সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস- তৃতীয় পর্ব

প্রবন্ধ ফুটনোটে জলছাপ
সাধের আসনঃ বিহারীলালের প্লেটোনিক ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন আফসোস- তৃতীয় পর্ব

কবি বিহারীলালের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ প্রণয়ের একটা বেদনা ছিল। বাস্তবে সে প্রণয় পরাহত হয়ে ভাব ও আদর্শকে স্থান করে নিয়েছে। মধ্যযুগের চণ্ডীদাস শ্রীরাধার ভাবনায় নিজের বিরহ বেদনার সুরকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। আধুনিক যুগের কবি বিহারীলাল গোষ্ঠীগত ভাবনায় নায়িকাকে কেন্দ্র করে নয়, ব্যক্তিগত কল্পনায় দেবীকে আশ্রয় করে নিজের মনের বিরহযন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন। দেবী সারদাকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন,  

 

সে মহা পুরুষের মেলা  

সে নন্দন বন খেলা

সে চির বসন্ত বিকশিত ফুলহার

কিছুই সেথায় নাই

মনে মনে ভাবি তাই

কি দেখে আসিতে মন সরিবে তোমার।

 

রেনেসাঁস যুগের অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের মতো বিহারীলাল নারী সচেতন কবি, `বঙ্গসুন্দরী` নারী বন্দনামূলক কাব্য। জীবনানন্দ দাশ যেমন নাটোরের বনলতা সেনের পাখির নীড়ের মতো চোখে শান্তির আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন, এমনি একজন রোমান্টিক কবি বিহারীলালও প্রিয়ার দিকে চেয়ে এতকালের অস্বস্তি আর যন্ত্রণাকে ভুলে তৃপ্ত হয়েছেন। একজন নারী অর্থাৎ প্রিয়তমা নারীই একজন কবির সবরকম দুঃখদৈন্যকে ঘুচাতে পারে, সেই নারী কি কাদম্বরী দেবী! তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থদ্বয় `সারদামঙ্গল` ও `সাধের আসন` মুখ্যত নারী প্রশস্তিই। তার প্রেম কবিতায় প্লেটোনিক প্রেমের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর সূচনা হয়েছিল প্রেম-প্রবাহিণীতে। তার বিস্তার লক্ষ্য করা যায় সারদামঙ্গল কাব্যে। তবে সৈয়দ আলী আহসান বিহারীকাব্যে প্লেটোনিক প্রেমকে স্বীকার করেননি। কিন্তু বিহারীলাল প্লেটোনিক প্রেম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং এর প্রতি তার অবজ্ঞার পরিচয়ও পাওয়া যায় শরৎকাল কাব্যে,  

 

ধিক রে পরম ধিক

ভালোবাসা `প্লেটোনিক`  

 

তবুও বিহারীলালের কাব্যে প্লেটোনিক প্রেমকে অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজ গীতিকবি শেলির কাব্য তার পড়া ছিল। শেলি যেমন তার Epipsychidion কবিতায় এমিলিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন,

 

Veiling beneath that radiant from of Woman

All that is insupportable in thee

Of light and love and immortality.

 

তবে বিহারীলালের `সাধের আসন` কাব্যে এই প্লেটোনিক রূপটি সামনে ছিলো না, পেছন থেকে প্রেরণা যুগিয়েছে। সামনে তখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ভারতীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত বন্দনা- সারদার ধ্যান,

 

প্রত্যক্ষে বিরাজমান  

সর্বভূতে অধিষ্ঠান

তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি অনুপমা,

কবির যোগীর ধ্যান

ভোলা প্রেমিকের প্রাণ

মানব মনের তুমি উদার সুষমা।

 

`সাধের আসন` এর নবমসর্গ `আসনধাত্রীদেবী` শুরুতে একটি ললিত রাগের গীতি আছে। আসনধাত্রী দেবী কাদম্বরীকে উদ্দেশ্য করে এই সর্গটা নিবেদিত। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বিহারীলালের মধ্যে গভীর বেদনার ছায়াপাত করেছিল। কাদম্বরী দেবীর অস্বাভাবিক মৃত্যু অন্যদের মতো বিহারীলালকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এই সর্গের গীতিটির শেষাংশে এরকম একটি আভাস পাওয়া যায়,   

 

ত্যাজি এই মর্ত্য ভূমি 

কোথা চলে গেলে তুমি

কি জানি কি অভিমান ভরে।

 

`ভগ্নহৃদয়` যখন `ভারতী` পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হতে থাকে তখন রবীন্দ্রনাথকে ঠিকই কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করলেন তার বিখ্যাত `তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা` গানটির মাধ্যমে। এই গানের `আঁধার হৃদয় মাঝে দেবীর প্রতিমাপারা` লাইনটার মাধ্যমে সম্ভবত গ্রীক দেবী হেকাটে-র কথা   মনেপড়েছে। পারসেস ও এস্টেরিয়ার কন্যা `হেকাটে` হলেন এক রহস্যময় দেবী যার প্রভাব বিস্তৃত স্বর্গ-মর্ত্য-সমুদ্রে। রোমানরা তাকে ট্রিভিয়া বলে থাকে, `তে-মাথা`র দেবী, ঠিক তেমনি কাদম্বরী দেবীর প্রভাব বিন্যস্ত তিন কল্পনাপ্রবণ মানুষের উপরে। তারা হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং বিহারীলাল  চক্রবর্তী। এখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্ভবত স্বর্গ, রবীন্দ্রনাথ সমুদ্র এবং বিহারীলাল চক্রবর্তী মর্ত্য। ঠাকুর বাড়িতে বিহারীলালের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। এছাড়াও কাদম্বরী দেবী বিহারীলালের গুণমুগ্ধ ভক্ত হবার কারণে মাঝে মাঝেই সাহিত্য আলোচনা করার জন্য তাকে বাড়িতে ডাকেন, তার লেখা কবিতা শোনেন। নিজ হাতে তাকে রান্না করে খাওয়ান আর রবীন্দ্রনাথকে বলেন, `তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতো লিখতে পারবেনা`, এই কথা শুনে মরমে মরে যেতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রীক দেবী হেকেটির স্বর্গ-মর্ত্য-সমুদ্রের প্রভাব বিস্তারের মতো কাদম্বরী দেবী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং বিহারীলাল চক্রবর্তীর উপরে প্রভাব বিস্তার করেছেন অনুমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তরঙ্গ মুহুর্তে কাদম্বরী দেবীকে `হেকাটে` বলে ডাকতেন। এটা একসময় ঠাকুরবাড়ির পুরুষমহলে, বিশেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ- রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠদের মাঝে তার ডাকনামে পরিণত হয়। এরপরে `ভগ্নহৃদয়` যখন বই আকারে বের হলো তখন রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গের বিভঙ্গ ভেঙ্গে দিয়ে লিখলেন, `শ্রীমতী হে`কে উপহার,     

 

হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমুখী শত শত

এই মুখপানে চেয়ে ফুটিয়া উঠিছে যত।  

 

এই লেখাটা শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমান বোধ থেকে নিঃসরিত কিছু লাইন দিয়ে, শেষটাও `সাধের আসন`কে ঘরে তার আজীবনের কষ্টবোধ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই। ইন্দিরাকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, `ছেলেবেলায় নতুন বউঠান যথোচিত উৎসাহের সঙ্গে তাঁর  দেওরের অভিমান খর্ব করে এসেছেন, সেটা আমি ন্যায্য বরাদ্দের মতোই মাথা পেতে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিলুম, কখনো ভাবতে পারতুম না বিহারী চক্রবর্তীর গৌরবের সীমা আমি কোনো দিন পেরতে পারব। তিনি তাঁকে নিজের হাতে পশমের আসন বুনে দিয়েছিলেন, আমি নিশ্চয় জানতুম আমার আসন মাটিতে-আদরের এই উপবাস এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আজ তার প্রাচুর্য আমার পাওনার বেশি মনে না করলেও তাতে অস্বস্তি বোধ করি।`   

 

হদিসঃ

১। নতুন বৌঠান- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

২। গোপনচারিণী রবীন্দ্রপ্রেমজীবনালেখ্য- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩। কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৪। দশ নারীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ- পৃথ্বীরাজ সেন  

৫। কলঙ্কিত ঠাকুরবাড়ি- পৃথ্বীরাজ সেন     

৬। রবীন্দ্রনাথের কাছে কাদম্বরী দেবীর শেষ চিঠি- মামুনুর রহমান

৭। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব 

৮। সারদামঙ্গল- বিহারীলাল চক্রবর্তী

৯। গীতিকবি বিহারীলাল – আবুল কাশেম

১০। গ্রিক মিথলজি- আদি থেকে অন্ত- এস এম নিয়াজ মাওলা  

পোস্ট ভিউঃ 57

আপনার মন্তব্য লিখুন