তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনেঃ কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু রহস্য
প্রবন্ধ
ফুটনোটে জলছাপ
১
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই ধ্রুবতারা তিনতলা’র খোলা ছাদকে নন্দন কানন বানিয়েছিলেন,
তাকে ঘিরে গান-বাজনার আসর বসতো। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সরলা রায়,
অবলা বসু, চন্দ্রমুখী’র মতো
ঠাকুরবাড়িতে যারা আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া এনেছিলেন তিনি তাদের অন্যতম ছিলেন, লোকলজ্জাকে
তুচ্ছ করে স্বামীর পাশাপাশি চিৎপুরের রাস্তায় এবং গড়ের মাঠে ঝড় তুলে ঘোড়া ছুটিয়ে
যেতেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালের ১৯শে এপ্রিল জোড়াসাঁকো’র ঠাকুর পরিবারে যেন কালবৈশাখীর
ঝড় উঠলো। এই দিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের প্রিয় নতুন বউঠান, কাদম্বরী দেবী পরপারে চলে গেলেন। নিজের জীবনের পঁচিশ
বসন্ত পূর্ণ হতে না দিয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। তার এই চলে যাওয়া কতোটা যে
শূন্যতা রেখে গেছে তা বোঝা যায় শরৎকুমারী’র লেখা থেকে,
‘ফুলের তোড়ার ফুলগুলিই সবাই দেখিতে পায়, যে বাঁধনে তাহা বাঁধা থাকে তাহার অস্তিত্বও কেহ জানিতে পারে না। মহর্ষি পরিবারের
গৃহলক্ষ্মী শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী ছিলেন এই বাঁধন।’
তবে কাদম্বরী দেবী ঠিক কবে মারা যান তা নিয়ে মতান্তর আছে। প্রশান্ত কুমার পাল
বলেছেন, ‘অনুমান করা যায় ৮ ও ৯ বৈশাখ (১৯ ও ২০শে এপ্রিল)
ডাক্তাররা তাঁর জীবন রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সম্ভবতঃ ৯ বৈশাখ (২০শে এপ্রিল) রাত্রে বা ১০ই বৈশাখ (২১শে এপ্রিল) প্রভাতে তার জীবনাবসান ঘটে।’ ডাক্তার ডি বি স্মিথ তার চিকিৎসা করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবই-এ
চিকিৎসার হিসাব পাওয়া যায়, ‘ডাক্তারকে বাঙ্গাল ব্যাঙ্কের এক চেক খোদ হস্তে সোভারাম
সিং ৪০০; নগদ ঔষধি ক্রয় ও দাইয়ের ঔষধ আনিতে
ও ডাক্তার আনিতে ‘জাতাতের’ গাড়ি ভাড়া প্রভৃতির ব্যয় ইস্তক (৯ বৈশাখ) ১ বৌচর (ভাউচার)
২৫ টাকা ৬ আনা ৬ পয়সা; বধূ ঠাকুরানির পীড়া উপলক্ষ্যে তেতালার ঘরে আলোর জন্য বাতি ক্রয়
বৌচর ১ টাকা ৬ আনা; শ্রীমতী নতুন বধূ ঠাকুরানির পীড়ার জন্য রাত্রে ডাক্তার নীল মাধব
হালদার ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাবু মহাশয় এ-বাটীতে থাকায় উঁহাদের জল খাবার ও আহারের
ব্যয় ১০ বৈশাখের ১ বৌচর ৩ টাকা ২ আনা ৩ পয়সা; এই সময়ে ডাক্তারবাবুদের জন্য উইলসন হোটেল
থেকে খাবারের খরচ ৩৮ টাকা।’
তার মৃত্যুটা আত্মহত্যাজনিত বলে আইনগত দিক থেকে পুলিশকে জানানো
বাধ্যতামূলক ছিল, সেটা করাও হয়েছিল কিন্তু মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়নি। স্ক্যান্ডাল
এড়াতে করোনার কোর্ট বসেছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই। এ বাবদ সব খরচ ঠাকুর বাড়িই
বহন করেছিল। ১৪ ও ৩১
বৈশাখের ক্যাশবই-তে তার খরচের হিসাব, ‘নূতন বউঠাকুরানির মৃত্যু হওয়ার দরুণ বাবু যদুনাথ
মুখোপাধ্যায় দং কাঁউসেলের ফি ৫১ টাকা; করোনার ক্লার্কের গাড়িভাড়া ২ টাকা; উহাদিগের
জন্য ব্রান্ডি, ৩ টাকা ১২ আনা ও ৫৮ টাকা ১২ আনা।’ এই মৃত্যু সম্পর্কে
করোনার নিশ্চয়ই তার রিপোর্ট দিয়েছিলেন কিন্তু এ যাবৎ সেই রিপোর্টের কোন খোঁজ পাওয়া
যায়নি। করোনার
রিপোর্ট লোপাট করতে কত খরচ হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি।
আমরা জানি ঠাকুর বাড়ি ঐ সময় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির
জগতে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়। সেসময়ে ঠাকুর বাড়ি বিরোধী কিছু লোক ছিলেন, যারা শ্যেন
দৃষ্টিতে তাকাতেন, ছিদ্রান্বেষণ করতেন। সংবাদপত্র তাই এরকম
একটা খবরকে ছেড়ে দিত না। খবরটি যাতে সংবাদপত্রে না ছাপানো হয় সেজন্য ৫২ টাকা উৎকোচ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল খবরের
কাগজের মুখ, তাই কোন সংবাদপত্রে খবরটি ছাপা হয়নি।
কাদম্বরী দেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিমতলা শ্মশানে ১১ বৈশাখ
পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়। শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ,
অরুণেন্দ্রনাথ (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজো ছেলে, কাদম্বরীর ভাসুরের ছেলে), সোমেন্দ্রনাথ
(রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই, কাদম্বরীর দেওর), দ্বিপেন্দ্রনাথ (দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে)। কাঠ ঘি চন্দন ধুনোর খরচ ও হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিমতলায় যাওয়া-আসার
গাড়ি ভাড়ার খরচ ১৩ টাকা ২ আনা ৯ পয়সা। ঐ সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতাতেই ছিলেন
কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ে আসেননি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উপস্থিত
ছিলেন না, কেন? প্রশ্ন আসে এই মৃত্যুকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন?
জানা যায় যে, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর একমাস পরেই তিনি
জ্ঞানদানন্দিনী, সুরেন্দ্র, ইন্দিরা এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজে চেপে
বেড়াতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ‘যেমন আছিল আগে তেমনি রয়েছে জ্যোতি।’ ফিরে এসে
জ্ঞানদানন্দিনীর কাছেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরে ১৯১০ সালে রাঁচির মোরাবাদী
পাহাড়টা কিনে সেখানে বাড়ি তৈরি করেন। সেই পাহাড়ের তলায় তৈরি হলো জ্ঞানদানন্দিনীর
বাড়ি। তবে রবীন্দ্রনাথ ভুলেও কোনোদিন জ্যোতিদাদার কাছে রাঁচিতে যাননি। তবে কাদম্বরীর
মৃত্যু জ্যোতিকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল বলা যায়। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য না, তিনি জীবনের
কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার মতো প্রতিভাবান নাট্যকার সব ছেড়ে
দিয়ে অনুবাদ নিয়ে পড়ে রইলেন। জমাট আড্ডাবাজি ছেড়ে দিলেন, শোনা যায় তিনি কিছুদিনের
জন্য মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে স্ত্রীর আত্মহত্যার জন্য জ্যোতি
কোনদিন ছোটভাইকে দায়ী করেননি, কাদম্বরীর মৃত্যু দুই ভাইএর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি
করেনি। এই মৃত্যুর মাঝেই জ্যোতি খুঁজেছেন কাদম্বরীর বিদেহী সত্তাকে, আর
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নতুন করে চিনেছেন। কাদম্বরীর দেহহীন সত্তা মিশে রইল তা কবিতায়,
গানে, ছবিতে। কাদম্বরীর যখন মৃত্যু হয় তখন তার বয়স ৩৫ বছর, দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি
কেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেছেন, ‘তাঁকে ভালবাসি।’
সবমিলে কাদম্বরীর মৃত্যু পরবর্তী ঠাকুরবাড়ির লোকদের অদ্ভুত
আচরণ একটা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেটা হলো কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কী হত্যা!
নাকি আত্মহত্যা! আত্মহত্যা হয়ে থাকলে তিনি কেন
এই সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন! কেউ বা কোন ঘটনা কি তাকে প্ররোচিত করেছিল! এই নিবন্ধে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে চেষ্টা করবো। তবে তার আগে
কাদম্বরী দেবী এবং তাকে ঘিরে অন্যদের মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা
দরকার। আলোচনার সুবিধার্থে ঘটনাগুলো সময় ধরে পরপর না সাজিয়ে, প্রসঙ্গক্রমে বা যখন
যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সেখানে সাজানো হয়েছে।
২
‘ইন্দিরা দেবীর ভাষ্য অনুযায়ী, “জ্যোতিকাকামশাই
প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তাঁর প্রধান আড্ডা ছিল বির্জিতলাওয়ে আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর
সঙ্গে ওঁর খুব ভাব ছিল।” এরই মধ্যে একদিন অভিমানিনী কাদম্বরী স্বামীকে
বলেছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। গানে গানে আড্ডায় আড্ডায় সেদিন এত দেরি হয়ে গেল যে জ্যোতিরিন্দ্রের
বাড়ি ফেরাই হল না। প্রবল অভিমানে কাদম্বরী ধ্বংসের পথই বেছে নিলেন। বাড়িতে কাপড় নিয়ে
আসত বিশু বা বিশ্বেশ্বরী তাঁতিনী। সেই বিশুকে দিয়ে লুকিয়ে আফিম আনিয়ে, সেই আফিম
খেয়েই কাদম্বরী মর্ত্যজীবনের মায়া কাটালেন।’ চিত্রা দেব
এর ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বইটা থেকে বোঝা
গেল তার মৃত্যু হত্যা নয়, আত্মহত্যা। তাহলে প্রশ্ন আসে
কাদম্বরী দেবী কেন আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন? সে প্রশ্নের উত্তরে যাবার
আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার সম্পর্কের ধরণ এবং তার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের
মাঝে কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটা বোঝা দরকার। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর কবি ‘পুষ্পাঞ্জলি’তে লিখেছেন,
‘যাহারা ভাল, যাহারা ভালবাসিতে পারে,
যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহাদের কিসের সুখ!
কিছু না। কিছু না। তাহারা যন্ত্রের মতো, বীণার মতো, তাহাদের প্রত্যেক
শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে। সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়া সকলেই
মুগ্ধ হয়- তাহাদের বিলাপধ্বনি রাগিণী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিঃশ্বাস ফেলে না।’
এই বীণাটি আর কেউ নন, কাদম্বরী। এরপর কবি লিখেছেন, ‘পাষণ্ড
নরাধম পাষাণ হৃদয় যে ইচ্ছা সেই ঝন্ঝন্ করিয়া চলিয়া যায়, আর মনে রাখে না। এ বীণাটিকে তাহারা
দেবতার অনুগ্রহ বলিয়া মনে করে না- তাহারা আপনাকেই প্রভু বলিয়া জানে- এই জন্যে কখনও বা উপহাস করিয়া, কখনও বা অনাবশ্যক জ্ঞান
করিয়া, এই সুমধুর সুকোমল পবিত্রতার উপরে তাহাদের কঠিন চরণের আঘাত
করে-’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন তাঁর নতুন বউঠানের মনোবেদনার কথা,
‘যদি কেহ শুধাইত
আমি জানি কী যে সে কহিত
যতদিন বেঁচে ছিল
আমি জানি কী তারে দহিত।’
কবি জানতেন, কেননা তার জীবনের একটা বড় অংশজুরে যেমন কাদম্বরী
দেবীর ছায়া, তেমনি কাদম্বরী দেবীর অনেকটা জুরে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ সিএসপি অফিসার হবার সুবাদে জ্ঞানদানন্দিনীকে স্বামীর সাথে ভারতবর্ষের
এখানে সেখানে থাকতে হলেও, কাদম্বরী দেবীর বিয়ের পর থেকে এমনকি বিয়ের আগেও
বাজার সরকার শ্যামলালের মেয়ে হিসেবে জীবনটা কেটেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেই। ঠাকুর পরিবারের সাথে
তার ছিল অমোঘ বন্ধন। কবির কথায় বারবার ফিরে এসেছে কাদম্বরীর কথা, ‘খুব ভালবাসতুম
তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বউঠান বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার
বেঁধে দিয়ে গেছেন।’ তাই তো সারাজীবন ধরে চলে তার অনুসন্ধান,
বহু কবিতা, বহু গানে মিশে আছেন তিনি, ছবিতে ধরা পড়েছে তার চোখের আভাস। সব মিলে কাদম্বরী আজ আমাদের
কাছে বাস্তবে-কল্পনায় মেশা একটা অপরূপ চরিত্র হয়ে আছেন। কবি’র ভাষায়,
‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’
৩
পৃথ্বীরাজ সেন তার ‘কলঙ্কিত ঠাকুরবাড়ি’ বইয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে
ঠাকুরবাড়ির অভিশপ্ত সন্তান বলে অভিহিত করেছেন। কেননা অসীম সম্ভাবনা নিয়ে তিনি
পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, বড় হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক আবহে। হিন্দু স্কুল এবং
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তার কলম থেকে একে একে অনেকগুলো লেখা বের
হয়েছে, যেগুলো সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে, যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। যে তিনি
লিখেছেন ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ এর অনুবাদ, অশ্রুমতী নাটক, উত্তর চরিত, কর্পূর
মঞ্জুরী, জুলিয়াস সিজারের বাংলা, ঝাঁসির রানী, ধনঞ্জয় বিজয়, না গানন্দ, পূর্ণ
বসন্ত, পুরু বিরহ, বসন্তলীলা, মানময়ী, রত্নাবলী, শোণিত সোপান, সেই তিনি কিনা
একাধিক নারীর প্রতি অদম্য আকর্ষণে নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করেছেন।
মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যোতি’র জন্য ডাক্তার
সূর্যকুমার গুডিব চক্রবর্তীর মেয়েকে বধু হিসেবে ঠিক করলেও তার বিয়ে হলো বাজার
সরকার শ্যামলাল গাঙ্গুলীর তৃতীয় কন্যা মাতঙ্গিনী’র সাথে, জন্ম ১৮৫৯ সালের ৫ই জুলাই। প্রায় ৯ বছর
বয়সে ঠাকুরবাড়ি’র বউ হবার পর তার নাম রাখা হলো কাদম্বরী দেবী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের
প্রিয় নতুন দাদা তখন ১৯ বছর ২ মাস বয়সের যুবক। কাদম্বরী দেবী কিঞ্চিত শ্যামবর্ণা
হলেও সুন্দরী ছিলেন। বিশেষ করে তার চুল এবং চোখের প্রশংসা তখন সবাই করত। জ্ঞানদানন্দিনী বলেছেন, ‘আমরা বউয়েরা
প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম। শাশুড়ি ননদ সকলেই গৌর বর্ণা ছিলেন। প্রথম বিয়ের পর
শ্বাশুড়ি আমাদের রূপটান ইত্যাদি মাখিয়ে রং সাফ করার চেষ্টা করতেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চেয়ে বয়সে বছর দেড়েকের বড় কাদম্বরী দেবীর
সংস্পর্শে আসেন মূলত হিমালয় ভ্রমণ থেকে ফেরার পরপরই। তবে নতুন বৌঠানের সাথে সে
অর্থে ঘনিষ্ঠতা হয় আরও পরে। ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তার চেয়ে
বয়সে সামান্য বড় নতুন বৌঠানের সংস্পর্শে আসার। তাই তিনি কখনো বৌঠানের সাথে
বাড়ির ছাদে আমসত্ব পাহারা দিতে, কখনো ফাইফরমাস খাটতে বা জাঁতি দিয়ে সুপারি
কাটতে কিংবা কোন বই বা গল্প পড়ে শোনানোর দায়িত্ব মাথা পেতে নিতেন। এপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর লিখেছেন,
‘বাড়িতে আমি ছিলুম একমাত্র দেওর-বউদিদির আমসত্ত
পাহারা, তা ছাড়া আরো পাঁচ রকম খুচরো কাজের সাথি। পড়ে শোনাতুম ‘বঙ্গাধিপ-পরাজয়’। কখনো কখনো আমার উপরে ভার পড়ত জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটবার। খুব সরু করে সুপুরি
কাটতে পারতুম। আমার অন্য কোনো গুণ যে ছিল সে কথা কিছুতেই বউঠাকরুন মানতেন না, এমন-কি চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু, আমার সুপুরি-কাটা হাতের গুণ বাড়িয়ে বলতে মুখে বাধত না। তাতে সুপুরি কাটার কাজটা
চলত খুব দৌড়-বেগে।’
নতুন বউঠানকে এইযে সন্তুষ্ট করার এত প্রচেষ্টা, এর বিপরীতে
নতুন বউঠানের ‘তুমি কম্মের নও’ গোছের মন্তব্য
তাকে হতাশ করে তুলতো। এরইমধ্যে কবির মাতৃবিয়োগ ঘটলো। ১০ মার্চ ১৮৭৫ সালে অনেকদিন
রোগ ভোগের পর সারদা দেবী যখন মারা গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ১৩ বছর ১০ মাস।
‘যে রাত্রিতে তাহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে
ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ
হ’ল রে।’ তখনই বৌঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভৎর্সনা
করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন—পাছে গভীর রাত্রে
আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল।’
এ প্রসঙ্গে প্রশান্ত কুমার পাল রবিজীবনীতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের
রচনায় মায়ের উল্লেখ অবিশ্বাস্য রকমের কম। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, সারদা দেবীর
অন্যান্য সন্তানরাও কি খুব বেশি উল্লেখ করেছেন? করা সম্ভবও ছিল
না, জন্মাবার পরই পরিবারের নিয়ম মেনে তাদের দায়িত্ব দেওয়া
হত দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হাতে। তারপর পুত্রসন্তানদের
স্থান হতো ভৃত্যরাজকতন্ত্রে। অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কই ছিল না। তার ওপর সারদা দেবী
বহুসন্তানবতী হওয়াতে জীবনের অনেকটা সময় তো আঁতুর ঘরেই কাটাতে হত। তাছাড়া তিনি ছিলেন
স্থূলকায়া-ফলে নড়াচড়া করাও ছিল তার পক্ষে বিড়ম্বনা।
সারদা দেবীর মৃত্যুর পর মাতৃহীন বালকদের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতিবশতঃ
ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠা বধূ কাদম্বরী দেবী তাদের ভার গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন
বউ ঠাকরুনের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সূত্রপাত আসলে এখান থেকেই। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লিখেছেন,
‘তিনিই আমাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া আমাদের
যে কোন অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিন রাত্রি চেষ্টা করিলেন।’
কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনোগঠনে কাদম্বরীর অবদান অসামান্য। তার অকালমৃত্যু রবীন্দ্রমানসে
গভীর ছাপ রেখে যায়। একথা কবি নিজেই অসংখ্য কবিতায় ও গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। তাদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার
সুযোগ রবীন্দ্রনাথ নিজেই করে দিয়েছেন। তিনি নিজেও জানতেন সেকথা। তাই শেষ বয়সে কৌতুক
করে বলতেন,
‘ভাগ্যিস নতুন বউঠান মারা গিয়েছিলেন তাই আজও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখছি-
বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা হত।’
৪
রবীন্দ্রনাথকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলেও
তিনি নিয়মিত স্কুলে যেতেন না। পরিবারের লোকজন একারণে
এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে তারা তাঁকে ভর্ৎসনা করাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও বুঝতে
পেরেছিলেন
‘ভদ্রসমাজের বাজারে আমার দর কমিয়া যাইতেছে। …কাজেই কোন
কিছুর ভরসা না রাখিয়া আপন মনে কেবল কবিতায়
খাতা ভরাইতে লাগিলাম। সে লেখাও তেমনি। মনের মধ্যে আর কিছুই নাই, কেবল তপ্ত
বাষ্প আছে….উহার মধ্যে আমার যেটুকু সে কেবল একটা অশান্তি,
ভিতরকার একটা দুরন্ত আক্ষেপ।’ এই সময়েই
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর সাথে কবির পরিচয় হয়।
কবি বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ সংগীত আর্যদর্শন পত্রিকায় তখন নিয়মিত
ছাপা হচ্ছে। কাদম্বরী দেবী বিহারীলালের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন এবং বিহারীলালের
কাব্য অনেকটাই তার কণ্ঠস্থ ছিল। মাঝে মাঝেই তিনি কবি বিহারীলালকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। একদিন দুপুরে বিহারীলাল এসে
ঢুকলেন কাদম্বরীর ঘরে, তখন কাদম্বরী আপনমনে একটা আসন বুনছিলেন। তিনি সূচীকর্মে দারুণ
নিপুণা ছিলেন। মনের ভাবনার প্রকাশ ঘটাতেন এইসব হাতের কাজের মধ্য দিয়ে, অসমাপ্ত আসনখানি
দেখে বিহারীলাল প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। তারই ফলশ্রুতিতে দুদিন পরে আসনটার বুনন
শেষ করে তার কোণে বিহারীলালের নাম লিখে উপহার স্বরূপ কবিকে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আসনের ওপর, প্রশ্নচ্ছলে
কার্পেটের অক্ষরে লেখা ছিল ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যেরই কয়েকটা লাইন। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার উল্লেখ করে অনেক পরে ইন্দিরাকে লিখেছিলেন,
‘ছেলেবেলায় নতুন বউঠান যথোচিত উৎসাহের সঙ্গে তাঁর দেওরের অভিমান খর্ব করে এসেছেন,
সেটা আমি ন্যায্য বরাদ্দের মতোই মাথা পেতে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিলুম, কখনো ভাবতে পারতুম
না বিহারী চক্রবর্তীর গৌরবের সীমা আমি কোনো দিন পেরতে পারব। তিনি তাঁকে নিজের হাতে
পশমের আসন বুনে দিয়েছিলেন, আমি নিশ্চয় জানতুম আমার আসন মাটিতে- আদরের এই উপবাস এমন
অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আজ তার প্রাচুর্য আমার পাওনার বেশি মনে না করলেও তাতে অস্বস্তি
বোধ করি।’
কবি বিহারীলাল কাদম্বরী দেবী’র সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার
জন্যে আরেকটা কাব্য যখন রচনা করলেন তখন কাদম্বরী ইহলোকে নেই। বিহারীলাল তাঁর
উপহারকে স্মরণ করে কাব্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সাধের আসন’। আসনদাত্রীর উদ্দেশে
লিখেছিলেন,
‘তোমার সে আসনখানি
আদরে আদরে আনি,
রেখেছি যতন করে চিরদিন রাখিব;
এ জীবনে আমি আর
তোমার সে সদাচার,
সেই স্নেহমাখা মুখ পাশরিতে নারিব।’
কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার খবরে কবি বিহারীলাল শালীনতার
আড়াল না রেখেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে
ভর্ৎসনা
করে লিখেছিলেন,
‘পুরুষ কিম্ভূতমতি চেনে না তোমায়।
মন প্রাণ যৌবন-
কি দিয়া পাইবে মন।
পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।’
কবি অক্ষয় চৌধুরী লিখেছেন,
‘রাখিতে তাহার মন, প্রতিক্ষণে সযতন
হাসে হাসি কাঁদে কাঁদি- মন রেখে যাই,
মরমে মরমে ঢাকি তাহারি সম্মান রাখি,
নিজের নিজস্ব ভুলে তারেই ধেয়াই,
কিন্তু সে ত আমা পানে ফিরেও না চায়।’
সমসাময়িক কালের কবিদের কোন কোন লেখা থেকে এটা ধারণা করা যায়
যে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর জন্য তারা মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দায়ী করেছেন।
নিঃসন্তান স্ত্রীর সঙ্গহীন-শূন্যতা ভরিয়ে তোলার জন্যে একজন স্বামীর যতোটা মনযোগী
হওয়া উচিত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ততোটা হয়তো ছিলেন না। তিনি এই ব্যাপারে হয়তো কিছুটা
উদাসীন ছিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বা নতুন দা’র লেখা নাটক
‘সরোজিনী’ বা ‘চিতোর আক্রমণ’
প্রকাশিত হলো। সংস্কৃতের
শিক্ষক রামসর্বস্ব পণ্ডিত এই বইয়ের প্রুফ দেখতেন। একদিন উচ্চেঃস্বরে প্রুফ
দেখার সময় রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে ছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন,
‘গদ্য রচনাটি একেবারেই খাপ খায় নাই বুঝিয়া কিশোর রবীন্দ্রনাথ
(সবে চোদ্দ পেরিয়েছে) একেবারে আমার ঘরে আসিয়া
হাজির। তিনি বলিলেন ‘এখানে পদ্য রচনা ছাড়া কিছুতেই জোড় বাঁধিতে পারে না। প্রস্তাবটা আমরা
উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। ..কিন্তু আমি সময়াভাবে আপত্তি উত্থাপন করিলে…
রবীন্দ্রনাথ তখনই খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘জ্বল
জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ গানটি রচনা করিয়া আনিয়া আমাদিগকে
চমৎকৃত করিয়া দিলেন।’ গানটি এরকম,
জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ।
পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা।
এ জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন।
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা।।
দেখ রে যবন দেখরে তােরা।
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বাললি সবে।
সাক্ষী হলেন দেবতা তার
এ প্রতিফল ভুগিতে হবে।
এই গানটির জন্যই নাটকটা মঞ্চসফল হয়েছিল, অনেকের মতে
ঐ গানটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রথম গান। এরপর থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ
এবং অক্ষয় চৌধুরী সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চায় নিযুক্ত হলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এরফলে নিজের ওপরে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলেন। এজন্যই তিন তার নতুনদা’র প্রতি বারবার
কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন,
‘জ্যোতিদাদাই সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে সমস্ত ভাল মন্দের মধ্য দিয়া আমাকে
আমার আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিয়াছেন। …সাহিত্যের
শিক্ষায়, ভাবের চর্চায় বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান
সহায় ছিলেন।’
নতুন দা’র কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের পর থেকেই তিনি যেন
কাদম্বরী দেবীর নজরে পড়লেন। তবে আদরের দেবরের প্রতি বউদি’রা যেমন করে লেগে থাকে তেমন
করে কাদম্বরী দেবী লেগে রইলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি। কিছু বললেই, ‘গুরুমশায়গিরি
করতে হবে না’, ‘আর পাকামো করতে হবে না’, ‘জ্যোঠামি করতে হবে না’, এসব বলে রবীন্দ্রনাথকে যেন ছেলেমানুষ
করে রাখতে চাইতেন।
রবীন্দ্রনাথ হয়তো একটা কবিতা লিখে বিপুল আগ্রহ নিয়ে বৌঠানকে
দেখাতে গেলেন। কিন্তু বৌঠান মনযোগ দিয়ে পড়ে বলতেন, ‘তোমার কবিতা বিহারীলালের মত হয় না।’, ‘কোনোকালে
বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবে না।’ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের তখন শুধুই মনে হয় ‘কী করে এমন হব যে আর কোনওদিন রবির
দোষ খুঁজে না পায়।’ বউদিদির চোখে নিজেকে যতোটা দামি করে তোলার চেষ্টা
চলছিল, কাদম্বরী মুখ টিপে হেসে ততই দেবরটিকে অগ্রাহ্য করে গেছেন,
‘রবি সবচেয়ে কালো, দেখতে একেবারেই ভালো নয়,
গলা যেন কী রকম। ও কোনোদিন গাইতে পারবে না, ওর চেয়ে
সত্য ভালো গায়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
‘মনে পড়ে পয়ারে ত্রিপদীতে মিলিয়ে একবার একটা কবিতা বানিয়েছিলুম…………অক্ষয়বাবু তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই কবিতা শুনিয়ে বেড়ালেন। আত্মীয়রা বললেন- ছেলেটির
লেখবার হাত আছে। বউঠাকরুনের ব্যবহার ছিল উল্টো। কোনো কালে আমি যে লিখিয়ে
হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না। কেবলই খোঁটা দিয়ে বলতেন কোন কালে বিহারী চক্রবর্তীর
মতো লিখতে পারব না।’
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার দর্পহরণ করিবার জন্য তাহার প্রবল অধ্যবসায়
ছিল।’ নতুন বউঠানের মন্তব্য শুনে রবীন্দ্রনাথের মনটা একটু দমে যেত, কিন্তু আরো ভাল লেখার জন্য জেদটা দুরন্ত হয়ে উঠতো।
৫
কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারণ সাহিত্য-প্রেমিক ছিলেন। তিনি বাংলা বই পড়তেন
শুধু সময় কাটানোর জন্য নয়, সত্যিই উপভোগ করতেন। অথচ সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকুর জ্যোতিরিন্দ্রের
সাথে তার বিয়ে মানতে পারেন নি কারণ তার বলতে গেলে অক্ষর জ্ঞানই হয় নি। তবে অন্যান্য বধূদের
মত কাদম্বরীরও শ্বশুরবাড়িতে বিদ্যাচর্চা শুরু হয় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়, ধারাপাত প্রথম ভাগ দিয়ে। প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, সে বছরের
হিসেবের খাতায় তার জন্য ধারাপাত ও বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয়
ভাগ কেনা হয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরে এই প্রায় অশিক্ষিত বালিকাটি ঠাকুরবাড়ির মতো বিখ্যাত
পরিবারে সাহিত্য সভার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি নিজে কোনও কিছুতেই অংশগ্রহণ করতেন না। শুধু অপরের
প্রাণে প্রেরণার প্রদীপটাকে উজ্জীবিত করে তোলাই ছিল তার জীবনের ব্রত। আমরা যাকে বলি রোম্যান্টিক সৌন্দর্যবোধ তার সেটা পুরোমাত্রায় ছিল। তিনি ধীরে ধীরে গৃহকর্মনিপুণা, রন্ধনপটিয়সী,
সাহিত্য সভার সবার কাছ থেকে কেবল সমীহ আদায় করেই ক্ষান্ত হন নি,
স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে ময়দান দাপিয়ে প্রতিবেশীদের চোখ ছানাবড়া
করে দিয়েছেন। কাদম্বরী দেবীর শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধুমাত্র এইটুকুই
অনুমান করা যায়, যেহেতু সঙ্গীতরসিক পরিবারে জন্মেছিলেন, বিখ্যাত
সংগীতজ্ঞ জগম্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রি তিনি, গান তার রক্তে, তার ‘গানের কান’ অন্তত ভাল ছিল। ‘বসন্ত উৎসব’
এবং ‘মানময়ী’তে কাদম্বরী শুধু ভালো অভিনয়ই করেননি, তিনি ভালো গানও গেয়েছিলেন। তার
উদ্যোগে তিনতলার ঘরে শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ অনুশীলনও
শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার ‘নন্দনকাননে’র সান্ধ্য-সভাতেও বসতো গানের আসর।
তবে স্বামীর দৃপ্ত পদচারণার তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে কাদম্বরী খানিকটা
নিষ্প্রভ, নিভৃতচারী ছিলেন। লোকজন চারপাশে বসিয়ে অনর্গল গল্প করে আসর মাতিয়ে রাখার যে প্রবণতা
দেখা যেত সে সময়ের ড্রয়িংরুম কালচারের কর্ণধার সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ভেতর, সেটা তার
ভেতর একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। আসরের মধ্যমণি নয়, তিনি স্বস্তি পেতেন নিজের মনে একা একা থেকে,
নিজের কল্পনার আকাশে। রাজ্যের বই তার সঙ্গী ছিল একাকীত্বের। দীর্ঘাঙ্গী,গাঢ় ভ্রূ,
বড় বড় অক্ষিপল্লব, কৌতুকময় চোখ, পরিমিত বেশভূষা, কথা বলার ভঙ্গী সবকিছু নীরবে জানান দিত
তার ব্যক্তিত্বের মহিমা। জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতন না, তার সৌন্দর্য
ছিল গ্রীক দেবীর মতন। স্বল্পভাষী, রহস্যময়ী, প্রচণ্ড অভিমানী,
জেদী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মায়ের মতো স্নেহপরায়ণা,
বালিকার মতো উচ্ছল স্বভাবের। কঠিন কোমলের অপূর্ব সমন্বয়
এই নারীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই গ্রীক দেবী হেকেটি নামে ডাকতেন। কাদম্বরী দেবী পড়তেন
দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’, দুপুর বেলায় রবীন্দ্রনাথ তাকে পড়ে শোনাতেন। হাতপাখা নিয়ে হাওয়া
করতেন নতুন বউঠান, কারণ আপনমনে পড়ার চেয়ে তার শুনতে বেশি ভালো লাগতো। এপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
লিখেছেন,
‘আমার একটা গুণ ছিল- আমি ভালো পড়ে শোনাতে
পারতুম, আপন মনে পড়ার চেয়ে আমার পড়া শুনতে বউঠাকরুন ভালোবাসতেন। তখন বিজলিপাখা ছিল
না, পড়তে পড়তে বউঠাকরুনের হাতপাখার হাওয়ার একটা ভাগ আমি আদায় করে নিতুম।’ একটা একান্নবর্তী
পরিবারের খুবই সাধারণ দৃশ্য। যে কোন বাঙালি একান্নবর্তী পরিবারে এই দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক।
‘তখন পিতৃদেব জোড়াসাঁকোয় বাস ছেড়েছিলেন। জ্যোতিদাদা এসে বসলেন
বাইরের তেতলার ঘরে। আমি একটু জায়গা নিলুম তারই একটি কোণে।’ ঘরের সামনে
প্রকাণ্ড ছাদ, সেখানে এর আগে মেয়েরা আসতে পারতেন না,
অনুমতি ছিল না। ‘ছাদটাকে বউঠাকরুন একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। পিল্পের উপরে সারি
সারি লম্বা পাম গাছ; আশেপাশে চামেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা।’ কাদম্বরীর
সৌন্দর্যবোধে ছাদটা হয়ে উঠল ‘নন্দনকানন’। অন্যদিকে ‘ছাদের ঘরে
এল পিয়ানো। আর এল একালের বার্নিশ-করা বউবাজারের আসবাব। বুকের ছাতি উঠল ফুলে। গরিবের চোখে দেখা
দিল হাল আমলের সস্তা আমিরি। এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত
চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম সুর তৈরি করে যেতেন; আমাকে রাখতেন পাশে। তখনই-তখনই সেই
ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার।’ কাদম্বরী
দেবী ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ বাগানটিকে
গড়ে তুললেন। এলো নানারকম পাখি। দেখতে দেখতে বাড়িটার চেহারা বদলে গেল। গৃহসজ্জার দিকে নববধূর
প্রথম থেকেই সতর্ক দৃষ্টি ছিল। কিশোর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধকে সবেচেয়ে উঁচু তারে
বেঁধে দিয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী, সেই বাঁধন কোনদিন শিথিল হয়নি।
‘দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপোর রেকাবিতে
বেলফুলের গোড়েমালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক-গ্লাস বরফ-দেওয়া জল, আর বাটাতে ছাঁচিপান। বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে,
তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে
লাগাতে ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান……প্রায়
আসতেন অক্ষয় চৌধুরী।’
এরকম একটা সুরেলা পরিবেশকে কাদম্বরী দেবী তার উপস্থিতি দিয়ে
যেন রোমান্টিকতায় ভরে তুললেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা নিয়েও তার ভাবনা ছিল। ‘ভারতী’তে ছাপার
অক্ষরে তার নাম লেখা না থাকলেও তিনি যে ঐ পত্রিকার প্রাণ ছিলেন সেটা তার মৃত্যুর
পরে বোঝা গিয়েছিল। ‘ভারতী’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হয়ে উঠলেন ভারতী
মধুচক্রের মক্ষীরানী। কবি অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে
‘ভারতী’ জ্যোতিরীন্দ্রর মানস কন্যা। বস্তুতপক্ষে তিনতলা
তখন সর্বদা ভারতী উৎসবে মুখরিত। নাম দেয়া হয়েছিল নন্দন কানন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, নতুন কাকিমা
অর্থাৎ জ্যোতিকার স্ত্রী ছিলেন এই বৈঠকের কর্ত্রী। এখানে চলত গান, বাজনা,
কবিতার পর কবিতা পাঠ। এই আসরে মাঝেমাঝে যোগ দিতেন কবি অক্ষয় চৌধুরী
ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী ‘লাহোরিণী’, জানকীনাথ,
কবি বিহারীলাল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী এবং রবীন্দ্রনাথ এই সভার স্থায়ী
সভ্য ছিলেন, কাদম্বরী হয়ে উঠলেন এই আসরের কর্ত্রী।
৬
কাদম্বরী দেবী সন্তানহীনা ছিলেন। ১৮৭৮/৭৯ সালের
দিকে কাদম্বরীর বয়স যখন ১৯/২০ বছর, ততদিনে
তার ১০ বছরের বিবাহিত জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে। তার নিঃসঙ্গ জীবনে একমাত্র
অবলম্বন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্তর্মুখী কাদম্বরী সম্ভবত সন্তান না থাকার বেদনা ভুলতে রবীন্দ্রনাথকে
আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। তার এই যে ‘নন্দনকানন’ গড়ে তোলা,
সাহিত্য-সঙ্গীতের আসর, এসবই
সেই বেদনা ভোলার জন্য। তার এরকম মানসিক অবস্থার মাঝেই লন্ডন যাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের জোড়াসাঁকো ত্যাগ করার পরই, কাদম্বরীর মধ্যে একটা শূন্যতা নেমে আসে। ঠিক একই সময়ে রবীন্দ্রনাথের
বড় বোন ও বিখ্যাত কবি স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী, জানকীনাথ ঘোষালও ব্যারিস্টারি
পড়ার জন্য ইংলন্ডে যান। যাবার আগে, চার সন্তানসহ স্বর্ণকুমারীকে জোড়াসাঁকোতে রেখে
যান। ছোট সন্তানটির নাম ছিল ঊর্মিলা, বয়স বছর পাঁচেক। কাদম্বরী যেন আকড়ে
ধরলেন তাকে। সন্তানহীনা এক রমনী যেন একটা অবলম্বন পেলেন। ঊর্মিলাও নতুন মামী বলতে
অজ্ঞান। একমাত্র ইস্কুলে যাবার সময়ই সে নিজের ভাইবোনদের সঙ্গে যেত, ফিরে এসে
আবার নতুন মামীর স্নেহচ্ছায়ায়। কয়েক মাস কাদম্বরী দেবীর ভালই কাটলো। অন্ততঃ রবিহীন থাকার
যন্ত্রণায় তিনি কাতর, এমন কিছু মনে হল না। উর্মিলার খাওয়া পড়া থেকে
সব দায়িত্বই স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।
১৮৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাদম্বরীর ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে
গিয়ে নিচে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে উর্মিলার মৃত্যু হয়। এই ঘটনাটা তার মনে
যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছিল। কাদম্বরী দেবী আবার নিঃসঙ্গ হলেন, সঙ্গে এলো
অবসাদ, বিষন্নতাবোধ এবং অপরাধবোধ। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যা-নাতি-নাত্নিদের কলরবে ঠাকুরবাড়ি যখন কলকাকলিতে মুখরিত,
তখন কাদম্বরী বিষাদের সাগরে নিমজ্জিত। শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে এমনিতেই
তিনি ছিলেন দেমাগী, মিশতে পারে না। এর উপরে ঊর্মিলা যখন মারা গেল, আত্মীয়স্বজন-ঝি-ঠাকুর সবাই কানাঘুষা করা শুরু করলো, কাদম্বরী হলো আঁটকুড়ি, হিংসা করে খেয়ে ফেলেছে এত্তটুকুন
মেয়েটাকে।
৭
সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফেরার পর ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহলে
পরিবর্তনের হাওয়া আনেন। তার বক্তব্য, পর্দা প্রথা আমাদের জাতির নিজস্ব নয়,
মুসলমান রীতির অনুকরণ। অবরোধ প্রথা আসলে অনিষ্টকর কুপ্রথা। রবীন্দ্রনাথ যেমন
ছিলেন নতুনদা ভক্ত, তেমনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন তার মেজদা, সত্যেন্দ্রনাথের ভক্ত। এতটাই যে, কলকাতায় পড়াশুনা ছেড়ে মেজদার
সাথে বোম্বাই চলে যান। জ্ঞানদানন্দিনী তার প্রিয় বৌঠান ছিলেন। সেখানে দাদা-বৌদির সঙ্গে
প্রায় ০৭ মাস ছিলেন। সেখানেই তিনি ফরাসি শিখেছেন, ছবি আঁকা এবং সেতার শিক্ষাও
করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার জীবনে সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,
‘…মেজদাদা বিলাত হইতে ফিরিয়া আমাদের পরিবারের যখন আমূল পরিবর্তনের
হাওয়া বহাইয়া ছিলেন, তখন আমারও মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। তখন হইতে আর আমি
অবরোধ প্রথার সমর্থক নহি; বরং ক্রমে একজন সেরা নব্যপন্থী হইয়া উঠিলাম…
স্ত্রী স্বাধীনতার শেষে আমি এতবড় পক্ষপাতী হইয়া পড়িলাম যে,
গঙ্গার ধারের কোন বাগান বাড়িতে সস্ত্রীক অবস্থানকালে আমার স্ত্রীকে
আমি নিজেই অশ্বারোহন পর্যন্ত শিখাইতাম। তাহার পরে জোড়াসাঁকোতে আসিয়া
দুইটি আরব ঘোড়ায় দুইজনে পাশাপাশি চড়িয়া বাড়ি
হইতে গড়ের মাঠ পর্যন্ত প্রত্যহ বেড়াইতে যাইতাম। ময়দানে পৌঁছিয়া দুইজনে
সবেগে ঘোড়া ছুটাইতাম। প্রতিবেশীরা স্তম্ভিত হইয়া গালে হাত দিত। রাস্তায় লোকেরা
হতভম্ব হইয়া থাকিত…এইরূপে অন্তঃপুরের পর্দাতো উঠাইলামই, সঙ্গে সঙ্গে চোখের
পর্দাটিও একেবারে উঠিয়া গেল।’
প্রিয় ছোটভাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর বিয়ে
নিয়ে পরিবারে খানিকটা মতভেদ দেখা যায়, পাত্রী নির্বাচন করেন
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে। সত্যেন্দ্রনাথ তখন জোড়াসাঁকোতে ছিলেন না। তার ইচ্ছে ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে
তিনি বিলেত নিয়ে যাবেন। তার ধারনা ছিল যে, বিয়ে হয়ে গেলে, জ্যোতিকে
আর বিলেত যাওয়া সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়তঃ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত যাবার
আগেই নারী জাগরণের পক্ষপাতি ছিলেন। বিলেত থাকাকালীন
তার সেই বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হয়। তাই তিনি বলেন, ‘শ্যাম গাঙ্গুলীর ৮ বৎসরের মেয়ে। আমি যদি নতুন হইতাম, তবে কখনই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ
কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।’ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও তিনি কাদম্বরী দেবীর পিতা
শ্যাম গাঙ্গুলীকে কখনো ভালো চোখে দেখেন নি এবং শ্যাম গাঙ্গুলী সম্পর্কে তার ভালো ধারনা
ছিল না। তাই শ্যাম গাঙ্গুলীর মেয়ে ভালো মেয়ে হতে পারে না বলে তিনি এক পত্রে মত প্রকাশ
করেছিলেন, ‘শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনোই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে-
কোনো অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আমার বাল্যকথা’য় কাদম্বরীর ঠাকুরদা জগম্মোহন
সম্পর্কে লেখেন,
‘তখন ১১ মাঘের উৎসব খুব ধুমধামে সম্পন্ন হত। ঐ উপলক্ষ্যে একবার একদল মিলে পলতার
বাগানে গিয়ে বড়ই আমোদ আহ্লাদ করা গিয়েছিল; সেদিনের ব্যাপার আমার বেশ মনে পড়ে। ভোজের
কর্মকর্তা ছিলেন জগমোহন গাঙ্গুলী। লোকটি বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ, -তাঁর ভুঁড়িটিও
অতুলনীয়। এমন সৌখিন আমুদে অথচ কর্মিষ্ঠ মানুষ আমি কখনো দেখিনি। খাওয়া-পরা-ওঠা-বসা,
প্রত্যেক কাজে তাঁর কারিগরি প্রকাশ পেত। রান্নাবান্ন ঘরকন্না-পোষাক সাজসজ্জা, কারুকার্য,
ছুতরের কামারের কাজ-সকল কর্মেই তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমরা ছেলের দল
তাঁর বড় নেওটা ছিলুম- তাঁর ঘরে গিয়ে খেলা করতুম;- তাঁর মুখের পান কি মিষ্টি লাগত।
তাঁর ভুঁড়িটি আমাদের আদরের সামগ্রী ছিল আর তিনি সকালে যে নাকডাকানী গম্ভীর আওয়াজে
দিগ্বিদিক প্রতিধ্বনিত করতেন আমরা ভোরে উঠে তাই শুনতে যেতুম। তিনি একপ্রকার আমাদের
বাড়ির দ্বারপাল ছিলেন।’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বরীর বাবা বা দাদা সম্পর্কে
মনোভাব উপরের লেখাগুলো থেকে বোঝা যায়। তবে
তার আপত্তি থাকলেও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল, এবং সেটা
তিনি পত্রের মাধ্যমে ছেলেকে জানিয়েছিলেন,
‘জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এই-ই ভাগ্য। একে ত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেনীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে
যোগ দিতে চাহে না, তাহাতে আবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুষ্ঠানের জন্য পিরালীরা আমাদের ভয়
করে। ভবিষ্যৎ তোমাদের হস্তে- তোমাদের সময় এ সঙ্কীর্নতা থাকিবে না। দেবেন্দ্রনাথের কথাতেই
স্পষ্ট তাঁর পরিবার ঐ সময় আর্থিক দিয়ে স্বচ্ছল হলেও, সামাজিক
দিক দিয়ে একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। বস্তুতঃ তারা ছিলেন এক ঘরে।’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিয়েতে অমতের অবশ্য আরো একটা কারণ
ছিল, সেটা প্রকাশ পায় তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর এক পত্রে, চিঠিতে জ্ঞানদানন্দিনী উল্লেখ করেছেন,
‘যে সূর্যকুমার চক্রবর্তীকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ডাক্তারী শেখাতে বিলেত
নিয়ে গিয়েছিলেন তার বড় মেয়ে মিস্ কার্পেনটারের সঙ্গে বিলেত থেকে এসেছিল। …সে আমার
বড় ছিল। শ্যামলা রঙের উপর তার মুখশ্রী ভাল ছিল। তাকে আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের
সঙ্গে বিয়ে দিতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল, কলকাতায় এসে তাকে দেখিয়েও ছিলুম।’
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর
বিয়ে হলো বটে কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী কখনই কাদম্বরীকে ‘জা’ হিসেবে মেনে নেননি।
তিনি কাদম্বরীকে ‘গরিবের মেয়ে’, বন্ধ্যা বলে খোঁচাতেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার
ঘনিষ্ঠতাকেও ভালোভাবে নেননি। পাছে কাদম্বরীর সাথে ঘর করতে হয় তাই কলকাতায় ফেরার পর
তিনি পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে এবং পরে উড স্ট্রিটে থাকতেন। কাদম্বরীর সেই অপমান ও
একাকীত্বের মধ্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউই তার পাশে এসে দাঁড়াননি। যাহোক
ঠাকুর পরিবারের এই বিয়ের খবর ১৮৭০ সালের শ্রাবণ সংখ্যার তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল,
‘গত ২৩ আষাঢ়, ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য
শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পঞ্চমপুত্র শ্রীমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সহিত কলিকাতা নিবাসী শ্রীযুক্তবাবু শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যার
যথাবিধি ব্রাহ্মধর্মের পদ্ধতি অনুসারে শুভবিবাহ সমারোহপূর্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বিবাহসভায় বহু সংখ্যক
ব্রাহ্ম এবং এতদ্দেশীয় প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণ সকল উপস্থিত ছিলেন। দরিদ্রদিগকে প্রচুর
তক্ষ্যভোজে পরিতৃপ্ত করিয়া বিস্তর অর্থ প্রদান করাও হইয়াছিল।’
দেবেন্দ্রনাথ বিয়ে ঠিক করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি
এই বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলেন। কারণ সেই সময় তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের
উপস্থিত থাকার কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। বিয়ের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন গণেন্দ্রনাথ। বেশ সমারোহ করেই
এই বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও বিয়ে
হয়েছিল হিন্দু প্রথায়। বিবাহ উপলক্ষ্যে বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় জুতো
ইত্যাদি উপহারস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল। এখানে প্রশান্ত কুমার পালের একটি প্রাসঙ্গিক মতামত দেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,
‘জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্বন্ধে দেবেন্দ্রনাথের মনে কোন কারণে ক্ষোভের
সঞ্চার হয়েছিল। যার জন্যে তিনি বাড়িতে ফিরতে অনিচ্ছুক ছিলেন, ফলে জ্ঞানদানন্দিনীর
অন্য কোন বাড়িতে থাকার কথাও চিন্তা করা হচ্ছিল ইত্যাদি এক অনির্দেশ্য পারিবারিক অশান্তির
ইঙ্গিত সত্যেন্দ্রনাথের পত্রের মধ্যে পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর
বোম্বাই যাত্রার পূর্বেই বাড়িতে ফিরে আসেন।’
কাদম্বরী দেবী আর জ্যোতিরিন্দ্রের বিয়ে হলেও ঠাকুরবাড়ির অনেকেই
কিন্তু কাদম্বরী দেবীকে নিচু চোখে দেখতো। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
যেমন প্রায়ই বলতেন,
‘নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কী যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায়
ওর বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায়
এতটাই নীচু হয়, সেই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায় হয়তো, সুখী হওয়া
যায় না। নতুন তো সারাক্ষণ আমার কাছেই পড়ে থাকে। গান বাজনা থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের
দুঃখটা ভুলে আছে।’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যতোই অমত থাকুক কিংবা জ্ঞানদানন্দিনী
যাই বলুন না কেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই বিয়েতে যে খুব অখুশি ছিলেন তা কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথের এই
লেখাটি পড়লে তা একবারও মনে হয় না। তিনি লিখেছেন,
‘দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপার রেকাবিতে
বেলফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক গ্লাস বরফ দেওয়া জল আর বাটিতে ছাঁচি
পান। বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে
আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের
গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনো তা ফিরিয়ে নেননি। সূর্যডোবা আকাশে ছাদে ছাদে
ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায়
যেত আকাশ ভরে।’
কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে জ্যোতি হয়তো তেমন অখুশি ছিলেন না এবং এই বিয়ের ফলে কাদম্বরী
দেবী ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে গেলেও তার বাবা শ্যামলাল গাঙ্গুলীর অবস্থানের কোন
পরিবর্তন হয়নি। তিনি স্বল্প মাসোহারায় জোড়াসাঁকোর বারবাড়ির খাটাখাটুনি নিয়েই পড়ে থাকলেন,
এরকম দুটো ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে ঠাকুরবাড়ির
সামনের বাগানে গোল পাঁচিল দেয়ার, বাগানের ভিতরে বেড়ানোর জন্য পথ তৈরি করার এবং আস্তাবলের
সামনে পাঁচিল দেয়ার দায়িত্ব পড়ে শ্যামলালের উপরে। এই কাজের জন্য তাকে ১০০ টাকা আগাম
দেয়া হয়। পাঁচিল দেয়ার কাজ থেকে শুরু করে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাদেবীর বিছানা
‘দুরস্ত’ করার দায়িত্ব, সবই পড়ত শ্যামলালের ঘাড়ে। কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির বউ হলেন বটে
কিন্তু শ্যামলাল ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারই থেকে গেলেন। সেজন্য বাজার সরকারের কালো মেয়ে,
এই পরিচয় থেকে কাদম্বরী দেবীর কোনদিনই মুক্তি মেলেনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর,
ঠাকুরবাড়ির বেয়াই, এই সামাজিক পরিচয়ে কোনদিনই নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেননি বাজার সরকার
শ্যামলাল গাঙ্গুলী। এর একটা কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীচ-তলার ঠাকুরবাড়ি নিয়ে লেখা
থেকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে,
‘ছেলেবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি, নিঃসহায় অনাথা আশ্রয় পেয়েছে। প্রকাণ্ড বাড়িটি
তাদের বসবাসে একেবারে পায়রার খোপের মতো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিবাসিনীদের অবস্থা তখন
অতি শোচনীয় ছিল। তাদের অশিক্ষিত মন আত্মাবমাননাতে পূর্ণ হয়ে থাকত। তারা কখনো আত্মমর্যাদা
অনুভব করতে পারেনি। তখনকার দিনে দেশের অন্যান্য মেয়েদের মতো অভ্যস্ত অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের
মধ্যে তারা জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা পরস্পরে ঈর্ষা করেছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির
দ্বারা যত রকম কুচিন্তার প্রশ্রয় দিয়েছে। মানুষের জগতে তাদের স্থান কত তলায়, তা বোধ
করিবার শক্তি তাদের ছিল না। … বাড়ির আবহাওয়া একেবারে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল।’
মনে রাখতে হবে শ্যামলাল এবং তার মেয়ে কাদম্বরী ছিলেন এই বিষাক্ত নীচতলার বাসিন্দা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে নীচ-তলার বাসিন্দাদের প্রতি ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মনোভাব
বোঝা যায়। এজন্যই কাদম্বরী ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্দরপুরে। মাঝে মাঝে চকিত
অবসরে কাদম্বরী দেখতে পেতেন তার শীর্ণকায় পিতাকে, মাথা নিচু করে দু’হাতে দুটি বাজারের
থলে নিয়ে অতিদ্রুত রান্নাঘরে প্রবেশ করছেন। তবে শ্যামলাল গাঙ্গুলীকে এই অপমানের হাত
থেকে বাঁচাতে গাজীপুরের জমিদারিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
৮
স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকু্রের দিনরাত ব্যস্ততা তার কাজ, নাটক,
নোভেল নিয়ে। এছাড়াও সময় সুযোগ পেলেই
তিনি ছুটে যেতেন বির্জিতলাওয়ে মেজবউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে, আগেই উল্লেখ
করেছি। তাদের স্বামী-স্ত্রীতে মনের মিল তেমন না থাকায় কাদম্বরী কখনো স্ত্রীর মর্যাদা
পুরোপুরি পাননি। যে তলার মানুষের সাথে তার স্বামীর চলাফেরা, সেখানে ঠিক
মানিয়ে নিতে পারতেন না কাদম্বরী। তাই তার একাকী সময় কাটতো জোড়াসাঁকোর তেতলায়। তার একাকীত্ব আর
অবসাদের জীবনে ছোট্ট একটা ছুটির মতন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ৯ বছর বয়সে বউ
সেজে যে টুকটুকে মেয়েটি এসেছিল, তার সাথে রবির ভাব করে নিতে এতটুকু বেশি সময়
লাগেনি। প্রায় ২ বছর বয়সের ব্যবধান, প্রায় সমবয়সী দেখে বন্ধুত্বও ছিল সমানে সমানে। রবির যতো টুকিটাকি
আবদার সব সে এসে করতো নতুন বউঠানের কাছে। আর বউঠান শুনতে চাইতো রবির লেখা নতুন কোন কবিতা
অথবা গল্প। পরস্পরের সান্নিধ্যে তারা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল দিনগুলি।
দুইবার বিলেত থেকে পড়াশুনা শেষ না করেই ফিরে আসা রবির যখন আত্মীয়স্বজনের
বাক্যবাণ থেকে বাঁচতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সে সময় তার ত্রাণকর্তা হিসেবে রঙ্গমঞ্চে এলেন
নতুনদা। দাদা-বউদির সাথে তিনি অবকাশ যাপন করতে লাগলেন চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ
কয়েকমাস জ্যোতিদা এবং নতুন বৌঠানের সঙ্গে কাটান, আর এই সময়টুকু নিয়েই যতো জল্পনা,
যত কৌতুহল। কতদিন ছিলেন এখানে? রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন ৫/৭ মাস, অথচ জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন, এক বছর। প্রশান্ত কুমার পাল বলেছেন, এই বাগান বাড়িতে কতদিন ছিলেন,
বলা যাবে না। আবার আরেক জায়গায় তিনিই বলেছেন, মোরাম সাহেবের
বাগানে রবীন্দ্রনাথ যে কয়টি মাস জ্যোতিরিন্দ্র ও কাদম্বরীর সঙ্গে বাস করেছিলেন…….
নিত্যপ্রিয় ঘোষও বলেছেন, ৫-৭ মাস। আরেকটি সূত্র অনুযায়ী মে থেকে নভেম্বর, ৭ মাস। তবে তিনি সেখানে
যতদিনই থাকুন না কেন, তার সুখস্মৃতি রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন বহন করেছেন। এই বাগানবাড়ির দিনগুলির
কথা তাই ঘুরে ফিরে অনেকবার এসেছে তার লেখায়। সেই সময়েই যেন লেখার বান ডেকেছিল। নিভৃত সাহিত্যচর্চার
এই সময়টি ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম সুন্দর সময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
‘আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ করা পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি
করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়ম-যন্ত্র যোগে
বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’- পদটিতে
মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন
খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম, কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা
লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম—জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন,
আমি গান গাহিতাম, পূরবী রাগিনী হইতে আরম্ভ করিয়া
যখন বেহাগে গিয়া পৌঁছিতাম তখন পশ্চিমতটের আকাশে সোনার কারখানা একবারে নিঃশেষে দেউলে
হইয়া গিয়া পূৰ্বান্ত হইতে চাঁদ উঠিয়া আসিত। আমরা যখন বাগানের ঘাটে ফিরিয়া
আসিয়া নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করিয়া বসিতাম তখন জলেস্থলে শুভ্রশান্ত নদীতে নৌকা
প্রায় নাই, তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড় নদীর তরঙ্গহীন প্রবাহের উপর আলো
ঝিকঝিক করিতেছে।’
সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন কাদম্বরী
দেবী। কী অসাধারণ সূক্ষই না ছিল তার রুচিবোধ, সৌন্দর্যবোধ আর সাহিত্যজ্ঞান! লেখার প্রশংসা, প্রেরণা কিংবা সমালোচনা, কাদম্বরীর জায়গা নিতে পারেনি পরবর্তীতে কেউই। রবির অসংখ্য লেখায় কিংবা
গানে ছায়া পাওয়া যায় শ্রীমতি হে’ এর। একই সাথে তিনি ছিলেন রবির
দেবী, হৃদয়ের রাণী, খেলাঘরের সাথী, বিচক্ষণ
পাঠিকা। তার রূপের বর্ননা, তাদের কাটানো সময়ের কথা, তাদের খুনসুটি এসব
নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গান। ‘বউঠাকুরানির
হাট’ উপন্যাসের পরিকল্পনা তিনি দুপুরবেলা বউঠানের পাশে বসে হাতপাখার
বাতাস খেতে খেতেই করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কাদম্বরী দেবীর ‘স্নেহের
ভিখারি’ বলেছেন। নিত্যপ্রিয় এই ‘স্নেহের’
মানে করেছেন একরকম, কিন্তু তপোব্রত ঘোষ বা শুভেন্দু
দাশমুন্সির মত ভিন্ন। একেবারে অভিধান থেকে স্নেহ শব্দের মানে বার করলেন, বিশেষ্য
‘স্নেহ’ শব্দের প্রধান আর প্রথম অর্থই হল—প্রেম, প্রীতি, প্রিয়তা হার্দ। ক্রিয়াপদ স্নেহকরা
মানে হল, ভালোবাসা, প্রীতিকরা। এমন কি রবীন্দ্রনাথের স্নেহগ্রাম
কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শুভেন্দু দাশমুন্সি দেখিয়েছিলেন, স্নেহের
অর্থ প্রেমঃ ‘দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায়। কিশোর প্রেমের মৃদু
প্রদোষ কিরণে/আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো কাদম্বরী দেবীকে ভালোবাসতেন, তবে সেটা
কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেন নি।
তপোব্রত ঘোষ তার রবীন্দ্র জিজ্ঞাসুর ডায়েরিতে বলেছেন, ‘স্পষ্টোচ্চারিত
ভাষায় কাদম্বরীর প্রতি নিজের প্রেমানুভূতিকে প্রকাশ করাটা এই দেশের এবং এই কালের একজন
সামাজিক মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একেবারে অসম্ভব ছিল।’ হেমন্তবালা
দেবীর রবীন্দ্রস্মৃতির গোড়াতেই ‘যাকে ভালবাসতেন কে তিনি?’
এই প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ
পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যা বলার নয় তা কেমন করে বলব?’
তপোব্রত ঘোষ আরো লিখেছেন, কিন্তু প্রকাশ ধর্মই
যেহেতু কবি ধর্ম, তাই এহেন ভাবাবস্থাতেও রবীন্দ্রনাথ কবিতায়
লিখেছেন,
‘মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কতজনে কত করে পরিহাস,
পাছে সে না পারি সহিতে
নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়’
‘ভগ্নহৃদয়’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার সময় কবি বদলে দিলেন
উৎসর্গের বিভঙ্গ। লিখলেন ‘শ্রীমতী হে’-কে উপহারঃ
হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমুখী শত শত
এই মুখ পানে চেয়ে ফুটিয়া উঠিছে যত।
সজনীকান্ত দাস সরাসরি কবি’কে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হে’ কে? কবি
সজনীকান্ত দাস পালটা প্রশ্ন করেন, ‘তোমার কি মনেহয়?’ সজনীকান্ত বলেছিলেন,
‘হেমাঙ্গিনী। অলিকবাবু’তে আপনি অলীক ও কাদম্বরীদেবী হেমাঙ্গিনী সাজিয়াছিলেন। সেই
নামের আড়ালের সুযোগ আপনি গ্রহণ করিয়াছিলেন।’ কবি স্বীকার করেন, ‘ইহাই সত্য অন্য সব
অনুমান মিথ্যা।’ তবে ইন্দিরা মনেকরেন ‘হে’র পুরোনাম হেকেটি, গ্রিক পুরাণের
ত্রিমুণ্ড দেবী, সংক্ষেপে কাদম্বরী’র ডাকনাম। অন্তরঙ্গ মুহুর্তে রবীন্দ্রনাথ নতুন
বউঠানকে ‘হেকেটি’ নামে ডাকতেন কেননা তিন-তিনজন পুরুষ কাদম্বরীকে অধিকার করেছিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং বিহারীলাল চক্রবর্তী। কাদম্বরীর চোখে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বর্গের দোসর, রবীন্দ্রনাথ অতলান্ত সমুদ্রের প্রতীক আর
বিহারীলাল মর্ত্যলোকের বাসিন্দা। রবীন্দ্রনাথ কোন এক জায়গায় ইন্দিরাকে লিখেছিলেন, ‘জীবনে জ্ঞাত
এবং অজ্ঞাতসারে অনেক মিথ্যাচরণ করা যায়। কিন্তু কবিতায় কখনো মিথ্যা
বলিনে- সেই আমার জীবনের সমস্ত গভীর সত্যের একমাত্র আশ্রয়স্থল।’ এখানে রবীন্দ্রনাথ
নিজেই স্বীকার করেছেন, ব্যক্তিজীবনে যদিও বা কোন মিথ্যাচরণ করে
থাকেন—অর্থাৎ কাদম্বরীর প্রতি প্রেমকে স্বীকৃতী না দিয়ে থাকেন,
সাহিত্যে কিছু লুকোন নি, কখনো মিথ্যা বলেন নি।
৯
ইংল্যাণ্ড থেকে কোন পরীক্ষা না দিয়েই রবীন্দ্রনাথকে ফিরে আসতে
হয়েছিল কলকাতায়। সেও এক দুঃসময়কারণ সিভিল সার্ভিস বা ব্যারিস্টারি পাস না করেই। ফিরে আসার জন্য অনেক
বক্রোক্তি শুনতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। পুরো ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথকে ব্যথা দিয়ে থাকবে, তাই পিতার
কাছে অনুমতি চান আবার ইংল্যাণ্ড যাবার জন্য। দেবেন্দ্রনাথ অনুমতি দেন
এই আশা পোষণ করে যে, সৎপথে থেকে কৃতকার্য হয়ে যথা সময়ে দেশে ফিরবে। রবীন্দ্রনাথ অনুমতি
পান ১৮৮০ সালের আগষ্ট মাসে, যাবার কথা ছিল সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু হঠাই কোন
এক অজ্ঞাত কারণে বিলেত যাওয়া বন্ধ হল। যেহেতু কারণটি অজ্ঞাত, তাই গুজবও
অফুরন্ত। তবে প্রায় সব রবীন্দ্ৰজিজ্ঞাসুই মেনে নিয়েছেন ঐ সময়ে কাদম্বরী
আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। আমরা জানি, কাদম্বরী দেবী মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।
শুধু মোরান সাহেবের বাগানে বা সদর স্ত্রীটেই নয়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
যেখানেই সস্ত্রীক গেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গী হয়েছেন। এমনকি কাদম্বরী দেবী
এই সময় অসুস্থ হয়ে পড়ায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্ত্রীকে নিয়ে হাওয়া বদলের জন্য দার্জিলিং
যেতে মনস্থ করেন। কারণ তার মনে হত হাওয়া বদল করলেই শরীর সুস্থ হবে। দার্জিলিং যাবার
সময় দেখা গেল, রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গী। পরবর্তীকালে, জ্যোতিদম্পতি
যখন কারোয়ায় যান, তখনও
রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন স্ত্রীকে নিয়ে বোম্বের দিকে কোন পাহাড়ে
গিয়েছিলেন, সেখানেও কাদম্বরী দেবী ভানুর অনুপস্থিতি অনুভব করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে কাদম্বরী দেবীর নন্দন কানন প্রায়
শুকিয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। এর একটা কারণ অবশ্য এই যে, অসুস্থতার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
দীর্ঘকাল অনুপস্থিত ছিলেন। প্রায় দুই বৎসর পর রবীন্দ্রনাথের ফিরে আসার কিছুদিন পরে বা
আগেই জ্যোতিরিন্দ্র কাদম্বরীও ফিরে এলেন। ‘নন্দন কাননে’ আবার বসন্ত
এল। আবার আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল ‘ভারতী’র দপ্তর বা নন্দন
কানন। কিছুদিনের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তো বটেই, বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিনাট্য
‘মানময়ী’ অভিনীত হল। আর প্রধান তিনটি
চরিত্রে অবতীর্ন হলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরীদেবী এবং রবীন্দ্রনাথ। কিছুদিন পরই ‘মানময়ী’
কিঞ্চিৎ সংশোধিত হয়ে হ’ল, ‘পুনর্বসন্ত’—যথার্থ। নামকরণ।
১০
তেলেনিপাড়ায় বাঁড়ুজ্যের বাগানবাড়ি থেকে চন্দননগরের
মোরানসাহেবের বাগানবাড়ি, এবং সেখান থেকে পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের ১০
সদর স্ট্রিটের বাড়ি, সবখানে জ্যোতিদাদা-নতুন বউঠানের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
অবস্থান। একের পর এক কবিতা লেখা হতে থাকলো, প্রকাশিত হতে থাকলো। তবে গোল বাঁধলো
‘ভারতী’ পত্রিকার জুন ১৮৮৩ মাসের লেখাটা প্রকাশিত হবার পর,
‘সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে,
সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে, আর একজন যে আমার পাশে
দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শে হিজিবিজি
কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়া ছিল।
তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি
ছাপা হইয়া গেল।’
ভারতী পত্রিকায় এই লেখা ছাপা হওয়ার পরেই ঠাকুরবাড়ির
অন্দরমহলে দেখা দিল অন্ধ বেগে ধেয়ে আসা ঝড়ের অশনি সংকেত। রবীন্দ্র-কাদম্বরী
সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। তড়িঘড়ি করে বিয়ের ঠিক হলো রবীন্দ্রনাথের।
এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই’, বলতেন ‘আমার বিয়ে যা-তা করে
হয়েছিল।’ এই বিয়ে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই নিস্পৃহ ছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবীকে
বলেছেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই।’ বৌঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন,
আমি বল্লুম, ‘তোমরা যা হয় কর, আমার কোন মতামত নেই।’ প্রথম দিকে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বড় মাপে। দাসী পাঠিয়ে মেয়ে
পছন্দ করা পুরনো ব্যাপার, তাই এবার একটা কমিটি তৈরি হলো, জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। তারা সদবলে মেয়ে খুঁজতে গেলেন যশোরে- সেখান থেকেই
ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ বউ এসেছিলেন। মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর বাবার বাড়ি নরেন্দ্রপুরে
গিয়ে উঠলেও দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশেপাশের সব গ্রামের
বিবাহযোগ্য মেয়েই দেখা হয়ে গেল কিন্তু বউঠাকুরানিদের মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া গেল
না। তাই শেষকালে ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সাথেই বিয়ে
ঠিক করা হলো। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হলো। তবে কাদম্বরী দেবী অসুস্থ
হয়ে পড়ায় বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। জ্ঞানদানন্দিনীর তত্ত্বাবধানেই সবকিছু সম্পন্ন
হয়, অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে। ইন্দিরা দেবীর বর্ণনা অনুসারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী
দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী, রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে
বালিকা ইন্দিরাদেবী ও তার ভাই কণে দেখতে গিয়েছিলেন যশোরে। কিন্তু অনেক চেষ্টা
করেও কোন পাত্রী পছন্দ হল না। অগত্যা জোড়াসাঁকোর কাছারির একজন কর্মচারির কণ্যাকেই মনোনীত
করা হলো।
রবীন্দ্রনাথের এই বিয়ে নিয়ে নিস্পৃহতার অনেক কারণ থাকতে পারে, প্রথমতঃ
বিয়ে করার জন্য পিতার চাপ ছিলো। রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে বেশ
নাম করেছেন অথচ পাত্রী নির্বাচন করা হয়েছে এমন একজনকে, যার বয়স বড় জোর ১০ বছর এবং
যিনি প্রায় অশিক্ষিতা। দ্বিতীয়তঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ততদিনে আনা তড়খড় বা স্কট তনয়া
লুসি’র মতো মেয়েদের ভালবাসা পেয়েছিলেন। তৃতীয়তঃ ঐ সময়টাতে আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ
ও কাদম্বরীর মাঝে সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে, প্রভাত সংগীত কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে
তার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। যাইহোক অত্যন্ত সাধারণ ভাবে বা যেভাবে বিয়ের পর্বটা সমাধা হয়েছিল তা আসলেই অভূতপূর্ব। বিশেষ করে ঠাকুর
বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের বিয়ের কথা এবং ঐ বয়সেই রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট খ্যাতিলাভের
কথা মনে রাখলে একথা বলতেই হবে।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম ছিল ভবতারিনী, বিয়ের পর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাম রাখলেন মৃণালিনী। বিয়ের পর ভবতারিণীর
শুরু হলো মৃণালিনী হয়ে ওঠার শিক্ষা। প্রথমে মহর্ষির নির্দেশে ঠাকুরবাড়ির
আদব-কায়দা-বাচনভঙ্গির ঘরোয়া তালিম নিলেন সেজ বউঠান নীপময়ীর কাছে। তারপর নীপময়ীর
মেয়েদের সাথে লোরেটো হাউসে পড়তে যেতেন। মতান্তরে তিনি আধুনিকা হবার তালিম
নিয়েছিলেন মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে। তবে লোরেটোয় তাকে অন্যান্য ছাত্রীদের
সাথে না পড়িয়ে আলাদাভাবে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ফুলতলির ভবতারিণী
একসময় হারিয়ে গেলেও স্কুলের ইংরেজি শিক্ষা, পিয়ানো শিক্ষা, সঙ্গীতের শিক্ষা,
হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে বাড়িতে সংস্কৃত শিক্ষা তার তেমন কোন কাজে লাগেনি। ইংরেজি,
বাংলা এবং সংস্কৃতের সাথে ভালোভাবে পরিচয় ঘটলেও গান-অভিনয়-সাহিত্যচর্চার মধ্যে
মৃণালিনীর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হয়তো বিয়ের পর কাদম্বরীকে হারানোর
নিগূঢ় যন্ত্রণা থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, আগে তোমাকে যেমন গান
শুনাইতাম, এখন তোমাকে তেমন শুনাইতে পারিনা কেন? এ-সব লেখা যে আমি তোমার জন্য
লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে-চলিতে যখন দৈবাৎ
তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পারো, তাই প্রতিদিন তোমাকে
স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের মাত্র কয়েকমাস পরেই কাদম্বরীর মৃত্যু হয়।
স্বর্ণকুমারী মৃণালিনীকে খুব ভালোবাসতেন, তিনি কথা প্রসঙ্গে
বলেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের বাড়ির জ্যোতির্ময় বউ। স্বভাব তাঁর এত সুন্দর ছিল যে
চেহারার কোন ত্রুটি আমাদের চোখেই পড়ত না...বাইরের সৌন্দর্য অপেক্ষা ভিতরের
সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালিনী, মহিমময়ী।’ মৃণালিনী রূপসী ছিলেন
না, কিন্তু অপরূপ মাতৃত্বের আভা তার মুখে লাবণ্যের মতো ঢলঢল করত, একবার দেখলে আবার
দেখতে ইচ্ছে হয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রতিটা পদে লোকান্তরিত মৃণালিনীর অভাব অনুভব
করে বলেছেন, ‘এমন কেউ নাই যাকে সব বলা যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘স্মরণে’
কবিতায় মৃণালিনীর জন্য বেদনা ঝরে পড়েছে,
‘তোমার সংসার মাঝে হায় তোমাহীন
এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন-
তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস-টানে
তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে?’
১১
কাদম্বরীর মৃত্যুর ঘটনাটা আকস্মিক, তবে সম্ভবত অপ্রত্যাশিত
ছিল না। আগেও তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, যেকারণে রবীন্দ্রর দ্বিতীয়বার
বিলেতেযাত্রা করা সম্ভব হয়নি। এই সুরসিকা, রুচিসম্পন্না, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনে
শান্তির অভাব ছিল। প্রশান্ত কুমার পালের ভাষায় কাদম্বরী, ‘যেমন অভিমানিনী, তেমনই
সেন্টিমেন্টাল এবং আরও বলিব ইন্ট্রোভার্ট, স্কিজোফ্রেনিক।’ তার মতের সাথে সবাই
একমত না হলেও কাদম্বরীকে আরও অনেকে অভিমানিনী বলেছেন। তার নিঃসন্তান জীবনের ব্যাথা
অভিমানকে আরও তীব্র করে তুলেছে। তাই প্রাণের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুঃখের ফল্গুধারা
হঠাৎ এক আঘাতে নিজেকে হারিয়ে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত দুকূল ছাপিয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে কাদম্বরী কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা জানা যায়না তবে জানা যায়
যে, বিয়ের সময় কাদম্বরী দেবী অসুস্থ ছিলেন, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সময় তার
অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ের সাথে কাদম্বরীর আত্মহত্যার
যোগসূত্র খুঁজে থাকেন, কিন্তু কাদম্বরীর সাথে মৃণালিনীর কথাবার্তা বা দেখা সাক্ষাতের
কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। ভবতারিণীকে মৃণালিনী করে গড়ে তুলবার ভার নতুন বউঠান
কাদম্বরী না পেয়ে সেজ বউঠান নীপময়ী বা মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনী কেন পেলেন তাও
জানা যায়না। হেমলতার প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের খুঁটিনাটি জানা যায়,
সেখানেও কাদম্বরী আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। প্রিয় দেবরের বিয়ের পাত্রী নির্বাচনের
জন্য যার এত উৎসাহ ছিল তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন? তাহলে পাত্রী নির্বাচন করতে
গিয়ে কারও সাথে তার মতান্তর হয়েছিল কি? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এজন্যই বলেছেন,
‘কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দের পরিণাম।’ তবে এই
‘মহিলা’ মৃণালিনী নন, তিনি তখনও বালিকামাত্র। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীই হলেন সেই
মহিলা, যিনি তার প্রিয় দেবরের সাথে কাদম্বরীর বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি। সময়ে
অসময়ে দেবরকে তার বির্জিতলাওয়ে’র বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন। সেখানে গানের আসরে ডুবে
থেকে জ্যোতি বাড়িতে ফিরতে ভুলে যেতেন, ভুলে যেতেন তার পথচেয়ে অপেক্ষায় থাকা
বঁধুটির কথা। এজন্যই সমসাময়িক অনেকেই কাদম্বরীর আত্মহত্যার জন্য
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দায়ী করেছেন আগেই উল্লেখ করেছি।
স্বামীর কাছ থেকে ধারাবাহিক যন্ত্রণা পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত
কাদম্বরী হয়ে গেলেন বিষণ্ণতার পাষাণ প্রতিমা। অবশেষে ঘটে গেল সেই অঘটন, যা
কাদম্বরীকে খুবই আহত করেছিল। সেদিনটি ছিল তার জন্মদিন এবং বিয়ের তারিখ, ৫ জুলাই।
জ্যোতিরিন্দ্রকে বারবার বলেছিলেন আগে বাড়ি ফিরে আসতে, চেয়েছিলেন তারা দুজনে একসাথে
কিছুটা সময় কাটাবেন। অস্তাচলের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আপন মনে হেসে উঠেছিলেন
কাদম্বরী, তারপর সাজতে বসেছিলেন। সেজেছিলেন সালাংকারা নববধূর বেশে। কপালে কুমকুম
অলক্তক রাগরঞ্জিত পদযুগল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। একসময় রাত ঘনিয়ে এলে
ব্যক্তিগত পরিচারিকা মুচকি হেসে বললো, বউঠান, শুয়ে পড়ুন, দাদাবাবু বোধহয় আজ আর আসবেন
না। কেননা ততদিনে ঠাকুরবাড়ির সবাই জেনে গেছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইদানীং
জ্ঞানদানন্দিনীর সাথে রাত কাটান। তাদের দুজনের ভাব ভালোবাসা শালীনতার সব সীমাকে
অতিক্রম করে গেছে। ইতিমধ্যে মস্ত বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন তিনি। তৈরি করেছেন জাহাজ
কোম্পানি, শোনা যায়, এমনই এক জাহাজের কেবিন ঘরে বউদি জ্ঞানদানন্দিনীর সাথে তিনি
ভালোবাসার অবুঝ খেলায় মগ্ন ছিলেন। পরে বাড়ি ফিরে এসে কৈফিয়ত দিয়ে বলেছিলেন, ‘জাহাজ
ভাটার টানে আটকে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও তাকে চালু করতে পারিনি। রাতে তাই ফিরতে
পারিনি আমি।’
তবে এরপরে এরচেয়েও বড় অঘটন ঘটে গেল। ঘটনাটা বর্ণকুমারী,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটদিদিকে অমল হোম প্রশ্ন করে শুনেছিলেন। ধোপার বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বা পাঠাতে হবে, জোব্বার পকেট হাতড়ে কাদম্বরী তখনকার দিনের একজন
বিখ্যাত অভিনেত্রী, মতান্তরে নটি বিনোদিনীর কয়েকটা চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিগুলো উভয়ের
অন্তরঙ্গতার পরিচায়ক। নটি বিনোদিনীর সাথে তার স্বামীর গোপন সম্পর্কের কথা বুঝতে
বাকী রইলো না। বিনোদিনী দেখতে কালো হলেও ভারী সুশ্রী ছিলেন, তাই সেসময়ে অনেকেই তার
প্রেমে পড়েছিলেন। জ্যোতির সাথে তার সম্পর্ক হয় যখন তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের
লেখা ‘অশ্রুমতী’ এবং ‘সরোজিনী’ নাটক দুটাতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। বিনোদিনী
লিখেছেন, ‘সরোজিনী নাটকের অভিনয় ভারী জমত। অভিনয় করতে-করতে আমরা একেবারে আত্মহারা
হয়ে যেতাম।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তখন সত্যিই আত্মহারা অবস্থা।
চিঠিগুলো পেয়ে কাদম্বরী কয়েকদিন বিমনা হয়ে কাটান, তারপর পরজায়ের
গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন ওই
চিঠিগুলোই তার আত্মহত্যার কারণ। অথচ
জ্ঞানদানন্দিনীর দ্বিচারিণী কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নারীপ্রীতি
স্বভাব না, জ্যোতির নটি-প্রবণতার জন্য
ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল কাদম্বরীকেই দায়ী করেছিল। মহর্ষির আদেশে
সেসব চিঠি এবং তার স্বীকারোক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়। কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য লিখেছেন,
তিনি ঠাকুরবাড়ির একজন খ্যাতনামা ব্যক্তির মুখে শুনেছেন, ‘যে মহিলার সঙ্গে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গতা জন্মেছিল তিনি অভিনেত্রী নন, তবে সেই অন্তরঙ্গতার
জন্য কাদম্বরী নাকি আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।’ তাহলে কে সেই মহিলা ?
ফিরে আসি সেই পুরনো কথায়। ইন্দিরা আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে লিখেছেন,
‘জ্যোতিকাকামশাই প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তাঁর প্রধান আড্ডা ছিল বির্জিতলাওয়ে
আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে ওঁর খুব ভাব ছিল।’
সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীর কলকাতায় প্রত্যাবর্তন ও
তাদের পরিবারের আধুনিক পরিবেশ জ্যোতিরিন্দ্র ও রবীন্দ্রকে আকৃষ্ট করায়,
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের পর তার নিঃসন্তান জীবনে নিঃসঙ্গতা বৃদ্ধি পাওয়ায়, উর্মিলার
মৃত্যু নিয়ে তাকে দায়ী করা, শুরু থেকেই সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদানন্দিনীর কাদম্বরী
দেবীকে মেনে না নেয়া, বাজার সরকার শ্যামলালের মেয়ে বলে উপেক্ষা, ঠাকুরবাড়িতে যথাযথ
মর্যাদা না পাওয়া, সবকিছু মিলে ২৪/২৫ বছরের একটা যুবতীর ওপরে প্রচন্ড মানসিক চাপ
ফেলে। এরকম মানসিক অবস্থার মাঝে একদিন এমনকি কাদম্বরীর জন্মদিনের রাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে
তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে বললেও তিনি গানে-আড্ডায় ডুবে প্রিয় বউঠাকরুনের বাড়িতে থেকে
যান। এরফলে অভিমানিনী কাদম্বরী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং আত্মহননের পথ
বেছে নেন। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার সাথে বর্ণকুমারির মন্তব্য বা ইন্দিরা দেবীর
মন্তব্য কিংবা দুটোই হয়তো জড়িত। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আত্মহত্যা সংশ্লিষ্ট
কোন অনুমানের অবকাশ নেই।
১৮৮৭ সালে রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্য জীবনের ৪ বছর পার হয়েছে,
কাদম্বরী দেবীও ৪ বছর আগে পরপারে চলে গেছেন। পৃথিবীটা কবির কাছে শূন্য লাগে, তবু
তাকে লিখতেই হয়। কারণ লেখাই তার এই জীবনের একমাত্র প্রেমিকা। যখন আকাশ জুড়ে মেঘের
ঘনঘটা, যখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুই ব্যথার্ত বৃষ্টির অনুরণন, তখন কবিচিত্তে
আবেগ উথলে ওঠে। হৃদয়ের না বলা কথাগুলো স্পন্দিত হতে চায়। অনেক ব্যথা ছুঁয়ে যায় মন।
তখন কবি কলম নিয়ে বসেন। সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলির ওপরে আলোকপাত করেন,
স্রোতস্বিনীর স্বপ্নভঙ্গ ঘটে, কলম এগিয়ে চলে। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর কবির কাছে
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এক শ্মশান বলে মনেহয়। সেখানে গেলে সবখানে বউঠানের স্মৃতি। এই
সেই অলিন্দ, সেখানে দাঁড়িয়ে দুটি তরুণ হৃদয় অনায়াসে হৃদয়ের উত্তাপ বিনিময় করেছে।
এই সেই উঠান- এখানে কতদিন সহসা স্পর্শসুখের আনন্দে মেতে উঠেছেন তরুণ কবি। আর এই
ছাদে এলে তো চোখের জল আর বাধা মানতে চায় না। এখানেই তো প্রতি সন্ধ্যায় সান্ধ্য
আসরে বাতাস হতো স্পন্দিত। অনিমিখ নয়নে কবি তাকিয়ে থাকতেন তার প্রিয় নতুন বউঠানের
নিষ্পাপ মুখখানির দিকে।
এজন্যই তার দিনরাত্রি এখন শিলাইদহের বোটেই কাটে। সব সময়
অন্বেষক চোখে তাকিয়ে থাকেন কবি। তাকিয়ে থাকেন দূর আকাশের পানে। তাকিয়ে থাকেন
দিগন্ত বিস্তৃত ওই স্তব্ধ মৌনমুখর প্রকৃতির রাজ্যে, আর ভাবেন কোন সে রমণী এসে নতুন
বউঠানের শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। কবি এক স্থিতধী পুরুষ। তিনি জানেন এই পৃথিবীতে কোন
কিছুই বেশিদিন শূন্য অবস্থায় থাকতে পারে না। তারপরও কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর ২৫ বছর
পরে ‘লিপিকা’র ‘প্রথম শোক’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাসনা-কামনা-স্বপ্ন ও
যন্ত্রণার কথা লিখেছেন,
‘বনের ছায়াতে যে-পথটি ছিল সে আজ ঘাসে ঢাকা। সেই নির্জনে
হঠাৎ পিছন থেকে কে বলে উঠল, আমাকে চিনতে পার না? আমি ফিরে তার মুখের দিকে তাকালাম।
বললেম, মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছিনে। সে বললে, আমি তোমার সেই অনেক কালের
সেই পঁচিশ বছর বয়েসের শোক। বললেম, সেদিনের তোমাকে শ্রাবণের মেঘের মতো কালো দেখেছি,
আজ যে দেখি আশ্বিনের সোনার প্রতিমা। কোনো কথাটি না বলে সে একটু হাসলে; বুঝলেম
সবটুকু রয়ে গেছে ঐ হাসিতে। বর্ষার মেঘ শরতের শিউলি ফুলের হাসি শিখে নিয়েছে।
দেখলেম, সেদিনকার বসন্তের মালার একটি পাপড়িও খসেনি। আমি বললেম, আমার তো সব জীর্ণ
হয়ে গেল, কিন্তু তোমার গলায় আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবন আজও তো ম্লান হয়নি।
আস্তে-আস্তে সেই মালাটি নিয়ে সে আমার গলায় পরিয়ে দিলে। বললে, মনে আছে? সেদিন
বলেছিলে, তুমি সান্ত্বনা চাও না, তুমি শোককেই চাও। লজ্জিত হয়ে বললেম, বলেছিলেম,
কিন্তু তারপরে অনেকদিন হয়ে গেল, তারপরে কখন ভুলে গেলেম। সে বললে, যে অন্তর্যামীর
বর, তিনি তো ভোলেননি। আমি সেই অবধি ছায়াতলে গোপনে বসে আচি। আমাকে বরণ করে নাও।’
১২
কাদম্বরী দেবী এবং রবীন্দ্রনাথ যথাক্রমে ৯ ও ৭ বছর বয়স থেকে
ঠাকুরবাড়ির সবার অলক্ষ্যে লতায়-পাতায় বেড়ে উঠেছিলেন, তারা আসলে একে অপরের ছায়া বা
পরম নির্ভরতা ছিলেন। সে নির্ভরতার টান রবীন্দ্রনাথ কোনদিন কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
প্রতিটি মুহুর্তে জাগরূক ছিল কাদম্বরী দেবীকে ঘিরে থাকা যত স্মৃতি। বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে
সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না
হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে
চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে
সে হয় সারা।
হদিসঃ
১। রবিজীবনী: প্রশান্ত কুমার পাল (১-৯)
২। জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩। ছেলেবেলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪। নতুন বউঠান- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৫। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন
৬। গোপনচারিণী- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৭। রবীন্দ্রনাথের কাছে কাদম্বরী দেবীর শেষ চিঠি- মামুনুর
রহমান
৮। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব
৯। কলঙ্কিত ঠাকুরবাড়ি- পৃথ্বীরাজ সেন
১০। আদরের উপবাসঃ রবীন্দ্রনাথ- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
১১। নায়ক রবি- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
১২। রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী- পুলক চট্টোপাধ্যায়
১৩। তিন নায়কের কলঙ্ক- পৃথ্বীরাজ সেন
১৪। ইন্টারনেট
পোস্ট ভিউঃ
56