সীটে বসতে না বসতেই জাঞ্জিবার এয়ারপোর্ট
থেকে রুপালী ডানার প্লেনটা টেক অফের প্রস্তুতি নেয়। ল্যাপটপ আর ক্যারি অন লাগেজ ওভারহেড
বীনে রেখে কোমরের সীট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতেই ঋদ্ধ জানালার বাইরে তাকায়। নীল
জলরাশি আগলে রাখা বাদামী সৈকত ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। গত ক’দিনের টানা জার্নি শেষে সহসাই কেমন যেন এক ধরনের আলস্য
এসে ভর করে তার মাঝে। শরীরের মাংস পেশীগুলো যেন শিথিল হয়ে যায়। প্লেন রানওয়ে ছেড়ে
মুহূর্তে আকাশে উড়াল দেয় আর উইংসের নীচের চাকাগুলো গুটিয়ে ঢুকে যায় প্লেনের ক্ষুধার্ত
পেটের ভিতর। ভারত মহাসাগরের সৌম্য জল রাশি ভেদ করে বেরোনো নীচের ছোট
দ্বীপ রাষ্ট্রটা আরও ছোট হতে হতে একসময় বিন্দুর মত মিলিয়ে যায়। অবয়ব হারিয়ে সেটা ঢাকা পড়ে যায় মেঘের অসীম রাজ্যে।
স্নিগ্ধ সবুজের জায়গায় এখন শুধুই পেঁজা তুলার মত সাদা মেঘেরা ভেসে বেড়ায় চারদিক। ঋদ্ধ
জাঞ্জিবার থেকে রিটার্ন ফ্লাইটে সীটটা ইচ্ছা
করেই হাতের বাঁ পাশে নিয়েছে। কারণ অবশ্য একটা আছে! আর সেটা হল প্রিসিশন এয়ার লাইন্সের এই ফ্লাইটগুলো জাঞ্জিবার থেকে
নাইরোবি যাবার পথে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর পাশ দিয়ে একটা রাউন্ড দিয়ে
যায়। অফিসের কলিগদের মধ্যে যারা
এর আগে এই রুট ব্যবহার করেছে সে তাদের কাছ থেকে শুনেছে। সে কাছ থেকে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর বরফ জমাট চূড়াটা দেখার সুযোগ
হাত ছাড়া করতে চায়না। আসলেই দারুণ
চমৎকার সে দৃশ্য! সূর্যের আলোতে বরফ সাদা চূড়াটা জ্বল জ্বল করছে যেন সত্যি সত্যিই
একটা জ্বলন্ত আগুনের গোলা। একমনে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঋদ্ধকে এক রকম
ভাবালুতায় পেয়ে বসে। সে সীমাহীন
মেঘের রাজ্য আর ঘন নীলের মাঝে
হারিয়ে যায়। সংবিৎ ফেরে কৃষ্ণাঙ্গ
সুন্দরী এয়ার হোস্টেজের ডাকে। সে ট্রলি থেকে croissant
এর প্যাকেটটা সীটের সামনে ট্রে টেবিলে রেখে কি ড্রিংকস সার্ভ
করবে তা জানতে চায়। ঋদ্ধ আনারসের জুস আর নর্মাল পানি চেয়ে শুকনা স্ন্যাক্সে কামড়
বসায়। এয়ার হোস্টেজ জুসের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে স্মিত হেসে বলে HAKUNA
MATATA ! I love that. ঋদ্ধ তার পরনের টি
শার্টের বুকে লেখাটার দিকে তাকিয়ে তার হাসির সপ্রতিভ
উত্তর দেয়। সে ওটা আগের দিন বিকেলে স্টোন টাউনের কারুপণ্য বাজার থেকে কিনেছে। পাইলটের যান্ত্রিক ঘোষণায় প্রায় এক ঘন্টার জার্নিটা
হঠাৎই যেন শেষ হয়ে গেল।
ধূসর টারমাকের প্রান্ত ছুঁয়ে প্লেন নাইরোবি
এয়ারপোর্টের ঝকঝকে রানওয়েতেল্যান্ড করে। সে ইমিগ্রেশনের
আনুষ্ঠানিকতা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জের চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দেয়। কাঁধে ঝোলান ক্যারি অন লাগেজ
থেকে একটা বই বের করে তার ঝকঝকে পাতায় চোখ বোলাতে চেষ্টা করে। এন্টেবির কানেক্টিং ফ্লাইট
আরও চার ঘন্টা পরে। এতটা সময় কিভাবে কাটাবে সে বুঝতে পারেনা। বইও
পড়তে ইচ্ছে করেনা। ধবধবে সাদা পাতায় লেখা শব্দগুলো চোখে ক্রমশ ঝাপসা ঠেকে। বই বন্ধ
করে মলাটের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপরে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে,এগিয়ে
যায় ডিউটি ফ্রি শপগুলোর দিকে। সুন্দর পরিপাটি
করে সাজানো দোকানগুলোতে নানা রকমের
প্রসাধনী দ্রব্য থেকে শুরু করে হস্তশিল্প সামগ্রী কি নেই সেখানে! ঋদ্ধ বন্ধু-বান্ধবদের
জন্য টুকি টাকি এটা সেটা কেনে। ঘুরে বেড়ায় টার্মিনালের এ মাথা থেকে সে মাথা। এক্সিট রুটের কাছেই থাকা সেলফোনের
কিওস্ক থেকে এয়ারটাইমসহ জেইন ফোন কোম্পানির একটা সিম কিনে দেশে বাবা-মা’র সঙ্গে
কথা বলে। এরপর অপেক্ষমান অন্যান্য যাত্রীদের মত সেও চেয়ারে বসে
যাত্রীদের আনাগোনা দেখতে থাকে। নানা
দেশের নানা ভাষার নানা চেহারার নানান
বয়সী যাত্রীদের আনাগোনা সেখানে। সবাই ব্যস্ত। কেউ
টিকেট আর পাসপোর্ট উঁচিয়ে কোন
নির্দিষ্ট গেইটের দিকে ফ্লাইট ধরার জন্য ছুটে
যাচ্ছে,কেউ মানি এক্সচেঞ্জে
টাকা ভাঙ্গাতে ব্যস্ত আবার কেউবা উদ্বিগ্ন হয়ে এখান থেকে সেখানে ছুটোছুটি করছে
হারানো লাগেজের সন্ধানে। কেউ কেউ অবশ্য
তার মতই শুয়ে বসে সময় পার করছে। সম্ভবত একটা এয়ার ক্রাফট এই মাত্র ল্যান্ড করেছে। একসঙ্গে
একদঙ্গল যাত্রী কিচির মিচির করতে করতে ছুটে যাচ্ছে কনভেয়ার বেল্টের দিকে,লাগেজ সংগ্রহ
করতে। হঠাৎ মেয়েদের একটা দল এসে দখল করে পাশের খালি চেয়ারগুলো। তারা তিনজন অজানা
ভাষায় প্রায় চীৎকার করে কথা
বলছে,সঙ্গে বাঁধ ভাঙ্গা হাসির জোয়ার,একটু পরপর প্রায় গড়িয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে।
তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ তাতে। ঋদ্ধ ভাবে, পৃথিবীর সব মেয়েরা বোধ হয় একই ভাবে তাদের
আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকে, শুধু স্থান ভেদে তার প্রকাশ মাধ্যম বা ভাষার
ভিন্নতা থাকে মাত্র। এক সময় তার কেন
যেন মনেহয় তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু এখন সে নিজেই। হয়ত
তার সে ধারণাকে সত্যি
প্রমাণ করতেই পাশেরজন কাঁধ ঝুকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে.......
Hi! Are you from India?
ঋদ্ধ বিরক্তভাবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। আসলে
গত কয়েকদিন ধরে এই একই ধরনের প্রশ্ন শুনতে শুনতে তার কান একরকম ঝালাপালা। হিন্দি
মুভি আর সারা পৃথিবী জুড়ে অভিবাসী ভারতীয়দের কারণে এই অবস্থা। সে কিভাবে উত্তরটা
দিবে তা ভাবতে থাকে। প্রশ্নকারিণী একটু
অপ্রতিভ হয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে হ্যান্ডশেকের
জন্য হাত বাড়ায়
I am Nadege and you are Mr
Hriddho
Here.
Okay. Nice to meet you Hriddho. You are from which country?
ঋদ্ধ স্মিত হেসে উত্তর
দেয়। এরপর
তাকে একটু কষ্ট করে ভূগোলের ক্লাস নিতে
হয়। তিন অনুসন্ধিৎসু ছাত্রীকে ম্যাপ এঁকে বোঝাতে হয় তার দেশের অবস্থানটা ঠিক
কোথায়। সে পাল্টা জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় যে তারা মাদাগাস্কারের অধিবাসী। তিন জনই
ছাত্রী, তারা দুবাই যাচ্ছে। ঋদ্ধ অবাক হয় শ্যামা সুন্দরীদের গায়ের রং আর টানা কাল
চোখ দেখে। তার ধারণা ছিল তারা ইথিওপিয়ান। এরপর
চলতে থাকে আরও টুকটাক কথাবার্তা আর সেই সঙ্গে হালকা হাসির ছররা। হাতঘড়ির মিনিটের
কাঁটাগুলো যেন সেকেন্ডের কাঁটার মত দুরন্ত গতিতে ছুটতে থাকে। এরপর হঠাৎই যেন
ভোজবাজীর মত মিলিয়ে যায় তারা। শূন্য চেয়ারগুলো তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে
থাকে। একধরনের হাহাকার এসে ছুঁয়ে যায় তার নিউরন। বইয়ের পাতায় চোখ ফেলে সে। পড়তে
চেষ্টা করে হিজিবিজি অক্ষরগুলো।
কেমন আছ ?
প্রথমে ভাবে শ্রবণ ভ্রম
কিন্তু একটা বাচ্চার আধো বাংলায় কথা শুনে সে সামনে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। এও কি
সম্ভব! এতটা বছর পর সামনে এ কাকে দেখছে সে! Miracles
still happen!
দেবযানী জলজ্যান্ত
দেবীর মত তার সামনে দাড়িয়ে আছে। তার সিঁথির সিঁদুর ঊষার আলোর মত জ্বল জ্বল করছে। ঋদ্ধ প্রায়
তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়ে। অসময়ে তোতলামি এসে ভর করে তার মাঝে।
ভা...ভাল আছি। তুমি কেমন
আছ? এখানে কোথায়? বাচ্চাটা কে? তোমার মেয়ে নাকি!
প্রায় বুলেটের বেগে অজস্র
প্রশ্ন এক সাথে জিজ্ঞেস করে সে যেন খানিকটা হাঁপিয়ে ওঠে।
ভাল
আছি। হুম! আমার মেয়ে রুদমিলা। নাইরোবিতেই থাকি।
তাই নাকি! স্বামী কি করেন?
ওর
এখানে Moi Avenue এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।
গার্মেন্টসের ব্যবসা ওর।
কোথায়
গিয়েছিলে?
দেশে গিয়েছিলাম। পূজা
শেষে ঢাকা থেকে ফিরছি।
ঋদ্ধ ডানে বামে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। পতি
দেবতা কোথায়? তুমি একা?
ও যেতে পারেনি। আমি একাই গিয়েছিলাম। ও
সম্ভবত পার্কিং এ গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ও
আচ্ছা।
কিন্তু তুমি এখানে কেন? কোথা থেকে ফিরছ?
কোথায় আছ? কি করছো?
জাঞ্জিবার গিয়েছিলাম ছুটি কাটাতে। ইউএনডিপি’র হয়ে উগান্ডাতে কাজ করছি। থাকি কাম্পালাতে।
বিয়ে-শাদী’র কি খবর? বউ কোথায়?
তুমি ফাঁকি দেয়ার পর ও নিয়ে আর ভাবার সুযোগ
হয়নি। বিয়ে করিনি। একা বেশ ভাল আছি।
ঋদ্ধ’র কথায় খানিকটা
অভিমান ঝরে পড়ে।
মানে! বল কি! এটা কিন্তু তুমি ঠিক করনি। দেবযানীর
গলা খানিকটা কেঁপে যায়।
মেয়ে বিরক্ত করতে থাকে। ঋদ্ধ
চট্ করে পাশের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে একটা টেডি বিয়ার কিনে এনে মেয়ের হাতে দেয়। সে
ওটা হাতে নিয়ে লাফাতে থাকে। এটা সেটা কথায় অনেকটা সময় কেটে যায়। একটু
পরপর লাউড স্পিকারে কনভেয়ার বেল্টে লাগেজ পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। দেবযানী একটা
কাগজে ফোন নাম্বার আর বাসার ঠিকানাটা লিখে ঋদ্ধ’র হাতে দেয়। আবার কখনও নাইরোবি এলে
তার বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করে। এরপর সে হ্যান্ড লাগেজ ঠেলে সামনে এক্সিট রুটের দিকে এগিয়ে
যায়। কনভেয়ার বেল্ট থেকে ব্যাগ-স্যুটকেস সংগ্রহ করতে হবে তাকে।
মেয়েও লাফাতে লাফাতে অনুসরণ করে
তাকে। ঋদ্ধ তাদের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। নির্বাক
নিশ্চুপ সে। দেবযানী এস্কেলেটরে পা রেখে পিছনে ফিরে তাকায়। হাত নেড়ে
বিদায় জানায়। একসময় সে জনস্রোতে হারিয়ে যায়। তার জায়গায় এখন অন্য
মানুষ।
চোখে
মুখে রাজ্যের বিষাদ নিয়ে ঋদ্ধ ফিরে এসে আগের মত চেয়ারে বসে পড়ে। মন খারাপ
করে সে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।
তম্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে দূরের কফি
শপটার দিকে। বিভিন্ন বয়সের যাত্রীর
আনাগোনা সেখানে। শুন্য দৃষ্টিতে সে কিছু দেখে,কিছু দেখেনা,তবু ভাবলেশহীন
ভাবে তাকিয়ে থাকে মানুষের কোলাহলের দিকে। তারা কেউ হাসছে,কেউ কথা বলছে উচ্চ স্বরে
আবার কেউবা হাত নাড়িয়ে গভীর কোন আলোচনায় ব্যস্ত। তার
ভাবালুতা ভাঙ্গে আগের সেই কণ্ঠে
Hey! Wassup!
সে ঘাড় ফিরে তাকায়। পাশের
আসন আবারও দখল করে বসে আছে সেই কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী। সে মুখে মিটি মিটি হাসি আর
দু’চোখে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে।
Yah….I’m
okay.
I saw everything….ex girlfriend….right!!!
ঋদ্ধ অবাক হয়ে পাল্টা
প্রশ্ন করে।
How could you guess that?
It’s so simple. I was standing there,
right behind the kiosk…..staring at you two…
Ohh! No
Yuhh…Both
of you seemed upset and emotional…so there was nothing much to dig out…
কথাটা বলেই সে এক গাল দুষ্টুমি ভরা হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। তার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে Matata…..Matata এরপর হঠাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে Sorry if I have crossed my limits.
ঋদ্ধ জানে সোয়াহিলি
ভাষায় Matata মানে হল সমস্যা। সে দু’হাত
সামনে বাড়িয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ায়।
Don’t feel sorry, it’s okay.
কথাটা বলে পাল্টা হাসি
ছুড়ে দেয় তার দিকে। Nadege এর উষ্ণ আর আন্তরিক ব্যবহারে
গুমোট পরিবেশটা হাল্কা হতে সময় লাগেনা। এরপর সেলফোন নাম্বার,
ঠিকানা ইত্যাদি নিতে না নিতেই লাউড স্পীকারে ঋদ্ধ’র ফ্লাইটের ঘোষণা আসে। ফ্লাইট
KQ 518 টারমাকে অপেক্ষা করছে যাত্রীদের
নেয়ার জন্য।
May I give you a Hug!
ঋদ্ধ পূর্ণ দৃষ্টি মেলে
Nadege এর দিকে তাকায়। সেখানে সম্মতির
চিহ্ন ফুটে ওঠে।
Stay cool. Take care.
বিদায় পালা শেষে ক্যারি অন লাগেজটা টেনে নিয়ে ছুটে চলে সে রিপোর্টিং ডেস্কের দিকে। তাকে যেতে হবে অনেক দূর। দ্রুত পায়ে সে ছুটে যায় তার গন্তব্যের দিকে। কানের কাছে তখনও অনুরণন তুলছে Nadege এর সেই দুষ্টুমি ভরা কথাগুলো... Matata……Matata.
পোস্ট ভিউঃ 4