময় দুটো মিষ্টি কথা, সামান্য কুশল বিনিময়, হালকা আলাপচারিতায় কারো কাছ থেকে যেটুকু সম্মান, ভালোবাসা
বা শ্রদ্ধা অর্জন করা যায় তা লাখ টাকা খরচা করেও অর্জন করা সম্ভব না। তাছাড়া আমরা ক’’দিনইবা বাঁচবো!
সবাইতো অনন্তমেরুর যাত্রী, যেভাবে টিকেট কাটা আছে
সেভাবেই নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মে নেমে যেতে হবে আরেক পথের সন্ধানে। ক্ষণিকের মুহুর্তটুকু
রাঙাতে তাই চেষ্টা করি কারো জন্মদিনের নোটিফিকেশন এলে তাকে একটা বার্থ ডে উইশ করার। অনেকের সাথে হয়তো
সেভাবে পরিচয় নেই কিংবা লেখালেখির সূত্রে ঘটেছে এই মিথস্ক্রিয়া তাই অনেকেই উইশ পেয়ে
অবাক হন, ফিরতি শুভাশিস জানান কেউকেউ। আজ সেরকমভাবে আমার শৈশবের একবন্ধুকে সকালে বার্থ
ডে উইশ করতে গিয়ে দুজনে যেন গল্পের ফল্গুধারা মেলে ধরলাম। তাতে পড়াশোনা, ক্লাসের
নোটস বিনিময়, মেয়েদের সাথে দুষ্টামি, কাব্যচর্চা
কিছুই বাদ যায়নি। স্কুল জীবনের দুরন্ত মুহুর্ত, প্রিন্সিপাল, টিচার, ম্যাডাম সবাইকে নিয়েই টুকটাক গল্প করলাম।
২
আমি বলছি আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। সেসময়ে রংপুরের সরকারি স্কুলগুলোতে
ক্লাস সিক্সের বেতন হয়তো ছিল ৮/১০ টাকা কিংবা তারচে কম, আমি আসলে জানিনা। তবে রংপুর ক্যান্টনমেণ্ট পাবলিক স্কুলে ক্লাস সিক্সেই আমাদের
বেসিক বেতন দিতে হতো ৭১টাকা, সেই সাথে অন্যান্য চার্জ। ঢাকার স্কুলগুলোর
সাথে তুলনা করছিনা, তবে আশির দশকে আর্থসামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মফস্বল নগরী রংপুরের
জন্য ওটা কিন্তু অনেক বেশী। এজন্য স্কুলের নাম শুনলে অভিভাবকদের অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে
থাকতেন, আজ বুঝি তাদের সেই দৃষ্টিতে শ্রেণীবৈষম্যের রেশ ছিল। আমরা যেন একটা পেটিবুঁর্জোয়া
সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বেড়ে উঠছিলাম! তখন পড়াশোনা, ডিবেট,
খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ে রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এবং জিলা স্কুলের
মাঝে তুমুল প্রতিযোগিতা হতো। আর্মির পরিচালিত স্কুল বলেই হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম না হলেও ক্যাডেট
কলেজগুলোর মতো কঠোর ডিসিপ্লিনের মাঝে ইংরেজির চর্চাটা একটু বেশি হতো, আর টিচার-ম্যাডামরা পোশাক-পরিচ্ছদ, জ্ঞান
ও চিন্তাভাবনায় ছিলেন বেশ আধুনিক। আমাদের প্রিন্সিপাল মোঃ আনোয়ার হোসেইন স্যারের
ইংরেজি/বাংলায় বক্তৃতা, কথা বলার ধরণ, চলাফেরা এবং স্মার্টনেস দেখে আমরা ওনাকে আর্মি অফিসার ভাবতাম। অনেক পরে অবশ্য সে
ভুলটা ভেঙেছিল।
২.১
আমার স্কুলের স্যারদেরকে নিয়ে আরেকদিন লিখবো, আজ লিখবো
ম্যাডামদের নিয়ে। বিশেষ করে ইভা মণ্ডল ম্যাডাম, শিরিনা ম্যাডাম এবং মাহবুবা
ম্যাডামকে নিয়ে খানিকটা স্মৃতিচারণ করবো। প্রথমেই বলি ইভা মণ্ডল ম্যাডামের
কথা, উনি আমাদের রেগুলার ক্লাস নিতেননা। যখন নিয়মিত টিচারদের কেউ
অনুপস্থিত থাকতেন তখন ম্যাডাম প্রক্সি দিতে আসতেন অথচ আমরা খুব করে চাইতাম উনি যেন
নিয়মিত ক্লাস নেন। কারো কণ্ঠস্বর যে এতোটা মিষ্টি হতে পারে ম্যাডামের সাথে পরিচয়
না হলে জানতাম না। ওনার হাতে কখনো কখনো বেত থাকলেও উনি এতো মিষ্টি করে কথা বলতেন
যে ওনার কাছে শাস্তি পেতেও ভালো লাগতো। আজ এতো বছর পরে ওনার কথা খুব করে মনেপড়ছে। উনি সম্ভবত ক্লাস
সেভেন কিংবা এইটে গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন শেষ ক্লাসটা নিয়েছিলেন। ম্যাডামের গল্পের
ভাণ্ডার অফুরন্ত এবং সময় সুযোগ মিললেই উনি সুন্দর করে গল্পগুলো শোনাতেন। ওনার কাছ থেকে বাংলা
সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত গল্প শোনা হয়েছিল। যেহেতু পরদিন থেকেই ছুটি শুরু হবে তাই আমরা সেদিন
আবদার করলাম, কোন লেখাপড়া না, আমরা ম্যাডামের কাছে গল্পশুনতে
চাই। উনি টেবিলের ওপরে বেত দিয়ে কয়েকবার আঘাত
করেও যখন আমাদের শান্ত করতে পারলেন না, তখন শুরু করলেন তার অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠে গল্প
বলা। উনি সেদিন আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘ছুটি’’গল্পটা শুনিয়েছিলেন। ম্যাডাম জানতেন গল্প বলার সময়ে যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার। তিনি জানতেন গল্পের
কোথায় স্বরটা উঁচুতে এবং কোথায় খাদে নামাতে হয়। এরফলে গল্পের প্রতিটা চরিত্র
এবং আবহ যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো। আজও ‘‘ছুটি’’ গল্পের দরিদ্র-বিধবা মায়ের সন্তান ফটিকের সেই সংলাপটা কানে বাজে, “মা,
এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
২.২
ক্লাস নাইনে ওঠার পর শিরিনা ম্যাডাম আমাদের বায়োলজি ক্লাস নিতেন। ম্যাডাম ছিলেন অসম্ভব
রূপসী আর তাঁর নাকের ওপরে একটা আঁচিল ছিল। আঁচিলটা ওখানে ছাড়া মুখের আর কোথাও যেন মানাতো
না। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসে মায়াবতী বিশেষণে
যেই নারীদের চিত্রিত করেন, ম্যাডাম যেন ঠিক সেরকম একজন মায়াবতী টিচার। যিনি আমাদের শাসন
করতে পারতেন না, জোরে চীৎকার করতে পারতেন না, তাই ক্লাসটাও
কন্ট্রোলে নিতে তাঁর বেশ বেগ পেতে হতো। ক্লাসে প্রথম দিকে যাদের
রোল, সেই ছেলেগুলো সাধারণত একটু ভদ্র-শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকে,
তারা এবং ক্লাসের মেয়েরা খুব ভদ্র হলেও আমরা ছিলাম দুরন্তপনায় সেরা। তাই ম্যাডামের পক্ষে
কোনদিনই আমাদেরকে কন্ট্রোল করা সম্ভব হয়নি, আর আমরাও যেন ম্যাডামের ক্লাসটার জন্যই অপেক্ষা
করতাম। ম্যাডামের আঁচিলের দিকে তাকিয়ে হাইস্কুল জীবনটা পার করে দিলাম। অনেক পরে, মিলিটারি
একাডেমির ট্রেনিং শেষে অফিসার হওয়ার পরে স্কুলের টিচার/ ম্যাডামদের
সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন শিরিনা ম্যাডাম পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সেই
মাতৃস্নেহ আজও যেন অনুভব করি।
২.৩
মাহবুবা ম্যাডামকে নিয়ে আমি সম্ভবত একটা উপন্যাস লিখতে পারি। আমার জীবনে সম্ভবত
এরকম প্রভাব আর কেউ কখনো ফেলেনি। আমি একইসাথে ওনাকে শিক্ষক হিসেবে প্রচুর শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম এবং ঘৃনাও করতাম। ঘৃনার কারণ উনি আমাকে
খুব শাসন করতেন, বলতে গেলে শাসনে শাসনে স্কুল জীবনটা বিষিয়ে তুলেছিলেন। আমি তারপরও ওনাকে
ভীষণ শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি, কারণ আমার মাঝে লেখক সত্ত্বার বীজটা যদি আমার
বাবা বপন করে থাকেন, তাহলে বলবো তার পরিচর্যাটা উনিই করেছেন। ওনার কারণেই বাংলা
সাহিত্যের প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা জন্মে। ম্যাডামের ছিল অন্তর্ভেদি দৃষ্টি, আর সেটা
দিয়ে এক্স-রে’’র মতো উনি আমার মনোজগতে কি
চলছে তা ধরে ফেলতে পারতেন। উনি ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী, রাশভারী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন শিক্ষক। ম্যাডাম বাংলা পড়াতেন। ওনার এতো এতো বাংলা
কবিতা মুখস্ত ছিল এবং লেকচারের মধ্যে সেসব
কী সুন্দর করে ব্যবহার করে আমাদের বোঝাতেন যে আমি অবাক হয়ে যেতাম। লেকচারের প্রয়োজনে
উনি সিলেবাসের বাইরেও যেতেন, আমাদের শেখাতে তাঁর মাঝে বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টার
অভাব দেখিনি। আমি কখনও পরীক্ষার জন্য চিঠি বা দরখাস্ত লেখা, ভাবসম্প্রসারন,
সারাংশ, রচনা এসব মুখস্ত করিনি। বাংলা সাহিত্যের
পোকা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার কারণে প্রচুর গল্প-কবিতা-উপন্যাস স্কুল জীবনেই
পড়া হয়েছিল। আমাদের স্কুলে একটা চমৎকার এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল, সেখান থেকে
নিয়মিত বই সংগ্রহ করে পড়তাম। আমার মনেপড়ে মিলিটারি একাডেমীতে সম্ভবত আমাদের ডিগ্রী পরীক্ষায়
অথবা টার্ম এন্ডে একটা রচনার বিষয়বস্তু ছিল
‘‘বাংলাদেশের কবিতা’’, আমি যেখন সেটা লেখা শুরু করলাম তখন
পরীক্ষার হলে পর্যবেক্ষক ছিলেন মেজর মাহমুদ স্যার, স্যার আমাকে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘Can you really write it? Are you sure?’’, আমি নির্দ্বিধায় বলেছিলাম, ‘‘Yes Sir, I can.’’ কারণ
উনি তো জানতেন না যে আমি মাহবুবা ম্যাডামের নির্যাতনে বড় হয়েছি, বাংলা সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছে ওনার কাছেই। তাই হয়তো মিলিটারি একাডেমীর
কঠিন প্রশিক্ষণও কবিতা লেখার ভুত ছাড়াতে পারেনি। আজও কান পাতলে মাহবুবা ম্যাডামের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
লেখা ‘‘দুই বিঘা জমি’’ কবিতার লাইনগুলো আমার কানে বাজে,
নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল
লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
অনেকবার প্ল্যান করেছিলাম, ছুটিতে রংপুরে গেলে ম্যাডামের সাথে দেখা করে আমার কাব্যগ্রন্থগুলো ওনার পায়ের কাছে রাখবো। এ হতো আমার গুরুদক্ষিণা, আমি জানি উনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু সেটি আর করা হয়ে ওঠেনি, আর কখনো সেটা করা হবেওনা। কারণ ম্যাডাম তার প্ল্যাটফর্মে নেমে গেছেন পরের যাত্রার সন্ধানে। আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ্ যেন তাঁর ওপরে বেহেশত নসীব করেন। খুব ভালোবাসি তাঁকে, তাঁর জন্য প্রাণভরে দোয়া করছি।
৩
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর
০৫ অক্টোবর শিক্ষকদের অবদানকে
স্মরণ করার জন্য
বিশ্বের
প্রায় ১০০টি দেশে পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক
দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন
করা হয়। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর, অথচ তারা আমাদের সমাজে আজও অবহেলিত। তাদের মাথায় করে
রাখবার কথা থাকলেও বেতন স্কেলে তারা আজও নিচের সারিতে। আমি আজ গভীর শ্রদ্ধা ভরে
স্মরণ করছি আমার প্রিয় শিক্ষকদের, যাদের জন্য এতোটা পথ হাঁটতে পেরেছি। তাদের জন্য দোয়া।
৪
এই দিনটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে আমার তিনজন প্রিয় ম্যাডামের
গল্প সবার সাথে শেয়ার করলাম। ভালো থাকবেন সবাই।
পোস্ট ভিউঃ 7