ঝরা পাতার গান

গল্প ঝরা পাতার গান
ঝরা পাতার গান

হেমন্তের শেষের দিনগুলোতে শুকনা পাতার ওড়াউড়ি আর গাছের কোটরে লুকিয়ে থাকা দুধের সরের মতো ছেঁড়া কুয়াশা দেখেই বলে দেয়া যায় শীত আসছে। প্রকৃতির নীরব আর সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো রাসেল খুব গভীর ভাবে খেয়াল করে থাকে। আর সেটা প্রাণ ভরে উপভোগ করার জন্যই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের পারের এই জায়গাটা রাসেলের খুব প্রিয়। লেকের ওপারে ডালপালা ছাড়িয়ে অগোছালো ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো শ্বেত কাঞ্চনআর লেকের এপার ঘেঁষে জল ছুঁইছুঁই হিজলের সারি তার  পাশেই ল্যাম্পপোস্টের মতো নিঃসঙ্গ ছাতিম গাছটা তার অনেকগুলো একাকী মুহূর্তের সাক্ষী। শরতের শেষে শুক্লা দ্বাদশীর রাতে বুড়ো ছাতিম গাছটা হলদেটে সাদা রঙের থোকা থোকা ফুলে ভরে যায়। তখন ক্ষ্যাপাটে বাতাসে তার মিষ্টি ঘ্রাণ থেকে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। সে ফুরফুরে মিষ্টি ঘ্রাণে কি রকম এক ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে যায় শরীরের শিরায় উপশিরায়।   

লেকের অদূরে অনেকটা জায়গা জুড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একহারা মেহগনি গাছগুলো। সেখানে ফ্যাকাসে খয়েরী রঙের গাছগুলোর মাথায় সবুজপাতার জটা। হেমন্তের বিবর্ণ দুপুরগুলোতে যখন খাঁখাঁ নির্জনতা, নিস্তব্ধ থাকে চারদিক, তখন আচমকা এলো বাতাসে গাছগুলো যেন কথা বলে নিজেদের মাঝে। বাতাসের হালকা ভেজা স্পর্শে মেহগনি বনে সবুজ জটা খুলে যায় লজ্জাবতি পাতার মতোএকধার থেকে ঝুরঝুর করে পড়তে থাকে জীর্ণ পাতাগুলো। বাতাসের টানে পাতাগুলো ছুটে যায় এদিক থেকে সেদিকে। রাসেলের খুব ভাললাগে পাতার এই হঠাৎ ছন্দপতন দেখতে। পাতার এই ঝরে পড়াটাকে সে অবশ্য বলে থাকে ঝরা পাতার গান। আর তাই পাতার মর্মর সুর শোনার জন্য অবসর মুহূর্তগুলোতে সে প্রায়ই শুয়ে থাকে গাছের দীর্ঘ সারির নিচে সবুজ গালিচার মতো দূর্বা ঘাসের ওপর একে একে ঝরে পড়া সবুজ পাতাগুলো তখন ঢেকে দেয় তাকে পরম মমতায় শুকনো পাতার স্তূপে শুয়ে আকাশ দেখতে তার ভালো লাগেহেমন্তের আকাশ কি দারুণ স্বচ্ছ নীল আর সেখানে ভর দুপুরে নিঃসঙ্গ চিলেরা আশ্রয় খুঁজে ফেরে।     

রাসেল তার বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান, আর তার বেড়ে ওঠা দেশের একদম উত্তর থেকে উত্তরে ঠাকুরগাঁ শহরে সেখানেই এসএসসি আর এইচএসসি’র বেড়াজাল টপকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে। পড়াশোনার বাইরে ফটোগ্রাফি আর নিসর্গ তাকে খুব টানে। রাসেল তার বাবার মতোই জীবনের রস খুঁজে পায় কবিতার বই কিংবা ক্যামেরার লেন্সে। রাসেলের বাবা-মা দু’জনই কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারা ছেলেকে গড়ে তুলেছেন তাদের মতো করেই উদার পারিবারিক আবহে। ছেলের সব পাগলামি আর খেয়ালিপনাগুলোকে তারা সস্নেহে সামলেছেন। তারা জানেন তাদের সন্তান খুবই আবেগপ্রবণ আর ভাবুক প্রকৃতিরতবে ভাবের জগতে ছেলের বিচরণ থাকলেও সে যে কখনও খারাপ কিছু করবেনা সে দৃঢ় বিশ্বাস তাদের বরাবরই ছিলোরাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলোতে মানিব্যাগে সামান্য টাকা ভরে ছুটে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুধুমাত্র প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করার ইচ্ছেয়! সময়কে ধরে রাখার জন্য তার কি দারুণ প্রচেষ্টা! সে এক অদ্ভুত নেশা আর পাগলামি। দ্বিতীয়বর্ষে ওঠার বেশ পরে, হেমন্তের কোন এক পড়ন্ত বিকেলের আধফোটা রোদে ক্যাফেটেরিয়াতে স্বাতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত তার এসব পাগলামি ছিলো নিজের সাথেই

সুদীপ্তা ব্যানার্জী অর্থাৎ স্বাতি গাবতলি, বগুড়ার মেয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সেই বড়। বাবা সুশান্ত ব্যানার্জি পেশায় আইনজীবী হলেও তার মা সরযূবালা দেবী ব্যস্ত থাকেন ঘর-সংসার নিয়ে। আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে স্বাতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছে হেমন্তের অলুক্ষণে বিকেলের এক পশলা বৃষ্টিতে খানিকটা কাকভেজা হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় যখন সে চুলের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা জল ঝরাতে ব্যস্ত, রাসেল তখন ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করছিল অবেলার বৃষ্টিতে ভেজা শালিকের ডানা ঝাপটানি। কি এক কারণে হঠাৎ ক্যামেরার লেন্স ঘুরে গেলে পুরো ফ্রেম দখল করে বসে স্বাতির জলে ভেজা মুখটা, বিশেষ করে চিবুকের কালো তিলটাবৃষ্টির ভেজা রেশ লেগে আছে তার চোখে-মুখে প্রচন্ড বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে তাকানোর আগেই ক্যামেরার শাটার টিপে দেয় রাসেলরেগে ক্যামেরাটা কেড়ে নেয়ার জন্য রাসেলের দিকে তেড়ে যায় স্বাতি কিন্তু তার আগেই কিউপিড এসে ভর করে তাদের দুজনের মাঝে ফলে স্বাতির আর রাগ করা হয়না।  

হালকা বৃষ্টির তোড়ে ভেজা সে বিকেলে ছিলো আলো আঁধারির খেলা, আর ছিল একজোড়া যুবক-যুবতীর ভালবাসা শুরুর গল্প। সৃষ্টিছাড়া সে ভালোবাসায় তারা ভেসে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকী দিনগুলোয়ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ছুটির দিনগুলোতে তারা প্রায়ই এসে বসতো লেকের পারে ছাতিম গাছটার নিচে মাঝে মাঝে ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে রাসেল জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ থেকে দরাজ গলায় আবৃত্তি করতো,   

 

                                                     সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি;    

                                                     বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;

                                                     ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ

                                                     নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;  

                                                     ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

                                                     ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

                                                     দূর থেকে দূরে-আরো দূরে

                                                     যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর। 

 

আবার কখনোবা William Wordsworth এর লেখা থেকে,  

I wandered lonely as a cloud

That floats on high o’er vales and hills,

When all at once I saw a crowd,

A host, of golden daffodils;

Beside the lake, beneath the trees,

Fluttering and dancing in the breeze.

আবৃত্তি করার মুহূর্তগুলোতে স্বাতি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতো রাসেলের দিকে। শুদ্ধতার মাপকাঠিতে আবৃত্তিতে তাকে বড়জোর চল্লিশ দেয়া যেতে পারে, অর্থাৎ টেনেটুনে পাশ কিন্তু স্বাতির ভালোলাগে  রাসেলের এই হঠাৎ লাগামছাড়া কণ্ঠে কবিতার জাল বোনা, কিংবা উচ্চকণ্ঠে সিনেমার যত উদ্ভট গান গাওয়া, ভালো লাগে তার সব পাগলামী এবং অযথা হৈ চৈ। কখনোবা সে কহলিল জিবরানের কোন লেখার গভীর মর্মার্থ নিয়ে তার সাথে অযথা তর্ক জুড়ে দেয়।  

When love beckons to you, follow him,
Though his ways are hard and steep.
And when his wings enfold you yield to him,
Though the sword hidden among his pinions may wound you.
 And when he speaks to you believe in him,
Though his voice may shatter your dreams
as the north wind lays waste the garden.  

স্বাতি যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবের সদস্য, আবৃত্তির সাথেও জড়িত, কিন্তু রাসেলের এসব পাগলামির সাথে সে কখনও পেরে উঠে না। হয়তোবা সে ইচ্ছে করেই রাসেলের কাছে হেরে যেতে চায়ভালোবাসার মানুষের কাছে হেরেও সুখ, হয়তোআসলে রাসেলকে ঘিরে স্বাতির একধরনের ঘোরলাগা অনুভূতি কাজ করেতাকে ঘিরে সে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেকিন্তু বাস্তবতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর চোখের সামনে এসে দাঁড়ালে ভীষণ কষ্ট হয় তার। সে বুঝে উঠতে পারেনা সে কি করবে! মাঝে মাঝেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। 

কঠিন বাস্তবতায় তারা দু’জন ভিন্ন ধর্মের অনুসারী এবং আজন্মের লালিত বিশ্বাস আর সংস্কার তাদের মাঝে যোজন দূরত্ব পেতে রেখেছে সে জানে তাদের এই সম্পর্ক দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধে তো নয়! বাবা শুনলে নির্ঘাত সম্পর্কচ্যুত করবেন, আর মা এই অসম সম্পর্কের কথা জানলে হয়তো লোক-লজ্জার ভয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়বেনবিভিন্ন পূজা পার্বণে পরিবার-পরিজন, কাছের কিংবা দূরের আত্মীয় স্বজন আর ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দ উল্লাসের চিত্র টুকরো টুকরো স্মৃতি হয়ে তার চোখের সামনে ভেসে আসে। সে জানে তার পক্ষে কোনভাবেই ধর্ম-সংস্কার ত্যাগ করা সম্ভব না। সে পারবেনা জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এসে এখন নতুন করে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হতে কিংবা অপরিচিত নতুন কোন বিশ্বাস ধারণ করতে ব্যাপারটা নিয়ে সে অনেকবারই রাসেলের সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু রাসেল যেন নিজেই এক প্রবল ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার ভয় তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। সে  কখনোই বিষয়টাকে তেমন সিরিয়াসলি নেয়নি। বরং স্বভাব সুলভভাবে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে রাসেলের ধারণা, যে উদার ধ্যান ধারণায় তার বাবা-মা তাকে গড়ে তুলেছেন তাতে ধর্ম বা সংস্কারের মতো  বিষয়গুলো স্বাতির সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারেনা। রাসেল দৃঢ় বিশ্বাসে সবসময় স্বাতিকে বলেছে, সময় আসুক তখন ভেবে দেখা যাবে, এখন ওসব নিয়ে অযথা মাথা ঘামিয়ে মন খারাপ করতে রাজী নয় সেস্বাতি ভেবে পায়না সে কি করবে। একদিকে পরিবার-সমাজ-ধর্ম, আর আরেকদিকে তার ভালোবাসা, দু’টোই সমান গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। সে জানে রাসেলও তাকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু সে জানেনা সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধার দেয়াল তারা পেরোবে কি করে!     

লেকের পারে রাসেলের প্রিয় জায়গাটাতে বছর জুড়ে থাকে প্রকৃতির পালাবদলের অদ্ভুত সব দৃশ্য! রাসেল কখনও সেসব ক্যামেরার লেন্সে, পেন্সিল স্কেচে কিংবা কবিতার লাইনে বন্দি করে রাখতো আবার কখনওবা শুধুই দু’চোখ মেলে উপভোগ করা! বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক, ক্যাফেটেরিয়া আর ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরীতে বই’র পাতার ভাঁজে ফেলে আসা তারুণ্যের উদ্দাম ভরা দিনগুলো সত্যিই কি দারুণ ছিল! মাস্টার্স শেষে লেখাপড়ার ঝামেলা শেষ হতে না হতেই রাসেলের শুরু হয় চাকুরী খোঁজার ঝক্কি। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর দিনাজপুরে একটা বেসরকারি কলেজে চাকুরী জোটে চাকুরীতে বছর না ঘুরতেই স্বাতির প্রেসারে মেস ছেড়ে শহরের সুইহারি এলাকায় একটা দু’রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে টুকটাক করে সাজিয়ে তোলে নিজের ছোট সংসার। এরপর অনেক জল্পনা কল্পনার শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা বিয়ের পর্বটা সেরে নেয় শুরু হয় রাসেল আর স্বাতির নতুন জীবনের সূচনা। একে অপরের ওপর নির্ভর করে পথচলা   

স্বাতি ধর্মমত পরিবর্তন না করলেও সুশান্ত ব্যানার্জি মুসলিম ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে মেনে নিতে পারেন না। তারা স্বাতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসেলের বাবা-মা একমাত্র ছেলের এভাবে বিয়ে করা মেনে নিতে বাধ্য হলেও পরবর্তীতে আত্মীয় স্বজনদের চাপে পড়ে তারাও বেঁকে বসেন। তারা ছেলেকে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী বিয়ে করার জন্য ক্রমাগত চাপ দেন। অবশ্য স্বাতি তার ধর্ম মত পরিবর্তন না করলে বা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত না হলে তা’তো সম্ভব নয়। স্বাতি এবং রাসেলের বাবা-মা তাদের সিদ্ধান্তে একদম অনড় থাকায় রাসেল দিশেহারা বোধ করে একরকম দোটানার মাঝে কখনও পড়তে হতে পারে তা’ সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে উদার পারিবারিক আবহে তার বেড়ে ওঠা তার সাথে সে বিয়ে পরবর্তী জীবনের হিসেব মেলাতে পারেনা সে জানে তার পক্ষে স্বাতি কিংবা বাবা-মা কাউকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। তাদের সবাইকেই সে অসম্ভব ভালোবাসে, সবাইকে নিয়েই সে থাকতে চায় অথচ বিয়ের পর পরিচিত মুখগুলো তার কাছে কেমন অপরিচিত ঠ্যাকে সবাই কিভাবে এতোটা পাল্টে গেলো সে ভেবে পায়না   

ক্রমাগত মানসিক চাপ আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে তার মাঝে এক সময় মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। আগে থেকেই রাসেলের মাঝে ঘর পালানোর রোগটা ছিল, বিয়ের পরের দিনগুলোয় বাস্তবতার কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে তা যেন আরও বেড়ে গেল সে ইদানীং মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রায়ই এদিক সেদিকে বেরিয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। দু’তিন দিন পর উসকো-খুসকো চুল-দাড়ি আর ময়লা জামা-কাপড়ে যখন সে ঘরে ফেরে তখন তার দিকে তাকানো যায়না। নিয়মিত ক্লাস না নেয়ার কারণে কলেজ থেকেও অভিযোগ আসে রাসেলের এরকম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় তার কি করা উচিত স্বাতি বুঝে উঠতে পারেনা। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার জন্য প্রবল মমত্ববোধ আর অন্যদিকে আজন্মের লালিত বিশ্বাস ধরে রাখার তীব্র বাসনার মাঝে পড়ে সেও যেন  অবসাদগ্রস্থ বাবা-মা সম্পর্ক ছিন্ন করায় তাদের সাথে যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে সে সুযোগটাও থাকেনা। একা একা ভেবে পায়না সে কি করবে সে বোঝে না আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় কেন শুধু মেয়েদেরই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়!     

দিনটা ছিল শুক্রবার বিগত কয়েক মাসের মতো সেদিনও সকালে নাস্তার পরে রাসেল আর বাসায় ফেরেনি। স্বাতি প্রথমে ভেবেছিলো ছুটির দিন বলে হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে গিয়েছে। এরকম অনেকবার হয়েছে কিন্তু সেদিন দুপুর গড়িয়ে রাতেও রাসেল বাসায় না ফিরলে সে মোটামুটি ধরে নেয় আবারও ঘোড়া রোগ ভর করেছে তার পতিদেবতার ওপরে। আগেরদিন অনেক রাত অবধি তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছিল এবং তার রেশ ধরে পরদিন সকালে বাবা-মার সাথেও রাসেল মোবাইলে তর্ক করেছে অনেকক্ষণ। তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে, প্রসঙ্গ সেই একটাই। স্বাতিকে ধর্মান্তরিত করে মুসলিম নিয়ম অনুসারে বিয়ের ফর্মালিটি পূর্ণ করা অবশ্য বিয়ের দু’মাস পর থেকেই এসব দেখতে দেখতে স্বাতির এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে এখন রাসেলের মোবাইলে ফোন করে কোন লাভ নেই, সে কল রিসিভ করবেনা। অভিমান ভেঙ্গে গেলে দু’দিন পরে সে নিজ থেকেই বাসায় ফিরে আসবে কিন্তু দিন গড়িয়ে যখন সপ্তাহ হতে চললো অথচ রাসেলের দেখা নেই, অজানা আশঙ্কায় তখন স্বাতির গা শিউরে উঠে।     

স্বাতি উদ্ভ্রান্তের মতো রাসেলের মোবাইলে বারবার ফোন করে কিন্তু রিং টোন বাজলেও কেউ সে কল রিসিভ করে না একসময় ফোনটাও আর বেজে উঠেনা ওপাশে জমাট নিস্তব্ধতা বাধ্য হয়ে রাসেলের বাবা-মাকে ফোনে বিষয়টা জানালে তারাও উদ্বিগ্ন হন এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে ফোন করে খোঁজ নিতে বলেন। স্বাতি রাসেলের খোঁজে বন্ধুদের যাদের নাম্বারগুলো জানা ছিল তাদেরকে ফোন করে, কিন্তু তারাও এবিষয়ে কিছু জানে না বলে জানায়। রাসেলের সাথে তাদের দেখা হয়নিরাসেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাসুদ একটু এগিয়ে আসে, সে স্বাতিকে নিয়ে শহরের সবগুলো ক্লিনিক, হাসপাতাল ঘুরে শেষে থানায় যায়। কিন্তু কেউই তাদের কোন খবর দিতে পারেনা। থানার ওসি তাদেরকে একটা জিডি করে পত্রিকায় ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদ ছাপতে পরামর্শ দেন। হুহু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে স্বাতি। মাসুদ কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। স্বাতিকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে সে নিজেই থানায় জিডি করে জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় অফিসে যায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে।   

ছেলের খোঁজে অস্থির হয়ে রাসেলের বাবা-মাও দিনাজপুরে আসেন তারাও আত্মীয় স্বজনদের কাছে খোঁজ খবর নেন কিন্তু কেউই তাদের ছেলের সংবাদ দিতে পারে না। এদিকে পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে আরেক জ্বালা। প্রায় প্রতিদিনই সময়ে অসময়ে কেউ না কেউ ফোন করে অর্থের বিনিময়ে রাসেলের খবর দিতে চায়, কেউ কেউ তার স্বামীর মতো কাউকে কোথাও দেখেছে জানিয়ে অর্থ দাবী করে দুঃসময়ে মানুষের এধরনের নিষ্ঠুর আচরণে স্বাতি বিপর্যস্ত বোধ করে।   

রাসেলের বাবা-মা দুদিন ছেলের বাসায় কাটিয়ে স্বাতিকে সাথে নিয়ে নিজের বাসায় ফেরেনকিন্তু এভাবে বসে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণতে কারইবা ভালো লাগে! প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্বাতির মুখের দিকে তাকানো যায়না। কয়েকদিনের প্রবল উৎকণ্ঠা আর অভিমানে ফুটফুটে মেয়েটা শুকিয়ে প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গেছে রাসেলের বাবা-মায়ের মাঝে প্রচণ্ড অনুশোচনা এসে ভর করে মেয়েটা ভালোবাসার টানে নিজের পরিবার-সমাজ-সংস্কার ছেড়ে তাদের ছেলের কাছে ছুটে এসেছিলো অথচ তারা কি না মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন কি হতো অতটুকু অপ্রাপ্তি মেনে নিলে! আশেপাশে এধরনের বিয়ে তো আজকাল প্রায়ই হচ্ছে। সমাজও মেনে নিচ্ছে কিন্তু তারা কি করবে! আত্মীয় স্বজনদের কটু কথা আর বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে আসলে তাদের  মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাদেরকে তো সবাইকে নিয়ে একই সমাজেই বসবাস করতে হয়। একঘরে হওয়ার ভয়ে তাদের কথা শুনতে যেয়ে একমাত্র সন্তান নিখোঁজ অথচ তারা কেউই এই দুঃসময়ে আজ সেভাবে পাশে নেই। রাসেলের বাবা একাই ছেলের খোঁজে কোথায় কোথায় না ছুটে বেড়াচ্ছেন! এদিকে স্বাতির শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা। এমনিতে বোঝা যায়না, সে অন্তঃসত্তামাহবুবা বেগম তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন ঠিক করেন।    

প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেলেও রাসেলের কোন খোঁজ না পেয়ে আলতাফ সাহেব র‍্যাবের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেনএকদিন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রস

পোস্ট ভিউঃ 75

আপনার মন্তব্য লিখুন