ঘটনাটা কিন্তু বেশ অবাক করার মতো। চৈত্র মাসের এমন দিনে
কেউকি এমন ঝড়-বাদলের কথা কখনও শুনেছে! কিন্তু গতকাল রাত থেকে তাই যেন হল। গত কয়েকদিনের
প্রচন্ড দাবদাহের পর এমন ঝড়ো বাতাসে
নগরবাসীর প্রাণ জুড়াল আরকি! অবেলার বৃষ্টিতে তৃষ্ণার্ত বায়সের তৃষ্ণাও মিটেছে যেন। থেকে থেকেই কেমন
সুন্দর ঝিরঝিরে একটা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আকাশ ছোঁয়া ইউক্যালিপ্টাসের শীর্ণ শাখাগুলো বাতাসে নড়ে উঠলে মাঝে মাঝে তার
ডগা চুইয়ে টুপটাপ পানি ঝরে পড়ছে। দেখে মনেহয় প্রকৃতি যেন কাঁদছে! ঝড়-বাদলের দাপটে
নগরবাসীর প্রাণ জুড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে বনানী কবরস্থানের চারপাশটা ভিজে একদম
সপ্সপ্ করছে। চারদিকে কাদা-পানিতে একেবারে গা ঘিনঘিনে মাখামাখি অবস্থা! অবশ্য সমাজের
বিত্তশালী আর ক্ষমতাবানদের যেদিকটায় কবর দেয়া হয় সেদিকে ইট-সুরকির বাঁধানো পথ আছে।
সেখানে পথের ধারে থোকায় থোকায় নাম না জানা হাজার ফুলের বাহার। প্রতিনিয়ত সুদৃশ্য বেশধারীদের আনাগোনা সেখানে। ধ্রুব জানে খুব কষ্টে তার জন্য কবরস্থানের এই জায়গাটার
ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতো তার ছেড়ে আসা জগতে সম্পদশালী বা ক্ষমতাবানদের কেউ ছিলনা।
নিতান্তই বন্ধু ভাগ্যে বনানী কবরস্থানের এ জায়গাটায় তাকে দাফনের ব্যবস্থা করা
গেছে।
ধ্রুব আসলে আর সবার মতো প্রবলভাবে
বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুটাকে আরও কিছুদিনের জন্য কোনভাবেই
ঠেকিয়ে রাখা গেল না! অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার অবশ্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা
চালিয়েছিল। কিন্তু স্বয়ং আজরাইল এসে দোর গোড়ায় দাড়িয়ে থাকলে কিইবা করার থাকে! এত অল্প আয়ু
নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে তা আগে থেকে জানা থাকলে হয়ত বিয়েই করত না। ধ্রুব জানেনা তার বউটার এখন কি হবে বা কি হবে তার দু’বছর বয়সী
বাচ্চাটার? সে বরাবরি চাকুরীসূত্রে দেশের বাইরে থাকায় ছেলেটাকে তেমন করে কাছে
পায়নিও কখনো। সে জানে সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই সে রেখে আসতে পারেনি। মাস শেষে বেতন হিসাবে যা পেত তা থেকে নিজের খরচটা রেখে বাকীটা সে দেশে পাঠিয়ে দিত,
কিন্তু তা দিয়ে সংসারের টুকটাক খরচ চালাতেই হিমসিম খেতে হত তার স্ত্রী সৌমিকে। ধ্রুব আজ জানেনা সৌমি এই অবেলার স্রোতে কিভাবে যুদ্ধ করে টিকে
থাকবে! বিধাতার কাছে তার প্রশ্ন, আচ্ছা মানুষের জীবন এত ছোট হয় কেন? মালয়েশিয়ার
পেনাং এ সে একবার বাটারফ্লাই পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে একুরিয়ামে
দু’শো বছর বয়সী কচ্ছপ দেখে পাশে দাঁড়ানো
মহিলা গাইডকে জিজ্ঞেস করেছিল ওরা এত বছর বাঁচে, কিন্তু মানুষের আয়ু এত কম কেন?
একটা কচ্ছপ এত বেশী বছর বাঁচলে কি লাভ হয় মানব সভ্যতার? একজন মানুষ তার সারা
যৌবনকাল ব্যয়ে জ্ঞান অন্বেষণ করে যখন সমাজকে কিছু দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন সে
কেন মরে যায়? গাইড ধ্রুব’র প্রশ্নের
উত্তর দিতে পারেনি। স্মিত হেসে সরে গিয়েছিল শুধু। কি ভালই না হত যদি সে ঐ কচ্ছপটার
মতো দীর্ঘ জীবন পেত!
ধ্রুবর
ছোটবেলাটা কেটেছিল দিনাজপুর শহরে। বাবার চাকুরি সূত্রে সুইহারির কাছেই গুড়গোলা
রোডে থাকত তারা। সেখানে স্কুলে যাওয়া আসার পথটা ছিল বিশাল এক কবরস্থানের গা ঘেঁষে।
সেই কবরস্থানের এখানে সেখানে এলোমেলো ভাবে বেড়ে উঠেছিল বট-পাকুর আর শ্যাওড়ার সারি। ভর দুপুরেও
আকাশ আঁধার করে রাখা সেসব গাছগুলো ঘিরে ছিল কলকাসুন্দা আর আকন্দ’র বুনো ঝাড়। সেখানে
শেয়ালকাঁটা আর কানসোনার ছোট ছোট ঝোপের ফাঁকে নতুন আর পুরাতন সব কবরের দীর্ঘ সারি। সেসব
কবরের কোন কোনটাতে অনেক সময়ে নুইয়ে পড়ে থাকত সদ্য বোনা খেজুরের ডাল। সে স্কুলে
আসা-যাওয়ার পথে অনেকবার কবরের ভিতরে শেয়াল ঢুকতে দেখেছিল। কিন্তু কারণটা তখনো সে জানত
না। অনেকপরে বাবার কাছে শুনেছিল শেয়ালগুলো কবরের ভিতরে ঢুকে মৃতদের হাড়-মাংস খেয়ে প্রোটিনের
চাহিদা মেটাত। ধ্রুব ভাবে, দাফন শেষে সবাই চলে গেলে তার কবরেও কি মাংসের লোভে ঢুকে
পড়বে কোন প্রোটিন লোভী শেয়াল! ও জানেনা বনানী কবরস্থানে শেয়াল আছে কিনা! তার আধা
থ্যাঁতলানো শরীরের হাড়-মাংস শেয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁতের ফলায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে
ভাবতেই তীব্র ভয় এসে গ্রাস করে ধ্রুবকে। হয়ত কবরের নির্জন আঁধারে সার্জনের দক্ষ
হাতের সেলাইগুলো ধরেই টান দিবে অর্বাচীন শেয়ালগুলো!
ছোট বেলায় ধ্রুব
গাছ হতে চেয়েছিল। তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? পরীক্ষার খাতায় এমন
প্রশ্নের উত্তরে সে লিখেছিল, সে গাছ হতে চায়। তার এমন অদ্ভুত আবদার শুনে ক্লাসের বন্ধুরা
হেসে লুটিয়ে পড়েছিল। তারা বুদ্ধিমান, তাই
তাদের কেউ ডাক্তার, আবার কেউবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল। কিন্তু ধ্রুব শুধু
গাছই হতে চেয়েছিল,আকাশ সমান গাছ। কবরস্থানের ধূসর পাঁচিল লাগোয়া একহারা
কদম গাছটার মতো। ঘন বরষায় যার পাতা চুইয়ে চোখের নোনা জলের মতো ঝরে পড়ে ফোঁটা
ফোঁটা বৃষ্টির অবিরত ধারা আর পুষ্ট ডালগুলো ছেয়ে থাকে সৌমির নরম ঠোঁটের মতো হলদেটে ফুলে! ছোটবেলাটা
আসলে ওর গাছে গাছেই
কেটেছে। গাছের মগ ডাল ছিল বই পড়ার প্রিয় জায়গা। এক হাতে বই নিয়ে তরতরিয়ে
উঠে যেত গাছের চূড়ায় কোন ডালে আর সেখান থেকে সেই সন্ধ্যায় বই পড়া শেষ হলে নেমে আসত। একবার এক
ছুটির দিনে তাকে নিয়ে সে যে কি দারুণ খোঁজাখুঁজি! কারণ সেদিনের বইটা বেশ মোটা
হওয়ায় গাছ থেকে নামতে প্রায় রাত হয়ে গিয়েছিল। বইটার নাম মনে
আছে আজও, রবিনহুড। ধ্রুব অবশ্য একবার রোদও হতে চেয়েছিল। শীতের কুয়াশা ভেদ করা সকালের এক চিলতে সোনালী
রোদ্দুরের মতো। ছেলেবেলার সেই সব অদ্ভুত চাওয়াগুলো পূর্ণ
হলে আজ অবশ্য তাকে লাশখেকো শেয়ালদের কথা ভাবতে হত না। ধ্রুব বড় হয়ে জানতে পেড়েছিল গাছের
হাড়–মাংস নেই আর রোদকে শুধুই অনুভব করা যায়,স্পর্শ করা যায়না। মানুষ কেন যে গাছ কিংবা
শীতের সোনালী রোদ্দুর হয়না!
বৃদ্ধ জামগাছটার
পাতা চুইয়ে পানি পড়ছে তখনও। হয়ত বেরসিক পাখীর ডানার ঝাপ্টানিতে পাতার এই বেখেয়ালি জলতরঙ্গ!
একদঙ্গল লাল পিঁপড়ের সারি খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত। সেদিকে আনমনে
তাকিয়ে আছে তার সদ্য বিধবা স্ত্রী সৌমি। সেই
কখন থেকে একঘেয়ে ভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলছে সে। তার গভীর কালো চোখ বেয়ে ঝরছে ঘন শ্রাবণের
ধারা। কবরস্থানের দেয়ালে ঠেশ দিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে সে। ক্লান্তিতে
অবসন্ন পা ভেঙ্গে নুয়ে পড়তে
চাচ্ছে যেন। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পাশে দাড়িয়ে আছেন ছোট খালা। অন্যান্য
মহিলারা অদূরে দাড়িয়ে দোয়া-দরুদ পাঠে ব্যস্ত। তাদের কারো কারও হাতে অলস তসবি
ঝুলছে, তবে সবারই চোখে–মুখে ক্লান্তি আর রাত্রি জাগরণের ছাপ সুস্পষ্ট।
ধ্রুবর সুঠাম দেহটা ইতিহাস হয়ে ফিরেছে
গতকাল রাত দশটার এমিরেটস’র ফ্লাইটে। ও ব্র্যাকে চাকুরী করত। উগান্ডায় বছর
তিনেক কাটিয়ে কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছিলো সুদান স্টেশনে। সেখানেই ইতিহাস হবে বলে তিন দিন আগে অর্থাৎ ১৭ মার্চ বিকাল
তিনটার দিকে এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় সে। ধ্রুব সেদিন
দাপ্তরিক কাজ শেষে ৫৪০ এয়ারলাইন্সের বিমানে দারেস সালাম থেকে জুবা ফিরছিল। দুর্যোগপুর্ণ
আবহাওয়ায় বিমানটা ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে রানওয়ের মাথা বরাবর ক্যাকটাসের নিচু ঝোপ
আর জলাশয়ের মাঝের ফাঁকা জায়গাটাতে। বিমানের মাথাটা জলাশয়ের পার
ঘেঁষে নরম মাটিতে গেঁথে গেলেও তার বডিটা প্রায় মাঝ বরাবর ভেঙ্গে দু’টুকরা হয়ে
খানিকটা ছিটকে পড়ে। অবশ্য রানওয়ের বহিঃসীমানার কন্সারটিনা তারে আটকে যায় সেগুলো। মুহূর্তেই
আগুন ধরে যায় তাতে। বেশীর ভাগ যাত্রী আগুনের লেলিহান শিখায় কয়লা হলেও ধ্রুবসহ আরও
কয়েকজনের মৃতদেহ বিমানের খোলের বাইরে ছিটকে পড়ে যায়। তীব্র আঘাতে তাদের মৃত্যু
হলেও ডেড বডিগুলো অন্তত আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। এয়ারপোর্টের নানান
আনুষ্ঠানিকতা শেষে ধ্রুবর শববাহী কফিনটা বাড়ীতে পৌঁছালে আত্মীয় স্বজন যে যেভাবে জানতে পেরেছে ছুটে
এসেছে। তারা এসেছিল সমবেদনা জানাতে, সাহস জোগাতে। দুঃসংবাদগুলো সবাই কিভাবে যেন
ঠিকঠিক জেনে যায়!
কবরের ভিতরটা
কেমন যেন ঠাণ্ডা আর নিঃসীম কালো অন্ধকারে ঠাসা। বৃষ্টির কারণে কবরের মাটি ভেজা আর
স্যাঁতস্যাঁতে হওয়ায় তাকে কবরে শুইয়ে দিতে না দিতেই পিঠের দিকটা আধ ভেজা হয়ে যায়। সাদা
কাপড়টা ভিজে জব্জবে হয়ে শরীরের সঙ্গে লেপটে যায়। প্রচণ্ড গরমের
দিনে ঘামে ভেজা শরীরের সঙ্গে শার্ট লেপটে গেলে ধ্রুব খুব বিরক্ত হত অথচ তাকে এখন সেটাই
মেনে নিতে হচ্ছে। মৃতের পছন্দ বা অপছন্দের খবর কে রাখতে চায়! মরে যাওয়ার সাথে
সাথেই ভালোবাসার মানুষটি হয়ে যায় ভীতিকর বা অস্পৃশ্য কিছু একটা। সবাই ভুলে যেতে
চায় পুরনো স্মৃতি কিংবা সেই সব স্থান,
যেখানে একসময়ে তাদের উষ্ণ পদচারণা ছিল। ছুঁড়ে ফেলতে চায় সহস্র রজনীর স্পর্শ ছুঁয়ে
থাকা তার সব কিছু। পাশের দেয়াল থেকে তার শরীর ঢেকে রাখা কাপড়টার ওপর একটা কেঁচো
খসে পড়ল বোধহয়। বুকে ভর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্বোধ
প্রাণীটা। আচ্ছা কেঁচো কোন পর্বের প্রাণী! সম্ভবত এ্যানিলিডা হবে। কেঁচোর বৈজ্ঞানিক নাম অবশ্য ‘মেটাফেরেটুমা
পোস্তুমা’, প্রাণীবিজ্ঞান ক্লাসে শিরিনা ম্যাডাম পড়িয়েছিলেন সেই কবে কোন কালে! এখন
অনেক কিছুই মনে নেই তার। ব্যবহারিক ক্লাসে কতবার যে তাকে কেঁচো ব্যবচ্ছেদ করতে
হয়েছে! বোধহয় তারই প্রতিশোধ নিতে শরীর মাড়িয়ে গেল অহংকারী কেঁচোটা। মুখের কাপড়ের উপরে
ঝুরঝুর করে আধা ভেজা কিছু মাটি খসে পড়ল বোধহয়। ওরা বাঁশের বাতাগুলো
কবরের উপরে ঠিক মত না সাজিয়েই মাটি দেয়া শুরু করেছে নাকি! কিসে যে এত ব্যস্ততা
সবার! যেন তাড়াতাড়ি মাটি দিয়ে চলে যেতে পারলেই বাঁচে সবাই। একরাশ অভিমান এসে ভর করে ধ্রুবর মাঝে। কবরের উপর
ধীরে ধীরে মাটির আস্তর পড়তে থাকে এবং তার সাথে একসময় মিলিয়ে যায় বিকেলের শেষ আলোর
রেখাটুকুও। আচ্ছা, কনে দেখা রোদের রঙটাও কি এরকম অপার্থিব হয়! উত্তরটা জানা হবেনা
কোনদিন।
হিমশীতল
অন্ধকার এসে গ্রাস করে ধ্রুবকে। এক মেরু জমাট বাঁধা অন্ধকার সেখানে! কবরের ভিতরটা
কেমন যেন গুমোট আর স্যাঁতস্যাঁতে। সে নিঃসীম এক শূন্যতার মাঝে পেঁজা তুলার মত
ভাসতে থাকে। আচ্ছা সনাতন ধর্মের অনুসারী হলে তাকে কি চিতার আগুনে পোড়ান হত! আগুনের
স্পর্শে সে কি কষ্ট পেত! কি জানি,হয়ত কষ্ট পেত। তবে কবরের মাঝে সাইবেরিয়ান
শীত লাগছে তাকে। কবরের ভিতরের আয়তনটা এত আঁটসাঁট আর আবদ্ধ যে
মনেহয় দু’পাশের মাটির দেয়াল পিষে ফেলবে তাকে যে কোন মুহূর্তে।
তার ভয় হয় বৃষ্টিতে আধা ভেজা দেয়াল তার শরীরের উপর ধ্বসে না পড়ে! পুরান ঢাকায় যে
হারে বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার ঘটনা ঘটছে আজকাল! অবশ্য সে রকম কিছু হলে বাইরের পৃথিবীর
কেউ কোনদিন তা’ জানতেও পারবে না। এটা আসলে
কবরবাসীদের একান্তই আপন অভিজ্ঞতা। ধ্রুবর কেবলই মনে হতে থাকে তার পিঠটা পানিতে
ক্রমান্বয়ে ভিজে যাচ্ছে যেন। কবরের মেঝে থেকে যেভাবে
পানি উপচিয়ে বের হচ্ছে শেষে কবরটা না আবার তলিয়ে যায়! আচ্ছা সেরকম কিছু হলে তার
শরীরটা কি কবরের ভিতরে নিঃসঙ্গ বয়ার মত ভাসতে থাকবে, নাকি টাইটানিকের মত তলিয়ে
যাবে আবারও মৃত্যুর স্বাদ চেখে নিতে। মৃত্যুর যন্ত্রণাটা দ্বিতীয় বারের মত নাড়া
দিয়ে যায় ধ্রুবকে। বিগত দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া সবকিছু সোপ অপেরার মত মনেপরে তার। মনেপরে
যায় সবকিছু।
সে ছিল
সেদিনের ফ্লাইটের শেষ যাত্রী,বলতে গেলে টারমাক ধরে একরকম দৌড়ে প্লেনে উঠে পড়েছিল
সে। এয়ারপোর্টে আসার পথে রাস্তার জ্যামে আটকা পড়েছিল ধ্রুব। দারেসসালাম
শহরটা বেশ প্রাচীন আর তার রাজপথগুলোও বেশ
সরু। তাতে ট্যাক্সির পাশাপাশি ঘোড়াটানা গাড়ীও চলে হরহামেশা। ডালা ডালা
নামের জন পরিবহণগুলো বেপরোয়া গতিতে চলে সেখানে। ট্রাফিক ব্যবস্থাও খুব দুর্বল। ওয়ার্ক
শিডিউল অনুযায়ী তার অবশ্য সেদিন ফেরার কথা ছিলনা। পরদিন বিকালের টিকিট বুক করা ছিল
তার জন্য। সেদিন সন্ধ্যায় তার অফিসের ইথিওপিয়ান কলিগ লিডিয়ার সঙ্গে মিরাম্বো
স্ট্রীটে’র ফোর সিজন্স রেস্টুরেন্টে ডিনার করার কথা ছিল। সেখানে লেক
ট্যাঙ্গানিকার ক্যাপ্টেন ফিশ দিয়ে তৈরি ‘ফিশ ফিলেট উইথ অ্যাভাকাডো সালাদ’ তার খুব
প্রিয় খাবার। লিডিয়ার
সঙ্গে দারেসসালাম থেকে ৭৫ কিঃমিঃ উত্তরে
ভারত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রাচীন নগরী বাগাময়ো ঘুরে
আসারও প্ল্যান ছিল তার। বাগাময়ো একসময় জার্মান পূর্ব আফ্রিকার রাজধানী এবং দাস
ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু অফিসের কাজ
নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় তার আর সেখানে মন টিকছিল না। তাই সে তার
অন্য সব কর্মসূচী বাতিল করে বহু কষ্টে ফেরার টিকেটটা ম্যানেজ করে। কেন যে সে এটা করতে গেল! ধ্রুব অফিসের শিডিউল অনুযায়ী পরদিন
বিকালে ফিরলে হয়ত বিমান দুর্ঘটনাটা এড়াতে পারত! তাহলে হয়ত তাকে এভাবে অপঘাতে মরতে
হত না! হত না জীবনের এমন অসময়ের ছন্দপতন! হয়ত এখনো সে স্কাই পি’তে সন্তানের সঙ্গে
হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতে পারত! কিংবা তার মৃত্যুটা হয়ত ঘটত অন্যরকম বা অন্য কোন ভাবে!
মানুষের জীবনের সব কিছুই পুর্ব থেকেই নির্ধারিত। চাইলেও মানুষ তা পরিবর্তন করতে
পারেনা। কখনই না। মানুষের ক্ষমতা এত ক্ষুদ্র কেন! ধ্রুবর মনটা খারাপ হয়ে যায়। কবরের
নিকষ কালো আঁধারের মাঝে একরাশ বিষণ্ণতা এসে গ্রাস করে তাকে। পাথর সময়ে তার ঘড়ির
কাঁটা আজ স্তব্ধ। অথচ কিছুই করার নেই। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার সেই কান্নার আর্তি
পৃথিবীর কাউকে স্পর্শ করে না।
পোস্ট ভিউঃ 7