অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
গল্প
ঝরা পাতার গান
১
চৈত্রের দুপুরগুলো যেন কাটতেই চায়না। ঘড়ির কাঁটা দুপুরের
এই নির্জন খাঁ খাঁ মুহূর্তগুলোতে কেমন যেন শ্লথ হয়ে যায়। গ্যাসের চুলায় অল্প আঁচে
ডাল বসিয়ে পাশের এক চিলতে বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় পৌলমি। তার দৃষ্টি চলে যায় দূরের আবছায়া
সবুজ তৃণভূমির দিকে। বিচ্ছিন্ন ভাবে সেখানে কিছু মহিষ–গরু চড়ে বেড়াচ্ছে।
কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলোতে যেন আগুন লেগেছে। চোখে কেমন ধাঁধা লেগে যায়। পীচ ঢালা কাল রাজপথ
যেন বিষবাষ্প উগড়ে দিচ্ছে। সেখানে কেবল মরীচিকার হাতছানি। কেমন যেন উদাস হয়ে যায়
তার বলাকা মনটা। উত্তরার এদিকটায় এখনও বাড়িঘর তেমন গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন দালানকোঠার
ফাঁকে তাই বেশ খোলা জায়গা, খেলার মাঠ ইত্যাদি চোখে পড়ে। তবে নগরের ব্যাপ্তি যেভাবে বাড়ছে তাতে এইসব খোলা জায়গা ভরে উঠতে বেশী
সময় নিবেনা। পৌলমি অবশ্য জমিটা কেনার পরপরই বাড়ীর নির্মাণ কাজে হাত দেয় এবং মোটামুটি একাই বিল্ডার দিয়ে
সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপরে চার বিল্ডিংটা দাঁড় করিয়ে ফেলে। তিনটা ফ্লোর ভাড়া দিয়ে নিজেরা
দোতলায় থাকে। হুদা সাহেব অর্থাৎ পৌলমি’র স্বামী ইউএনডিপি’তে
কাজের সূত্রে রুয়ান্ডায় থাকেন। সেখান থেকে বছরে এক আধ বার দেশে আসা হয় কিন্তু তিনি
যে ছুটি নিয়ে আসেন তা’ প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই অল্প যে বাড়ি বানানোর সময় সব ধরনের
ঝামেলা পৌলমিকে একাই সারতে হয়। মাঝে মাঝে অবশ্য তার ভাসুর মতলব সাহেব এসে কাজের
তদারকি করে গেছেন। আবার পৌলমি নিজেও সমস্যায় পড়লে তার কাছে দৌড়ে গেছে। মতলব সাহেব
বনানীতে থাকেন।
পৌলমি বারান্দার গ্রিল ধরে বেড়ে ওঠা ‘ব্লিডিং হার্টের’
লাল কুঁড়িগুলোর দিকে আনমনে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ রাস্তার
ওধারে শিরিষ গাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো তিন তলা বাড়ীর লোহার গেটের ঘরঘর শব্দে সে দরজার একপাশে
সড়ে দাঁড়ায়। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সে জানে রোজ এই সময়টায় ওই
বাসাটা থেকে ঝাঁকড়া চুলের এক যুবক বেরিয়ে কোথায় যেন যায় আর ফেরে সেই বিকেলের শেষ
আলো গায়ে মেখে। পৌলমি জানেনা নাম না জানা যুবক কি করে, কোথায় যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য তার
জানতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু তা’ ঐ পর্যন্তই। কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি সে কথা। সে শুধু দরজার
আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছে মাত্র! ধরা পড়ে যাওয়ায় দু’একবার অবশ্য চোখাচোখি
হয়েছে। একটা কাঁপা কাঁপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পৌলমি’র বুক থেকে। বিয়ের প্রায় ১৫/১৬ বছর হয়ে গেছে কিন্তু আজো সে স্বামীকে ভালবাসতে পারেনি। অথচ সেই
মানুষটার সঙ্গেই তাকে সংসার করতে হচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে
রেজাল্ট বেরোতে না বেরোতেই মামা-খালারা জোর করে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। ছেলের সাথে
মেয়ের বয়সের ব্যবধানের কথা ভেবে মা সালেহা
খাতুন অবশ্য প্রথমদিকে খানিকটা আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু তার
সে নিস্ফল প্রচেষ্টা ভেসে গেছে বেনো জলের মত। গরীব
স্কুল শিক্ষক বাবার নিষ্প্রভ দৃষ্টির সামনে
দাঁড়িয়ে পৌলমিকে মেনে নিতে হয়েছে এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। মধ্যবিত্ত বাবা-মা’র
সংসারে আরও তিন তিনটি বোন বেড়ে উঠছে লাউডগার মত ধাই ধাই করে। তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ের পিড়িতে
বসাতে না পারলে শেষে বিয়ের জট লেগে যাবে! তার অনিচ্ছার কোন দাম থাকেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের
পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠা লাভের বা চাকুরী
করার স্বপ্ন অঙ্কুরেই চাপা পড়ে যায়। গরীব হলে সমাজে মুরুব্বীর সংখ্যাটা যেন বেড়ে
যায় ফিবোনেচ্চি সংখ্যার মত। আত্মীয়- স্বজন কিংবা পাড়া-পড়শি সবাই অবলীলায় সাংসারিক
ব্যাপারগুলোতে নাক গলাতে থাকে।
২
বড় খালা যেহেতু বলেছেন যে ছেলে খুব ভাল, উচ্চ শিক্ষিত
এবং বিদেশে ভাল বেতনে চাকুরী করছে। বিয়ের পরে স্ত্রীকেও সাথে নিয়ে যাবে। সেহেতু কেউই
বিয়েতে না করার সাহস পায়না। সে অবশ্য বিয়ের পরে স্বামীর সাথে ঠিকই কিগালি, রুয়ান্ডা
গিয়েছিল। প্রায় চার বছর
সেখানে সংসার করে সে দেশে ফিরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে
বেঁচেছে। মেয়ে মৌনতার
জন্ম সেখানেই। কিগালিতে Avenue de Nyabarongo এ ইসলামিক
কালচারাল সেন্টারের কাছেই তারা থাকত। হুদা সাহেবের অফিস অবশ্য
ছিল Avenue de I’Arme’e 12 এলাকায়। ঠিকানাটা খুবই সহজ। রেমেরা ট্যাক্সি
পার্ক থেকে ট্যাক্সি নিলে সোজা বাসার কাছে পৌঁছে দেয়। পুরো কিগালি শহরটাই নানান
প্রজাতির গাছ গাছালিতে সুন্দর করে সাজানো। প্রশস্ত আর পরিচ্ছন্ন বুলেভার্দের
দু’ধারে লাল টালির সুন্দর সব বাংলোয় সৌন্দর্যের হাতছানি। এভেন্যু’র ক্রস সেকশনগুলোতে
বিশাল সব ভাস্কর্য কিংবা পানির ফোয়ারা শত ধারায় ঝরে পড়ে রাতদিন। এখানে সেখানে
আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে ঠায় দাড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া সব সুউচ্চ ভবন। শহরের আইন
শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভাল আর ট্র্যাফিক
আইনটাও খুব কড়া। পুরো শহর জুড়ে হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল কিংবা গাড়িতে সীটবেল্ট
বিহীন কোন আরোহীকে চোখে পড়েনা। নির্বিঘ্নে অনেক রাত অবধি ঘুরে বেড়ানো সম্ভব।
ছিনতাই বা চুরির ভয় বলতে গেলে নেই। তাই শনিবারের রাতগুলোতে কিগালি শহরের অলিগলির
সব নাইট ক্লাবে প্রায় ভোর অবধি হৈ হুল্লোড় চলতে থাকে।
হুদা সাহেব অফিসের সাদা গাড়িতেই যাতায়াত করে থাকেন। ওখানে
সবাই ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে, প্রথমদিকে লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ অসুবিধা হত পৌলমির। মন খুলে কথা
বলার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। বইপত্র ঘেঁটে টুকটাক যেটুকু ফ্রেঞ্চ শিখেছে তা
দিয়ে Avenue du Mont Kigali‘তে সার বেঁধে দাড়ানো ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরগুলোতে বহু কসরত করে কেনাকাটা করা সম্ভব হলেও কারও সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প
করার মত তা যথেষ্ট ছিলনা। এরফলে বিয়ের পর প্রথম চারটি বছর একরকম জেলখানাতেই কেটেছে
তার। হুদা সাহেব অফিস
থেকে বাসায় ফিরলে তবেই না মন খুলে দু’টো কথা বলা যেত। ঐসব দিনগুলোতে
তখন খুব অস্থির লাগত পৌলমির। মোবাইলে দেশে কথা বলা যেত তবে বিল বেশি
আসায় অল্পেই কথা সারতে হত তাদের। তাই প্রবাস জীবনের এই সব উটকো ঝামেলা পিছনে ফেলে দেশে
ফিরে আসাটা তার জন্য অনেক আনন্দকর এবং সুখদায়ক অনুভূতি ছিল। অবশ্য একঘেয়েমি কাটাতে
ছুটির দিনগুলোতে তারা কিগালির বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যেত। তার সবচেয়ে ভাল
লেগেছিল কিগালি জেনোসাইড মেমোরিয়াল সেন্টার। ওটা Avenue ULK ধরে
কিছুটা সামনে এগোলে গিসোজি হিলে তৈরি করা হয়েছে। কি দারুণ ভাবে ১৯৯৪ সালে
হুতু’দের হাতে নির্মম ভাবে তুতসি জনগোষ্ঠী হত্যার নিদর্শন তারা সংরক্ষণ করছে
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। বলা হয় যে সেদেশে গণহত্যা শুরুর প্রথম একশ দিনে প্রায় দশ
লক্ষ তুতসি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় এবং গণহত্যা শেষে প্রায় ৮৫% তুতসি জনগোষ্ঠী পৃথিবী
থেকে স্রেফ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এই কুখ্যাত
অপরাধ চির জাগরূক রাখার প্রত্যয়ে হত্যাকাণ্ডের দশম বার্ষিকীতে অর্থাৎ ২০০৪ সালের
এপ্রিলে কিগালি সিটি কাউন্সিল আর যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এইজিস ট্রাস্টের সহায়তায়
কিগালি মেমোরিয়াল সেন্টার গড়ে ওঠে। এই মেমোরিয়াল সেন্টারের পাশেই গণকবরে শুয়ে আছে প্রায় আড়াই
লক্ষ হতভাগ্য তুতসি জনগোষ্ঠীর মৃতদেহ। নিজ দেশের পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য
দেশের গণহত্যার নিদর্শন সেখানে থাকলেও বাংলাদেশের ১৯৭১এর গণহত্যার নিদর্শন না
থাকায় মন খারাপ হয়েছিল পৌলমির।
৩
বিল্ডিঙের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তরার ৭ নাম্বার
সেক্টরে একটা ভাড়া ফ্ল্যাটে ছিল পৌলমি। রিয়েল এস্টেট কোম্পানি
বিল্ডিঙের কাজ শেষে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিলে সে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে একহাতে সাজিয়েছে তার
সুন্দর ছিমছাম সংসার। ছেলে ঋদ্ধ’র জন্ম এখানেই। ছেলে–মেয়ে,
ড্রাইভার আর কাজের বুয়াকে নিয়েই দিন কাটে তার। তার একঘেয়ে জীবনে বসন্ত বাতাসের মত খানিকটা
দোলা দিয়ে যায় রাস্তার ওধারের নাম না জানা যুবক। দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে সামনে
তাকায় পৌলমি। একটা খবরের কাগজে মাথা আড়াল করে সে তখনও দাঁড়িয়ে। সম্ভবত
সিএনজি বা ট্যাক্সির জন্য সে রোদে ওভাবে দাঁড়িয়ে
আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা
করেও কোন বাহন না পেয়ে শেষে হাঁটতে শুরু করে ঝাঁকড়া চুলের যুবক। হয়ত তার কাজের
তাড়া আছে। তার দীর্ঘ শরীরটা ক্রমান্বয়ে ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায় একসময়। পথের সে
নিঃসীম শূন্যতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার রান্নার কাজে মন দেয় পৌলমি। যুবকের জন্য কেন যেন মায়া
হয় তার। ইচ্ছে করে গাড়ীসহ
ড্রাইভারকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। সে জানেনা নাম না জানা যুবক এই চৈত্রের দুপুরে
সূর্যকে মাথায় নিয়ে আরও কতটা পথ হাঁটবে! খারাপ লাগা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে পৌলমিকে।
দমকা বাতাসের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে বুক হালকা করে দেয়। ধুর্! কি আর হবে ওসব ছাইপাশ ভেবে। তার জীবনতো নির্ধারিত হয়ে
গেছে এক রকম সাদামাটা ভাবে। চাইলেও সে পাল্টাতে পারবেনা দাবার গুটির ছকে বাঁধা সাদা-কালো
জীবনের নিয়তি। ছেলে-মেয়ে এবং স্বামীর মন
জুগিয়ে চলা আর সাংসারিক ঝামেলাগুলো মেটানোর মত একঘেয়ে কাজগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও
করে যেতে হয়।
মেয়ে রাজউক হাই স্কুলে আর ছেলে টার্কিশ হোপে পড়ছে। মেয়েটা এখনই হয়েছে বাবার মত, স্বার্থপর আর একরোখা গোছের। সাধারণত মেয়েরা মাকে
বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু মৌনতা হয়েছে একদম অন্যরকম। তার সঙ্গে কোনদিনই
পৌলমির তেমন একটা জমেনি। হাই স্কুলে পড়ে, কিছুটা হলেও তো বুঝতে শিখেছে। অথচ এই ছেলেমেয়েদের
জন্য সে রাতদিন কি পরিশ্রমই না করেছে! তাদের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা
কিংবা পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো, তার সাধ্যে যা কুলায় তার সবই সে করছে একহাতে।
কিন্তু এত কষ্টের বিনিময়ে হলেও সন্তানদের মন পেল না। মেয়েটার মত ছেলেটাও হয়ত দিনে দিনে একইরকম স্বার্থপর
হয়ে উঠবে! একই রক্ত শরীরে তো। ভাবতে অবাক লাগে যে সে একদিন এদের পেটে ধরেছিল। ওদের বাবার সাথে যখন
সাংসারিক কোন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তখন নির্দ্বিধায় এরা দু’ভাইবোন বাবার সাথে তাল
মিলিয়ে কথা বলে, এমনকি মেয়েটা তার বাবার মত তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতেও
দ্বিধাবোধ করেনা। হুদা সাহেব মায়ের সাথে ছেলেমেয়েদের এরকম বেয়াদবিতে কিছু না বলে চুপ থাকেন,
আর তাই তারা এতটা বেপরোয়া। ভাবটা এমন যে তারা দু ভাই-বোন তাদের
ইচ্ছে মত চলবে, আর পৌলমির কাজ হল তাদের সেবা করা বা মন
জুগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে বেশি খারাপ লাগলে বাথরুমে বসে কাঁদে। বালতিতে পানির
ট্যাপ ছেড়ে দেয় যেন কেউ তার কান্নার শব্দ শুনতে না পারে। বুক ভরা
অভিমান ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সে জানেনা
আল্লাহ্ তার কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছেন। সে কি তার জীবনে কোনদিনই সুখের
নাগাল পাবেনা! সে কি কোনদিনই পারবে না কাউকে সত্যিকরে ভালবাসতে! এর উত্তর তার জানা
নেই। সে জানে তার মত তার বড় জা’ও একই রকম
ভাবে তার সংসারে কষ্ট ভোগ করে আসছেন। আসলে তার স্বামীর বংশে মেয়েরা এভাবেই নিগৃহীত
হয়ে আসছে। বলতে গেলে মেয়েদের ছোট করে দেখা তাদের বংশের ধারা। হুদা সাহেব হয়ত কখনও ভাবেন
না যে তার নিজেরও একটা কন্যা সন্তান রয়েছে এবং একদিন তার কন্যারও বিয়ে হবে। তাকেও স্বামীর সাথে সংসার
করতে হবে। পৌলমি মাঝে মাঝে তার স্কুল জীবনের বান্ধবী মিলার সাথে কষ্টগুলো
শেয়ার করে। অবসর মুহূর্তগুলোতে এভাবে এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে গল্পে গল্পে সান্ত্বনা
জুগিয়ে যায়। এছাড়া তাদের আর কিইবা করার আছে! অবেলার বিয়ের কারণে লেখাপড়াটা ঠিক মত
শেষ করতে পারেনি। তা’ নাহলে কবেই হয়তবা একটা চাকুরী জুটিয়ে এই সংসারের বুকে ঝাটা
মেরে চলে যেত। তার খুব রাগ হয় বড় খালার ওপরে যিনি তাকে এভাবে জোর করে
বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছিলেন। রাগ হয় তার বাবা-মা’র ওপরে,
যারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি।
৪
হুদা সাহেব আর পৌলমির মাঝে এই সমস্যার সূত্রপাত আসলে প্রথম
দিন বা বলতে গেলে বাসর রাত থেকেই। একটা মেয়ে একজন স্মার্ট, সুদর্শন এবং আর্থিকভাবে
স্বচ্ছল একটা ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাশে পেতে চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু হুদা
সাহেবের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। পারিবারিক
সিদ্ধান্তের চাপে বয়সের ব্যবধান মেনে নিতে হলেও হুদা সাহেবের অতি সাধারণ চেহারা আর
ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর শুনে বাসর রাতেই চমকে উঠেছিল পৌলমি। এই লোকের সাথে
সে গল্প করবে কী করে! তার সাথে কাটাতে হবে একটা জীবন! সেই রাতে পৌলমির আশাহত
দৃষ্টির সামনে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করেছিলেন হুদা সাহেব। তিনি কনে দেখতে এসে পছন্দ
করে ফেলেছিলেন পৌলমিকে এবং সে রাতেই
তড়িঘড়ি করে তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয় কোন ধরনের বাড়তি আয়োজন ছাড়াই। পৌলমি সঙ্গত কারণেই স্বামীকে
মন থেকে মেনে নিতে পারেনি কখনো, কোনদিনই। আর এভাবে স্বামীকে না ভালোবেসেই পার করে
দিয়েছে এতোটা বছর। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সন্তান জন্মেছে কিন্তু স্বামীর প্রতি
ভালোবাসা জন্মায়নি এতটুকুও।
হুদা সাহেব প্রথমদিকে স্ত্রীকে স্বাভাবিক
করতে অনেক চেষ্টাই করেছেন কিন্তু পৌলমির ক্রমাগত নিঃস্পৃহতায় একসময় তিনিও হাল ছেড়ে দেন। দেশে বা বিদেশে একই ছাদের
নীচে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে কখনও আত্মার বন্ধন গড়ে উঠেনি। হুদা
সাহেব সাংসারিক প্রয়োজনে ৫/৬ মাস পর পর ছুটিতে দেশে আসেন, এছাড়া নিয়ম
করে ফোনেও কথা হয়। কিন্তু হুদা সাহেব আর পৌলমি’র মাঝে মানসিক টানাপড়েন ক্রমান্বয়ে যেন
বাড়তেই থাকে। কখনো কখনো তা ভীষণ ঝগড়ায় রূপ নেয়। একসময় ফোনে ঝগড়া
করাটাও যেন নিয়মিত অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সাথে বাস্তবতার
অসম সাযুজ্য তাদের মাঝে
বিরাট ব্যবধান তৈরি করে দেয়। দূরত্ব আর একাকীত্ব তাদের সম্পর্কের বাঁধন ক্রমশ
দুর্বল করে দেয়। পৌলমি মায়ের সাথে সাংসারিক ঝামেলাগুলো শেয়ার করে।তার অন্যান্য
বোনরা এরমাঝেই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেছে এবং স্বামী সন্তান নিয়ে তারা বেশ ভালোই আছে বোঝা
যায়। সালেহা খাতুনের মনটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। নিজের
সংসারের অবস্থা ভাল নয়, টেনেটুনে মাস চলে যায়। এমন অবস্থায় মেয়ের সংসার
ভেঙ্গে গেলে কোথায় উঠবে! কে দেখবে তাকে! তিনি মেয়েকে চোখ বুজে সংসার করে যাওয়ার
পরামর্শ দেন। তার মতে সব সংসারেই স্বামী-স্ত্রী’তে খুঁটিনাটি সমস্যা হয়েই থাকে, তাই ওসব বেশি ধরতে নেই। কিন্তু দিন
দিন হুদা সাহেবের উপেক্ষা আর মানসিক উৎপীড়ন পৌলমির সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া
সব সময় ঝগড়া করতে কারইবা ভালো লাগে! অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ফোন করে
লাইন ব্যস্ত পেলে কিংবা সাংসারিক কোন প্রয়োজনে কোথাও গেলেও হুদা সাহেব সন্দেহ করে
বসেন, এবং তা নিয়েও শুরু হয় ঝগড়া।
৫
এবারেও তাই, ঈদের ছুটিতে দেশে এলে হুদা সাহেব আর পৌলমি’র
মধ্যে ছোটখাট বিষয়ে ঝগড়া বা খিটিমিটি লাগে, আর তা থেকে পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। ইদানীং ড্রাইভার সময় মত গাড়িতে গ্যাস না ভরলে কিংবা ছেলেমেয়েরা
ঠিক সময়ে স্কুল থেকে বাসায় না ফিরলে অথবা দারোয়ান ঠিক মত ডিউটি না করলে, এমনকি
ভাড়াটেরা ঠিক মত ফ্ল্যাটের ভাড়া পরিশোধ না করলেও হুদা সাহেব তার জন্য পৌলমিকে
দোষারোপ ও বকাবকি করেন। তার ধারণা পৌলমির উদাসীনতার কারণেই তার সংসারটা উচ্ছন্নে
যেতে বসেছে। সে দেশে বসে শুধু শুধুই তার উপার্জন ধ্বংস করছে, সাংসারিক কোন বিষয়ই সে
ঠিক মত দেখাশোনা করছে না। এমনকি সে হয়তো কারও সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছে
বলে সংসারে মন নেই। হুদা সাহেবের এরকম দোষারোপে পৌলমি প্রতিবাদ
করে। প্রথম দিকে এক কথা দু’কথায় কথা কাটাকাটি শুরু হলেও একসময় তা কঠিন ঝগড়ায় রূপ
নেয় এবং এক পর্যায়ে সন্তানদের সামনেই হুদা সাহেব পৌলমি’র চিবুকে চড় মেরে বসেন।
মুহূর্তে সব কিছু যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। একটু আগে চিবুকের যে জায়গাটায় হুদা সাহেব
আঘাত করেছেন পৌলমি সেখানে ডান হাতটা চেপে ধরে স্বামীর মুখের
দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তার বিশ্বাস
করতে কষ্ট হয়।
পৌলমি’র দু’চোখ বেয়ে নামে জলের অজস্র ধারা। হুদা সাহেব
মুখটা ঘুড়িয়ে নেন। পৌলমির সব অভিমান আর কষ্ট এক সাথে বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে
চায়। হুদা সাহেব বিদেশ থেকে প্রতি মাসে তার এফসি একাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন শুধু। পৌলমি
সেই টাকাটাকে কাজে লাগিয়ে তিল তিল করে সাজিয়েছে এই সংসার।
নিজের শখ আহ্লাদ অপূর্ন রেখে সংসার আর সন্তানদের পিছনে ব্যয় করেছে স্বামীর
উপার্জনের প্রতিটি টাকা। অথচ আজ তার কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে
স্বামী তাকে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে! এমনকি তাকে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পৌলমি সিদ্ধান্ত
নেয় এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। যে সংসারে সে স্বামী আর সন্তানদের
কাছে অপাঙতেয় সেখানে তার থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। শোয়ার ঘরে ঢুকে চুপচাপ স্যুটকেস
গুছিয়ে নেয়। ঘর থেকে বেরনোর মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে থাকে ড্রেসিং
টেবিলটার দিকে। সেখানে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে তার ব্যবহার করা টুকিটাকি এটাসেটা
জিনিস। দরজা খুলে বেরিয়ে যায় পৌলমি। বাচ্চারা তাদের ঘরে, সুনসান নীরবতা। সময়টা যেন স্থির হয়ে
গেছে। হুদা সাহেব সোফায় ব??
পোস্ট ভিউঃ
91