তোমিকো ওয়াদা কোরাঃ ফিরে এসো বন্ধু আমার

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
তোমিকো ওয়াদা কোরাঃ ফিরে এসো বন্ধু আমার

“তুমি চলে গেছো, থেকে গেছে তোমার রেশম কোমল চুল। টগর ফুলের মতো তা রেখেছি আমি, তুলে নিয়েছি গোলাপি প্যাকেটে। মাঝেমধ্যে যখন তোমার কথা মনেপড়ে আমার, তোমার কবিতার শব্দগুলো যখন আমাকে উদ্বেল করে, আমি এক অদ্ভুত অসহায়তার জগতে পৌঁছে যাই, তখন সন্তর্পণে সেই গোলাপি প্যাকেট খুলে তোমার রেশম কোমল চুলগুলোর দিকে হাত রাখি। আমার মনেহয় আমি বুঝি তোমার সমস্ত শরীর স্পর্শ করার স্বর্গীয় সাহস লাভ করেছি। আমি বোধহয় তোমার সান্নিধ্য পেয়েছি আর একবার”

 

কে এই তরুনি? যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাথার চুল সযত্নে গুছিয়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে, খারাপ লাগার মুহুর্তগুলোতে দেখবেন বলে। যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,   

 

গোপন পথে আপন-মনে বাহির হও যে কোন লগনে,

হঠাৎ-গন্ধে মাতাও সমীরণ,

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন- 

তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন। 

 

তিনি আর কেউ নন, জাপানী তরুণী তোমিকো ওয়াদা কোরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপনচারিণী।

তোমিকো ওয়াদা কোরার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম দেখা ১৯১৬ সালে। ইতিমধ্যে ১৯১৩ সালে প্রথম এশিয়বাসী হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। রাজকীয় সংবর্ধনা পেতে জাপানে গিয়েছেন  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বয়স তখন পঞ্চান্ন আর তোমি’র বিশ, কলেজের ছাত্রী। তবে এর আগেই তোমি যখন ১৭/১৮ বছরের তরুণী, তখন একটা জাপানী পত্রিকায় কবির লেখা চিত্রা কাব্যের সেই অসাধারণ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়েছেন, 

 

সংসারে সবাই রবে সারাক্ষণ শতকর্মে রত

তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো।

মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে

দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে

সারাদিন বাজাইলি বাঁশি

 

কবির লেখা কবিতার জাপানী অনুবাদ পড়েছেন, আর এভাবেই কবির প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহে বয়সের ব্যবধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।    

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেছেন তোমি’র কলেজে, মঞ্চে উঠলেন তাঁর একান্ত অনুভূতির কথা সবাইকে জানাতে। তোমি দর্শক আসন থেকে তম্ময় হয়ে শুনলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিটা কথা। এমন কণ্ঠস্বর তিনি এর আগে কখনো শোনেননি। এই হিরম্ময় মানুষটার প্রতি জেগে উঠলো তাঁর অমাপ্য ভালোবাসা। এরপর যে  ক’টা দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানে ছিলেন, তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন তোমি। তাঁর   দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন। যাতে তিনি কোন ভাবেই কোন বিড়ম্বনার সম্মুখীন না হন। এভাবেই তোমি তাঁর জীবনের এক অন্যতম আশ্রয় এবং অবলম্বন হয়ে উঠেছেন।

 

ধীরে ধীরে বিদায়ের বেলা ঘনিয়ে এলো, শেষবারের মতো বসেছে কবিতার আসর। রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করছেন আর দোভাষীর ভুমিকায় তোমি। ইতিমধ্যে জাপানের বিখ্যাত কারুইজাওয়া পাহাড়ে ভ্রমণ এবং বিভিন্ন স্থানে কবিতার আসরের কারণে তারা অনেকটা কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। সে বারের যাত্রায় শেষবারের মতো উচ্চারিত হলো,

 

এ জীবনে আমি গাহিয়াছি বসি গান

পেয়েছি অনেক ফল

সে আমি সবারে বিশ্ব জানালে, করেছি দান

ভরেছি ধরণী তল

যার ভালো লাগে সে-ই নিয়ে যাক

যতদিন থাকে ততদিন থাক

যশ অপযশ উড়ায়ে বেড়াক ধূলার মাঝে

বলেছি যেকথা করেছি সে কাজ

আমার সীমায় সবার সে আজ

ফিরিয়া ভ্রমিয়া সংসার মাঝ বিরূপ সাজে।

 

শেষবারের মতো কবিতা উচ্চারিত হলো, তোমি তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনালেন। দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। তোমির চোখে তখন বিদায় অশ্রুধারা।

১৯১৯ সাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রথম আলাপের পর তিন বছর কেটে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স আটান্ন আর তোমির তেইশ। পড়াশোনা করার জন্য তোমি গেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা। সাথে নিয়ে গেছেন গোলাপি কাগজের ছোট একটা মোড়ক। তার মধ্যে অতি যত্নে পূজার ফুলের মতো করে রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চুল। জাপানে কবির বিছানা তোমিই গুছিয়ে দিতেন আর বালিশে লেগে থাকা কাঁচাপাকা- রেশমচিকন চুলগুলোকে রেখে দিতেন গোলাপি প্যাকেটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাথার চুল তাঁর সাথে আমেরিকায়, এভাবেই কবির স্মৃতি আগলে রাখতেন তিনি। একদিন  জানতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ নিউইয়র্ক, আমেরিকায় ভ্রমণে গিয়েছেন। দুজনের মাঝে তখন কয়েক ঘণ্টা উড়ান দুরত্ব। তোমি ছুটে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ নিবেদন করলেন প্রেম, তোমি সাড়া দিলেন তাঁর ডাকে।  তারপর তারা ফিরে গেলেন কবিতার মাঝে। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে কবিতা উচ্চারণ করছেন আর তোমি তার বিমুগ্ধ শ্রোতা। ফিরে যাবার আগে তোমি বলেছিলেন, ‘কবি, ইচ্ছে হলে এসো জাপানে, আমার অতিথি হয়ে, না, এত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নয়, তুমি আর আমি প্রকৃতির নিভৃত নিরালায় কাটাব আমাদের একলা থাকার প্রহর। আসবে তো?’ কবি বলেছিলেন,

 

কোথা হতে সমীরণ আনে নব জাগরণ

পরানের আবরণ মোচন করে।

বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে

আমার নিভৃত নব জীবন ‘পরে।   

দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমিকো ওয়াদা’কে দেয়া কথা রেখেছিলেন। ১৯২৪ সালে তাদের আবার দেখা হয়। কবি গিয়েছিলেন চীন ভ্রমণে, সেখান থেকেই তেষট্টি বছরের কবি তাঁর আটাশ বছর বয়সের চিরদিনের অনুরাগিণীকে টেলিগ্রাম করে জাপানে আসবার কথা জানিয়েছেন। তাদের দেখা হবে বসন্তে। তোমি উত্তর দিয়েছিলেন, I have received your telegram with such gratitude and joy. So you are coming to Japan which I think is timely and most needed. I am thankful that you decided so. I will come to Kobe to welcome you. 

তাদের দেখা হলো নাগাসাকিতে। কবি তখন আরও বেশি খ্যাতিমান, জাপানের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর জাপান ভ্রমণের কথা। কিয়েটো থেকে টোকিও, নাগাসাকি থেকে ইয়াকোহামা, সবখানে অসংখ্য  বক্তৃতা, সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে হবে কবিকে। সবার চোখে তোমি তখন কবির ভাষাসঙ্গিনী। কবি ইংরেজিতে যা বলেন, তোমি সাথে সাথেই তা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে শ্রোতাদের শোনান। কবি একটানা বলে যান, তোমি কথার খেই হারিয়ে ফেলেন, কবির জোব্বা ধরে টান দেন। কবি জনসমক্ষে স্বীকার করেন, This young girl puts the great poet in her pocket and carries him along where ever she wishes. 

দীর্ঘ যাত্রা শেষে কবি যখন টোকিওতে ফিরলেন তখন তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তোমি রাতদিন ক্লান্তিহীন পরিচর্যা করলেন। তাঁর নিবেদিত প্রাণে একটাই আকুতি, মনেরেখো বন্ধু। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আকাশের পাখি, কারও কাছে বন্দি হওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। জাপান ভ্রমন শেষে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে কবি তাঁর আটাশ বছরের বান্ধবীকে লিখলেন, The bird leaves no trace of its flight, only some feathers on the dust. বাংলায়,

 

আকাশের পাখি

চিহ্ন কিছু না রাখে

স্খলিত পালক

ধূলায় পড়িয়া থাকে।      

 

তোমি সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মনে রেখেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও তাঁর মন থেকে রবীন্দ্রনাথকে অন্তর্হিত হতে দেননি। দু’বছরের যন্ত্রণাক্লিষ্ট দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর ১৯৩৬ সালে শান্তি নিকেতনে এলেন পঁচাত্তর বছর বয়সে ভগ্নস্বাস্থ্যের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখতে। কবি তখন চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের মহড়া দিচ্ছিলেন। তাঁকে ওভাবে দেখে তখনও তাঁর মনের মাঝে এক আশ্চর্য অনুরণন জেগে উঠেছিল। অপার মুগ্ধতা নিয়ে তিনি কবিকে বলেছিলেন, ‘পারলে, আবার জাপানে এসো, আমার আমন্ত্রণ রইল’।  

বিদায় লগনে ধরিয়া দুয়ার তাই তো তোমায় বলি বারবার

ফিরে এসো এসো বন্ধু আমার। 

কবিগুরুর আর ফেরা হয়নি, কিছুদিন পর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিরোশিমায় বোমা পড়লো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তোমিকো ওয়াদা কোরার আর দেখা হয়নি।

 

হদিসঃ

১। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন

২। গোপনচারিণী- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩। জাপান যাত্রী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

পোস্ট ভিউঃ 55

আপনার মন্তব্য লিখুন