আমার কাছে বাবা মানে

কবিতা জলের কাছে যাবো
আমার কাছে বাবা মানে

 
বাবাকে দেখিনা অনেকদিন,
তার কালো ফ্রেমের চশমাটা আজো
তেমনি ভাবে কাঠের টেবিলে পড়ে আছে-   
বাবার রুম,বিছানা,লেখার টেবিল-চেয়ার তেমনি আছে,  
আমার মা বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে এখনো বাবার জায়নামাজ-
তসবীহ-টুপি সযতনে গুছিয়ে রাখেন- 
যেমনটা গুছিয়ে গেছেন বিগত পঞ্চান্নটি বছর ধরে।
একটা দীর্ঘ জীবন, একসাথে দীর্ঘ পথচলা !  
 
বাবা হঠাৎ করেই কী রকম ইতিহাসে ঠাঁই পেতে নিলেন!  
এখন আমার কাছে বাবার স্মৃতি মানে শ্রান্ত দুপুরে -
সাদা গেঞ্জি-ডোরা কাটা লুঙ্গি আর
বইয়ের পাতায় অভিনিবিষ্ট একজোড়া চোখ।
আমি ঠিক জানতাম দুপুরে খাওয়ার পর
ঐ সময়টায় হৈচৈ করা মানা। 
কতদিন বাবা ওভাবেই- 
বইয়ের পাতায় সেঁটে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছেন
আর মা কখন যেন ধীর পায়ে চোখ থেকে চশমাটা-
কিংবা বুকের জমিনে কাৎ হয়ে পড়ে থাকা-  
বইটা সরিয়ে বিছানার পাশে টেবিলে রেখে দিতেন।
বাবা, বই আর কালো ফ্রেমের চশমা মাখা স্মৃতি
আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য একাকার করে দেয় !
 
বাবা গান ভালোবাসতেন
কতদিন তাকে দেখেছি-
ট্রানজিস্টর কানের কাছে পেতে গান শুনতে।
মনের অজান্তেই গুনগুন করতেন কখনো কখনো,
বাবা হয়তো লজ্জা পেতেন তাই- 
অস্ফুট স্বরে তার উচ্চারিত গানের কলি
শুনবার আগেই বাতাসে মিলিয়ে যেতো।
ছোটবেলায় একবার-
বন্ধু রাহেলের সাথে আড়ি হয়েছিলো,
তার সাথে কথা বলা-
এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। 
আমার প্রবল বিষাদে ভরা সেই সন্ধ্যেয়-  
আলোর দীপ জ্বালাতে বাবা আমাকে
গানের ইসকুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন,
কেননা বাবা গান বড্ড ভালোবাসতেন।
 
বাবা আসলে ভীষণ সংস্কৃতিমনা ছিলেন-
আমাদের ছুটির দিনগুলো ছিলো খুব আনন্দের,
কেননা ছুটির দিন মানেই আমরা জানতাম 
সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া,
ম্যাটিনি শো’তে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা 
অথবা টাউন হল মঞ্চে চেয়ারের সারিতে 
বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে নাটক দেখা।  
আমার বাবা কখনো প্রশ্নের উত্তর দিতেন না 
হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, পড়ে শেখো-
উত্তরটা নিজেই খুঁজে নাও।
ছোটবেলা থেকে আজো এভাবে
অজস্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে-  
কবে যে বইএর নেশায় আসক্ত হয়ে গেছি-
তা বুঝতেও পারিনি।  
এখন শিওরের পাশে বই না থাকলে
আমার ঘুম আসেনা, রাতগুলো নিঃস্ব মনেহয়।
 
আমি এখন বুঝি, বাবা কেন ওভাবে
বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন-  
কেননা তিনি জানতেন, একদিন তিনি থাকবেন না- 
তখন বইই হবে আমার আশ্রয়, একমাত্র ঠিকানা।
 
বাবাকে দেখিনা কতো দিন! কতো সহস্র কাল!   
এখন বাবা মানে নিপাট কবরস্থান
বুকের মাঝারে খাঁ খাঁ বিরান ভূমি
বাঁশের বেড়ায় ঘেরা একখণ্ড জমি,   
নিমগ্ন চৈত্রে বিবর্ন কাঠ বাদাম গাছ
শুকনো পাতার ভিড়ে জেগে থাকা ঘাস। 
আমার কাছে বাবা মানে এখন নিঃসঙ্গ বাতাস-
কুয়াশা ভেজা আকাশ।

পোস্ট ভিউঃ 63

আপনার মন্তব্য লিখুন