জাঞ্জিবার এয়ারপোর্টের রানওয়েতে প্লেনের চাকা যখন স্পর্শ করল ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। ছোট ছিমছাম এয়ারপোর্ট। যাত্রীর চাপ বলতে গেলে গোটা ত্রিশেক বিমানযাত্রী, যারা এইমাত্র কেনিয়ান এয়ারওয়েজের প্লেনে নাইরোবি থেকে এল। সবাই বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটি কাটাতে আসা পর্যটক। প্লেনের বাইরে পা রাখতেই চোখে পরে ধূসর আকাশে মেঘের অযথা ছোটাছুটি। বছরের এই সময়টায় এখানে বর্ষাকাল, মাঝে মাঝেই তাই হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। পর্যটকদের জন্য অফ সিজন, তাই তাদের সংখ্যাটাও কম। হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে ইমিগ্রিশনের সামনে দাঁড়ায় সুহাইব। পাসপোর্টটা সামনে বাড়িয়ে ধরতেই মুহূর্তে সিল পড়ে যায় তাতে। তিন মাসের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা! মনের আনন্দে কনভেয়ার বেল্ট থেকে ব্যাগটা সংগ্রহ করে এয়ারপোর্টের বাইরে পা বাড়ায় সে। আকারে আমাদের দেশের যশোর এয়ারপোর্টের মত এই এয়ারপোর্টের মাধ্যমে আগত পর্যটকই হচ্ছে জাঞ্জিবারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় মাধ্যম।
সুহাইব শাকের বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি
এনজিও’তে চাকুরির সুবাদে বর্তমানে উগান্ডাতে কর্মরত। পূর্ব আফ্রিকার দাস ব্যবসার কেন্দ্রভুমি আর ভারত
মহাসাগরের মাঝে কপালের টিপের মত ছোট এই দ্বীপের অপার সৌন্দর্য দেখতেই মূলত তার জাঞ্জিবারে
আসা। তাঞ্জানিয়া’র মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ দূরে
জাঞ্জিবার দু’টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। পেম্বা দ্বীপ লম্বায় ৪০ মাইল, প্রস্থে ১৪
মাইল নিয়ে ৬০৮ বর্গ মাইলের সবুজ ভূখণ্ড আর উঙ্গুজা দ্বীপটি পেম্বা থেকে ২৯ মাইল
উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত, যেটি
লম্বায় ৫০ মাইল আর প্রস্থে ২৪ মাইল নিয়ে প্রায় ১০০০ বর্গ মাইলের এক বিচ্ছিন্ন মানবভূমি। এর বাইরেও রয়েছে চাঙ্গু, বাওই, কাওয়ানি, তুম্বাতু, নেম্বা, চুম্বে
ইত্যাদির মত অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপমালা। প্রায় দুই লাখ মানুষ অধ্যুষিত এই জনপদে বিভিন্ন
নৃগোষ্ঠীর বসবাস আর পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতই সোয়াহিলি ভাষায় তারা সবাই
কথা বলে থাকে। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার কারণে সোয়াহিলি’র
পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাটাও বেশ চালু আছে।
যাহোক ফরেক্স ব্যুরো’তে ডলার ভাঙ্গিয়ে
স্থানীয় মুদ্রা কেনে সে। এক ডলারে তাদের ১৫০০ শিলিং মেলে। পথের বাঁ পাশের কিয়স্ক থেকে সিম কার্ড আর এয়ার টাইম কিনে এদিক সেদিক তাকাতেই লম্বা ছিপ
ছিপে একটা ছেলে এসে দাড়ায় সামনে। নাজারেথ। সংক্ষেপে সবাই বলে নাজা। সে একজন ট্যুর অপারেটর। সুহাইব’র কাছে
পর্যটনের জন্য বিভিন্ন স্থানের নাম উল্লেখ
করে তার সার্ভিস চার্জটা জানায়। সুহাইব অবশ্য ইন্টারনেটে বসে মোটামুটি হোম ওয়ার্ক করেই
এসেছে। তারপরও কিছুক্ষণ দর
কষাকষি শেষে একটা অংকে রফা হয় তাদের মাঝে। ঝকঝকে একটা মাইক্রোবাস সামনে এসে দাড়ায়। ট্রলি ব্যাগটা টেনে সুহাইব
তাতে উঠে পড়ে। গন্তব্য সাউথ-ইস্ট কোস্ট। সেখানে সান সেট বীচ হোটেলে ওঠে সে।
এরপর ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে নাজার তত্ত্বাবধানে তার জাঞ্জিবার ট্যুর শুরু হয়
সেদিনই। প্রথমেই যোজানি ফরেস্ট আর মশলা বাগান।
যোজানি ফরেস্ট জাঞ্জিবার দ্বীপের
পূর্বদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মূলত ‘রেড কলোবাস’ বাঁদরের জন্যই এই বনভূমি বিখ্যাত। ওদের
দেখা মেলে শুধু এখানেই। এদের হাতে মাত্র চারটে আঙ্গুল আর পীঠের পুরো অংশটাই লালচে।
সেখানে অনেকটা সময় নিয়ে ঘুরে এরপরে চলে যায় মশলার রাজ্যে। বিশাল ফার্মে নানান
জাতের মশলা আর ওষধি গাছের সমারোহ। পুরো দ্বীপ জুড়ে এরকম অসংখ্য মশলার বাগান
বিখ্যাত করেছে জাঞ্জিবার’কে। মূলত ১৬৯৮ সালে দ্বীপের কর্তৃত্ব পর্তুগীজদের হাত
থেকে ওমানি সুলতানদের হাতে গেলে এই দ্বীপে মশলা চাষের ব্যাপক প্রসিদ্ধি ঘটে এবং
প্রায় সব দ্বীপেই গড়ে ওঠে অসংখ্য মশলার বাগান। সেআমলেই
আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জাঞ্জিবারের মশলা রফতানি হতো ভারতবর্ষে। এমনকি জাঞ্জিবারের মশলা আকৃষ্ট করেছিল আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজগুলোকেও।
বাণিজ্যের সুবিধার্তে ১৮৩৭ সালে আমেরিকা এখানে একটি কনস্যুলেট স্থাপন করেছিল। দীর্ঘ
গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে কাঁচা হলুদ রঙের লাং লাং ফুল। চারদিক সে ফুলের ঘ্রাণে
মাতোয়ারা। সুহাইব
হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে নাম জানা-অজানা নানান মশলা আর ওষধি ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে নর্থ
কোস্টে তার হোটেলে ফেরে। বিশেষ করে বৃষ্টিতে ভেজা কাঁচা দারচিনির ঘ্রাণ নাকে অনেকক্ষণ মাছির মত লেগে থাকে।
পরদিন সাউথ-ইস্ট কোস্ট থেকে সে সোজা চলে যায়
স্টোন টাউনে। সেখানে ‘ধাও পালেস’ নামের হোটেলটাই পরবর্তী দু’রাতের জন্য তার ঠিকানা। লোকেশনটা
চমৎকার আর হোটেলেও সুলতানি আমলের আভিজাত্যের ছোঁয়া। নিজেকে ওমানি সুলতানদের বংশধর বলে মনেহয়। কাউন্টারের ফর্মালিটি সেরে রুমে ঢুকেই উষ্ণ পানির ধারায়
ভিজিয়ে নেয় নিজেকে। এরপর তৈরি
হতে না হতেই নাজা এসে হাজির। হাতে সময় কম। যেতে হবে নর্থ কোস্ট। কেওয়ান্দা সি বীচ। বীচটা আসলেই অদ্ভুত রকমের সুন্দর। ভারত মহাসাগরের পাড়ে
ধবধবে সাদা সি বীচ মাথার সিঁথির মত চলে গেছে উত্তর দক্ষিণ বরাবর। পানির রঙ গাঢ় ফিরোজা আর তাতে স্বচ্ছ
আকাশের ছায়া। একহারা গড়নের নারিকেল গাছগুলো নুয়ে পড়েছে বাড়ন্ত ফলের ভারে। বীচের কোল
ঘেঁষে ঝাউ বনের সবুজ দীর্ঘ সারি যেন ফিরোজা আর সবুজের মৌতাতে মেতেছে। দীর্ঘ বেলা
ভূমির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। অনেক
ছবি তোলে সুহাইব। বীচ লাগোয়া রেস্টুরেন্টে বসে কফির মগে ঠোট লাগায় আর
তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের অথৈ জলরাশির দিকে। এক সময়
দিগন্ত নীল থেকে হলুদ, কমলা আর লাল হয়ে ভেসে যায়। ভারত
মহাসাগরের অথৈ জলে সূর্যটা হারিয়ে যায়
সেদিনের মত। নিকষ
কালো অন্ধকার ছাপিয়ে চোখে পড়ে শুধু ঢেউয়ের মাথায় অপ্রকৃতিস্থ সাদা ফেনা।
এক সময় তাও মিলিয়ে যায়। দূর থেকে
ভেসে আসে ঢোলের দ্রিম দ্রিম শব্দ আর তাতে তার রক্তে বাণ ডাকে। উঠে পড়ে সে। হোটেলে
ফিরতে হবে যে।
পরদিন সকাল সাতটা বাজতেই দরজায় টোকা পরে। নাজা অপেক্ষা করছে নীচে।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সে হোটেলেই নাশতাটা সেড়ে নেয়। এরপর স্টোন টাউনের ঘাট থেকে
যন্ত্র চালিত নৌকায় প্রিজন আইল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা
করে। এর মূলনাম চাঙ্গু আইল্যান্ড। প্রায়
আধ ঘণ্টা ধরে সাগরের একঘেয়ে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সে ছোট সবুজ আইল্যান্ডের ঘাটে পৌঁছায়। এরপর দ্বীপের একমাত্র টুরিস্ট অফিসে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে
ঢোকে
জায়ান্ট কচ্ছপদের রাজ্যে। এদের
আরেক নাম আল্ডাব্রা কচ্ছপ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সিসিলিস থেকে এদের এই দ্বীপে আগমন ঘটে। দ্বীপের একটা অংশ লোহার জালে
ঘিরে বানানো হয়েছে তাদের আবাস ভূমি। বিশাল বিশাল সব কচ্ছপ ঘুড়ে বেড়াচ্ছে অবলীলায়। যেন একেকটা চলন্ত শিলা স্তূপ! তাদের শরীরে
কালের বিবর্ণ ছোঁয়া। বয়সে তাদের কেউ দু’শো,কেউ আড়াই’শ কিংবা দেড়’শ বছর বয়সী। বৃদ্ধ
পাথরের মত দেখতে ধূসর বর্ণের খোলে নীল
রঙে লেখা বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে যেন তারা ঘুরতে বের হয়েছে। কেউ ব্যস্ত কচি ঘাসের
ডগায়,একমনে খেয়ে যাচ্ছে। কেউ
কালের পরিভ্রমনে ব্যস্ত
গাছের শীর্ণ ছায়ায়। কেউবা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, হেয়ালি দৃষ্টিতে তার রাজ্যের
বিরক্তি! আবার কেউবা পাতার আড়ালে মত্ত অলস দীর্ঘ প্রণয়ে। শত
বছরের অভিজ্ঞতা পুষ্ট একেকটা দানব যেন মেতে আছে তাদের নিজেদের স্বর্গ রাজ্যে! সেখানে
সুহাইব শুধুই আগন্তক মাত্র! আচ্ছা ওরা এতটা বছর বাঁচে কেন! ওরা এতটা বছর বাঁচায় কি
লাভ হয়েছে মানুষের। পরে জোডিকে সে এই
প্রশ্নগুলোই জিজ্ঞেস করেছিল । দানবাকৃতির কচ্ছপদের রাজ্যে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সে ঢুকে
পরে দ্বীপের প্রিজন আইল্যান্ড অংশটায়। মূলত স্টোন টাউনের ‘দাসবাজারে’ তাঞ্জানিয়ার
বাগামায়ো,উগান্ডা,কেনিয়া ইত্যাদি এলাকা থেকে সদ্য আমদানিকৃত দাসদের নেয়ার আগে এবং
যাদের সেদিন বিক্রি করা সম্ভব হত না তাদেরকেই সাময়িক ভাবে বন্দী করে রাখা হত এই
প্রিজন আইল্যান্ডের নির্মম কুঠুরিগুলোতে। যেখানে ক্রীতদাসদের বন্দী করে রাখা হত সুহাইব
সে জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে। সে বাতাসে কান পেতে বন্দী শিশুদের কান্নার শব্দ
শোনার চেষ্টা করে। সেখানে কালের পরিক্রমায় ভেঙ্গে পড়ছে অনেক কিছুই। কুঠুরিগুলোর দেয়ালের
পলেস্তরা ছেয়ে আছে গাছের শিকড় আর ঘোলাটে লতায়। এখানে সেখানে সরীসৃপদের আনাগোনা। একসময়
হতভাগ্য ক্রীতদাসদের বুকভাঙ্গা আর্তনাদে যে জায়গাগুলো ভরে থাকত সেখানে এখন মুক্ত মানুষের পদচারনা। ফাস্টফুড, ধুমায়িত কফির মগ আর সিগারেটের ছাইয়ে চাপা পরে
থাকে রুদ্র কঠিন ইতিহাস। রেস্টুরেন্টের হালকা হাসির ছর্রা উপহাস করে চলে প্রতিনিয়ত অতীতের নিষ্ঠুর
ইতিহাস!
নৌকা থেকে নেমেই সে অপেক্ষমান মাইক্রোবাসে চড়ে
রওনা দেয় দুঙ্গা প্যালেস এর ধ্বংসাবশেষ দেখতে। এটা তৈরি হয়েছিল ১৮৫০ সালে এবং এখান
থেকেই সেই আমলে শাসক শ্রেণী পুরো জাঞ্জিবার দ্বীপশাসন করত। তাদের
বলা হত Mwinyui Mkuu বা গ্রেট চীফটেইন।
জনশ্রুতি আছে যে তারা তাদের সৌভাগ্য লাভের আশায় এবং প্রাসাদের নির্মাণ মজবুত করার
জন্য ক্রীতদাসদের হত্যা করে তাদের রক্ত ব্যবহার করত। এরপরে ১৯১০সালের
দিকে এই প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলা হয়। আজ তা’
অবশিষ্ট আছে কিছু জীর্ণ দেয়াল আর ঘুণে ধরা স্মৃতি নিয়ে। একপাশে সংস্কার করা ভবনে ছোট
একটা যাদুঘর তৈরি করা হয়েছে । হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। সুহাইব
রওনা দেয় স্টোন টাউনের উদ্দেশ্যে।
১৪৯৯ সালে ভাস্কো দা গামা’র মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের জাঞ্জিবারে
প্রথম আগমন ঘটে এবং ১৫০৩ সালের মধ্যে তারা দ্বীপের পুরোটা দখল করে নেয়। আগস্ট,১৫০৫
সালে জাঞ্জিবার পর্তুগীজ সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়। তবে স্টোন টাউন শহর হিসেবে পত্তন লাভ
করে ১৬শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। পর্তুগীজরা এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র আর রোমান
ক্যাথলিক মিশন স্থাপন করে। এরপর ১৬৯৮
সালে ওমানের আরবরা পর্তুগীজদের উৎখাত করে জাঞ্জিবারে একটি দুর্গ আর মসজিদ নির্মাণ
করে। ১৮৩২ সালে জাঞ্জিবার ওমানের রাজধানীতে পরিণত হয় এবং ১৮৬১
সালে মূল ওমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন সালতানাতে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত
তা’বজায় থাকে। তবে স্টোন টাউন প্রসিদ্ধি লাভ করে মূলত ওমান সুলতানদের হাতে ১৮৪১
সালের দিকে। এ শহরকে
কেন্দ্র করে তাদের শাসনকার্য পরিচালনার পাশাপাশি সমুদ্র
বন্দর ব্যবহৃত হত পূর্ব আফ্রিকার ক্রীতদাস,মশলা আর হাতির দাঁতের ব্যবসায়। সে সময়ে
জার্মান এবং ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ নিয়মিত জাঞ্জিবার বন্দর ব্যবহার করত । ১৮৯০
সালে স্টোন টাউন ব্রিটিশদের দখলে আসে এবং ১৯৬৩ সালে স্বাধীন জাঞ্জিবার রাষ্ট্রের
রাজধানী হয় এই বন্দর নগরী। এ অবস্থা চলে ১৯৬৪ সালে জাঞ্জিবার আর ট্যাঙ্গানিকা এক
রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে তাঞ্জানিয়া নাম ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত। আরব সংস্কৃতি মাখা জাঞ্জিবার
এখন সরু রাজপথ,কালের সাক্ষী দালান-কোঠা,মসজিদ,চার্চ আর বর্ণিল সব দোকান পাঠ নিয়ে
ঘুণে ধরা এক শহর। গাইড
নাজার সঙ্গে হাটতে থাকে সে শহরের গলি থেকে তস্যগলি। সবখানেই আরব সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট।
এখানে সেখানে লোকজন বসে আড্ডায়
মত্ত, কেউবা ব্যস্ত কফির কাপে। ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায় এটা সেটা বিক্রির জন্য। গাইড
অনর্গলভাবে বলে যায় শহরের সব ইট–পাথর–কড়িবর্গার ইতিহাস। যেন সে তার
দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে ঘটে যাওয়া সব কিছু।
সুহাইব মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যায় তার সব কথা। তারা এসে
দাঁড়ায় সেইন্ট মনিকা চার্চের সামনে। যেখানে
একসময় বিখ্যাত দাস বাজার
অবস্থিত ছিল। এটা পৃথিবীর
সর্বশেষ দাস ব্যবসা কেন্দ্র ছিল বলে জানা যায়। মুলত আফ্রিকার পূর্ব
এবং কেন্দ্রীয় এলাকাগুলো থেকে দাস ধরে এনে এখানে বিক্রি
করা হত। ১৮৫৭ সালে ডঃ ডেভিড
লিভিংস্টোনের করা এক আপিলের প্রেক্ষিতে জাঞ্জিবারের সুলতান ০৬ জুন ১৮৭৩ সালে এক ডিক্রী
বলে পুরুষ,মহিলা এবং শিশুদের ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করা নিষিদ্ধ করেন।
সুহাইব টিকিট কেটে বাজারের মূল অংশে প্রবেশ
করে, যেখানে ভূগর্ভস্থ চেম্বারে শিকল দিয়ে হতভাগ্য দাসদের আটকে রাখা হত। দাসদের
জন্য সেখানে না ছিল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বা না ছিল শুয়ে বসে থাকার জন্য পর্যাপ্ত
জায়গা। মানবতা সেখানে ছিল সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত,অকল্পনীয় কিছু একটা। সামান্য
প্রতিবাদে দাসদের কপালে জুটত কঠিন চাবুকের আঘাত কিংবা
আরও চরম কোনও শাস্তি। আসলে ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনে পরিবার পরিজন ছেড়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে খেয়ে বা না খেয়ে
স্টোন টাউনে যখন তারা পৌঁছাত তখন কারো প্রতিবাদ
করার মত ন্যূনতম শক্তিটুকুও আর শরীরে অবশিষ্ট থাকত না। তারা নির্দ্বিধায় মেনে নিত
জীবনের সব বিড়ম্বনা। আর নারী ক্রীতদাসদের জীবন ছিল আরও বিভীষিকাময়। ভূগর্ভস্থ
চেম্বারে ঢোকার রাস্তাটা খুবই সংকীর্ণ। কেউ একজন চারকোল দিয়ে সাদা দেয়ালে লিখে রেখেছে ‘MIND YOUR HEAD’। চেম্বারের
বাইরে খোলা চত্বরে ক্লারা
সোরনাস নামে একজন ইটালিয়ান মহিলার দাস ব্যবসার ওপরে তৈরি করা ভাস্কর্য
শোভা পাচ্ছে। পাথর খোদাই করে তৈরি করা নারী-পুরুষ
ভাস্কর্যের গলায় বাঁধা লোহার শিকল আরব দাস ব্যবসায়ীদের নিষ্ঠুরতার পরিচয় বহন করছে।
ভারত
মহাসাগর ভিত্তিক দাস ব্যবসা আসলে আটলান্টিক মহাসাগর কেন্দ্রিক দাস ব্যবসার চেয়েও
পুরানো। সম্ভবত দ্বিতীয় শতাব্দীর
প্রারম্ভে শুরু হওয়া ভারত মহাসাগর ভিত্তিক দাস ব্যবসা চলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক
পর্যন্ত। মূলত কঙ্গোর কিন্দু এলাকা,কেনিয়া,রুয়ান্ডা,বুরুন্ডী,মালাওই,উগান্ডা,মোজাম্বিক,তাঞ্জানিয়া
ইত্যাদি পূর্ব আফ্রিকার দেশ থেকে দাস সংগ্রহ করে দারেস সালাম থেকে ৭৫ কিঃমিঃ
উত্তরে বাগাময়ো বন্দরে তাদের প্রথমে নেয়া হত। এরপর ধাও নামের কাঠের বিশেষ
ধরনের নৌকায় তাদের নেয়া হত চেঙ্গা বা প্রিজন আইল্যান্ড অথবা স্টোন টাউনের দাস
বাজারে। এরপর তাদের বিক্রি করা হত তুরস্ক,ভারত,সউদি আরব,ইয়েমেন,ওমান,ইরাক,ইরান, সংযুক্ত
আরব আমিরাত ইত্যাদি আরব উপকূলীয় ও পার্সিয়ান গালফ এলাকার বাজারগুলোতে। উনিশ
শতকের গোড়ার দিকে জাঞ্জিবার,পেম্বা,মরিশাস, মাদাগাস্কার ইত্যাদি দ্বীপে
চা,মশলা,ওষধি চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলে দাস কেনাবেচা তুঙ্গে ওঠে। সে সময়ে প্রতি বছরে
প্রায় ৩০০০ থেকে ২০,০০০ পর্যন্ত ক্রীতদাস কেনা বেচা হত। মুলত গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড,বাগান বা খনি শ্রমিক এবং
যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার করা হত। পূর্ব আফ্রিকার দেশ গুলোর দুর্বল শাসন
ব্যবস্থা আর বিভিন্ন গোষ্ঠীপতিদের প্রতিহিংসা, লোভ ইত্যাদিকে ব্যবহার করে সে সময়ে বিভিন্ন
এলাকা থেকে দাসদের সংগ্রহ করা হত। এরপর লোহার শিকলে গলা বাঁধা
অবস্থায় মাইলের পর মাইল পথ হেটে
তারা পৌঁছাত কোন বন্দর বা বন্দীশালায়। এই দীর্ঘ পথচলায় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে
হত্যা করে হায়েনা বা সিংহ’র খাবার হিসেবে পথেই ফেলে রাখা হত। অনেক সময়ে আইভরি বহনের জন্য শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে তাদের সামনেই হত্যা করা হত। নাজার মুখে আফ্রিকার
এই অঞ্চলের মানুষের অতীত বঞ্চনার কথা শুনতে শুনতে মনটা খারাপ হয়ে যায় সুহাইব’র। ঘুরে
রওনা দেয় পাশেই দাঁড়ানো দি অ্যাংলিকান ক্রাইস্ট চার্চ ক্যাথেড্রালের দিকে। সে আপনমনে
চার্চের চারদিক ঘুরে দেখে আর একের পর এক ছবি তুলে যায়। একসময় ক্যামেরার শাটার
টিপতে গিয়ে দেখে লেন্স দখল করে আছে এক মোঙ্গলয়েড সুন্দরী। দুঃখিত বলে সে সরে আসে। সেখান থেকে ফিরে স্টোন টাউনের অলি-গলি,রাজপথ
ধরে আবারো হাঁটতে থাকে। পুরনো দুর্গ আর তাকে ঘিরে হস্তশিল্পের বাজারটা মুগ্ধ করে
তাকে। এটা সেটা কিনে নাজাকে সেদিনের মত বিদায় দিয়ে সন্ধ্যার মুখে হোটেলে ফেরে। আগামীকাল
ভোরে উঠতে হবে। সকাল ৯টায় ফ্লাইট আর চেক ইন শুরু হবে ৬টার দিকে। তারমানে ঘুম থেকে
উঠতে হবে সাড়ে চারটার দিকে। হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট গাড়িতে ৩০ মিনিটের পথ। নাজা সি
অফ করতে আসবে বলে গেল।
ন্যাশনাল
মিউজিয়ামের সামনে ভারত মহাসাগরের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সুন্দর একটা স্কোয়ার।
আগা খান ফাউন্ডেশনের সাহায্যে এর
সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। স্কোয়ার জুড়ে বিভিন্ন স্থানে বসার সুন্দর ব্যবস্থা।
স্কোয়ারের প্রান্ত ঘেষে নির্মান করা বাঁধে ভারত মহাসাগরের ঢেউ প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ছে । স্কোয়ারটা
হোটেল থেকে পায়ে হেটে প্রায় পাচ মিনিটের পথ।
রাতের খাবারটা সেখানেই কোন এক দোকান
থেকে সেরে নেয়ার জন্য সে হোটেল থেকে বের হয়। স্কোয়ারে
পৌঁছাতেই চোখে পরে সুন্দর সব ট্রলিতে সাজানো বিভিন্ন রকমের খাবার
আর তাকে ঘিড়ে নানান দেশের পর্যটকদের সমাহার। ভারত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা স্নিগ্ধ
বাতাসে জেসমিন আর শিক কাবাবের মাংস পোড়া ঘ্রাণ! ক্ষুধাটা পেটে চনমন
দিয়ে জেগে ওঠে। সে একটা দোকান থেকে ঘিয়ে ভাজা পরাটা আর কয়েকটা শিক
কাবাব নিয়ে সিমেন্টের বাঁধানো বেদীতে বসে পড়ে। সামনের ফোয়ারা
থেকে অবিরত পানি পড়ছে অজস্র
ধারায়। আশে পাশে আরও
অনেক পর্যটকদের জটলা।
সেসব ভেদ করে সাদা কালো একটা বেড়াল আর হয়ত তার পিছু পিছু দু’জন তরুণী এসে পাশের
খালি জায়গাটাতে বসে। একটু পর খাবার হাতে দু’জন তরুনও এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। একজন ফেরিওয়ালা এসে সুহাইবকে কিছু স্কার্ফ জাতীয় কাপড়
কেনার জন্য অনুনয় করে । সে স্কার্ফ কিনতে
আগ্রহী না জানালে
ফেরিওয়ালা সরে গিয়ে পাশে বসা তরুণীকেও একই ভাবে অনুরোধ
করে। তার স্কার্ফ দরদাম করা দেখে হাসি পায় সুহাইব’র। সে হয়ত একটু জোড়েই হেসেছিল। পাশে বসা তিনি
তাই ঘুড়ে তাকান। আরে এ যে সেই মুখ! তার ক্যামেরার লেন্স আচমকা দখল করে থাকা এক
খানা সতেজ মুখ। তারা দু’জনই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দু’জনের দিকে। এরপর সে
হাত বাড়িয়ে গল্পের অর্গল খুলে দেয়। তার জন্ম তাইওয়ানে। নাম জোডি। বর্তমানে
মালাওই’তে একটা এন জি ও’র সঙ্গে ভলান্টিয়ার
হিসাবে কাজ করছে। সে এবং তার সঙ্গে অন্য তিনজন যারা এসেছে তারা সবাই তাইওয়ানের
একটা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট। তার মত তারাও মালাওই’তে ভলান্টিয়ার হিসাবে ইন্টার্নশিপ
করছে। একে একে তারা সবাই হাত বাড়িয়ে পরিচিত হয়। তারা একে অন্যের খাবার শেয়ার করে।
পরবর্তী সপ্তাহে অন্যরা দেশে ফিরে গেলেও জোডি তার
কর্মস্থল মালাওই ফিরে যাবে। তার মনটা
তাই হয়ত একটু খারাপ!
তারা সেদিন সকালেই মালাওই থেকে সড়ক পথে
দারেস সালাম হয়ে জাঞ্জিবার এসেছে । উঠেছে কাছেই একটা হোটেলে। তাদের এরপরের গন্তব্য নর্থ কিংবা সাউথ
ইষ্ট কোস্ট। সুহাইব এ ক’টা দিন নর্থ এবং সাউথ ইষ্ট কোস্ট বেড়িয়েছে জেনে সবাই কিঞ্চিৎ উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
জানতে চায় অনেক কিছু। সেতো ওসব জায়গা বেড়িয়ে এখন অনেক বিজ্ঞ। সুহাইব বলে যায় যা সে
নিজে থেকে জানত আর যেটুকু শিখেছিল নাজা’র কাছে। আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে তার ভালই লাগে। এই প্রথম
সে কারও সঙ্গে তার ভ্রমন অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। এরপর কথার ডালপালা ক্রমাগত গজাতে থাকে। এ কথা সে কথায় এক সময়ে
আবিস্কার করে কথা বলছে শুধু তারা দু’জন আর বাকীরা হাওয়া। তারা দূরে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে চা
বা কফিতে ব্যস্ত। কথা প্রসঙ্গে জোডি জানায় তার কিছু বাংলাদেশী বন্ধু আছে এবং সে বাংলাদেশ সম্পর্কে
জানে। তার বাবার গার্মেন্টস ব্যবসা সূত্রে ঢাকা/ চট্টগ্রামে যাতায়াত আছে। সে
যদিও কখনও যায়নি তবে ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে বাংলাদেশ ঘুড়ে দেখার। সুহাইব তাকে
আমন্ত্রণ জানায় আর অনর্গল বলে যায় তার দেশ সম্পর্কে। ইতিহাস-অর্থনীতি-পর্যটন, বাদ যায়না কিছুই। কথায় কথায় অনেকটা
সময় কেটে যায়। একসময় তার বন্ধুরা এসে দাড়ায়,ফিরতে হবে তাদের। কুশল বিনিময় করে সেও
উঠে দাড়ায়, ফিরতে হবে তাকেও। সকালেই ফ্লাইট। পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে বিদায় নেয়
তারা। বিদায় আলিঙ্গন শেষে জোডি তার হাতটা কিছুক্ষণ ধরে রেখেছিল। আচ্ছন্নের মত তা’
ভাবতে ভাবতে সে পা বাড়ায় হোটেলের দিকে।
প্লেনের সীটে বসে সুহাইব’র মনেপরে জোডি বা তার
বন্ধুদের কারো ফেসবুক আইডি, ই মেইল বা ফোন নাম্বার কিছুই নেয়া হয়নি। খারাপ লাগে
হঠাৎ! এটাকি তার বোকামি ছিল! নাকি নেহায়েত ইচ্ছে হয়নি তাই নেয়া হয়নি। আর ভাবতে
ইচ্ছে করেনা। জীবনটা তো আর ডিভিডি প্লেয়ার নয় যে রিউইন্ড করে দেখে নিবে। কি
দরকার! যে ভাবে চলছে চলুক না। জোডি বিদায় নেয়ার সময় অবশ্য বলেছিল, হয়ত আবারো দেখা
হবে অন্য কোথাও অন্য কোন আকাশের নীচে। হয়ত
সেটাই সত্যি! ভাবতে ভাবতে একসময় দেখে প্লেনের চাকা স্পর্শ করছে নাইরোবি’র রানওয়ে। পাইলটের
ঘোষণায় সংবিৎ ফেরে তার। সে সীট বেল্ট বেঁধে ল্যান্ডিং এর জন্য প্রস্তুত হয়। সামনে অনেকটা পথ।
ও হ্যা, নাজা কথা রেখেছিল। সে সি
অফ করতে এয়ারপোর্টে এসেছিল। অত সকালে! দু’দিনেই তাদের মাঝে সম্পর্কটা বেশ গড়ে উঠেছিল। নাজা তাকে উইশ করে বলেছিল
‘হাকুনা মাতাতা’। আসলেই হাকুনা মাতাতা অর্থাৎ নো প্রবলেম। হাকুনা
মাতাতা! হাকুনা মাতাতা জাঞ্জিবার !!!
পোস্ট ভিউঃ 13