বৈঠকি খুন-এর জনক আকবর শেঠঃ এই শতাব্দীর ঠগি

এটাসেটা চিরকুট
বৈঠকি খুন-এর জনক আকবর শেঠঃ এই শতাব্দীর ঠগি

বৈঠকি খুন-এর জনক আকবর শেঠঃ এই শতাব্দীর ঠগি    

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর।

রবিবারের বিকেল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। 

৮০`র দশকে পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার, আকবর হোসেন ওরফে আকবর শেঠ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আলীজান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মারা যায়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। মৃত ইউসুফ জানের ছেলে আলীজান, বাবুবাজার সংলগ্ন শরৎ চন্দ্র চক্রবর্তী লেনে থাকতো। আকবর শেঠ জনপ্রতিনিধি হয়ে যখন খ্যাতির শীর্ষে, তখনই সে তার ঘনিষ্ঠ সাগরেদ আলীজানের হাতে খুন হয়। এই হত্যা মামলার আরেক আসামি ফজলুও জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই মারা যায়। কারারক্ষীরা ঘটনার দিন বিকেল পৌনে ৪টায় আলীজানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু। কে এই আলীজান? এবং কে এই আকবর শেঠ? তবে তাদের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জেনে নেই ঠগি কারা?      

১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলায় এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল একটা কুখ্যাত খুনি সম্প্রদায়, ইতিহাসে তারা ঠগি নামে পরিচিত। `ঠগ` একটি সংস্কৃত শব্দ, যা থেকে ঠগি শব্দটি উদ্ভূত। শাব্দিকভাবে এর অর্থ ধোঁকাবাজ বা প্রতারক। তারা তাদের শিকারের সাথে মিশে গিয়ে বা সম্ভাব্য শিকারকে দাওয়াত দিয়ে সুবিধাজনক সময়ে শিকারের গলায় হলুদ রং এর রুমাল/কাপড় জড়িয়ে হত্যা করতো। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত `ফিরোজ শাহর ইতিহাস` গ্রন্থে তাদের কথা প্রথম জানা যায়। বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। তবে ব্রিটিশ সরকার ১৮১২ সালে ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক ১৮৩০ সালে উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে ঠগিদের নির্মূল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লীম্যান কয়েক বছরের চেষ্টায় ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন। ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল বলে জানা যায়। এই ঠগিদের হত্যার আয়োজনের সাথে খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় ৮০`র দশকের পুরান ঢাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী আকবর শেঠের সাথে। কেননা সেও মদের আসর বা যেকোন আয়োজন করে তার শিকারকে দাওয়াত করে এনে খুন করতো। সময়ের পরিক্রমায় এসব হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত উপকরণের হয়তো ভিন্নতা রয়েছে, খানিকটা ভিন্নতা রয়েছে উদ্দেশে, তবে তাদের হত্যার কৌশল ছিল অভিন্ন।        

নয়াবাজারের আইউব উল্লাহ সড়কের বাসিন্দা, আকবর শেঠ ৮০`র দশকে পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার ছিল। নয়াবাজার থেকে শুরু করে সদরঘাট পর্যন্ত গোটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। তার অন্যতম সাগরেদ ছিল নয়াবাজার এলাকার আরেক ত্রাস, সন্ত্রাসী আলীজান। আকবর শেঠ লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে এনে খুন করতো, তার এই দাওয়াত দিয়ে খুন করার কৌশলটি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে `বৈঠকি খুন` নামে পরিচিতি লাভ করে। আকবর শেঠকে তাই `বৈঠকি খুন`-এর জনক বলা হয়ে থাকে।   

১৯৮০ সাল। বর্ষাকাল।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ। রাত আনুমানিক ৯টা।  

মুষলধারে বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে বলে পথে লোকজন তেমন নেই, দোকানপাটও বন্ধ। বরিসুর এলাকায় সন্ধ্যা থেকে চার রাস্তার মোড়ের একটি টিনশেডের বাসায় তখন খুব হৈ-হুল্লোড়, উচ্চ ভলিউমে গান বাজছে। মদের নেশায় চুর হয়ে ৮-১০ জন যুবক নিজেদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। তাদের আনন্দ-উল্লাস দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা আসলে একটা খুনের আয়োজন, একটুপরই সেখানে ঘটতে যাচ্ছে এক নারকীয় হত্যাকান্ড। কেননা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে হঠাৎ ৫-৬ জন যুবকের আগমন ঘটে, তাদের দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, বাকিদের হাতে ধারালো রামদা আর চাপাতি। মদের আসরে ঢুকেই বুঁদ হয়ে থাকা যুবকদের মধ্য থেকে তারা দুজনকে আলাদা করে সেখানেই চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি ভাবে কুপিয়ে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে, এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুজনের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। খুনিরা রক্তাক্ত ডেডবডি দুটা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়, পরে নদীর ধারে তাদের সন্ধান মেলে। সেদিনের সেই মদের আসরের দাওয়াত কবুল করে এভাবেই নির্মম খুনের শিকার হয় আইয়ুব ও মিন্টু নামে সেই দুই যুবক। আর তাদের দাওয়াত করে এনেছিল পুরান ঢাকার সেসময়ের গডফাদার আকবর হোসেন, যে আকবর শেঠ নামে পরিচিত। এভাবেই দাওয়াত দিয়ে এনে অসংখ্য খুন করেছে এই আকবর শেঠ। সেই সময়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কারও কথা বলার সাহস ছিল না, রংবাজি আর  মাস্তানিতে মানুষের মুখে মুখে তার নাম উচ্চারিত হতো। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, এমন কাউকেই সে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখতো না। তার মাস্তানি এমনই এক পর্যায়ে উঠেছিল যে এলাকার লোকজন আকবর নামের শেষে `শেঠজি` উপাধি জুড়ে দিয়েছিল। তবে তাকেও একসময় হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয় তারই ঘনিষ্ঠ সাগরেদ আলীজানের লোকদের হাতে।      

নয়াবাজারের ত্রাস আলীজান আকবর শেঠের অন্যতম সাগরেদ ছিল, আগেই বলেছি। আকবর শেঠ হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্যে বৈঠকের আয়োজন করে তার সাগরেদ আলীজানকে দিয়ে দাওয়াত দেয়ার ব্যবস্থা করতো। সেই দাওয়াতে এসেই বহু লোক একসময় প্রাণ হারিয়েছেন। মাস্তানিতে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে ব্যবসা, সমাজসেবা এবং  জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে খ্যাতির শীর্ষে যখন উঠে এলো আকবর তখন বার্ধক্যের কোঠায় পা রেখেছে। ঠিক এরকম সময়ই আকবর নির্মম খুনের শিকার হয়, আর খুন হয় কিনা ঘনিষ্ঠ সাগরেদের হাতেই। ক্ষমতার লোভ, লালসা, ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সাগরেদ আলীজান। যে এলাকায় আকবর শেঠ একসময় বুক চিতিয়ে হাঁটতো সেখানেই আলীজান তাকে খুন করেছে, তার সাথে ছিল নিজের ভাতিজা আসাদ এবং ফজলু নামে আরেক সহযোগী।  

পুরান ঢাকা এক রহস্যময় জায়গা, যেখানে অলিতে গলিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলে। আর প্রকৃত বাণিজ্যের আড়ালে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য করে থাকে সেখানকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এসব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল আকবর শেঠের হাতে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, সেখানকার আচার-বিচার থেকে শুরু করে অনেককিছুই হতো আকবর শেঠকে ঘিরে। তার বিরুদ্ধে গোপনে কেউ কেউ সংগঠিত হলেও, প্রকাশ্যে কখনো তার সামনে এসে দাঁড়াতে পারেনি। পুরান ঢাকার পশুর হাট থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো আকবর শেঠ নিজেই দেখভাল করতো, কিন্তু দিন যত এগোতে থাকে ভিতরে ভিতরে তার শত্রুপক্ষ ততোই সংগঠিত হতে থাকে। যৌবনের মাস্তানি থেকে ধীরে ধীরে সরে এলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় বার্ধক্যের কোঠায় পৌঁছেও কিছু বিষয় থেকে আকবর শেঠ কখনো সরে আসতে পারেনি। 

১৯৯১ সালের জুলাই মাসে নয়াবাজার গরুর হাট নিয়ে আকবর শেঠ তার ঘনিষ্ঠ সাগরেদ আলীজানকে বকাঝকা করে। ঘটনার দুদিন পর একটি পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলীজানের ওপর আকবর এতোটাই ক্ষুব্ধ হয় যে রাস্তায় শত শত লোকের সামনে আলীজানের গালে চড় মেরে বসে। এতে আলীজানের আত্মসম্মানে স্বভাবতই আঘাত লাগে। আলীজানের ভাতিজা আসাদ তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। রাগ ও ক্ষোভে আলীজান সেখান থেকে চলে গেলেও তার ভাতিজা আসাদসহ অন্যরা আলীজানকে বলে, তারা একদিন এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবে। আকবর শেঠ তাদের প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা জেনে গেলে লোকজন পাঠিয়ে আলীজানকে ডেকে সমঝোতা করে নেয়। সেসময়ে আকবর শেঠ আলীজানকে ২০ হাজার টাকা উপহার দেয়। এরপর তারা কোলাকুলি করে যে যার দিকে কাজে চলে যায়। 

১৩ আগস্ট ১৯৯১ সাল।

সময় রাত পৌনে ১২টা।

আকবর শেঠ তার বন্ধু সুলতানকে নিয়ে নয়াবাজারে অবস্থিত তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পারভেজ ট্রান্সপোর্ট থেকে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিল। আকবরের বাসার প্রায় কাছাকাছি, গলির অন্ধকারে শিকারের আশায় ওত পেতে ছিল আলীজান, ফজলু, নাইয়ুম, আলীজানের ভাতিজা আসাদসহ আরও কয়েকজন। চাপাতি আর রামদা নিয়ে রিকশার পেছন থেকে তারা হামলা চালায়। চাপাতির কোপে রক্তাক্ত আকবর শেঠ রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে যায়। তার বন্ধুর শরীর থেকেও রক্ত বের হতে থাকে, সে রিকশা থেকে কোনভাবে নেমে রক্তাক্ত অবস্থাতেই টিপু সুলতান রোডের দিকে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। কিন্তু রক্তাক্ত আকবর শেঠ আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। জনাকীর্ণ রাস্তায় খুনিরা তাকে এলোপাতাড়ি কোপায়, একজন গলায় পোঁচ দিতে শুরু করে। শেষে আকবর শেঠকে কাছ থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়। খুনিরা তাদের কিলিং মিশন শেষ করে গুলি করতে করতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।  

আন্ডারওয়ার্ল্ডে আপাতদৃষ্টিতে অনেকসময় ঘটনার নিষ্পত্তি ঘটেছে বলে মনেহলেও অবৈধ ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার, লোভ-লালসা, সুযোগ-সুবিধার মতো বিতর্কিত ঘটনাকেন্দ্রিক ঝগড়াগুলো আসলে আড়ালেই থেকেই যায়, সেসব ঘটনার নিষ্পত্তি ঘটে মূলত হত্যাকান্ডের মধ্যদিয়েই।    

১৯৭৮ সাল থেকে রংবাজি শুরু করা পুরান ঢাকার `বৈঠকি খুন`-এর জনক আকবর শেঠ খুব শৌখিন ছিল। হালকা পাতলা গড়নের আকবর সাদা পোশাক পরতে ভালোবাসতো। সেসময়ের নয়াবাজারের ব্যবসায়ীদের মতে রংবাজি করতে আকবর শেঠের অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। তার একটা হুঙ্কার পিস্তলের তপ্ত সীসার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। আকবর শেঠকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আলীজান তার সহযোগী ফজলুর মতোই জেলে থাকতেই মারা যায়, তবে তার ভাতিজা আসাদ ইতালিতে পালিয়ে আছে বলে জানা যায়।  

তথ্যসূত্রঃ

১। দৈনিক যুগান্তর, তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

২। মির্জা মেহেদী তমাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন ৪ আগস্ট ২০১৫

৩। ঠগী- শ্রীপান্থ

৪। ইন্টারনেট

পোস্ট ভিউঃ 66

আপনার মন্তব্য লিখুন