চিরকুট – ষোলো
১
হুমাঝাতিল্ লুমাঝাহ্।
পবিত্র কুরআন শরীফে সুরা-আর রহমানের মতো বেশকিছু সুরা আছে যেগুলোর আয়াত বা বাক্য কবিতার লাইনের মতো আওড়াতে ভাল লাগে। আমার কাছে এরকম একটা পছন্দনীয় সুরা হলো সুরা আল হুমাযাহ। এই সুরার প্রথম তিনটা বাক্য এরকম, ‘‘(১) ওয়াইলুল্লি কুল্লি হুমাঝাতিল্ লুমাঝাহ্। (২) আল্লাযী জামা’‘আ মা-লাওঁ ওয়া ‘‘আদ্দাদাহ্। (৩) ইয়াহ্সাবু আন্না মা-লাহূ~আখলাদাহ্’’। এই সুরাটি কুরআন শরীফের ১০৪ তম সুরা, যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং আয়াত সংখ্যা ০৯। প্রথম ০৩ আয়াতে মানুষের ০৩টি জঘন্য গোনাহ্র কথা (গীবত, সামনা সামনি দোষারোপ করা ও মন্দ বলা এবং অর্থলিপ্সা) এবং পরবর্তী ০৬ আয়াতে এসব গোনাহ্র কারণে প্রাপ্তব্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে। প্রথম ০৩ আয়াতের বঙ্গানুবাদ, “(১) প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ, (২) যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে, (৩) সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে”। এক জায়গায় পড়লাম এই সুরার প্রথম আয়াত ‘‘ওয়াইলুল্লি কুল্লি হুমাঝাতিল্ লুমাঝাহ্’’-তে ব্যবহৃত ‘‘হুমাঝাহ’’ এবং ‘‘লুমাঝাহ’’ শব্দ দুটির মধ্যে দিয়ে মানুষের ২৩ ধরণের আচরণকে নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক জানেন কুরআনের শেষ পারার ছোট সূরাগুলিই মানুষ নামাজ আদায় করার জন্য বেশি শিখবে, সেজন্যই হয়তো এসব সুরার ছোট ছোট বাক্যে বিভিন্ন নিয়ম কানুনের চেয়ে আত্মার পরিশুদ্ধতার দিকে বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
২
হুমাঝাতিল্ লুমাঝাহ্ কারা?
তাফসীরকাররা বলেন, এই আয়াতে ‘‘হুমাঝাহ’’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে গীবত কারীকে আর ‘‘লুমাঝাহ’’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে সম্মুখে তুচ্ছ- তাচ্ছিল্যকারীকে। অর্থাৎ এরা এমন এক ধরনের মানুষ, যে অন্যকে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করে। মানুষের দিকে তাচ্ছিল্য ভরে আঙ্গুল দেখায়। চোখের ইশারা করে ব্যাঙ্গ করে। কারও চরিত্রের কোনো দিক নিয়ে ব্যঙ্গ করে। কারও মুখের উপর তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করে। কারও পেছনে তার দোষ বলে বেড়ায়। এর নামে ওর কাছে কথা লাগিয়ে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে ফাটল ধরায় এবং এরকম করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একটু ভেবে দেখুন, এরকম বাজে স্বভাবের মানুষগুলো কিন্তু আমাদের আশেপাশেই আছে। তাদের চলাফেরা, কথাবার্তা, প্রকাশভঙ্গী, ফেসবুক স্ট্যাটাস ইত্যাদি দেখে সহজেই তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়। এই যেমন তারা,
# কাউকে তাচ্ছিল্য ভরে কোনকিছু নির্দেশ করে (আঙুল,চোখ,
মাথা
বা ভ্রু দ্বারা)।
# কারও অবস্থান বা পদবি নিয়ে তাকে ব্যাঙ্গ করে।
# কারো বংশের নিন্দা করে বা বংশ নিয়ে কথা বলে।
# কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলে, অপমান করে।
# কারও মুখের উপর তার সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করে।
# সরাসরি বাজে কথা দিয়ে কাউকে আঘাত করে।
# কাউকে এমন কোনো কথা বললো যাতে আরেকজন কষ্ট পাবে।
# অসন্মান করে কথা বললো।
‘‘আমি উচিৎ কথা মুখের উপর বলে দেই’’ বা নিজেকে ভীষণরকমের ‘‘স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড’’ দাবী করে তারা নিজেদের মনে যা আসে তাই বলে বেড়ায়। এই মানুষগুলো সমাজে তাদের অবস্থান বা পরিচিতি কিংবা যাকে নিয়ে বলছে সমাজে তার অবস্থান বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনো ভাবেনা। তারা কখনো কখনো এমনকি গালাগালিসহ সরাসরি মুখের উপর সব বলে দেয় বলে সবার কাছে ঠোঁটকাটা স্বভাবের হিসেবে পরিচিত পায়! আর এজন্য তারা মোটেও লজ্জিত না হয়ে বরং গর্ব অনুভব করে। অথচ যাকে নিয়ে কথা বলা হয় সেই ব্যক্তিটি হয়তো তার সামাজিক মর্যাদা, পরিচিতি, ব্যক্তিগত রুচি বা প্রজ্ঞা, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, মহানুভবতা কিংবা অনুগ্রহ বা দয়াবশতঃ এসব বিষয়ে চুপ থাকেন বা উপেক্ষা করে শুধু আল্লাহ্র কাছে গুনাহ্কারীর শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য দোয়া করেন। এদের সাথে আল্লাহ্ কী করবেন, তার বর্ণনা এই সুরার বাকী ০৬ আয়াতে আছে, যার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “(৪) কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। (৫) আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কি? (৬) এটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, (৭) যা হৃদয় পর্যন্ত পৌছবে। (৮) এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে, (৯) লম্বা লম্বা খুঁটিতে”। এই সুরাতে দোজখের ভয়াবহ রূপটা যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে পুরো কুরআন শরীফের আর কোথাও শাস্তিকে বোধহয় এতটা কঠিন করে বলা হয়নি।
৩
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যার ভিতরে নম্রতা নেই, সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’’। কাউকে সামনা-সামনি বা পেছনে, কথা-বার্তায় হোক বা ইশারা-ইঙ্গিতে কষ্ট দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। যারা এরূপ করবে তাদের জন্য রয়েছে দূর্ভোগ। আমাদের প্রিয় নবী তিনজন এক জায়গায় উপস্থিত থাকলে, যেকোনো দু’’জনকে কানাকানি করে কথা বলতেও নিষেধ করেছেন, যেন তৃতীয়জন কষ্ট না পায়। আসুন আমরা সহনশীল হই, অন্যকে অযথা কষ্ট না দেই এবং নিজেদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করি। হয়তো আমিও লুমাজার অন্তর্ভুক্ত, তবে প্রতিনিয়ত নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করে থাকি, আমার কাছে এটাই জিহাদ।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। আমীন।
সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।
পোস্ট ভিউঃ 6