বৈশাখের প্রথমটা প্রতি বছর প্রবল ঝড়ঝাপটা
দিয়েই শুরু হয়। এবছরও
তার ব্যাতিক্রম হয়নি মোটে। বিকাল পাঁচটার দিকে শুরু হওয়া ঝড় শেষ হয় রাত সাড়ে বারোটার দিকে। আর তারপর শহর জুড়ে রাস্তায় পরে থাকে গাছের জীর্ণ ডাল, কাকের বাসা কিংবা টেলিফোন আর
ডিশের ছিন্ন লাইনের সারি। কখনোবা ঝড়টা খুব বেশী হলে বিদ্যুতের তার কিংবা টেলিফোনের
খুঁটি অথবা বয়স পেরিয়ে যাওয়া কোন বিলবোর্ডের ফ্রেম পড়ে থাকে রাজপথে। গতকাল ঝড়ের পরেই লম্বা মই আর তারের বান্ডিল নিয়ে ডিশের
লাইন পরখ করে দেখতে বেরিয়েছিল মহল্লার ডিশের দোকানের দু’কর্মচারী, তারা কাজ করছিল মালিটোলার
মোড়ে ছয়তলা বিল্ডিঙটার পাশে দাড়িয়ে। এমন সময় হঠাৎ ওপর থেকে ধুপ্ করে কি যেন পড়ার
শব্দে চমকে উঠে দু‘জনেই। ভারী
কোন বস্তুর পতনের শব্দের সাথে সাথেই আর্ত চীৎকারে প্রকম্পিত হয় চারদিক। তারা দৌড়ে
ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখে ব্যথায় হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করছে ২৬/২৭ বছর বয়সের এক মহিলা, উঠে
বসার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তারা উপরে তাকায় কিন্তু কিছু চোখে পড়েনা। ঘটনার
আকস্মিকতায় হতবিহবল দু’জনের
সংবিৎ ফেরে মহিলার কাতর চীৎকারে। মোড়ের
চা’র দোকানটাতে প্রায় সারারাতই রিকশাওয়ালা
আর ভবঘুরে লোকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাদেরই দু’একজন এসে দাঁড়ায় সেখানে। তারা
মহিলাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করে। কেউ একজন ফোন করায় একটা এম্বুলেন্স আসে।
রোগীকে নিয়ে চলে যায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। মহিলা
মারা যায়নি তবে হাত-পা ভেঙ্গেছে বোঝা যায়।
উপরের দিকে তাকিয়ে তারা বোঝার চেষ্টা
করে কত তলা থেকে কিভাবে পড়েছে মহিলা। তার কপালটা সত্যিই ভাল বোঝা যায়,অতটা উপর থেকে পরেও দিব্বি
বেঁচে আছে।
কিছুক্ষণ পর পুলিশের একটা টহল গাড়ী এসে
দাঁড়ায় সেখানে। ঘটনা জেনে নাকি মানুষের জটলা দেখে এসে দাঁড়ায় বোঝা যায়না। পুলিশের উপস্থিতি দেখে জটলা ফাঁকা হতে শুরু করে।
আসলে পুলিশের
ঝামেলায় কেউই পরতে চায়না। আমাদের
দেশে তামাশা বা কোন ঘটনা দেখায় লোকের যতটা উৎসাহ ঠিক ততোটাই নিরুৎসাহ কোন ঘটনার পুলিশি
সাক্ষী হতে। একারনেই হয়ত
পুলিশের অনেক মামলা ঠিক মত গতি পায়না, আটকে যায় মাঝপথে যমুনার চরে বিকল ফেরীর মত। টহল
পিক আপ থেকে দু’জন কনস্টেবলসহ একজন সাব ইন্সপেক্টর নেমে আসেন ঘটনা স্থলে। তিনি সবাইকে
এত রাতে সেখানে জটলা করার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তারা
সবিস্তারে জানায় সব কিছু। কনস্টেবলদের একজন সবার নাম ঠিকানা টুকে নেয় পকেটে থাকা
ছোট নোট বুকে। এরপর তারা এগিয়ে যায় বিল্ডিংটার দিকে। দূর থেকে কয়েকটা বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ও মানুষের
কথাবার্তার হালকা আওয়াজ শোনা যায়। একটু পর ফিরে আসে পুলিশের দলটি। জটলায় উপস্থিত কেউ
একজন জানায় দুর্ঘটনার কবলে পড়া মহিলার নাম অঞ্জলি আক্তার। মাঝে মাঝে তিনি মোড়ের ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরে আসতেন এটা সেটা কিনতে অথবা মোবাইল সেটে ফ্লেক্সি লোড করতে। তিনি স্বপরিবারে
থাকেন বিল্ডিঙের পাঁচ তলার ২২ নাম্বার ফ্ল্যাটে। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী, শিক্ষিত
এবং স্মার্ট। কনস্টেবল দু’জন আবারো যায় পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে খোঁজ নিতে কিন্তু দরজা
ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় ফিরে আসে তারা। এরপর তাকে কোন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে তা’ পূনরায়
জেনে নিয়ে চলে যায় টহল পুলিশের দলটি। জটলার সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো!
সেদিনই
ভোর প্রায় চারটার দিকে বংশাল থানার ওসি জসিম উদ্দিন আহমেদ ফোর্স নিয়ে ঐ ফ্ল্যাটের
দরজা ভেঙ্গে শোয়ার ঘরের মেঝেতে আনুমানিক ৩২ বছর বয়সের হতভাগ্য এক যুবকের লাশ
উদ্ধার করেন। মৃত
ব্যক্তির মাথাটা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কাৎ করে রাখা। ঘন নীল রঙের জিহবাটা মুখ থেকে খানিকটা
বেরিয়ে আছে। তার পড়নে সাদা-কালো চেক
লুঙ্গি আর গায়ে ঘিয়ে রঙের একটা টি শার্ট। একটা পা স্যান্ডেল আকড়ে ধরে থাকলেও অপর পায়ের স্যান্ডেল মৃতদেহ থেকে প্রায় ১০ ফুট দূরে
দেয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। ঘন বাদামী রঙের দড়ির কাটা এক প্রান্ত ফ্যানের সঙ্গে সাপের মত
করে ঝুলছে। ধারালো কিছু একটা দিয়ে দড়িটা কাটা হয়েছে বোঝা যায়। দড়ির (ligature
material) অন্য প্রান্ত গভীরভাবে পেঁচিয়ে আছে মৃতদেহের গলা এবং মাথার পিছনের অংশটা
(occipital region)। একটু দূরে ড্রেসিং টেবিলের কাছে একটা ধারালো বটি পরে
আছে। হয়ত ওটা দিয়েই কাটা হয়েছিল দড়িটা। একপাশে
একটা টুল একদিকে হেলে পড়ে আছে।
প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার এবং হালকা পাতলা গড়নের যুবকের নাম ইমরান নূর তুষার। সে
চাকুরী করত একটি বহুজাতিক
ব্যাঙ্কে। বিয়ে করেছিল পাচ/ছয় বছর পূর্বে এবং তাদের আবীর নামে সাত মাস বয়সের একটা
বাচ্চাও আছে। ওসি সাহেবের প্রাথমিক ধারণা পারিবারিক কলহের জের ধরে আত্মহত্যা করেছে
ইমরান নূর তুষার। অবশ্য তদন্তেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত ঘটনাটা কি। উনি
মৃতদেহটা ময়না তদন্তের (Autopsy) জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের
মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সঙ্গে আসা একজন এসআইকে ঘটনাস্থলের নকশা,আলোকচিত্র ও ফরেনসিক
পরীক্ষার জন্য আলামত সংগ্রহের নির্দেশ দেন। এরপর সেখানে উপস্থিত দু’জন লোককে সঙ্গে
নিয়ে তিনি ফ্ল্যাটের বিভিন্ন ঘর পরিদর্শন করেন। শোয়ার ঘর (CRIME SCENE) ছাড়া সব কিছু সাজানো পরিপাটি অবস্থায় পাওয়া যায়। পাশের ঘরের বিছানায়
তুষার সাহেবের সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে বিছানা থেকে তুলে একই
বিল্ডিঙের অন্য ফ্ল্যাটে বসবাসরত তুষারের বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর তিনি
ঘটনাস্থলের কার্যাদি শেষে সেখানে উপস্থিত লোকজনের সাক্ষ্য/বক্তব্য গ্রহন করেন।
একেকজন একেক রকমের মন্তব্য করে। তুষারের
চাচাতো ভাই সাদেক হোসেনের দাবী তুষারকে তার শ্বশুর পক্ষের লোকজন পরিকল্পিতভাবে
হত্যা করেছে। তার
এই দাবীর স্বপক্ষে অবশ্য সে তেমন অকাট্য কোন যুক্তি দেখাতে পারেনা। ভাঙ্গা হাত-পা
নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অঞ্জলি আক্তার বলেন ভিন্ন কথা। তার বক্তব্য অনুযায়ী
বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন কারণে তাদের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। তখন অনেকবার আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল তুষার। কিন্তু
সেটাকে কখনই তিনি তেমন গভীর ভাবে আমলে নেননি। সেদিন সন্ধ্যার দিকে পারিবারিক একটা বিষয় নিয়ে তাদের
মধ্যে ঝগড়ার সুত্রপাত ঘটে। এরপর গভীর
রাত পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে উচ্চঃস্বরে ঝগড়া করে তুষার। ঝগড়ার
একপর্যায়ে বারান্দা থেকে কাপড়
শুকানোর দড়িটা খুলে এনে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলে পড়েন তিনি। তার স্বামী যখন
আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তিনি বাধা দেননি কেন সাংবাদিকরা এরকম প্রশ্ন
করলে অবশ্য তিনি দু’রকমের উত্তর দেন। একবার বলেন যে তিনি তখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে
দুধ পান করাচ্ছিলেন তাই তিনি বাধা দেয়ার সুযোগ পান নি। আবার তিনি এমনও দাবী করে বলেন যে তার স্বামী প্রায়ই এরকম আত্মহত্যার হুমকি দিতেন তাই বরাবরের মত এবারো
তিনি এটাকে পাত্তা দেননি। তিনি ভেবেছিলেন
তার স্বামী তাকে মিছেই আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে। যাহোক,
যখন তিনি বুঝতে পারেন যে এটা মোটেই কৌতুক ছিল না এবং তার স্বামী সত্যি সত্যিই
আত্মহত্যা করেছেন তখন তিনি খানিকটা হত বিহ্বল হয়ে পড়েন। হঠাৎ তার
মাঝে থানা–পুলিশ–জেল কিংবা
মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি ভয় এসে গ্রাস করে এবং তিনি ঘটনার আকস্মিকতায় ভেবে পাননা কি করবেন। এরকম একটা ভীতিকর অবস্থায় তিনি নিজেও
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাচ্চাটাকে পাশের ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাঁচ তলার
খোলা বারান্দা থেকে নীচে লাফ দেন। কিন্তু মাটিতে পতনের পূর্বেই তার পা টেলিফোন বা ডিশের তারের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি বেঁচে যান। স্বামীর
সঙ্গে ঝগড়ার সূত্রপাতের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে অবশ্য তিনি উত্তর দানে বিরত থাকেন। হয়ত
একান্ত পারিবারিক বিষয়ে মিডিয়ার
সামনে কথা বলতে বাঁধছিল তার। আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটা এরকমই ছিল এবং পরদিন দেশের সব
পেপারে অনেকটা এভাবেই খবরটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়।
আহত
অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অঞ্জলি বিভিন্ন সাংবাদিকদের যখন ঘটনার বর্ণনা দেন
তখন সেখানে অনেকের মাঝে তরুন এস আই চৌধুরী আশরাফুল বারীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বংশাল থানার সেকেন্ড অফিসার। আপাতত এ ঘটনার
প্রেক্ষিতে বংশাল থানায় একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু (UD) মামলা হওয়ায় তিনি এসেছেন অঞ্জলি আক্তারের একটা প্রাথমিক জবানবন্দী
নিতে। এস আই সাহেবের কাছে দেয়া তার জবানবন্দীটাতে অবশ্য ঘটনার
একটু ভিন্নতা বা আরেকটু বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তার জবানবন্দী অনুযায়ী সেদিন
সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে সাতটায় তুষার অফিস থেকে ফিরে অন্যান্য দিনের মত গোসল সেরে
এক কাপ চা খান আর ছেলের সঙ্গে খানিকক্ষণ খুনসুটি করেন। এরপর
একথা সেকথায় পারিবারিক সামান্য একটা বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির সূত্রপাত ঘটে
এবং একসময়ে তা’ তীব্র ঝগড়াতে মোড় নেয়। এ
পর্যায়ে থানার সেকেন্ড অফিসার সুনির্দিষ্টভাবে কথা কাটাকাটির কারণ জানতে চাইলে
তিনি আবারও বিষয়টি প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে জানান যে, বিভিন্ন সময়ে তার
মোবাইলে ফোন করে তাকে ব্যস্ত পাওয়াটাই আসলে ঝগড়ার মূল কারণ। তার কোন ছেলেবন্ধু আছে
কিনা বা কারো সঙ্গে তিনি কোনও ধরনের অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত কিনা জানতে চাইলে তিনি
জোর গলায় এর প্রতিবাদ করেন। তিনি জানান যে
তিনি মূলতঃ তার আত্মীয় স্বজন এবং ছোটবেলার বন্ধু বা কলেজ জীবনের সহপাঠীদের সঙ্গেই গল্প করে থাকেন। যেটা তার সন্দেহ প্রবণ এবং খুতখুতে স্বভাবের স্বামী বিশ্বাস করতেন না। ছোটবেলা
থেকেই তিনি বেশ প্রাঞ্জল এবং মিশুক স্বভাবের হওয়ায় তার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা অগনিত। তিনি নতুন কোথাও ঘুড়ে বেড়াতে এবং শপিং করতে ভালবাসেন। অবশ্য
স্বামীর সীমিত আয়ের কারণে তার অনেক সাধই অনেক সময় অপূর্ণ থেকে যায় কিন্তু সেটাকে
তিনি মেনে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন। তার
অনেক বান্ধবীদের মত তিনি স্বামীকে অযথা চাপ দিয়ে কখনই কস্ট দেন নি। অথচ তার এই স্বভাবটাকে
তুষার কখনই মূল্যায়ন করেনি। যাহোক সেদিন সন্ধ্যায় বাদানুবাদের
একপর্যায়ে অভিমান ভরে তিনি তার স্বামীকে বলেন, বেশি জ্বালাতন করলে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করব। এসময় তুষার বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে মজা করে বলেন,আত্মহত্যা
করা অত সহজ নয়,কি ভাবে আত্মহত্যা করতে হয় তুমি জান কি? আগে দেখে নাও কিভাবে
আত্মহত্যা করতে হয়,এসো শিখিয়ে দেই। এরপর তুষার একরকম দৌড়ে বারান্দা থেকে কাপড়
শুকানোর দড়িটা খুলে নিয়ে এসে গলায় পেঁচিয়ে নিজেই ঝুলে পড়েন ফ্যানের সঙ্গে। আতঙ্কিত
হয়ে অঞ্জলি জিজ্ঞেস করেন, কি করছ তুমি? কিন্তু তিনি ভালভাবে ঘটনাটা বোঝার আগেই স্বামীর
ঝুলন্ত দেহ নিথর হয়ে যায়। এ পর্যায়ে তিনি বঁটি দিয়ে দড়ি কেটে স্বামীর মরদেহ নামিয়ে
আনেন। এরপর নীচের ফ্ল্যাটে বসবাসরত শ্বশুর–শাশুড়ি, দেবরকে পাগলের মত ডাকা ডাকি করেন
কিন্তু কারো কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে অভাবিত ঘটনায় দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যা করার
উদ্দেশে বারান্দা থেকে নীচে লাফ দেন।
পরদিন
মালিটোলার ছয়তলা বিল্ডিঙটাতে গিয়ে দেখা যায় মহল্লার অনেক লোকের ভিড়। বিল্ডিঙয়ের
পাঁচতলায় পূর্বদিকের
ফ্ল্যাটে তুষার তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন আর চারতলার পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটে
থাকেন তার পক্ষাঘাতগ্রস্থ বৃদ্ধ বাবা বশির
আহমেদ,মা আর ছোট ভাই। বোন
তার স্বামীর সঙ্গে জিগাতলায় থাকে। বশির
সাহেবের পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া পাঁচ কাঠা জমির ওপড়ে এই ছয়তলা বিল্ডিং,যার নীচতলার
সম্পূর্ণটা গ্যারেজ। ডেভেলপারের সঙ্গে
ফিফটি ফিফটি চুক্তিতে পাঁচটি ফ্ল্যাট বুঝে পেয়েছেন,দু’টি তারা ব্যবহার করেন আর
বাকী তিনটি ভাড়া দেয়া আছে। পুরো বাড়ীতে শোকের ছায়া। হুইল চেয়ারে বসা বশির সাহেব
কথা বলেন ইশারায়,তার চোখের কোণ গড়িয়ে জল পড়ছে। পাশের ঘরে বিছানায় আলুথালু বেশে
তুষারের মা শোকে মাতম করছেন,অকালে ছেলেকে হারিয়ে তিনি পাগল প্রায়। পুরো বাড়িতেই
কথা বলার মত মানসিক অবস্থায় কেউ নেই বলা যায়। তবু কর্তব্য পালনের
খাতিরে তুষারের ছোট ভাই শিশিরকে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায় ঘটনার রাতে
সে ছিল বুয়েট হোস্টেলে। আর্কিটেকচার পড়ুয়া অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ইদানিং একটা প্রজেক্টের কাজে সে ব্যস্ত। সে সকালে খবর পেয়ে বাসায় এসে সবকিছু জানতে পারে। তার
ভাষ্য মতে,ভাবী যেভাবে ঘটনার
বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তার ভাই মরতে পারেনা। তার জানা মতে তাদের তেমন বড় কোন
সাংসারিক ঝামেলা ছিলনা যে তার ভাইকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হবে। টুকটাক ঝগড়া
ঝাটি বা মনোমালিন্য কমবেশি সব সংসারেই হয়ে থাকে এবং দু’টি মানুষ পাশাপাশি থাকলে
এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। তার মানে এই নয় যে এত সামান্যতেই কেউ আত্মহত্যা করে
বসবে! পুরো ঘটনাটাই তার কাছে বেশ রহস্যজনক বলে মনেহয়। তুষারের
ছোট বোন বৃষ্টি’র দাবী তার ভাবীর বেপরোয়া চলাফেরা এবং বেহিসাবি খরচের কারণেই তার
ভাইয়ের এই করুণ পরিণতি! তুষারের মৃত্যুর বিষয়ে অঞ্জলি আক্তারের বক্তব্য তাকে জানান
হলে তিনি খানিকটা উত্তেজিত ভাবে বলেন যে তার ভাবী বিনা প্রয়োজনেই প্রচুর মিথ্যা
কথা বলে থাকেন। মিথ্যা কথা না বললে যেন তার পেটের খাবার হজম হতে চায় না! তারা অনেকবার
এনিয়ে তাদের ভাবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাকে বোঝানর চেস্টা করা হয়েছে। এমনকি তার বোনদের কাছেও
অভিযোগ করা হয়েছিল কিন্তু তিনি কারও কথাই শুনতেন না। বিশেষ করে ভাবী তার বাবার মৃত্যুর
পরে আরও বেশী বেপরোয়াভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। হয়ত এসব কারণেই তার ভাই মানসিক
চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অবশ্য তুষারের চাচা,যিনি তুষারকে
কোলে পিঠে মানুষ করেছেন তিনি অর্থাৎ কবির আহমেদ বৃষ্টির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে
পারেন না। তিনি বৃষ্টিকে তার কথার মাঝেই এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,তুষার খুব চাপা
স্বভাবের ছেলে হওয়ায় তার কষ্টগুলো হয়ত কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি ঠিক কিন্তু তিনি ভালভাবেই
জানেন তার ভাতিজা প্রচণ্ড ধৈর্য আর মানসিক শক্তির অধিকারী। এই ছেলে আত্মহত্যা করতে পারেনা। তাকে পরিকল্পিত ভাবে মেরে
ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মতামতের
স্বপক্ষে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে কি না বা তিনি কাউকে এ বিষয়ে সন্দেহ করেন কি না
জিজ্ঞেস করলে অবশ্য তিনি তা’ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
নাখালপাড়ায় বসবাসরত অঞ্জলির মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে
যোগাযোগ করা হলে তারা তেমন কোন তথ্য দিতে পারেনা। তারা আসলে তাদের মেয়ের ভবিষ্যৎ
নিয়েই বর্তমানে বেশী চিন্তিত। অঞ্জলির বাচ্চাটা আপাততঃ তার বড় বোনের কাছেই আছে। বড়
বোনের নিজেরও প্রায় দশ মাস বয়সের একটা বাচ্চা আছে তাই বাচ্চার দেখাশোনায় তেমন
সমস্যা হবেনা বলেই বিশ্বাস। অঞ্জলির শ্বশুরবাড়ির পক্ষের অভিযোগটা তাদেরকে জানান
হলে তারা বলেন যে অঞ্জলির সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক কখনই ভাল ছিলনা। বিশেষ
করে তার ননদের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল খুবই খারাপ। তাদের মধ্যে মুখ দেখা-দেখিও এক
প্রকার বন্ধই ছিল। আর তুষারের চাচার খুব ইচ্ছা ছিল তিনি তার অতি আদরের মেজ
মেয়ের সঙ্গেই তুষারের বিয়ে দিবেন কিন্তু তুষার এক প্রকার পছন্দ করেই অঞ্জলিকে ঘরে
তোলে। এই বিয়েটা কবির সাহেব কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি এবং এ বিষয়ে তার সমস্ত
আক্রোশ ছিল অঞ্জলির ওপরে। তার মেয়ের সঙ্গে তুষারের বিয়ে না হওয়ার জন্য
তিনি অঞ্জলিকেই দায়ী করে এসেছেন সব সময়ে। এমনকি তিনি তাদের বিয়েতেও আসেননি। তারা
বিভিন্ন সূত্রে এও জানতে পেরেছেন যে কবির সাহেবের মেয়ে,তমাও খুব পছন্দ করত তুষারকে।
তুষারকে বিয়ে করার জন্য পাগল প্রায় ছিল সে। কিন্তু বিয়ে করতে না পেরে মানসিক
যন্ত্রণায় ভুগে শেষে কিনা পাগলই হয়ে গেল মেয়েটা! এখন বনানীতে
এক হেলথ ক্লিনিকে ভর্তি আছে সে। নিজের অতি আদরের মেয়ের এই করুন পরিণতি ক্রোধান্ধ করে তোলে
কবির সাহেবকে। তিনি তার প্রতিশোধপরায়ণ মনোবৃত্তি থেকেই অঞ্জলির বিরুদ্ধে বানোয়াট
সব অভিযোগ এনেছেন বলে অঞ্জলির পরিবারের ধারণা। অঞ্জলির মা’র
মতে তুষারের চাচাই হয়ত তুষারকে কোন ভাবে মেরে এখন তার মেয়েকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে
চাইছে। হয়ত এভাবেই তার নিজের মেয়ের করুণ পরিণতির জন্য তুষার এবং
তার স্ত্রী,উভয়ের ওপরে তিনি প্রতিশোধ নিলেন! তাদের সাজানো সুন্দর সংসারটা ধ্বংস করে দিলেন। এ পর্যায়ে তাকে
তার মেয়ের বক্তব্য শোনান হলে তিনি বলেন,তার মেয়ে স্বামীকে হারিয়ে এখন পাগল প্রায়,বিকার
গ্রস্থ। মানসিক বৈকল্যতায় সে জানেনা সে কি বলছে। এরকম মানসিক অবস্থায় তার এধরনের
বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। তিনি সেকেন্ড অফিসারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তার
মেয়েও কিন্তু আত্মহত্যা করার জন্যই লাফ
দিয়েছিল,হয়ত সৌভাগ্যক্রমে তাদের মেয়ে বেঁচে গেছে। এখান থেকেই তার মেয়ের মানসিক
অবস্থাটা বোঝা যায়। এস আই বারী তাদেরকে জানান যে এটা নিতান্তই প্রাথমিক তদন্ত।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা হাতে এলেই বোঝা যাবে এটা আত্মহত্যা নাকি একটা নিয়মিত হত্যা
মামলা হবে। তখন তদন্তে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। বোঝা
যাবে কে,কি উদ্দেশ্যে,কেন, কোথায়, কিভাবে হত্যা করেছে অথবা কিভাবে সে আত্মহত্যা করেছে এবং এ কাজে কেউ তাকে
প্ররোচিত করেছে কি না বা কি অবস্থার প্রেক্ষিতে সে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য
হয়েছিল। অবশ্য তার নিজেরও কবির আহমেদ লোকটাকে সুবিধার বলে মনে হয়নি। তাকে একটু কুটিল এবং উদ্ধত স্বভাবের মনেহয়। এ
পর্যায়ে প্রাথমিক তদন্তে বিরতি টেনে তিনি থানায় চলে যান। মটর
সাইকেলে স্টার্ট দিতে দিতে তার কেন যেন অঞ্জলি আক্তারের বলা গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য
মনে হয়না। কেবলি মনে হয় কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ফাঁক আছে যেটা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন
না। বিষয়টাতে তিনি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ অনুভব করেন। থানায় ফিরে তিনি ওসি জসিম
উদ্দিন আহমেদ সাহেবকে অনুরোধ করেন মামলাটার আইও হিসাবে তাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য। ওসি
এ ঘটনার ওপরে একটা ফাইল খুলে তাকে তদন্তের কাজে এগিয়ে যেতে বলেন। শুরু হয়
নতুন এক গল্পের পথ চলা।
মোটামুটিভাবে
তিনটা সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আইও বা তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কাজ শুরু করেন। প্রথম
সম্ভাবনা তুষার সাহেব আসলেই কোন কারণবশতঃ
আত্মহত্যা করেছেন। সে ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল (
scene of crime) সঠিকভাবে পরীক্ষা করা এবং ময়নাতদন্ত(autopsy) রিপোর্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি মনে করেন। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা হল তুষারের চাচা জনাব কবির আহমেদ তার
মেয়ের বর্তমান পরিণতির জন্য দায়ী করে প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে নিজে কিংবা আততায়ী ভাড়া
করে তুষারকে ঝুলিয়ে হত্যা করেছেন এবং তার স্ত্রীকেও হত্যার জন্য উপর থেকে ছুড়ে
ফেলেছেন বা কোন কারণ বশতঃ অঞ্জলি আক্তার উপর থেকে লাফ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বর্তমানে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও হয়ত তার সন্তানের জীবন রক্ষার্থে বা অন্য কোন অজ্ঞাত
কারণে কারো শেখান বুলি আউরিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে অবশ্য প্রচুর সাক্ষ্য প্রমাণ এবং যথাযথ ময়নাতদন্ত
রিপোর্টের প্রয়োজন হবে। তৃতীয় সম্ভাবনা হল অঞ্জলি নিজেই অথবা অন্য কারো সহযোগিতায়
কোন কারণবশত তুষারকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছেন। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, তিনি
যদি নিজেই তার স্বামীর হত্যার সঙ্গে যুক্ত থেকে থাকবেন তাহলে পাঁচ তলা থেকে তার
ভাষ্য অনুযায়ী আত্মহত্যা করার জন্য লাফ দিতে গেলেন কেন? তৃতীয় সম্ভাবনাটা প্রমাণ
করতে গেলেও প্রচুর সাক্ষ্য প্রমাণ,অঞ্জলির স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী এবং
ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত অবশ্য মামলার আলামত ও তদন্তের
অন্যান্য বিষয়গুলো অঞ্জলি আক্তারের স্বপক্ষেই আছে।
ঘটনার রাতে অর্থাৎ ১৭এপ্রিল রাতে ছয়তলা বিল্ডিঙের
কাছে যারা ডিশ লাইন মেরামতের কাজ করছিল তাদের
থেকে শুরু করে তুষার ও অঞ্জলির পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য লোকজন যারা ঘটনাটা
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জানে তাদের প্রায় সবার সঙ্গেই পুনরায় কথা বলেন মামলার
তদন্তকারি কর্মকর্তা। এরপর অঞ্জলিকেও আবারো খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন। অঞ্জলি
আক্তার সাবলীলভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। কেউ তাকে বা তার সন্তানকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে কি না তাও জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নটা শুনে একটু থতমত খেলেও তিনি
জানান যে এটা একটা অমূলক ধারণা,কেউ তাকে বা তার সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি
দিচ্ছেনা। তিনি আবারও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। ফ্ল্যাটের সব ঘর এবং বিশেষ করে যে ঘরে
তুষার সাহেব আত্মহত্যা করেছিলেন সে ঘরের প্রতিটা জিনিষ,আসবাবপত্র,ব্যবহার্য
দ্রব্যাদি নতুন করে পরীক্ষা করেন। যে টুলটায় দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করা হয় তাও পরীক্ষা
করেন। একটা টেবিলের ওপরে চেয়ার রেখে তার ওপরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সিলিং
ফ্যানটা পরীক্ষা করেন। লোহার যে আংটার
সঙ্গে ফ্যানটা ঝুলছিল সেখানে ফ্যানের নাট’টা নীচের দিকে একটু বাঁকানো অবস্থায়
পাওয়া যায়। বোঝা যায় ভারী কোন বস্তুর ওজনে অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তুষারের শরীরের ওজনে
বা মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার হাত-পা ছোড়া-ছুড়ির কারণে হয়ত এমনটা হয়েছে! তিনি সঙ্গে থাকা
ক্যামেরায় ছবি তুলে নেন। চেয়ারের
ওপরে যেখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সে স্থান থেকে নীচে তাকাতে ফ্যান বরাবর ঘরের মেঝেয় কিসের
যেন অস্পষ্ট কালচে দাগ দেখতে পাওয়া যায়। নেমে এসে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় ওগুলো
রক্তের ফোঁটার দাগ। শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অনেকক্ষেত্রে
দেখা গেছে যে আত্মহত্যার সময়
আত্মহত্যাকারীর নাক বা ঠোট থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে থাকে। ওগুলো তাই হবে হয়ত!
তিনি রক্তের শুকিয়ে যাওয়া দাগের
ছবি তোলেন। এরপর আরও কিছু সময় কাটান কিন্তু নতুন কিছু না পেয়ে তিনি সেখান থেকে ফিরে
আসেন। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে এটা একটা সাধারণ আত্মহত্যার ঘটনা।
অবশেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক
বিভাগ থেকে বহুল প্রতীক্ষিত ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা হাতে আসে। রিপোর্টটা ইংরেজিতে
চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় লেখা এবং সেটা অনেকটা এরকম।
POST–MORTEM
FINDINGS
External Findings.
Rigor mortis is present in all parts of body. The postmortem staining is
present and fixed over the dependent parts viz. both legs and distal portion of
upper limbs and area of waist above the belt.Both the eyes are found partially
open and the conjunctive congested while the cornea found hazy.The mouth is
partially open and a dark bluish tounge protruding out of the lips.The face is
congested.The tip of penis shows evidence of emission of semen.There is also an
evidence of defecation.The ligature material is a rope,which is present in situ
around the neck with the running knot placed over the occipital region.
Ante-mortem Injuries.
Ligature Mark. A ligature mark is present encircling the
whole neck except a small gap present beneath the knot. In front of the
neck,the ligature mark with 3cm width,is placed over the thyroid
cartilage,about 5cm above suprasternal notch and 8cm below chin.The ligature
mark running backwards,upwards and towards occipital region.On the right side
of the neck,the ligature mark with 2.8cm width,is placed about 5cm below the
mastoid process.On the left side of the neck,the ligature mark with 2.5cm width,is
placed about 4cm below the mastoid process.The base of the ligature is dark
brown in colour and ecchymosed.
Internal Findings. On dissection
of the neck, the underneath soft tissues are found soft, whitish and
glistening. There is no evidence of any extravasations of blood in the neck
tissues. Also, there is no evidence of fracture of thyroid cartilage or hyoid
bone. The scalp showed diffuse multiple petechial hemorrhages. The skull is
within normal limit. The meninges are intact and congested. The brain is
congested and edematous, with its parenchyma showing petechial hemorrhages.
Other organs are also congested. The stomach is congested and contains about
200ml thick yellowish colour food particles without any specific smell.
Cause of Death. ASPHYXIA due to suicidal hanging by
ligature.
ময়না তদন্ত রিপোর্টটার
দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন এস আই বারী। তার কেন যেন রিপোর্টটা মেনে নিতে মন সায়
দিচ্ছেনা। বিষয়টা নিয়ে ওসি সাহেবের সঙ্গে একটু আলোচনা করতে গেলে উনি বেশ বিরক্ত হন। ওনার অফিস
মাছের বাজারের মত লোকে গিজ্গিজ্ করছে। মাথার ওপরের রংচটা সিলিং ফ্যানটার নীচে
বসে তিনি অনবরত ঘামছেন আর লোকজনের কথা শুনছেন। তিনি বলেন ঘটনাস্থল (Scene of Crime) যেহেতু উনি নিজেই দেখেছিলেন
সেহেতু ময়না তদন্ত রিপোর্টটার সঙ্গে একমত হতে তার কোন সমস্যা হচ্ছেনা। পরিষ্কার
ভাবেই বোঝা যায় যে এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা। বরং দেরী না করে এই মামলার চূড়ান্ত
তদন্ত প্রতিবেদন (FIR) দাখিল করে হাতে থাকা অন্য
মামলাগুলোতে মাথা ঘামাতে পরামর্শ দেন তিনি। তিনি ভালভাবে ভেবে দেখার জন্য আরেকটা দিন
সময় চেয়ে নিয়ে ওসি সাহেবের অফিস থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর তিনি কি ভেবে ঘটনাস্থল আরেকবার দেখার জন্য মোটর
সাইকেলে স্টার্ট দেন।
এর আগে দেখা প্রতিটা বস্তু আবারো খুটিয়ে নেড়েচেড়ে
দেখেন তিনি। এরপর খানিকটা
ক্লান্তিতে শোয়ার ঘরে একটা ইজি চেয়ার টেনে এনে তাতে শরীরটা এলিয়ে সাক্ষীর বর্ণনা
আর প্রাপ্ত আলামতের (evidence) ভিত্তিতে দৃশ্যগুলো সাজিয়ে সে অনুযায়ী কল্পনা করতে থাকেন পুরো গল্পটা। তিনি আধা বোজা চোখে ভাবতে থাকেন আর সিগারেটের বাক্স খালি হতে থাকে। হাতের
পাশে মেঝেয় ছাইয়ের স্তূপ পিরামিড হয়। হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান’টা দিয়ে খানিকটা অভ্যাস
বশেই সিগারেটের বাট ছুড়ে মারেন ঘরের কোণে। দেয়ালে লেগে ওটা গড়িয়ে যায় আরেক পাশে।
সেখানে লম্বা আর ভারী পর্দা ঝুলান। কি ভেবে ছাইয়ের স্তূপ মাড়িয়ে সামনে যেয়ে পর্দা সরাতেই
চোখে পড়ে ছোট পরিপাটী ড্রেসিং রুম। মেয়েলী সব জিনিষপত্রে ঠাসা। একপাশে জুতার র্যাক আর তাতে হাল ফ্যাশনের জুতা-স্যান্ডেল। মহিলা খুব সৌখিন বোঝা যায়। আলনায় একগাদা
কাপড় সাজানো। সেগুনকাঠের ভারী আলমারিতে লাগান বড় আয়না। তিনি এই ঘরটা আগে কেন খেয়াল
করেননি তা বুঝতে পারেননা। আসলে জানালার মত এর
সামনেও দেয়াল জুড়ে ভারী বিলাসী পর্দা ঝুলান থাকায় তিনি সম্ভবত এটাকেও জানালা
ভেবেছিলেন। আলমারিটা খুলতেই একটা ছোট শিশি গড়িয়ে পড়ে। মেঝেতে
পড়ার আগ মুহূর্তে ধরে ফেলাতে ওটা ভেঙ্গে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। সাদা শিশির
অর্ধেকটা কি এক স্বচ্ছ তরলে পূর্ণ। পারফিউম নাকি! এখনতো আবার এধরনের স্বচ্ছ শিশিতে
হারবাল পারফিউম পাওয়া যায়। বুটিক হাউসগুলো তৈরী করে বলে তিনি শুনেছেন। হয়ত
ওরকম কিছু একটা হবে। ওটা একপাশে সরিয়ে রেখে আলমারির ভেতরটা দেখেন। আলমারিতে
দু’টো ভাগ। কোন তাক নেই ভেতরটাতে। এক
ভাগে ছোট ছোট হ্যাঙ্গারে নাম না জানা সব ফ্যাশন হাউসের শাড়ি ঝুলছে। আরেক ভাগে
ঝুলছে বেশ ক’টা স্যুট। স্যুটের সারি বরাবর
আলমারির নীচে তাকাতে সেখানে বেমানান কিছু একটা চোখে পড়ে। তিনি
দেয়ালের দিকে হাত বাড়িয়ে সুইচ বোর্ডে হাত রাখেন। সাদা
ধবধবে এনার্জি লাইট ঘরটাকে আলোয় ভাসিয়ে দেয়।
বেশ কাদা লেগে আছে সেখানে। মহিলা এত
পরিপাটি, বলা যায় পুরো ফ্ল্যাটটাই সুন্দর ভাবে গোছান অথচ যেখানে তার নিত্য আনাগোনা সেখানে কাদা আসে
কিভাবে! ভাল করে লক্ষ্য করায় কাদার ভেতর থেকে এক জোড়া জুতার অস্পষ্ট ছাপ বেরিয়ে আসে। কাদার মধ্যে ইটের
মিহি গুড়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। হয়ত একারণেই কাদাটা দেখতে একটু লালচে লাগছে। ইম্প্রেশন এভিডেন্স নেয়ার জন্য মোবাইল করে একজন ক্রাইম
সিন এক্সপার্টকে আসতে বলে তিনি নিজেও পরীক্ষায় নেমে পড়েন। একটু
গভীর ভাবে তাকালে ড্রেসিং রুমের মেঝে থেকে বেড রুম বরাবর হালকা কাদার ছাপ চলে গেছে
বোঝা যায়। যেটা বেড রুমের মেঝেতে একপ্রকার প্রায় মিলিয়ে গেছে বলা যায়। হয়ত কেউ
মুছে ফেলতে চেয়েছে সে ছাপ। ইতিমধ্যে ক্রাইম সিন এক্সপার্ট মোঃ ফজলুল হক তার সরঞ্জামাদিসহ
এসে পড়েন। ধূসর চোখের মাঝ বয়সী একজন ঝানু ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব, যিনি তার কাজটা খুব
ভাল ভাবেই বোঝেন। এসেই কালক্ষেপ না করে
কাজে নেমে পড়েন তিনি। প্রথমে ব্রাশ দিয়ে হালকা ভাবে জুতার ছাপের চারপাশটা মুছে
নেন। এতে শুকনা আলগা ধূলাগুলো সরে গিয়ে মেঝেয় জুতার ছাপ আগের চেয়ে অনেকটা স্পষ্ট
ভাবে ফুটে ওঠে। তিনি ছাপের
ছবি ক্যামেরা বন্দী করে প্রথমে ছাপের চারদিক ফ্রেমিং করেন। এরপর ফ্রেমের ভিতরে ছাপ
বরাবর ডেন্টাল স্টোন আর পানির মোল্ড ঢেলে ত্রিশ মিনিটের মত অপেক্ষা করেন কাস্টিংটা
(casting) শক্ত হতে। শুধুমাত্র যেখানে
ছাপের থ্রি ডাইমেনশনাল রূপ পাওয়া যায় সেখানেই কাস্টিং করা হয়ে থাকে। অন্যান্য
ক্ষেত্রে ছাপের ছবি তোলার পরে যে বস্তুর ওপরে ছাপ পাওয়া যায় সেটা তুলে নিয়ে কিংবা এডহেসিভ
লিফটার অথবা ইলেক্ট্রো স্ট্যাটিক লিফটিং
ডিভাইসের সাহায্যে ছাপ সংগ্রহ করে ল্যাবে নেয়া হয় পরীক্ষা করার জন্য। ইতিহাস ঘাটলে
দেখা যায় যে আনুমানিক ১৭৮৬ সাল থেকে এ ধরনের অপরাধের তদন্ত কাজে সম্ভাব্য অপরাধীর
পায়ের জুতার ছাপ সংগ্রহের এ পদ্ধতিটা চালু আছে। ডেন্টাল স্টোন ছাড়াও ডাই স্টোন,ডেন্টাল
প্লাস্টার কিংবা প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়েও কাস্টিং এর কাজ করা যায়। এগুলো সবই
জিপসাম থেকে তৈরি আর আমরাতো জানি জিপসাম হল ক্যালসিয়াম সালফেট এর ডিহাইড্রেট ফর্ম। প্লাস্টার
অফ প্যারিস একটু নমনীয় এবং সংরক্ষণে অসুবিধাজনক হওয়ায় আজকাল একাজে তার ব্যবহার প্রায়
উঠে গেছে। তিনি কাস্টিংটা শক্ত হলে তা’ সাবধানে উঠিয়ে পাশে রাখেন। এরপর
একইভাবে বাকী ছাপের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। যে ছাপগুলোর কাস্টিং করা সম্ভব হয় না সেগুলোর
ছবি তুলে টাইলস উঠিয়ে নেয়া হয় ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য। এ প্রক্রিয়ায় জুতার মাপ,আকার,কোম্পানির
লোগো বা নাম এবং কি ধরনের জুতা তা’ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া জুতার মাপ দেখে
জুতা ব্যবহারকারীর উচ্চতা সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়। আবার উচ্চতা
সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলে তার শারীরিক গঠন বা ওজন সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা সম্ভব।
নরম মাটি বা ভেজা জায়গায় পাওয়া ছাপের গভীরতা মেপেও ব্যক্তির ওজন সম্পর্কে ধারণা
নেয়া সম্ভব। এছাড়া ছাপের প্রকৃতি দেখে অনেকসময়ে ব্যক্তির হাঁটার ধরন সম্পর্কেও
বোঝা যায়। আসলে এগুলো সবই প্রায় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে
তুষার সাহেবের ফ্ল্যাটের মেঝেতে পাওয়া জুতার ছাপ মোটামুটি একই ব্যক্তির। তবে
সেগুলো যে তুষার সাহেবের না,তা’ নিশ্চিত ধরে নেয়া যায় কারণ তার জুতার র্যাকে রাখা
সব জুতাই ৭ নাম্বারের। কিন্তু যে নমুনা সংগ্রহ করা হল তা’ সম্ভবত ৯ নাম্বার জুতার
ছাপ হবে। এটা ঘটনাস্থলে অন্য একজন ব্যক্তির উপস্থিতির প্রমাণ করে এবং আগন্তকের উচ্চতা
যে বেশ ভাল তা’ তার জুতার মাপ দেখেই বোঝা যায়। ধারণা করা যায় তার উচ্চতা ৫ ফুট ৭
ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির মত হবে। সাধারণত
একজন মানুষের পায়ের দৈর্ঘ্য তার শরীরের উচ্চতার আনুমানিক ১৫% হয়ে থাকে। কাজ শেষে
ফজলু সাহেব তার জিনিসপত্র গুটিয়ে নমুনাগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য সঙ্গে নিয়ে
যান।
কে হতে পারে সে আগন্তক আর এইখানেইবা তার
জুতার ছাপ কেন? তবেকি অজ্ঞাত সেই ব্যক্তি এখানে লুকিয়ে ছিল? যদি তাই হবে তবে কি
কারণ বা উদ্দেশ্য ছিল তার? ঘটনার রাতে তার কি কোন ভূমিকা ছিল? সে কি চোর বা ডাকাত
ছিল? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় একসঙ্গে ঘুরপাক খেতে থাকে। ভ্রূ কুঁচকে আবারো তিনি
তাকান বর্ণহীন তরলে আধা পূর্ণ সাদা শিশিটার দিকে। ওটা যদি সত্যিই পারফিউমের শিশিই
হয়ে থাকে তাহলেতো ওটা থাকার কথা ড্রেসিং টেবিলে রাখা অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যের
সঙ্গে। এখানে কেন এল সেটা? তাহলে ওটাতে কি পারফিউম নাকি অন্য কিছু আছে? অন্য কিছু
হলে সেটা কি হতে পারে? শিশিটা কেমিক্যাল এক্সপার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য
মহাখালীতে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে। ওটা’তে কি বিষ আছে? বিষ হলে কে কাকে বিষ
খাওয়াতে চেস্টা করেছিল? তুষার সাহেবের
ভিসেরা পরীক্ষাতে তো শরীরে কোন ধরনের বিষের উপস্থিতি ধরা পরেনি! সে যে সত্যি
সত্যিই আত্মহত্যা করেছে তা’তো সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত! মাথায় কেমন চিন্তার জট
লেগে যায় বারী সাহেবের। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি নোট বুকে টুকে নিয়ে শিশিটা সহ থানায়
ফেরত আসেন। বুঝতে পারেন মামলার তদন্তে কোথাও ফাঁক রয়ে গেছে, তদন্তের কাজ আবারো
শুরু করতে হবে।
অঞ্জলি আক্তারের জবানবন্দী অনুযায়ী তুষার
সাহেব ঘটনার রাতে বাসায় ফিরেছেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আর আবহাওয়া বিভাগের রিপোর্ট
অনুযায়ী সেদিন ঝড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিকাল পাঁচটার দিকে। তার মানে
আগন্তক সে দিন সাড়ে সাতটার আগেই অর্থাৎ ছয়টা/সাড়ে ছয়টারদিকে বৃষ্টির মধ্যে হেটে ঐ
ফ্ল্যাটে যায়। একারণেই সম্ভবত তার জুতায় কাদা লেগেছিল। আর জুতার কাদায় ইটের গুড়া লেগে থাকার কারণ হল মোড়ের দোকানের পাশে
রাখা ইট সুরকির স্তূপ। এদিকটায় বেশ কয়েকদিন ধরে রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। তাই
রাস্তার কোথাও গর্ত আবার কোথাওবা ইট সুরকি বা বালি বিছানো। আগন্তক সম্ভবত রাস্তায়
জমে থাকা পানি এড়াতে সুরকির ওপর দিয়ে হেঁটে গেছেন। তাই যদি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে
দোকানদার হয়তবা আগন্তককে দেখে থাকবেন অন্তত দু’টি কারণে। প্রথমত বৃষ্টির সময় লোকের
আনাগোনা এমনিতেই কম থাকে কাজেই কেউ পাশ দিয়ে হেটে গেলে তা’ তার চোখে পড়ার কথা।
দ্বিতীয়ত ইটসুরকির স্তুপ তার দোকানের পাশে এমনভাবে রাখা যে কেউ রাস্তার আবদ্ধ পানি
এড়াতে সুরকির উপর দিয়ে হেঁটে গেলে তার চোখে না পড়ার কোনও কারণ নেই। অবশ্য কেউ ঘুমিয়ে
থাকলে সেক্ষেত্রে কথাটা ভিন্ন। কিন্তু দোকানদার সামচু মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তথ্য
পাওয়া যায় অনেক বেশী এবং তা’ চমকপ্রদও বটে। তার ভাষ্য অনুযায়ী সে দিন বিকালে
বৃষ্টি শুরু হলে তিনি ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটা থেকে রক্ষার জন্য দোকানের শাটার
অর্ধেকটা টেনে দিয়ে ভেতরে চুপচাপ বসেছিলেন। এরপর আনুমানিক সাতটার দিকে একজন ভদ্রলোক দোকানে এসে একটা সিগারেট কিনে লাইটারটা চেয়ে
নেন আগুন ধরানোর জন্য। সামচু মিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী ভদ্রলোক মাঝারী স্বাস্থ্যের
অধিকারী আর তার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। উনি এসেছিলেন বর্ষাতি গায়ে কিন্তু
সিগারেটে আগুন ধরানোর সময়ে মাথার ওপরে চাপানো বর্ষাতির হুডটা নামান তিনি। এতেই ভদ্রলোকের
মুখটা দেখার সুযোগ ঘটে। ফর্সা সুন্দর চেহারা আর বাম গালে প্রায় মিলিয়ে
যাওয়া একটা কাটা দাগ আছে। আসলে গালের ঐ দাগটা আর সেই সাথে তার উচ্চতার কারণেই তার
কথা সামচু মিয়ার মনে আছে। এর আগেও তাকে দুই/তিন দিন এদিকে কোথাও দেখেছেন। সম্ভবত
এর আগেও তার দোকান থেকে দু’একবার সিগারেট কিনেছিলেন তিনি। তবে তিনি কোথায় কোন ফ্ল্যাটে যান বা কোথায় থাকেন কিংবা কি
নাম তা’ তিনি জানেন না। সেদিন তাকে একটু অস্থির দেখাচ্ছিল কারণ তিনি বার বার বাম
হাতের হাতা গুটিয়ে ঘড়িতে সময় দেখছিলেন। একসময় মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে
সিগারেটের বাট ছুড়ে ফেলে সুরকী জুতায় মাড়িয়ে তিনি গলির দিকে এগিয়ে যান। আর্টিস্টকে
দিয়ে ভদ্রলোকের মুখের স্কেচ করাতে হলে তিনি সহযোগিতা করতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে
সামচু মিয়া তাতে সম্মতি জানান। এস আই বারী সাহেবের মনেহল তিনি যেন অন্ধকার
সুরুঙ্গের মুখে হঠাৎ আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছেন,তবে তিনি এও জানেন যে রহস্য উদ্ঘাটনে
তাকে আরও অনেকটা পথ চলতে হবে।
তিন/চার দিন পরে এস আই বারি সাহেব ঘটনাস্থলে
পাওয়া জুতার ছাপের ইম্প্রেশন এনালাইসিসের রেজাল্ট আর আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকানো
ভদ্রলোকের সম্ভাব্য স্কেচ নিয়ে তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে কথা বলছিলেন ওসি সাহেবের সঙ্গে। সামচু মিয়া তার সাধ্যমত সহায়তা
করেছেন। এরমধ্যে শিশিতে থাকা তরলের কেমিক্যাল বিশ্লেষণটা এসে পৌঁছায় হাতে। রিপোর্টটা
যেমন অস্বাভাবিক তেমনি চমকপ্রদও বটে। আসলে এ লাইনে তিনি কখনই চিন্তা করেননি। তরলটা
হচ্ছে বিশুদ্ধ ক্লোরোফরম। কিন্তু এ
জিনিসতো সাধারণভাবে বাজারে পাওয়া যায়না! মিটফোর্ট এলাকার কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী কঠোর
নিয়ন্ত্রনের মধ্যে এই তরল বিভিন্ন হাসপাতালে বা ক্লিনিকে বিক্রি করে থাকে। এটা মূলতঃ
রোগীর অপারেশনের সময়ে এনেস্থিশিয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যিনি এই তরল পদার্থটি ঘটনাস্থলে এনেছেন
তিনি সম্ভবত চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত এবং তিনি জানেন এটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়।
হয়তবা তিনি একজন এনেস্থেটিস্ট আর তাই তার পক্ষে সহজ হয়েছে এটা সংগ্রহ করতে। অবশ্য
এটা চোরাই মার্কেট থেকে কিংবা ওষুধের
দোকানদারদের কারও কাছ থেকে ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রেও সংগ্রহ করা সম্ভব। ওসি সাহেব
তদন্তের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে তাকে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে তদন্ত কাজ
তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদ দেন। বারী সাহেব তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ করার প্রতিশ্রুতি
দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসেন।
সম্ভাব্য একটা গল্প মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিকই
কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে হলে অঞ্জলি আক্তারের সঙ্গে আগন্তক ভদ্রলোকের যোগসূত্র
খুঁজে বের করতে হবে সবার আগে। এবিষয়ে ওনাকে প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। উনি এরই মধ্যে
আরও দু’টি নতুন গল্প বলে এমনিতেই তার চিন্তায় জট পাকিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা
হয়েছে ময়না তদন্ত রিপোর্টটা ওনার পক্ষে থাকায়। ওনার এ্যালিবাই ভাংতে হলে সব ধরনের
প্রমাণ তথ্যাদি প্রস্তুত করে তারপর ওনার সঙ্গে বসতে হবে। হঠাৎই মনেপরে অঞ্জলি
আক্তারের মোবাইল এবং কল লিস্ট এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে সিজার করা দ্রব্যের মধ্যে
মোবাইল ফোনটা না থাকায় ওসি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান যে সেটা সংগ্রহ
করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা সিজার লিস্ট মোতাবেক থানায় নেই কেন বুঝতে
পারছেন না তিনি। যাহোক অঞ্জলি আক্তারের ব্যবহৃত ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করে
কল লিস্ট নেয়া হয় এবং সেখান থেকে আই এম ই
আই নাম্বারের সূত্র ধরে ফোনটা উদ্ধার করা হয় তাল তলা, খিলগাঁ থেকে। ১৭/১৮ বছরের এক
যুবক অল্প দামে ওটা কিনেছিল স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে। সম্ভবত ঘটনাস্থলে মালামালের সিজার
তালিকা প্রস্তুত করার সময়ে কোন এক ফাঁকে সাক্ষীদের মধ্যে কেউ একজন সুযোগ বুঝে ওটা
সরিয়েছিল। মোবাইল উদ্ধার করা যায় ঠিকই কিন্তু ফোন বুকে কোন নাম্বার
পাওয়া যায়না। আর আগের সীমতো যে মোবাইলটা চুরি করেছিল সেই হয়ত ফেলে দিয়েছে সেট
বিক্রি করার সময়ে। সৌভাগ্যক্রমে এস এম এস বক্সে কয়েকটা এস এম এস পাওয়া যায় তার
মধ্যে একটা বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনেহয়। তারিখ পরীক্ষা করে দেখা যায় এস এম এসটা পাঠান
হয়েছিল ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে। আর এস এম এসটা হল-“ দূরের প্রিয় আসুক কাছে, কাছের জনও
থাকুক পাশে, মন ছুটে যাক মনের টানে, খুশীর জোয়ার লাগুক প্রাণে।” এস এম এসটা কেমন
যেন একটা ইঙ্গিত বহন করে। কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায় ঐ নাম্বারেই
অঞ্জলি আক্তার বিভিন্ন সময়ে সবচেয়ে বেশী বার কথা বলেছেন। বেশীর ভাগ কথোপকথন হয়েছে
রাত বারোটার পরে আর তা চলেছে ভোর চারটা/ সাড়ে চারটা পর্যন্ত। বোঝা যাচ্ছে তুষার
সাহেব ঘুমিয়ে থাকা কালে তার স্ত্রী অন্য একজনের সঙ্গে রাতের পর রাত গল্প করে
কাটিয়েছেন। তার অন্য আরেকজনের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছুইনা।
হয়ত তাই হয়েছে! হয়ত স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরেই স্বামীকে প্রাণ দিতে হয়েছে!
অঞ্জলি আক্তার সব সময় রাতে যে মোবাইল নাম্বারটাতে
কথা বলতেন সেই মোবাইল নাম্বারের সীম কার্ড রেজিস্ট্রেশন ফর্মটা সংগ্রহ করা হয় এবং
ফর্মের মধ্যে থাকা ছবির সঙ্গে সামচু মিয়ার সহায়তায় আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকানো ছবিটা
মেলান হয়। ছবি দু’টো অনেকটাই মিলে যায়,বিশেষ করে বাম গালে কাটা দাগটা থাকায় তাদের
বরং সুবিধা হয়েছে সনাক্ত করতে। রেজিস্ট্রেশন
ফর্মে থাকা ছবিটা সামচু মিয়াকে দেখান হলে তিনি তাকে সহজেই সনাক্ত করে জানান যে ঐ
ব্যক্তিকেই তিনি সেদিন তার দোকানে দেখেছিলেন। আগন্তক ভদ্রলোকের নাম ইমরুল কায়েস। তার
বাবার নাম কায়েস আহমেদ। ঠিকানায় লেখা উকিল পাড়া, গাইবান্ধা। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। তাকে গ্রেফতার
করার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয় কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া
যায়না। হয়ত পেপারে এবং টিভিতে সংবাদ কাভারেজ দেখে গা ঢাকা
দিয়েছেন। কল লিস্ট অনুযায়ী ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনি সামচু মিয়ার দোকান থেকে
অঞ্জলিকেই ফোন করেছিলেন। এস আই বারী সাহেব মনে মনে অনুভব করেন এবার তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য প্রস্তুত। হাসপাতালে যেয়ে
অঞ্জলি আক্তারের সঙ্গে এখন কথা বলা যায়। যদি তিনি স্বেচ্ছায় সব স্বীকার করেন তাহলে
তো মামলা চুকেই গেল। আর তা না হলে তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করবেন। হাসপাতালে
যেয়ে অঞ্জলি আক্তারকে সাক্ষ্য প্রমাণ সব দেখিয়ে সে রাতে আসলেই যা যা ঘটেছে তা খুলে বলতে অনুরোধ করা হলে
তিনি যথারীতি সব অস্বীকার করেন এবং তাকে নতুন আরেকটা গল্প শোনান। এ
পর্যন্ত তার শোনান সবগুলো গল্পই ঘুরে ফিরে প্রায় একরকম। এস আই বারী গভীর মনোযোগের
সঙ্গে ও ধৈর্য সহকারে সেসব গল্প শোনেন এবং মামলার স্বার্থে সাক্ষীকে অধিকতর
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোর্টের কাছে রিমান্ডের আবেদন জানান। দুই
দিনের জন্য তার রিমান্ড আবেদন
মঞ্জুর হয়। তবে তার শারিরীক অবস্থার দিকটাও খেয়াল রাখার জন্য আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়। সব সময় প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে স্বভাবগত ভাবে মিথ্যা কথা
বলার অভ্যাসকে সাইক্রিয়াটিস্টরা তাদের ভাষায় বলে থাকেন habitual বা compulsive lying। এটা আসলে এক ধরনের অসুখ যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় বলা
হয় pseudologia fantastica বা mythomania
কিংবা pathological lying । যে সব
পরিবারে সাধারণত বড়দের মধ্যে প্রচুর মিথ্যা বলার অভ্যাস থাকে কিংবা মিথ্যা বলা
যেখানে স্বাভাবিক একটা বিষয় সেসব পরিবারে এই অভ্যাসগুলো শিশুরা সহজাত প্রবৃত্তি
বশে রপ্ত করে থাকে। একরকম মিথ্যার বাতাবরণে তারা বেড়ে ওঠে। এই প্রবণতা পুরুষ বা
মহিলা উভয়ের মাঝেই সমানভাবে দেখা যেতে পারে। এস আই বারী সাহেবের ধারণা অঞ্জলি আক্তার pseudologia fantastica রোগে কঠিন ভাবে
আক্রান্ত !
সঙ্গে দু’জন মহিলা পুলিশ নিয়ে
ইন্টেরোগেশন রুমে ঢোকেন এস আই বারী। রুমের আলো আঁধারীর ভিতরে ইন্টেরোগেশন চেয়ারে
বসে ঘামছেন অঞ্জলি আক্তার। হাত-পায়ের প্লাস্টারের ওপর দিয়েই চামড়ার বেল্টগুলো
সেঁটে রেখেছে তাকে স্টিলের চেয়ারটার সঙ্গে। রুমের চারদিকের দেয়াল কালো রঙ করা,
জানালা নেই। ছাদের কাছে ঘুলঘুলি দিয়ে
ঘরে ঠিকরে পড়া এক টুকরা আলো জানান দেয় বাইরে এখনো দিন। কিন্তু বাইরের কোলাহল
মুখর জীবন যেন এখানে হারিয়ে গেছে। ঘড়ির
কাঁটা থেমে গেছে। সময় এখানে স্তব্ধ। মাথার ওপরে স্বল্প পাওয়ারের লাইট জ্বলছে
মিটমিট করে। তার সে আলো মেঝে পর্যন্ত পৌঁছায় না। সব মিলিয়ে যেন এক প্রাগৈতিহাসিক
পরিবেশ। রিমান্ডের রুমটা যেন কোন এক প্রাচীন গুহা। ঘরের ভিতরে ঢুকতেই মানুষের সব
চেয়ে প্রাচীন অভিজ্ঞতা ‘ভয়’ এসে গ্রাস করে। জন্মের মুহূর্ত থেকেই বংশ পরম্পরায়
নিউরনে বয়ে চলছে সবাই আদিম মানুষের সে অভিজ্ঞতা। অঞ্জলি আক্তার এক গ্লাস পানি খেতে
চাইলেন। একজন
কনস্টেবলকে পানি আনার আদেশ দিয়ে চেয়ারটা টেনে অঞ্জলি আক্তারের মুখোমুখি বসলেন বারী
সাহেব। হাতের আধ পোড়া জ্বলন্ত
সিগারেটের উৎকট গন্ধ পরিবেশটাকে করেছে আরও বিভীষিকাময়।
১৬১ ধারায় জবানবন্দী চাইলেন এস আই বারী সাহেব।
পানির গ্লাসটা খালি করে একটু ধাতস্থ হলেন অঞ্জলি আক্তার। এরপর তিনি বলা শুরু করলেন
তার গল্প। তার সে গল্পে আগের মতই অসংখ্য অভিযোগ তার মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে।
পাশাপাশি শাশুড়ি–ননদ ছাড়াও আরও অনেকের বিরুদ্ধে এনতার অভিযোগ জানিয়ে খানিকটা
থামলেন তিনি। একটু শ্বাস নিয়ে তার গল্পের চাকা আবারও মোড় নিল ইতোপূর্বে শোনান গল্পের
দিকে। পাশে দাঁড়ানো মহিলা কনস্টেবলকে ইশারা করতে সে হঠাৎই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল
তার দু’ গালে। সাধারণভাবে দেখা গেছে যে ইন্টেরোগেশনের সময় সাবজেক্ট যতক্ষণ তার
ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয় ততক্ষণ তার কাছ থেকে কোন তথ্য বের করা বেশ কঠিন।
তবে একবার কোন ভাবে সাবজেক্টের ব্যক্তিত্ব ভাঙ্গা গেলে জবানবন্দী নেয়ার কাজটা অনেক
সহজ হয়ে যায়। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে হয়না তা নয়। আর তাছাড়া যাদের পেশাগত কারণে
জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া মোকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে তারাও
ব্যতিক্রমীদের দলে পড়ে। তবে
সাধারণত সবারই একটা ব্রেকিং পয়েন্ট থাকে
আর জিজ্ঞাসাবাদকারীকে ধৈর্য সহকারে সে পর্যন্ত যেতে হয়। আচমকা এভাবে গালে চড় পড়াতে
হতভম্ব হয়ে যায় অঞ্জলি আক্তার। অবিশ্বাস্য এবং আহত দৃষ্টিতে সে ফিরে তাকায়
কনস্টেবলের দিকে। তার সঙ্গে কেউ কখনো এভাবে খারাপ ব্যবহার করতে পারে তা’ তার
কল্পনাতেও আসেনি। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে সে। একরকমের হতাশা এসে প্রচন্ডভাবে গ্রাস করে তাকে।
তার ওপরে মানসিক চাপ বৃদ্ধি করার জন্য এস আই বারী ইন্টেরোগেশন রুমে স্থাপিত
বিভিন্ন যন্ত্র, কোনটার কি কাজ এবং কোনটাতে সাবজেক্ট কি ধরনের ব্যথা অনুভব করে থাকে
তা’ বর্ণনা করে যান অনেকটা যান্ত্রিক স্বরে। ভয় আর আতংক এসে ভর করে অঞ্জলির মাঝে। তাকে
জানান হয় যে যার জন্য তিনি এসব করছেন তিন,ইতোমধ্যে পালিয়ে গেছেন কানাডা’তে। ইমিগ্রেসন বিভাগ থেকে তথ্যটা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। অবশ্য
তারা ইন্টারপলে নোটিশ পাঠাবেন সম্ভাব্য হত্যাকারীকে ধরে এদেশে ফেরত পাঠানর জন্য। কানাডার
সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি থাকায় বন্দী প্রত্যর্পণের বিষয়টা কঠিন কিছু
হবেনা। হয়ত একটু সময় লাগবে,এই যা। অঞ্জলি ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবেন,এরপর নিজেকে
ধাতস্থ করতে একটু সময় নিয়ে শুরু করেন তার বর্ণনা,তার গল্প বলা। বারী
সাহেব কয়েকবার প্রয়োজনীয় জায়গায় দু’একটা
প্রশ্ন করে ঘটনাগুলো আরেকটু বিশদ ভাবে জেনে নেন এবং টুকটাক তথ্যগুলো নোট বুকে টুকে
নেন। যাহোক অঞ্জলি আক্তারের দেয়া বর্ণনা আর খানিকটা কল্পনা করে দৃশ্যগুলো জোড়া
লাগালে তাদের প্রেমের গল্পটা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়।
কায়েসের
সঙ্গে অঞ্জলির পরিচয় সেই ছোটবেলা। বাবার চাকুরীর সুবাদে তখন তাদের গাইবান্ধায়
থাকা। একই পাড়াতে বাসা ছিল তাদের। সে তখন পড়ত ক্লাস ফোরে আর কায়েস ছিল ওর চেয়ে দুই
ক্লাস ওপরে অর্থাৎ ক্লাস সিক্সে। ভালবাসা
বলতে যেটা বোঝায় সেটা বোঝার মত বয়স
তখনো হয়নি। তবে তার আসেপাশে থাকতে ভাল লাগত কিংবা তার সঙ্গে একদিন দেখা না হলেই
বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। চারতলা বিল্ডিঙের নীচ তলায় থাকত ওরা আর কায়েস ভাইরা
থাকত ওদের ঠিক ওপরেই দু’তলাতে। আর তাই আসা-যাওয়ার মাঝে সিড়ির গোড়ায় কিংবা কখনো ছাদে গেলে চিলেকোঠায় দেখা হত
তাদের। আর যেদিন দেখা হতনা সেদিন ড্রইং রুমের পর্দা সরিয়ে বাইরে একমনে তাকিয়ে
থাকত। বিল্ডিঙের
সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে ক্রিকেট খেলত ওরা। মেয়ে হওয়াতে সে খেলতে পারতনা ঠিকই কিন্তু
যেদিন কায়েস ভাইরা খেলায় জিতত সেদিন তার আনন্দ হত খুব। সে জানত
না এই ভাললাগাগুলোকে আসলে কি বলে
কিন্তু যখন সে এসব বুঝতে শিখেছে তখন কায়েস ভাই অনেক দূরে। পরের বছরে ক্যাডেট কলেজে
চান্স পেয়ে কায়েস ভর্তি হয়ে গেল রংপুর ক্যাডেট কলেজে। তবে কায়েস ভাইয়ের কলেজের ছুটির
দিনগুলোতে তাদের দেখা হত। ক্যালেন্ডারের
পাতাগুলোতে দাগ দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনত সে। আন্টি অর্থাৎ কায়েস ভাইয়ের মা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন এসব, তাই তিনি তার ছেলেকে আগলে রাখতে
চাইতেন। মিশতে দিতেন না তাদের সঙ্গে। তার এতে খুব কস্ট হত। ইচ্ছে করত তাকে খুন করে
ফেলতে। তার বয়ঃসন্ধির কঠিন দিনগুলো সে এভাবে একা একাই পার করছিল। এমন সময়
হঠাৎ বাবার বদলীর সুবাদে তাদের সবাইকে
চলে আসতে হয় ঢাকায়। এমনকি সে কায়েস ভাইকে পর্যন্ত জানাতে পারেনি যে তারা ঢাকায় চলে
যাচ্ছে। হয়ত কলেজ ছুটিতে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে যে তারা আর
সেখানে নেই। এভাবে ভালবাসার কথাগুলো ভাগাভাগি করার আগেই তাদের সম্পর্কের ছন্দ পতন
ঘটে। আর সে সময়টাতে মোবাইল বা ফেসবুক না থাকাতে তার হঠাৎ চলে আসাটা কায়েস ভাইকে
জানানর কোন উপায়ই ছিলনা। সে অবশ্য লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কায়েসভাইকে তাদের ঢাকার
ঠিকানাটা দিতে আন্টিকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সে একদম নিশ্চিত যে আন্টি তার দেয়া কথা রাখেননি।
তবে সে মনে মনে নিশ্চিত ছিল একদিন তাদের দেখা হবেই। দেখা তাদের হয়েছিল ঠিকই,তবে সেটা
ছিল বিচিত্র জায়গায় বিচিত্র পরিবেশে।
ঢাকায় এসে অঞ্জলি ভর্তি হয়েছিল লালমাটিয়া
স্কুলে আর তারা থাকত মোহাম্মদপুরে তাজমহল রোডে। পরে
অবশ্য তার বাবা নাখালপাড়াতে বাড়ি করলে তারা সেখানে চলে আসে। এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সময়ে তার তুষারের
সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। তার এক কাজিনের বিয়েতে দেখা হয় তুষারের সঙ্গে। তুষার ওকে
পছন্দ করে এবং তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ছেলে যেহেতু ভাল বেতনের চাকুরী করে তাই এই বিয়েতে অমত করার
কোন যৌক্তিক কারণ ছিলনা। আর তাছাড়া কায়েসের সঙ্গে তো দেখা নেই অনেক কাল। এতটা
সময় কেউ কারো অপেক্ষায় থাকেনা।
বিয়ের পর প্রথম তিন বছর চমৎকার কেটে যায় নদীর
বহতা স্রোতের মত। এই তিন বছরে তাদের মধ্যে কোন ধরনের মনোমালিন্য বা মন কষাকষি ছিলনা।
সময়গুলো খুব সুখেই কেটেছিল তাদের। এরপর সে পেটে সন্তান ধারণ করে এবং বাচ্চা
প্রসবের জন্য ধানমন্ডিতে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়। গর্ভধারণ
করার পরের কয়েকটা মাস থেকে শুরু করে
ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত অন্য রকম একটা অনুভূতিতে ছেয়েছিল সে। সে মা হতে
যাচ্ছে। পেটে ধারণ করা সন্তানের মুখ দেখার জন্য সে প্রচণ্ড উদগ্রীব ছিল। তার মধ্যে
একটা অজানা ধারণা এবং ভয় কাজ করত। তার কেন
যেন শুধু মনেহত যে সে হয়ত বাচ্চা
প্রসবের সময় অপারেশন থিয়েটারেই মরে যাবে কিংবা সে হয়ত এনেস্থেসিয়া থেকে আর কখনও জেগে
উঠবে না। ঘুম থেকেই চলে যাবে চির ঘুমের দেশে। তার এইসব উদ্ভট ধারণাগুলো সে তার
স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেছিল। আর তাই অঞ্জলির মানসিক দুশ্চিন্তা লাঘব করার জন্য তুষার তার
স্ত্রীকে শহরের সবচেয়ে ভাল ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল। কিন্তু
এরপরও তার স্ত্রীর মধ্যে সবসময়ই
মৃত্যু বা কোন খারাপ সংবাদের আশঙ্কা ভীষণভাবে কাজ করত। অঞ্জলিকে যখন কেবিন থেকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তুষারের
খুব খারাপ লেগেছিল,কষ্টের মুহূর্তটাতে সে তার স্ত্রীর পাশে থাকতে পারছেনা বলে। তাকে একা
ওটিতে যেতে দিতে হচ্ছে হয়ত এমন একটা
কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য যার সম্পর্কে তার কোন পূর্ব ধারণাই নাই। সে
অসহায়ভাবে তাকিয়ে ছিল অঞ্জলির চলে
যাওয়া পথের দিকে।
অপারেশন থিয়েটারে অঞ্জলি যে পরিস্থিতির
মুখোমুখি হয় তার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলনা। সে কি
করবে ভেবে পায়না,তবে তা অল্প কিছু
সময়ের জন্য। বাস্তবতায় ফিরে আসে সে এবং শুয়ে পড়ে অপারেশনের বিছানায়। মাথার ওপরে
অনেকগুলো লাইট চেয়ে আছে তার দিকে। আরও চেয়ে আছে একজোড়া চোখ। মিটিমিটি হাসছে সে। কাপড়ের
তৈরী অপারেশন মাস্ক পরা,তাই মুখের অর্ধেকটা ঢাকা কিন্তু ওই চোখ জোড়া সে ভুলে কি
করে! তার অনেক রাতের ঘুম কেড়ে নেয়া সে চোখতো তাকে জ্বালিয়েছেও প্রচুর!
এরপরের ঘটনাগুলো খুবই দ্রুত ঘটে যেতে থাকে। অনেকটা
সিনেমার মত বা তার চেয়েও বেশী
কিছু। আসলে বাস্তবের অনেক ঘটনা মাঝে মাঝে সিনেমার কল্পনাকেও হার
মানিয়ে দেয়। শীতের শেষে
বিবর্ণ শিরিষ গাছে যেভাবে ডাল-পালা ছড়াতে থাকে তাদের ভালবাসায়ও তেমনই মেলতে থাকে নতুন
নতুন পাখনা। সে যেন ভালবাসার উম্মুক্ত আকাশে ক্রমাগত খাবি খেয়ে যায় আর কঠিন সুতোয়
লাটাইটা সামলে রাখে কায়েস। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূর। ক্লিনিকের কেবিনেই সে
তার স্বামী সঙ্গে কায়েসকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আর সে পরিচয়ের সূত্র ধরেই তাদের
ফ্ল্যাটে কায়েসের আসা যাওয়া। তুষার
সাহেব অবশ্য কায়েসের এই আসা যাওয়াটাকে প্রথম দিকে খারাপ ভাবে নেননি। ছোট
বেলার দু’বন্ধুর এতকাল পরে দেখা
হয়েছে কাজেই সেখানে কিছুটা উচ্ছ্বাস থাকতেই পারে। শুরুতে কায়েস ছুটির দিনগুলোতে
তুষার সাহেব যখন বাসায় থাকতেন তখন এসে বেড়িয়ে যেত। কিন্তু
আবেগের প্রবল জোয়ারে উত্তাল দু’টি আত্মা
এত অল্পে তৃপ্ত হবে কেন! এত শুধু কেবলই একপলক তাকিয়ে থাকা কিংবা কখনো ছেলেকে কোলে নেয়ার অজুহাতে আঙ্গুল ছুঁইয়ে
দেয়া নয়। কিংবা কখনও
বেশী বেপরোয়া হয়ে উঠলে খাবার টেবিলের নীচে চার পায়ের মিলন আর নীরব খুনসুটিতে দমে
যাওয়া নয়। আর
তাই শুরু হয় তুষার সাহেবের অগোচরে কায়েসের তার বাসায় আসা যাওয়া। এভাবেই চলছিল
কয়েকটা মাস। তাদের সম্পর্ক গভীর থেকে আরও গভীরতর হতে থাকে। এরকম একটা পর্যায়ে
একদিন তুষার সাহেব শারীরিক অসুস্থতার কারণে অসময়ে বাসায় ফিরে কায়েস আর অঞ্জলিকে বেডরুমে
অসংলগ্ন অবস্থায় পান। ফ্ল্যাটের সদর দরজাটা হালকা ভাবে ভেজানো থাকায় কলিং বেল
টিপতে হয়নি তাকে। বেডরুমে স্ত্রীকে ওভাবে দেখে মাথাটা ঘুরে ওঠে তার। কায়েসকে বাসা
থেকে বের করে দিয়ে বিছানায় ঝিম মেরে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। তিনি কি করবেন তা ভেবে পান না। এরপরের কয়েকটা সপ্তাহ একরকম বদ্ধ পরিবেশে
দিন কাটে তাদের। দু’জন দু’রুমে। তাদের মুখ দেখাদেখিও একপ্রকার বন্ধ। তুষার
বিষয়টি নিয়ে তার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলেন। এক
পর্যায়ে পারিবারিক আলোচনায় সন্তানের
ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অঞ্জলিকে ক্ষমা করে দেয় তুষার। গুমোট
ভাবটা কাটিয়ে সংসার শুরু করলেও কোথায় যেন
সম্পর্কের সুরটা কেটে গেছে। শত
চেষ্টাতেও তা মেলান যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ
করলেই বেডরুমের সেই
অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য এসে ভর করে তুষারের দু’চোখের পাতায়। এক ধরনের অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণার মধ্য
দিয়ে দিন কাটে তার। কি ভাবে যেন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে
থাকে বেশ দ্রুতই। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের থেকে লক্ষ্য যোজন দূরে সরে যেতে থাকে। একারণে স্বামীর কাছে ওভাবে ধরা পড়ে যাবার পর বেশ কিছু দিন
যোগাযোগ না থাকলেও পরবর্তীতে মানসিক প্রশান্তির আকাঙ্খায় আবারও ফোনে কথা বলা শুরু
হয় দু’জনের। কখনো কখনও মাঝ রাত থেকে শুরু করে ভোর অব্দি চলত তাদের প্রেমালাপ।
পাশের ঘরে তুষার তখন হয়ত গভীর ঘুমে অচেতন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে এসে কায়েস অঞ্জলিকে
বিয়ে করতে চায়। সে অঞ্জলিকে অনুরোধ করে তুষারকে ডিভোর্স দিয়ে তার কাছে
চলে আসতে। অঞ্জলি তার বাসায় এনিয়ে আলোচনা করে কিন্তু তার বাসা
থেকেই বাঁধা আসে প্রচুর। অঞ্জলির মা আত্মহত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দেন। তাছাড়া
তুষার কোনভাবেই তার সন্তানকে কাছ ছাড়া করতে রাজী নয়। সেদিনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার
পর থেকে তুষার সাহেবের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন যেন তার সন্তান। এসব বিভিন্ন জটিলতায়
শেষে পিছিয়ে আসতে হয় অঞ্জলিকে। কিন্তু সে কিছুতেই মন থেকে এসব মেনে নিতে পারেনা।
এভাবেই একসময় অবৈধ প্রণয়ের দোলাচলে দুলতে দুলতে তুষারকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা মাথায়
এসে ভিড় করে। আর সে
পরিকল্পনায় প্রবল ভাবে সায় দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে কায়েস। ঠিক করে তুষারকে মেরে
ফেলে ঘটনাটাকে আত্মহত্যার মত করে সাজাবে। এরপর সব কিছু শান্ত হয়ে গেলে এক সময় বিয়ে
করবে তারা। কিন্তু যদি
ঘটনাটাকে ঠিক ভাবে ম্যানেজ করা না যায় তাহলে তারা দু’জন বিদেশে পালিয়ে যাবে। আর সে
কারণে কায়েস অঞ্জলির পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র নিজের কাছে নিয়ে রাখে। সবার
অগোচরে পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে বাস্তবে রূপ দিতে দু’জনের প্রস্তুতি চলে।
অফিসের দিনগুলোতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বা
আটটার দিকে অফিস থেকে ফিরে গোসল সেরে এক কাপ চা হাতে নিয়ে টিভিতে খবর দেখা বা ছেলের
সঙ্গে খুনসুটি করা তুষার সাহেবের প্রতিদিনের অভ্যাস। কায়েসের পরামর্শ অনুযায়ী অঞ্জলি
প্রতিদিন স্বামীকে সন্ধ্যার চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ গুড়া করে মিশিয়ে খাওয়াতে থাকে।
প্রথমে দু’একদিন চায়ের তেতো স্বাদের কারণে চা বানানো নিয়ে রাগা রাগি করলেও এক সময়
তিনি তেতো চা পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন আর
ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে তাড়াতাড়ি রাতের খাবারটা সেড়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। তাছাড়া ও
সময়টায় এমনিতেও অফিসে কাজের বেশ ঝামেলা চলছিল। প্রতিদিন
সকালে উঠেই অফিসে দৌড় আর সন্ধ্যারাতে
রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফেরা! তুষার সাহেবের মনে
তাই কখনও সন্দেহ দানা বাঁধেনি।
ঘটনার রাতে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তুষার
সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফেরার আগেই কায়েস এসে রান্না ঘরের স্টোর রুমে লুকিয়ে থাকে।
অঞ্জলি কাজের মেয়েটাকে সেদিন কি এক কাজের অজুহাতে বিকালেই বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তুষার রাত সাড়ে আটটার দিকে অফিস থেকে বাসায় ফিরে যথারীতি গোসল সেড়ে চা খেয়ে কিছুক্ষণের
জন্য টিভি দেখতে বসে। এরপর সে শরীরটা বিছানায় একটু এলিয়ে দিয়ে অফিস থেকে সঙ্গে
নিয়ে আসা এক গাদা ফাইল খুলে বসে। দু’চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে ফাইলের পাতা ওলটাতে
থাকে সে। অঞ্জলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তুষারের দিকে। স্বামীর শ্রান্ত মুখটার দিকে
তাকালে এক মুহূর্তের জন্য গভীর মমতা এসে তাকে গ্রাস করে।কিন্তু সেত জানে যে পথে সে নেমেছে সেখান থেকে ফিরে আসা যায়না। আর তাই এক
ঝটকায় এসব অনুভূতি মাথা থেকে মাছি তাড়ানোর মত করে তাড়িয়ে রাতের খাবার টেবিলে লাগান
হবে কিনা জানতে চায়। তুষার অঞ্জলিকে খেয়ে নিতে বলে, তার হাতে অনেক কাজ। তার খেতে
দেরী হবে। অঞ্জলি কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে কায়েস এর সঙ্গে শলা
পরামর্শ করতে রান্না ঘরের স্টোর রুমে যায়।
তুষার যেন কথার ফিস্ ফাস্ শব্দ
শুনতে না পায় সেজন্য সে সিঙ্কে পানির ট্যাপটা ছেড়ে দেয়। পানির
অবিরত ধারা সিঙ্কে দুপুরের রান্নার
পরে জমিয়ে রাখা তৈজসপত্রগুলোর উপর আছড়ে পড়ে। অঞ্জলি কায়েসকে জানায় যে তুষার সহসাই ঘুমাতে যাচ্ছেনা।
বিছানায় গা এলিয়ে অফিসের কাজ করছে সে। কায়েস তাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে। সে আজ যেকোন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই
এসেছে। সঙ্গে আনা ছোট কাঁচের শিশিটা দেখিয়ে বলে তাতে ক্লোরোফর্ম আছে। বেশী সমস্যা
হলে প্রয়োজনে সে সেটা ব্যবহার করবে। কায়েসের কথায় একটু ভরসা ফিরে পায় অঞ্জলি। সে
বেডরুমে ফিরে দেখে তুষার তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ফাইল দেখছে,তবে হয়ত আর
কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়বে। সে কায়েসকে খবরটা দিতে রান্নাঘরে ফিরে যায়।
প্রায় আধ ঘন্টা পরে অঞ্জলি আবার পা টিপে
হেঁটে এসে দাড়ায় বেডরুমের আধা ভেজানো দরজাটার পাশে, ভারী পর্দাটা আস্তে সরিয়ে তুষার
কি করছে তা উকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে। তুষার সাহেব অবশ্য
আধ শোয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিছানার পাশে ফাইলের স্তূপ, এখানে সেখানে
কাগজপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে। মাথার উপরে ফ্যানটা বন্ বন্ করে ঘুরছে। সে
আর সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত রান্না ঘরে যেয়ে কায়েসকে খবরটা জানায়। কায়েস বেডরুমে
ঢুকেই অঞ্জলিকে ফ্যানটা বন্ধ করতে ইশারা করে আর সে গিয়ে দাড়ায় বিছানার পাশটাতে। কামারশালার হাপরের মত তুষারের বুক দ্রুত ওঠা
নামা করছে। হালকা নাক ডাকছে সে। কায়েস হাতে সার্জিক্যাল গ্লভস্ পড়ে ক্লোরোফর্ম
মাখা রুমালটা তুষারের মুখে ঠেসে ধরে। তুষারের
ঘুম ভেঙ্গে যায়,সে হাত পা ছুড়ে বাঁধা দেয়ার চেস্টা করে কিন্তু তার আগেই তার
নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে,আবারও নাক ডাকতে শুরু করে সে। এবার বেশ জোরে। সে আবারও ঘুমের
রাজ্যে হারিয়ে যায়। মাথার ওপরে ফ্যানটার মত এক সময় স্থির হয়ে আসে সেও। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে কাপড় শুকানোর দড়িটা খুলে এনে দু’জন
মিলে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। এমনিতে তুষার ওজনে
হালকা পাতলা হলেও সেদিন সিলিং ফ্যানের আংটার সঙ্গে দেহটা ঝুলাতে গিয়ে তাদের
দু’জনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। মাঝে
তুষারের নিঃশ্বাস একটু পাতলা হয়ে এলে আবারও ক্লোরোফর্ম ভেজা রুমালটা তুষারের নাকে
ঠেসে ধরে। ঘুম গাঢ় হয়ে নাক ডাকা শুরু করলে সে বাকী কাজটা সমাধা করে। রশিটা গলার ওপরে চেপে বসলে শরীরের
সব ভর সেখানে জড়ো হয়, তুষার তখন অবচেতন ভাবে হাত পা ছোড়ার চেস্টা করে। একসময় শরীরটা নিথর হয়ে ঝুলতে থাকে বৈদ্যুতিক তারে বাদুড় ঝোলার মত
করে। মাথাটা এক পাশে হেলে থাকে। জিহবাটা মুখ থেকে সামনে বেড়িয়ে আসে। বা পাশের
নাকের ফুটো বেয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা বের হতে গিয়ে হঠাৎ থমকে যায় যেন। হাত পা ছোড়ার
সময়ই হয়ত তুষারের লুঙ্গির বাঁধনটা আলগা হয়ে থাকবে,শরীর থেকে খসে পরে সেটা। কিছুটা
মল মূত্র ছড়িয়ে পরে মেঝেতে। তার পুরুষাঙ্গের মাথায় হাল্কা বীর্য লেপ্টে থাকে। অঞ্জলি
তাড়াতাড়ি লুঙ্গিটা সেভাবেই কোমরে পেঁচিয়ে মেঝে পরিস্কার করতে শুরু করে। কিন্তু কাজ শেষ করতে
না করতেই দরজার কলিং বেলটা বেজে ওঠে। কায়েস দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় তুষারের ব্যবহার
করা কাপড়ের আলমারিটার ভিতরে। ভুলে ক্লোরোফর্মের শিশিটা বিছানায় ফেলে যায় কায়েস।
অঞ্জলি সেটা কুড়িয়ে কাপড়ের আলমারির ভিতরে চালান করে দিয়ে কে এসেছে তা দেখতে যায়।
অঞ্জলির শাশুড়ি এসেছেন নাতীকে একটু দেখতে
আর বাটীতে করে ছেলের পছন্দের তরকারী এনেছেন। অঞ্জলি দরজার পাল্লটা খুলে ভিতরে ঢোকার পথটা আগলে দাঁড়ায়।
তাকে ডিঙ্গিয়ে ভিতরে ঢোকা সম্ভব হয় না তাই তার শাশুড়ি দরজার গোড়াতে দাঁড়িয়েই
কথাবার্তা বলতে থাকেন। ভয়,উত্তেজনা আর অজানা আশঙ্কায় অঞ্জলির হাত-পা কাঁপছিল,তারপরও যথাসম্ভব হাত বাড়িয়ে তরকারীর
বাটীটা নেয় এবং বাবা-ছেলে দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে জানিয়ে দরজাটা একরকম জোর করেই লাগিয়ে
দেয়। তরকারীর বাটীটা রান্নাঘরে রেখে সে বেডরুমে এসে ঢোকে।
কায়েস বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছে। বাচ্চাটা বিছানায়
অঘোরে ঘুমাচ্ছে হাত-পা ছাড়িয়ে। বাবার মত করে ঘুমানোর অভ্যাস পেয়েছে ছেলেটা। বুকটা কেন
যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। তার হঠাৎই বুকটা খালি খালি লাগে আর বমি বমি ভাব জেগে ওঠে। দ্রুত
বাথরুমে যেয়ে চোখে মুখে পানি দেয় অঞ্জলি।
তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে বেডরুমে এসে দেখে কায়েস নেই। কখন যেন তাকে কিছু না বলে চুপিসারে বেরিয়ে
গেছে। মাথাটা ঘুড়ে ওঠে তার। সে টেবিলের কোনাটা ধরে শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখে কিছুক্ষণ। অঞ্জলি মুহুর্তে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। ভেবে পায়না কায়েস তাকে কিছু না বলে এভাবে চলে গেল
কেন। এরকম তো কথা ছিলনা। সরীসৃপের
মত ভয়ের একটা শিরশিরে অনুভূতি মেরুদন্ড ধরে বয়ে
যায়। একই
সঙ্গে উৎকণ্ঠা আর অবসাদ এসে ভিড় করে তার মাঝে। সে মেঝেতে হাত পা ছাড়িয়ে বসে পড়ে। ছেলেটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে
বিছানায় আর স্বামী শরীরটা ঝুলছে
তখনো সিলিঙে, শুকনা কলাপাতার মত। ভালইত
ছিল সে স্বামী আর বাচ্চা নিয়ে। কেন যে পা বাড়াল এ পথে! এটা কিসের পরিণতি? কি
অপেক্ষা করছে তার জন্য? বছরের পর বছর ধরে জেল নাকি ফাঁসির দড়ি! তাকে কি ঠিক এভাবেই
ঝুলিয়ে মারা হবে! পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে তার। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ায় সে। রান্না
ঘর থেকে তরকারি কাটার বঁটিটা এনে অনেক কসরত করে দড়ির বাঁধন কেটে তুষারের মৃত দেহটা
নামিয়ে আনে। এরপর তুষারের চোখেমুখে পানি দিলে সে চোখ মেলে তাকায় কিনা তা বোঝার
চেষ্টা করে। নাকের কাছে হাতের আঙ্গুল ধরে পরখ করে দেখে সামান্যতমও শ্বাস নেয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়
কিনা। কিন্তু না, থেমে গেছে সব। তার স্বামী এখন জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে
ওঠে সে। তার আসলে তখন চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে কি করবে ভেবে পায়না।
এক রাশ আত্মগ্লানি এসে ভর করে তার মাঝে।
বেশ
কিছুটা সময় ওভাবে বসে থাকার পর সে উঠে দাঁড়ায়। মোবাইলে কায়েসকে চেস্টা করে কয়েক
বার। কিন্তু না,মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর বিছানার কাছে যেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে
চুপচাপ শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ, আদর করে চুমু দেয় কপালে। তারপর কোন কিছু না ভেবেই অনেকটা
হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত দৌড়ে বেডরুম থেকে বের হয়ে বারান্দা থেকে নীচে লাফ দেয়
কিন্তু এমনি কপাল তার! সে চাইলেও মরতে পারেনা! ডিশের তারে জড়িয়ে সে বেঁচে যায়!
শুধু হাত-পা ভাঙ্গে তার। আর এখন সে এখানে ইন্টেরোগেশন রুমে। এক নাগারে কথাগুলো বলে
খানিকটা দম নেয় অঞ্জলি। করণিক একটানা লিখে যায় লোমহর্ষক সে বিবরণী। অঞ্জলি এক
গ্লাস পানি খেতে চায়। পানির গ্লাসটা তার
সামনে ঠেলে দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে চান কায়েসের আসলে কি হয়ে ছিল। সে কিছু না বলে চুপিসারে পালিয়ে গেল কেন? অঞ্জলি এর উত্তর
জানেনা বলে জানায়। তার চোখ গড়িয়ে পড়ে অবিরত জলের ধারা। সে জানেনা তার পরিণতি কি?
কি অপেক্ষা করছে তার জন্য? কেন যেন ছেলেটার মুখ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎই
চীৎকার করে কেঁদে ওঠে সে। কান্নার
সঙ্গে কেঁপে ওঠে তার সারা শরীর।
তদন্ত কর্মকর্তা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। জবানবন্দীতে তার স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। দরজাটা চাপানো। মাথার উপরে আধা ভৌতিক বাল্বটা জ্বলছে মিট মিট করে। তার আলো মেঝে অবধি পৌঁছাতে চেয়েও পারেনা। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে মাঝ পথে আটকে থাকে যেন। চারপাশে তার আধো আঁধার, আধো নির্জনতা। নিঃসীম আঁধারের মাঝে ডুবে ক্রমাগত ফুঁপিয়ে কেঁদে চলে সে। তার জন্য থাকে শুধু অন্ধকার। নিকষ কাল অন্ধকার।
পোস্ট ভিউঃ 2