একালের রূপকথা

গল্প ঝরা পাতার গান
একালের রূপকথা

      ফুলমতির বয়স কত তা কেউ বলতে পারেনা। কেউ বলে ত্রিশ,কেউ বলে পয়ত্রিশএমনকি সে নিজেও তা জানেনা। তবে শুধু এটুকু মনে আছে যে তার জন্মের বছরে দেশে বেশ বন্যা হয়েছিল টানা সপ্তাহ জুড়ে একঘেয়ে বৃষ্টি হয়েছিল। সেই বৃষ্টি মুখর এক রাতে তার জন্ম হয়েছিল বলে তার নানী বলেছিলেন ফুলমতির বয়স যখন সাত তখন  তাদের বাড়ীতে একবার আগুন লাগে, তার মা দু’সন্তানসহ সে আগুনে পুড়ে মারা যায়কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকে যে নেশার টাকা হাতে না পেয়ে তার বাবাই রাগের বশে রাতের আঁধারে বাড়ীতে আগুন লাগিয়েছিল তারা অবশ্য ভুল বলে না। ফুলমতির বাবা আছিরুদ্দির চোখের সামনে অনটনের সংসারটা ছাইয়ে পরিণত হয়। সে ছাইয়ের ছোঁয়ায় কিংবা আগুনের আঁচে তার তাড়ির নেশাটা এক সময় ছুটে গেলে সেও পালিয়ে কোথায় যেন চলে যায় সে আর ফেরেনাঘরে না ফেরা পাখীদের মত  

       সে রাতে নানীর সঙ্গে না ঘুমালে ফুলমতি নিজেও হয়ত ছাইয়ে পরিণত হত। মা ওকে জন্মের পর থেকেই দু’চোখে দেখতে পারত না, তাই বাবার বাড়ীতে তার কখনও স্থান হয়নিওর মা আসলে ওকে জন্মের সময়ই গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর বাবা সেটা হতে দেয়নি। সেটা অবশ্য পিতৃস্নেহ বা ভালবাসার টানে নয়। বরং মেয়ে বড় হলে তাকে দিয়ে ভাল ব্যবসা হবে সেজন্য! ভিক্ষা বৃত্তির ব্যবসা সৃষ্টিছাড়া সে দিনগুলোতে আছিরুদ্দি তাড়ি খেয়ে দু’চোখে ভাঁটার আগুন নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াত কিংবা গুটিসুটি মেরে পরে থাকত লাউয়ের মাচার নীচে। সে  নেশায় ডুব দেয়া ছাড়া অন্য কোন কাজ করত না। একটা ব্যাঙের মত প্রাণীর আকৃতি নিয়ে ফুলমতি যখন জন্মায় তখন মা তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সে চোখে ভালবাসা ছিল নাছিল প্রচন্ড ঘৃণা। দু’হাতে পিষে ফেলতে চেয়েছিল তাকে। সে ভেবে পায়নি কি করে এই মাংসপিণ্ডটাকে পেটে ধরেছিল! কিভাবে তার জরায়ুতে দিনে দিনে বেড়ে উঠেছিল এই কিম্ভূতকিমাকার প্রাণীটা! মায়ের অবহেলায় তাই নানীর কাছেই বড় হতে থাকে সে নানীই  কেন যেন পরম মমতায় তাকে কাছে টেনে নেয়। অবশ্য রাজকন্যা কঙ্কাবতী আর রাজপুত্র ডালিম কুমারের গল্প শোনাতে শোনাতে সেই নানীও একদিন পটল তুললেন

       সংসারে আপনজন সবাইকে হারিয়ে ফুলমতি একসময়  রাস্তায় নেমে পড়ে। ততদিনে বয়সের ভারে তার বুকটা ভারী হলেও শরীরটা বাড়েনি মোটেওসেটা দেড় কিংবা দুই ফুট ছুঁই ছুঁই হবে হয়তবা কারণ তার উচ্চতা কখনও কেউ মেপে দেখেনি! তাছাড়া তার নিজেরও ইচ্ছে হয়নি দুঃখের পরিধি বাড়াতে! কোমরের নীচে পা দু’টো বাড়তে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়েছে যেন। আর তাই হাত দু’টোও বোধ হয় বেড়ে ওঠার খেই হারিয়ে ফেলে এই হাতজোড়া আর অপুষ্ট পাগুলো মানুষের মনে করুণার উদ্রেক করা ছাড়া আসলে ফুলমতির কোন কাজেই আসেনাআর তাই সেটাকে পুঁজি করেই রাস্তায় নামে সে। উপার্জন মন্দ হয়না। খাওয়ার খরচ বাদ দিলে দিনে শ’ দুয়েক জমা হয়, যেটা মাস শেষে গিয়ে দাড়ায় পাঁচ কিংবা ছয় হাজারে। অবশ্য দুই ঈদে এবং রোযায় উপার্জনটা আরও বেশী হয়ে থাকে! সে থাকে গঙ্গাচড়ায় মহিপুর বাজারে, তার পাতানো বোন জামাই ফারুক মিয়ার সংসারে। ভিক্ষার উপার্জনের একটা বড় অংশ অবশ্য সেখানেই চলে যায়। বিনিময়ে জোটে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, মাথার উপরে ছাদ আর বেঁচে থাকার জন্য মোটামুটি নিরাপত্তা। অসুখ বিসুখে তারাই ভরসা। তারাই তাকে যৎসামান্য সেবা যত্ন করে থাকে। এতকিছুর পর টাকা যেটুকু বাঁচে তা’ জমিয়ে রাখে ঘরের খুটির গর্তে কিংবা মাটির নীচে হাড়িতে। ফুলমতি স্বপ্ন দেখে একদিন তার অনেক টাকা হবে! চিকিৎসায় সাড়িয়ে তুলবে নিজেকেতারপর বিয়ে করবে। সংসার ছেলেপুলে হবেএই স্বপ্নই রো রো ফেরীর মত আজীবন টেনে নিয়ে যায় তাকে           

       তার স্বপ্নটাও শরীরের সঙ্গে বেড়ে ওঠে লতায় পাতায় লাউ ডগার বেড়ে ওঠার মত বয়সের ভারে তারা উভয়ই যদিও এখন প্রায় ন্যুজ্জ তবুও ফুলমতি স্বপ্ন দেখে যায়স্বপ্নের পাখীরা প্রতি রাতেই হানা দেয় তার ঘুমে। আর হানা দেয় তার বোন জামাই। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে ফুলমতির ঘরের দরজায় টোকা দেয় ফুলমতি তখন খেঁকিয়ে চিৎকার করে ওঠে খাটাশটা তার এ পঙ্গু শরীরে কি খুঁজে পায় তা’ সেই ভাল জানে। অবশ্য খাটাশটা তার জমিয়ে রাখা টাকা নাকি তার শরীরের টানে কাছে আসতে চায় তা’ জানা নেই ফুলমতিরআজকাল তার সম্পর্কটা বরং সুন্দর ভাবে জমে উঠেছে কালুমাঝির সঙ্গে।

       কালুমাঝি তার কৈশোরবেলা থেকে যৌবন ভরা তিস্তায় দাপিয়ে এখন প্যাডেল মারে রংপুর শহরের পথেঘাটে।  তার বয়সের এ পরন্ত বেলায় জোটেনি ছেলেদের সংসারে দু’মুঠো ভাত। বউটাও মরে গেছে কবে কার্তিকের মঙ্গা পেটে নিয়ে। তাই নিজেরটা এখন তাকে নিজেকেই দেখতে হয়। সে থাকে গঙ্গাচড়া বাজার ছাড়িয়ে আরও দূরের গ্রামটাতে। তিস্তা নদী সেখানে তার আগের সেই জৌলুশ হারিয়ে এখন হাঁটুজলে কালুমাঝির গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে যায়। সে আগে নৌকা বাইতো ভরা গাঙ্গে, আর এখন রিক্সা বায় শহরের অলিতে গলিতে। তবে মাঝি পদবীটা এখনও আঁঠালীর মত লেপ্‌টে আছে তার নামের সঙ্গেপ্রতিদিন ফজরের নামাজের পরে সে রিক্সা নিয়ে পথে নামে। মহিপুর বাজারে এসে ফুলমতিকে তুলে নেয় তার রিক্সায় পাকার মাথায় এসে রমিজের দোকান থেকে চা খায়। এরপর রিক্সায় পথ পাড়ি দিতে দিতে দু’জন রাজ্যের গল্পে মেতে ওঠেতাদের সে গল্প হোঁচট খায় ট্রাকের হর্ন, রাস্তার গর্ত কিংবা কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে। সকাল বেলাটা ফুলমতি এখানেই কাটায়। এসি গাড়িগুলো সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সে সময়টাতে তার আয় রোজগার ভাল হয়। বাস স্ট্যান্ডের দু’পাশেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে টিকেটের কাউন্টারগুলোসেখানেই এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে ঘোরাফেরা করে সে, থাকে দশটা অবধি। এরপর কালুমাঝি এসে তাকে নিয়ে যায় সুপার মার্কেটের সামনে। দু’টা আড়াইটার দিকে আরেকবার এসে তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বিকেলের এসি গাড়ীগুলো ধরার জন্য নামিয়ে দেয়।

      একধরনের বাজারের ফর্দের মত রুটিনে বাঁধা তার জীবন। গ্রীষ্ম,বর্ষা কিংবা শীতে তার হের ফের হয়না। অবশ্য হরতাল বা বন্যা হলে সে ভিন্ন কথা। বাসস্ট্যান্ডে সবাই তাকে চেনে। বাসের হেল্পার-ড্রাইভারগুলো তাকে মাসী বলে ডাকেকখনও কখনও কেউ পান-বিড়ি কিনে দেয়তার অবশ্য বিড়ি বা পানে তেমন নেশা নেই। তার নেশা বা সুখ বলতে একটাই,আর সেটা হল তামাকের গুড়া বা গুল। প্লাস্টিকের ছোট কৌটায় ভর্তি গুল সে পাঁচ টাকা দিয়ে কেনে। এক একটা কৌটায় তার তিন-চার দিন চলে যায়। খাওয়া-পরার বাইরে নিজের জন্য খরচ বলতে গেলে শুধু এই একটাই। ভিক্ষা, গুল আর গল্পেই দিন কেটে যায় তার। মাঝে মাঝে তার সাদা-কাল জীবনটাতে এসে ঝামেলা বাঁধায় ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাটা বুড়া ফকীরটা এক পা খোঁড়া তার। ফুলমতির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চুল-দাড়ি পাকিয়ে বলতে   গেলে এক পা কবরে দিয়ে বসে আছেহয়ত তার খোঁড়া পা টাই কবরে রাখা তাই সহজে মরছে না বুড়া! অন্যান্য যারা এ পেশায় আছে তারা সে আশে পাশে থাকলে তেমন একটা হালে পানি পায়নাযদিও ভিক্ষার প্রতিযোগিতায় নামতে তার কষ্ট হয়, তারপরও সবাই হাত বাড়ালেও সহানুভূতিটা সব সময় সেই আদায় করে নেয়। তার পা দুটো  আসলে শরীরের একটা অংশ হিসেবে মালগাড়ীর মত নিতম্বের সঙ্গে লেগে আছেতাকে চলাফেরা করতে হয় মূলত নিতম্ব আর অপরিণত হাত দু’টোতে ভর দিয়েএটাকে হাটা না বলে বরং মার্বেলের মত গড়িয়ে চলা বলা যায়! অবশ্য কাজের সুবিধার্থে সে হাত দু’টোতে একজোড়া স্যান্ডেল পরিয়ে নেয়। সাধারণত মানুষের লাগে এক জোড়া স্যান্ডেল কিন্তু সেত অসাধারণ,তাই তার দু’জোড়া স্যান্ডেল লাগে।

      বাসস্ট্যান্ডে তার প্রিয় মানুষ হল আমেনার মা। আমেনার মা স্বামী পরিত্যাক্তা হয়েছে তার মধ্য যৌবনে বয়সের এবেলায় এসে নানান রকমের অসুখ এসে তার শরীরে কবুতরের মত বাসা বেঁধেছে, তাই সে বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে পারেনা। আট-দশ মাস বয়সের আমেনাকে কোলে নিয়ে সে ভিক্ষা করে। কে যে আমেনার বাবা তা কেউ জানেনা। হয়ত আমেনার মাও বলতে পারবে না। লোকে আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। অবশ্য লোকের এই রঙ্গতামাশায় আমেনার মা গা করেনা। নির্জন খাঁ খাঁ দুপুরে যখন যাত্রীদের আনাগোনা তেমন থাকেনা তখন ফুলমতি আর আমেনার মা সজনা গাছের ছায়ায় বসে দুঃখ সুখের গল্প করে। আমেনাকে পাশেই মাটিতে বসিয়ে আমেনার মা ফুলমতির মাথার উকুন বেছে দেয়। ফুলমতি এজন্যই হয়ত একটা প্লাস্টিকের সবুজ চিরুনি তার প্রায় জট বাঁধা চুলে সব সময়ই গেঁথে রাখে। অবসর মুহূর্তগুলোতে তারা হাসি তামাশা করে, চা খায় আর শব্দ করে পানের পিক্‌ ফেলে। ফুলমতি গল্পের ফাঁকে তার নীচের মাড়িতে গুল ভরে নেয়। তারা হঠাৎ হঠাৎই হাত পা ছাড়িয়ে অলস দুপুরের আলসেমিতে মেতে ওঠে।      

      নতুন সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করা হয়েছেশহর জুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। মডার্নের মোড় থেকে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত রাস্তাটা চার লেনের হবে, দু’পাশের মাটির স্তূপ তাই দুই লেনের রাস্তাটাকে বেশ সংকীর্ণ করে দিয়েছে। এরই ভিতর দিয়ে ছুটে চলছে কালুমাঝির মত অন্যান্য রিক্সাওয়ালাদের স্লথ গতির রিক্সা আর দূর পাল্লার বেপরোয়া বাসগুলো। ইদানিং আবার তাদের উপার্জনে ভাগ বসাতে ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সাগুলো রাস্তায় নেমেছে। অবশ্য ফুলমতি তার বাঁধা প্যাসেঞ্জার। মাস শেষে টাকা দেয়। সেদিনও ভোরে কালুমাঝি ফজরের নামাজ পড়ে রিক্সা বের করে। বাজারের কাছে এসে সে ফুলমতিকে খোঁজে। এদিকে সেদিকে তাকায় কিন্তু তাকে খুঁজে পায়না। এরপর বাড়ীতে  গিয়ে সে হাঁক দেয়। ফুলমতি তখন ভোরের ঘুমের আমেজে অচেতন! ঠোঁটের কোণ গড়িয়ে লালা পড়ছে আর স্বপ্ন দেখছে সে অর্ধস্ফুট চোখেশৈশবে নানীর কাছে দাওয়ায় বসে শোনা ডালিম কুমার আর রাজকন্যার গল্পটা প্রায়ই স্বপ্নে তার কাছে দুখ তাড়ানিয়া মাছির মত ফিরে ফিরে আসেমাঝে মাঝে অবশ্য কোন কারণে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে স্বপ্ন দেখার অনুভূতিটা অন্য রকমের অনুরণন তোলে তার মাঝে নেশাগ্রস্থের মত তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বাস্তবে যদি কখনও এরকম হত! সে যদি রাজকন্যা কঙ্কাবতী রূপে কোনও অর্বাচীন রাক্ষসের গুহায় বন্দিনী থাকত আর রাজপুত্র ডালিম কুমার আসত তাকে উদ্ধার করতে! কালুমাঝি আরেকবার হাঁক দেয়। ঘুম ভেঙ্গে যায় ফুলমতির সে শাড়ীর আঁচলে লালা মুছে এক হাতে চোখের ময়লা ডলতে ডলতে ঘরের দরজা ঠেলে বাইরে আসে। ফুলমতি ভেবেছিল  খাটাশটা আবারও বিরক্ত করতে এসেছে। গতকাল প্রায় সারা রাত ধরে একটু পরপর সে দরজায় টোকা দিয়েছিলঠিকমত ঘুমাতে দেয়নি তাকে একবার ভেবেছিল দরজাটা খুলে দেখবে শয়তানটা কি চায়! কিন্তু মনটা তাতে সায় দেয়নি শরীরের পবিত্রতা সে ধরে রাখে। এত ভোরে কালু মাঝিকে ঘরের সামনে দেখে সে একটু অবাক হয়। আজ সে হয়ত সময়ের একটু আগেই এসে পড়েছে। অবশ্য এর আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে! সে হয়ত ঘুম থেকে উঠতে পারেনি, কিন্তু কালুমাঝি এসে ঠিকই ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাকেসেটা তার প্রতি কালুমাঝির  মমত্ববোধের কারণেই হোক অথবা রিক্সা ভাড়ার কারণেই হোক, ডেকে নিয়েতো গেছে! এজন্য ফুলমতির মনটা  তার জন্য একরকমের কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। আসলে একদিন ভিক্ষা না করলে ক্ষতিটাতো তারই

      ফুলমতি কালুমাঝিকে জানায় যে আজ হরতাল। বাস চলাচল বন্ধ, বাসস্ট্যান্ডে ভিক্ষা করতে যেয়ে কোন লাভ হবেনা কালুমাঝি তাকে সুপার মার্কেটের সামনে বসিয়ে দিবে বলে জানায়। ইচ্ছে না থাকলেও লোকটা কষ্ট করে অনেকদূর থেকে তাকে নিতে এসেছে, তাই ঝটপট চোখে-মুখে পানি দিয়ে সে ঘরের দরজায় তালা মারে।  

       পাকার মাথায় এসে যথারীতি দু’কাপ চা খায় দু’জন। এরপরে আবারো রিক্সায় প্যাডেল মারে কালুমাঝি। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে তার শ্লথগতির বাহনদূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তমাঝে মাঝেই ভেজা বাতাস এসে উড়িয়ে নেয় তার কাঁধে রাখা গামছাটারাস্তার দু’পাশে ধানের সবুজ চারাগাছ দমকা বাতাসের তোড়ে হালকা ভাবে ঢেউ  খেলে যায়। দোল খায় রাস্তার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা দোলনচাঁপার ঝাড়দূরের কোমল বাতাসে ভর দিয়ে ভেজা কদমের ঘ্রাণ এসে লাগে চোখে মুখে নাকে। কেমন সুন্দর ঝিরঝিরে একটা অনুভূতি হয় ফুলমতির! ভোরের স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলো আবারো মনেপরে আবারও আচ্ছন্ন হয় সে। যেন ফুলমতি হল স্বপ্নে দেখা সেই রাজকন্যা কঙ্কাবতী আর কালুমাঝি হল রাজপুত্র ডালিম কুমার! রিক্সাটা যেন আজ পঙ্খিরাজ ঘোড়া, আর সেটায় করে তার বোন জামাই রাক্ষসটার কাছ থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে ডালিম কুমার অর্থাৎ কালুমাঝিহঠাৎ খিক খিক করে হেসে  ওঠে ফুলমতি। কালুমাঝি অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ফুলমতি বিব্রত বোধ করে। হয়ত সেটা কাটানোর জন্যই  সে কালুমাঝিকে ধমক দেয় এবং সামনে তাকিয়ে সাবধানে রিক্সা চালাতে বলে। ফুলমতির আচমকা ধমক খেয়ে কালুমাঝি আরও বেশী অবাক হয় এবং জোরে জোরে প্যাডেল ঘোরাতে থাকে। রিক্সা চলতে শুরু করে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত,তারা বাসস্ট্যান্ডের দিকে প্রায় উড়ে যায়।

      হাজীপাড়া হয়ে মেডিক্যালের মোড় পার হতে না হতেই চারদিক ছেয়ে যায় কাল মেঘেহঠাৎ সন্ধ্যার নির্জনতা  নেমে আসে চারিপাশে। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। কালুমাঝি ভিজে সপ্‌ সপ্‌ হয়ে যায়চেকপোস্ট পার হয়ে ক্লিনিকের সামনে এসে রিক্সাটা রাস্তার পাশে দাড় করায়। এরপর সে ফুলমতিকে ধরে সীটের ওপরে বসিয়ে পলিথিনে ঢেকে দেয় কালু মাঝির এই উষ্ণ মমতাপূর্ণ ব্যবহার ফুলমতির মাঝে এক ধরনের ভাল লাগা অনুভূতির সৃষ্টি করে। সে অনুভূতিতে সিক্ত হয় তার দু’চোখের পাতা। সে চোখের দিকে তাকিয়ে কালু মাঝিও যেন বিপন্ন বোধ করে। সে বৃদ্ধ মানুষ, তাই বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনা। জীবন যুদ্ধে পরাজিত হতে হতে তার হৃদয়ের সব অনুভূতিই যেন আজ এক রকম লোপ পেয়ে গেছে! দৃষ্টি নামিয়ে নিতে না নিতেই বিপরীত দিক থেকে আসা এক অর্বাচীন ট্রাকের ধাক্কায় কালু মাঝির শীর্ণ পেটানো শরীরটা পাক্‌ খেতে খেতে গড়িয়ে যায় সাইকেলের গ্যারেজটার দিকে। আচমকা ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া ফুলমতি বোধহয় দম্‌ ফেলারও ফুরসৎ পায়নি। তার আগেই ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয় তার দেড় কিংবা দু’ ফুট উচ্চতায় বয়ে বেড়ান মুখমণ্ডলজন্মের পরপরই এক বর্ষায় তার মা যে শরীরটা পিষে ফেলতে  চেয়েছিল,এতটা বছর পরে আরেক বর্ষায় তার মায়ের সে ইচ্ছেটা পূর্ণ করে দিল মালপত্র বোঝাই এক দানব ট্রাকছয়টা থেকে হরতাল শুরু হবে। তার আগেই তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে রিক্সাটা ছিটকে পড়ে রাস্তার পাশে মাটির উঁচু স্তূপে। সামনের চাকাটা তখনো ঘুরছে বন্‌ বন্‌ করে। পীচঢালা কাল রাজপথের ওপরে ফুলমতির রক্ত জমাট বাঁধার সুযোগ পায়না। বৃষ্টির ফোঁটার তোড়ে ভেসে যায় রাস্তার পাশে। জমা হয় তোতার দোকানের পাশে সদ্য খোঁড়া গর্তটাতে। সেখানে কন্সট্রাকশন কোম্পানির ঢালাই করা পিলার। পিলার বেয়ে উড়ে যায় ফুলমতির পঙ্গু আত্মাটা।

      উপরে, মেঘের আরও অনেক উপরে আরেকটা আকাশ! সেখানে কালুমাঝি কিংবা রাজপুত্র ডালিম কুমার অপেক্ষা করছে তার জন্য! ফুলমতি অর্থাৎ রাজকন্যা কঙ্কাবতী উড়ে যায় সেখানে। পিছনে পরে থাকে তার চেনা পৃথিবী,পরিচিত বৃত্ত,কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ড-সুপার মার্কেট–পাকার মাথা-রমিজের চায়ের দোকান–বাজারের পাশে তার জীর্ণ কুটির! দরজায় তালা ঝুলছে তখনও ছেড়ে আসা সাপের খোলসের মত পিছনে পড়ে থাকে সব কিছু! আরও পড়ে থাকে তার পাতানো বোন জামাই। ফারুক মিয়া। খাটাশটা!



পোস্ট ভিউঃ 7

আপনার মন্তব্য লিখুন