তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারাঃ মোরান সাহেবের বাগানবাড়ী থেকে সদরস্ট্রীট পর্ব

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারাঃ মোরান সাহেবের বাগানবাড়ী থেকে সদরস্ট্রীট পর্ব

মোরান সাহেবের বাগানটি ছিল গঙ্গার দক্ষিণ সীমান্ত লাগোয়া ফরাসডাঙায়, যা আজকের চন্দননগর।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায় কেটেছে এই বাগানবাড়িতে। চন্দননগরে গঙ্গার ওপর হাউস বোটে চড়ে তিনি জ্যোতি দাদার সাথে সময় কাটাতেন।  গঙ্গাতীরে বকুলবীথিকা ঘেরা মোরান সাহেবের সুন্দর বাগানবাড়িতে কবি থেকেছেন দীর্ঘকাল। এখানে কবি প্রতিভা জাগ্রত হবার অনুকূল শান্ত পরিবেশ তার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতি গাইছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছেন কাদম্বরী। উত্তাল গঙ্গার উপর কখনো কখনো ঝাঁপিয়ে পড়তেন রবীন্দ্রনাথ। মসৃণ, সাবলীল ভাবে সাঁতরে যান তবু কাদম্বরীর উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ে, সাঁতার কাটতে কাটতে কবি দূরে চলে যান। তিনি অপেক্ষা করেন, ইশারা করেন রবিকে আরও দূরে না যাওয়ার জন্য, তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য।

মোরান সাহেব কে ছিলেন, তা খুব একটা জানা যায় না। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "বউ ঠাকুরানীর হাট" লেখা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। মোরান সাহেবের বাগান বাড়ি আজ আর নেই, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই জুটমিল হবার প্রয়োজনে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ি নিয়ে লিখেছেন,

 "বিলাতযাত্রার আরম্ভপথ হইতে যখন ফিরিয়া আসিলাম তখন জ্যোতিদাদা চন্দননগরে গঙ্গাধারের বাগানে বাস করিতেছিলেন— আমি তাঁহাদের আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। আবার সেই গঙ্গা! সেই আলস্যে আনন্দে অনির্বচনীয়, বিসাদে ও ব্যকুলতায় জড়িত, স্নিগ্ধ শ্যামল নদীতীরের সেই কলধ্বনিকরুণ দিনরাত্রি! এইখানেই আমার স্থান, এইখানেই আমার মাতৃহস্তের অন্নপরিবেশন হইয়া থাকে। আমার পক্ষে বাংলাদেশের এই আকাশভরা আলো, এই দক্ষিণের বাতাস, এই গঙ্গার প্রবাহ, এই রাজকীয় আলস্য, এই আকাশের নীল ও পৃথিবীর সবুজের মাঝখানকার দিগন্তপ্রসারিত উদার অবকাশের মধ্যে সমস্ত শরীরমন ছাড়িয়া দিয়া আত্মসমর্পণ— তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার খাদ্যের মতোই অত্যাবশ্যক ছিল। সে তো খুব বেশি দিনের কথা নহে— তবু ইতিমধ্যেই সময়ের অনেক পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। আমাদের তরুছায়াপ্রচ্ছন্ন গঙ্গাতটের নিভৃত নীড়গুলির মধ্যে কলকারখানা ঊর্ধ্বফণা সাপের মতো প্রবেশ করিয়া সোঁ সোঁ শব্দে কালো নিশ্বাস ফুঁসিতেছে। এখন খরমধ্যাহ্নে আমাদের মনের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রশস্ত স্নিগ্ধচ্ছায়া সংকীর্ণতম হইয়া আসিয়াছে। এখন দেশের সর্বত্রই অনবসর আপন সহস্র বাহু প্রসারিত করিয়া ঢুকিয়া পড়িয়াছে। হয়তো সে ভালোই— কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভালো, এমন কথাও জোর করিয়া বলিতে পারি না। আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ-করা পূর্ণবিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম-যন্ত্র-যোগে বিদ্যাপতির "ভরা বাদর মাহ ভাদর" পদটিকে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিণী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাতমুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম; কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম— জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন, আমি গান গাহিতাম; পুরবী রাগিণী হইতে আরম্ভ করিয়া যখন বেহাগে গিয়া পৌঁছিতাম তখন পশ্চিমতটের আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হইয়া গিয়া পূর্ববনান্ত হইতে চাঁদ উঠিয়া আসিত। আমরা যখন বাগানের ঘাটে ফিরিয়া আসিয়া নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করিয়া বসিতাম তখন জলে স্থলে শুভ্র শান্তি, নদীতে নৌকা প্রায় নাই, তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড়, নদীর তরঙ্গহীন প্রবাহের উপর আলো ঝিক্‌ঝিক্‌ করিতেছে।

আমরা যে-বাগানে ছিলাম তাহা মোরান সাহেবের বাগান নামে খ্যাত ছিল। গঙ্গা হইতে উঠিয়া ঘাটের সোপানগুলি পাথরে বাঁধানো একটি প্রশস্ত সুদীর্ঘ বারান্দায় গিয়া পৌঁছিত। সেই বারান্দাটাই বাড়ির বারান্দা। ঘরগুলি সমতল নহে— কোনো ঘর উচ্চ তলে, কোনো ঘরে দুই-চারি ধাপ সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া যাইতে হয়। সবগুলি ঘর যে সমরেখায় তাহাও নহে। ঘাটের উপরেই বৈঠকখানাঘরের সাশিগুলিতে রঙিন ছবিওয়ালা কাচ বসানো ছিল। একটি ছবি ছিল, নিবিড়-পল্লবেবেষ্টিত গাছের শাখায় একটি দোলা— সেই দোলায় রৌদ্রছায়াখচিত নিভৃত নিকুঞ্জে দুজনে দুলিতেছে; আর-একটি ছবি ছিল, কোনো দুর্গপ্রাসাদের সিঁড়ি বাহিয়া উৎসববেশে-সজ্জিত নরনারী কেহ-বা উঠিতেছে কেহ-বা নামিতেছে। সার্শির উপরে আলো পড়িত এবং এই ছবিগুলি বড়ো উজ্জ্বল হইয়া দেখা দিত। এই দুটি ছবি সেই গঙ্গাতীরের আকাশকে যেন ছুটির সুরে ভরিয়া তুলিত। কোন্‌ দূরদেশেরকোন্‌ দূরকালের উৎসব আপনার শব্দহীন কথাকে আলোর মধ্যে ঝল্‌মল্‌ করিয়া মেলিয়া দিত— এবং কোথাকার কোন্‌ একটি চিরনিভৃত ছায়ায় যুগলদোলনের রসমাধুর্য নদীতীরের বনশ্রেণীর মধ্যে একটি অপরিস্ফুট গল্পের বেদনা সঞ্চার করিয়া দিত। বাড়ির সর্বোচ্চতলে চারি দিক খোলা একটি গোল ঘর ছিল। সেইখানে আমার কবিতা লিখিবার জায়গা করিয়া লইয়াছিলাম। সেখানে বসিলে ঘনগাছের মাথাগুলি ও খোলা আকাশ ছাড়া আর-কিছু চোখে পড়িত না। তখনো সন্ধ্যাসংগীতের পালা চলিতেছে— এই ঘরের প্রতি লক্ষ করিয়াই লিখিয়াছিলাম, 

অনন্ত এ আকাশের কোলে

      টলমল মেঘের মাঝার—

এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর

      তোর তরে কবিতা আমার।"   

মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে গঙ্গাতীরের রোম্যান্টিক পরিবহে রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্কে এলো আরও ইন্দ্রিয়ঘনতা,  

"সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুইজনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুজনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস? সেই সন্ধ্যার ছায়া? একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রইল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছুদিনের গোটা কতক সুখদুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক-একদিন খুলিয়া, তুমি তাহাদের স্নেহের চোখে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না। আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল, এক লেখা তুমি-আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।"  

চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে কিছুদিন থাকার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চৌরঙ্গীর ১০ নং  সদরস্ট্রীটের ভাড়া বাড়িতে আসেন কারণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নানা কাজে প্রায়ই কলকাতায় যেতে হয়, আসা-যাওয়ায় অনেক সময় খরচ হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এসময়ে বির্জিতলাও-এর বাড়িতে থাকার প্ল্যান করেছিলেন কারণ দাদা-বউদিদিরা অন্যখানে থাকলে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তার একলা মন টিকবে না। এছাড়া মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনী তাদের সাথে কিছুদিন থাকতে বলেছিলেন, সুরেন আর বিবি তাদের সাথে থাকার জন্য খুব করে ধরেছে। কিন্তু রবির বির্জিতলাও-এর বাড়িতে যাওয়া হলোনা, রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিদাদা ও নতুন বৌঠানের সঙ্গী হলেন। এই অঞ্চলটিতে অধিকাংশ বাড়িই ইংরেজ, আরমেনিয়ান ও পারসিদের, বেশ নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্নসবচেয়ে বড় গুণ হলো পথে চলার সময় কিংবা কোনও বাড়ির বার-বারান্দায় দাঁড়ালে দুৰ্গন্ধ সহ্য করতে হয় না। রাস্তার পাশের কাঁচা ড্রেনগুলি ঢেকে সম্প্রতি এখানে পাথরের ফুটপাথ বানানো হয়েছে, রাত্তির বেলাতেও নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়, কোনও পগারে পদস্খলনের ভয় নেই। গ্যাসের আলোয় ঝলমলে এই পথটির সাথে লন্ডনের যেকোনও রাজপথের তুলনা করা যায়।   

চৌরঙ্গীর ১০ নং সদরস্ট্রীটের এই নতুন বাড়িতেই একদিন সকালে, "নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ" কবিতাটা নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল অন্য জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একটি অপূর্ব অদ্ভুত হৃদয় স্ফুর্তির দিনে "নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ" লিখিয়াছিলাম কিন্তু সে দিন কে জানিত এই কবিতায় আমার সমস্ত কাব্যের ভূমিকা লেখা হইতেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোর প্রথম পর্বে "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" কবিতার নেপথ্য গল্পটা এভাবে পাওয়া যায়,

সারাদিন ধরে লিখে গেল রবি মাঝে কাদম্বরী তার ঘরে এসে কয়েকবার উকি দিয়ে গেছেন, রবি লক্ষ করেনি সে আজ খেতে যায় নি, প্লেটে করে কিছু ফল মিষ্টি কেউ রেখে গেছে তার সামনে, সে তার থেকেও খেয়েছে সামান্যই সে কয়েকলাইন লিখছে, খাচ্ছে, বার বার পাঠ করছে সেই লাইনগুলো, আবার লিখছে 

বিকেলের দিকে কাদম্বরী গা ধুয়ে সাজগোজ করে এসে মৃদুস্বরে ডাকলেন তাকে রবি সাড়া দিল না

কাদম্বরী কাছে এসে বললেন, কত কী লিখছ? এবার ওঠো শরীর খারাপ হবে যে

রবি অন্যমনস্কভাবে বলল, না।।

কাদম্বরী রাগ করে বললেন, রবি এবার আমি তোমার খাতা কেড়ে নেব কিন্তু!

রবি ফিরেও তাকাল না কিছু বলল না

কাদম্বরী এবারে একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে কবির লেখার পাশে আঁকিবুকি কেটে দিলেন

রবি বলল, আঃ, কী হচ্ছে?   

কাদম্বরী বললেন, রবি, তুমি সারাদিন মাথা গুঁজে পড়ে থাকবে এটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না তুমি ওঠো না হলে সব লেখা কাটাকুটি করে দেব বলছি!   

রবি কয়েকবার মাথা ঝাঁকুনি দিল তারপর উঠে বসে বলল, নতুন বউঠান, কী লিখেছি শুনবে? এটার নাম "নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ"। 

কাদম্বরী বললেন, হ্যাঁ, শোনাও

তারপর তুমি স্নান করে পোশাক বদলাবে আমরা আজও ছাতে গিয়ে বসব

রবি পড়ল, প্রথম চার লাইন।

 

                          আজি এ প্রভাতে     প্রভাতে বিহগে

                                  কী গান গাইল রে!

                          অতি দূর দূর          আকাশ হইতে

                                  ভাসিয়া আইল রে!

 

এইটুকু পড়েই মুখ তুলে তাকিয়ে রবি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?

কাদম্বরী ঈষৎ ভুরু কোঁচকালেন ধীরে মাথা দুলিয়ে বললেন, তেমন ভালো লাগছে না তো! "ভাসিয়া আইল রে", এটা কেমন যেন!  

 

রবির বুকে যেন একটা শেল বিঁধল গভীর প্রত্যাশা নিয়ে শোনাতে শুরু করেছিল তার দৃঢ় ধারণা, এ কবিতা একেবারে অন্যরকম তার নবজন্মের কবিতা    

সে ফ্যাকাসে গলায় বলল, তোমার ভালো লাগছে না? নতুন বউঠান, এ কবিতা আমি চেষ্টা করে লিখছি না আপনা আপনি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে 

কাদম্বরী নিচু গলায় বললেন, আপনা-আপনি বেরিয়ে এলেই কি ভালো কবিতা হয়? কবিতা তো একটা নির্মাণের ব্যাপার, তাই না? আমি অবশ্য কিছুই বুঝি না

রবি গম্ভীর হয়ে আবার পড়তে শুরু করলঃ  

 

                      না জানি কেমনে পশিল হেথায়

                      পথ হারা তার একটি তান,

                      আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্ৰমিয়া,

                      আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাদিয়া

                      ছুঁয়েছে আমার প্রাণ……

          

রবি আবার মুখ তুলল 

কাদম্বরী অপরাধীর মতন মুখ করে বললেন, কী জানি, আমি এতে নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাচ্ছি না হয়তো আমার বোঝার ভুল- 

রবির মাথায় রাগ চড়ে গেল কাদম্বরীর দিকে সে এমন রক্তচক্ষে কখনও তাকায় নি তার মনে হল, এ রমনী কিছুই কবিতা বোঝে না একে আর শুনিয়ে কী হবে? নাঃ, আর কোনও দিন সে নতুন বউঠানকে তার কবিতা শোনাবে না  

কাদম্বরী ঝুঁকে রবির গা ছুঁয়ে মিনতি করে বললেন, রবি, তুমি রাগ করেছ? আর একটু পড়ো

রবি এবার অনেকটা বাদ দিয়ে চিৎকার করে পড়তে লাগল, 

আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে

প্রভাত পাখির গান

না জানি কেন রে এতদিন পর

জাগিয়া উঠিল প্রাণ…..

কাদম্বরী বললেন, বাঃ, এই জায়গাটা ভালো লাগছে, সত্যি বেশ ভালো লাগছে 

রবি পড়ে যেতে লাগল প্রায় গর্জনের স্বরে,  

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ  

ওরে উথলি উঠেছে বারি

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ

রুধিয়া রাখিতে নারি

থর থর করি কাঁপিছে ভূধর

শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে

ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল

গরজি উঠিছে দারুণ রোষে…..   

কাদম্বরী রীতিমতন ভয় পেয়ে রবির একটা হাত চেপে ধরে আর্ত গলায় বলে উঠলেন, রবি, রবি, থামো তোমার আজ কী হয়েছে, রবি?   

রবি থেমে গেল তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে থমথমে মুখ, উষ্ণ শ্বাস 

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, নতুন বউঠান, আজ আমার ঘোর লেগেছে কিসের ঘোর তা জানি না আমি যেন আর আমাতে নাই   

৪   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোতে "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" কবিতাটি লেখার নেপথ্য গল্পে বর্ণিত কবিতার সাথে সঞ্চয়িতার কবিতার পার্থক্য আছে,   

আজি এ প্রভাতে রবির কর

             কেমনে পশিল প্রাণের "পর

      কেমনে  পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!

না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।

             জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে       উথলি উঠেছে বারি,

ওরে       প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

                থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,

                শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,

                ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল

                গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।

                হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়

                ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় –

বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।

                কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,

                চারি দিকে তার বাঁধন কেন!

                ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন,

                সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,

                লহরীর পরে লহরী তুলিয়া

                আঘাতের পরে আঘাত কর্।

                মাতিয়া যখন উঠেছে পরান

                কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!

                উথলি যখন উঠেছে বাসনা

                জগতে তখন কিসের ডর!

                আমি    ঢালিব করুণাধারা,

                আমি    ভাঙিব পাষাণকারা,

                আমি    জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া

                            আকুল পাগল-পারা।

                কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,

                রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,

রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।

                শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,

                ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,

হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।

এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর,

এত সুখ আছে, এত সাধ আছে – প্রাণ হয়ে আছে ভোর।।

কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ –

দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।

                ওরে, চারি দিকে মোর

                এ কী কারাগার ঘোর –

ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।

ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,

এসেছে রবির কর।

 

হদিসঃ

১। জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২। প্রথম আলো - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

৩। সঞ্চয়িতা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪। নতুন বউঠান- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৫। গোপনচারিণী- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৬। ইন্টারনেট  

পোস্ট ভিউঃ 56

আপনার মন্তব্য লিখুন