প্রাক্তন

কবিতা জলের কাছে যাবো
প্রাক্তন

কাঁচের স্লাইডিং দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকছিলে তুমি-    
আর আমিও বেড়োবো বলে দোকানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে,
মুহুর্তেই সময়-কাল যেন স্থির হয়ে গেল ছাপচিত্রের মতো
থমকে দাঁড়িয়ে দুজন, ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে তুমি বললে-
 
-কেমন আছো ? 
 
-আমি ভালো। তুমি ?
 
উত্তর দিলে নাকি দিলে না বুঝিনি, তবে তারপর চুপচাপ।
খানিকটা নীরবতার পর মৃদু হেসে বললে-
 
-৯১ সালের পর আর দেখা হয়নি। নাহ্‌! এখন তো ২০২০    
 
-হুম। মাঝে ত্রিশটি বছর!    
 
বুকের গভীর থেকে আবেগের ঘূর্ণি পাক খেয়ে কোথায় মিলিয়ে যায় 
তোমার মায়াবী চোখে এখন ক্লান্তির ছাপ, চুলেও রূপোলি আভা
পৃথিবীর বয়সী নারীদের মতো তুমিও বুড়িয়ে গেছো মানতে কষ্ট হয়!
মানতে পারছি না। মনেহচ্ছে-
এভাবে দেখা না হলেই বরং ভালো হতো!  
তোমার যে মুখছবি করোটিতে লালন করে এতোটা পথ হেঁটেছি
বাকী পথটাও নাহয় শুঁয়োপোকার মতো ওভাবেই হেঁটে যেতাম!
হয়তো প্রজাপতির মতো ডানা মেলা হতো না তবু-
তবুও আমি তো জানতাম এই আকাশের নীচে ফুরিয়ে যাওনি তুমি,  
শরীরে অন্য পুরুষের ঘ্রাণ মেখে তুমি আজো আছো একই লাবণ্য আধারে!  
তোমার চুলের অরণ্যে একদিন হারিয়ে গেছে কত যুবকের চোখ
আর কেউ না জানুক, আমি তো ঠিক জানতাম।
কারণ রাবার বুলেট-টিয়ার গ্যাস, হই-হুল্লোড়ের অবসরে 
আমরা ওগুলো নিয়ে কথা বলতাম, হাসতাম।   
তুমি ছিলে প্রবল জেদি, একরোখা আর কি ভীষণ সাহসী!  
সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলে তুমি বসনে-ভূষণে-ফ্যাশনে 
আমাদের দেখা হতো মানববন্ধন মিছিলে রাজপথে আন্দোলনে  
কিংবা চায়ের কাপে ঝড় তোলা কোন আড্ডার টেবিলে-  
আন্দোলনের সাহসী উচ্চারণে শ্লোগানে তোমার ববকাট চুল
বাতাসে দোল খেতো, আছড়ে পড়তো মুখের উঠোনে।
এভাবে ক্রমাগত শোণিতে-স্বেদে মিছিলের স্বপ্ন  
একসময় আমাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নে পরিণত হয়েছিল।  
কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো, বুকলেট-লিফলেট হাতের মুঠোয় চেপে  
আমরা হেঁটেছি অনেকটা পথ। তারপর একদিন-   
সেই তুমি কিনা প্রেমে পড়লে আমার মত যুবকের আহ্বানে  
যার স্বপ্ন পূরণের জ্বালা থাকলেও, শ্রেণী সংগ্রামের অঙ্গীকার থাকলেও 
মাথার ওপরে গুঁজে দেবার মতো চালা ছিলো না কোন কালে।     
আমার মনেপড়ে সব, ভেবে অবাক হই,
টুকরো টুকরো স্মৃতি, কতো কথা!
প্রথম যেদিন চুমু খেলাম, সেদিনের কথা মনেপড়ে 
 
-একটা চুমু খেতে পারি !
 
চোখে ভিখেরীর প্রত্যাশা নিয়ে-  
বহু কষ্টে, সাহস সঞ্চয় করে কথাটা বলতে পেরেছিলাম 
অথচ রাজপথে আমি তখন প্রতিবাদী যুবক, যার দৃপ্ত আহ্বানে  
ভেস্তে যায় পুলিশের ব্যারিকেড, বুর্জোয়া শাসন, নিষেধের শৃঙ্খল!          
আর তুমি মহারানী যেন, বহুমূল্য সম্পদ-মোহর ছড়িয়ে দেয়ার মতো করে বললে,
  
-হুম। কিন্তু কোথায় ?
 
সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে টর্পেডোর মতো প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলে  
আমি সেদিন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, মাইরি!    
ভেতরে সুনামি-সাইক্লোন, তবু চেহারায় স্মার্টনেস এনে বলেছিলাম, 
 
-কেন ? কপালে!
 
তুমি হাসলে, ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির লহর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমার বেশ মনে আছে, তুমি বললে- 
 
-বাবা তো নও! চুমু খেতে পারো ঠোঁটে।
 
বিশ্বাস করো তোমার উত্তরে আমি শামুকের মতো গুটিয়ে গিয়েছিলাম।
কেননা ঐ যে বললাম, তুমি ছিলে সময়ের চেয়ে এগিয়ে-  
আর আমি চিরকালের প্রলেতারিয়েত!   
তারপর!
তারপরের ইতিহাস গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকার চেয়ে কম কিছুতো নয়!    
আজ এতোদিন পর সেলুলয়েড ফিতের মতো সব মনেপড়ে,  
তোমার ধূসর মুখের দিকে তাকিয়ে মনেহয়- 
এভাবে আমাদের দেখা হওয়াটা ঠিক হয়নি।
 

পোস্ট ভিউঃ 60

আপনার মন্তব্য লিখুন